এইসব বিহঙ্গেরা
(একটি সম্পূর্ণ
আবেগঘন উপন্যাস)
হিমাদ্রি
বন্দ্যোপাধ্যায়
পরিচ্ছেদ - ১
এমনও কারোর জীবনে হয় ! এ যেন খানিকটা গল্প-উপন্যাসের মতো । মানুষের জীবনে
নানা আঘাত আসে, সম্পদ-বিপদ আসে । সে সব তো আলাদা । এতো একেবারে কল্পনার মতো । এমনটাই হয়েছে
বনলতা-র জীবনে । বনলতা আমাদের এ পর্যায়ের নায়িকা । বাড়ি থেকে বার বার
ওর বিয়ের উদ্যোগ নেওয়া হ’য়েছে, কিন্তু
বনলতা বার বার তাঁর নিজের বিয়ে থেকে দূরে থাকার জন্যে যুদ্ধ ক’রে চ’লছে । বাড়িতে বার বার এ
নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে নিজেদের মধ্যে, প্রশ্ন করা হ’য়েছে বনলতা-কে । ওর কথা শুনলে নানা মন্তব্য ক’রবে সেইসব মানুষ যারা জীবনকে সোজা অঙ্কের বাঁধা গতে সাজানো
দেখেন, কারণ ওর কথা তো ও নিজেও প্রতিষ্ঠিত ক’রতে পারবে না । বস্তুতও, ওর কথা তো তেমন কোন যুক্তিসঙ্গত-ও নয় । এমনকি
বিবেচনাপ্রসূত নয় ব’লে মনে হবে সবার
কাছে । কেমন ক’রে ও বাবা বা
মা-কে বোঝাবে ! অন্যও কাউকে বোঝাবার কোন দায় ওদের নেই, তাই বাঁচোয়া । তা নয়তো বেশ
মুশকিলে প’ড়তো বনলতা । বিয়ের ব্যাপারে
ঘরের মানুষের থেকে বাইরের মানুষের মাথাব্যথা থাকে বেশি । তাদের কিছু না
এলে-গেলেও তারাই বয়প্রাপ্ত পাত্র বা পাত্রী-কে ঝামেলায় ফেলে, বাড়ির মানুষদের মাথা
খায় । সে পাট নেই ব’লেই রক্ষে । কিন্তু বিষয়টা যে ওর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এ প্রসঙ্গ
যে ওকে কতটা অসহায় করে, তা কে বুঝবে! ও বোঝাতেও তো পারবে না । তাই বিয়েটা আটকে
আছে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে । বনলতা পড়াশুনোয় ফেল মারা মেয়ে নয় । মাস্টার্স ক’রছে। পার্ট ওয়ান । সোশিয়লজি ওর সাবজেক্ট । ওকে তো জোর ক’রে বিয়ের পিড়ি-তে বসানো যায় না । ও বাচ্চা মেয়েও নয়
যে, ধ’রে-বেঁধে ওকে জবাই করার মতো ঝুলিয়ে দেওয়া
হবে কারোর গলায় । একটা কঠিন ব্যক্তিত্বে এড়িয়ে যায় এ প্রসঙ্গ । মা দুশ্চিন্তা
করেন । ভাবেন, এরপর হয়তো এক সকালে মেয়ে অনুভব ক’রবে যে, তার বিয়ের বয়স পার । অযাচিত, স্বাভাবিক
বা প্রাকৃতিক যে কোন কারণই বলা যাক না কেন, মন বা শরীর তখন আর যুগল জীবনে সায়
দিচ্ছে না । এটাও কিন্তু বনলতা চায় না । সে তো বিবাহ
বিরাগিণী নয় ।
সাধারণত, মেয়েদের জীবনে দু-বার বিয়ের জন্যে মন কেমন করে । প্রথমবার, একেবারে
ছোট বয়সে, মানে পুতুল খেলার বয়সে । সেই সময় একটা কাউকে, মানে যে কোনো ছেলেকে, রাঙ্গাদা, পাড়ার
ঝন্টু দা, কিম্বা বাড়িতে কাজ করে নাদুস-নুদুস উড়ে চাকরটা--- যাকে হোক, মানে যাকে
শিশুমনে ধরে, তাকেই মনে মনে বর ব’লে ভেবে বসে,
বর-বউ খেলে । তাকে বর ব’লে ভাবতে ভালো
লাগে । বর কী--- এসব না বুঝেই চলে এ খেলা। এরপর একটা লগ্নে
এই বোকামিটা চলে যায় । মেয়েটি বড়ো হয়, তাঁর স্কুল জীবন শুরু হয় । সে বুঝতে পারে যে, সে বড়ো হচ্ছে । তার শরীরে নানা
বৈশিষ্ট এসে তাকে জানিয়ে দ্যায়, সে নারী । তখন অর্থাৎ ক্লাশ এইট বা নাইনে আর একবার
সেই পুরনো নেশার মতো বিয়ে-পাগলামিটা পুরো না হ’লেও একটা প্রেম- পাগলামি মনে বাসা বাঁধে । যার বাঁধে না, সে
হয়তো কোন অনুভূতির মধ্যে পড়ে না । এই সময় অনেককেই প্রেমিক পুরুষ ব’লে ভাবতে ইচ্ছে করে। সে হ’তে পারে বোকা-সোকা প্রাইভেট টিউটরটি, অথবা দাদা-র খুব স্মার্ট শ্যালকটি বা
দিদি-র দেওরটি । শরীরে এমন সব বৈশিষ্ট্য জেগে জেগে উঠতে শুরু করে যে, যৌনতার
সম্পূর্ণ জ্ঞানগম্যি না থাকলেও একটা যৌনতা পেয়েই বসে। এটার মধ্যে কোনো
লজ্জার ব্যাপার নেই । শাস্ত্র বলে, এটা না হওয়াটাই লজ্জার বিষয় । পথে পঞ্চাশ টাকার
নোট গড়াগড়ি খাচ্ছে, অথচ একজন তা দেখেও তুলে নিতে চাইছে না, এতে যথেষ্ট চিন্তার কথা
থাকে। এমন লোককে বলে মহাপুরুষ বা অথবা ভীরু । এরা দুজনেই সমাজে
বা অর্থনীতিতে কোন কাজে আসে না । সহজে পয়সা আয় করার পিছনে একটা সাহসিকতা আছে । সেটা যার থাকে না,
সে নিজেকে সৎ ব’লে অন্যের কাছে
চালাবার চেষ্টা করে অথবা অসৎ-এর প্রতি তাঁর আক্রোশ দেখাবার জন্যে তাকে নানাভাবে
লাঞ্ছিত করে । আসলে ওটা তার হতাশা এবং হতাশাকে স্বীকার না করার একটা
মিথ্যে কৌশল ।
সে ভাবও বনলতা-র জীবনে এসেছিল। চ’লেও গেছে । কিন্তু যেদিন থেকে সত্যি সত্যি বিয়ে নিয়ে ভাবনা করা উচিত,
সেদিন থেকে চ’লে যাওয়া একটা
পুরনো ভাবনা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে । এইটাই কাউকে সে ব’লে বোঝাতে পারবে না ব’লেই বিয়ে থেকে স’রে স’রে আছে ।
বনলতা অবিনাশ সেনের মেয়ে । ও পরিবারের একই
সন্তান । ওর বাবা-মা মনে করেন, তাদের সন্তান প্রয়োজন ছিল, পেয়েছেন । দ্বিতীয় সন্তানের
কোন প্রয়োজন নেই । তাই বনলতা একমেবাদ্বিতীয়ম্ । একাই সে রাজ করে
গোটা পরিবারে । ওর বাবা অবশ্য রাজা-র মতো কেউ নন । ব্যাঙ্কের এক
করণিক মাত্র । তবু বাবা-র যা কিছু সে একা ভোগ করে । তা আদর হোক, বায়না
হোক, শখ-সাচ্ছন্দ্য হোক, বিলাসিতা হোক, বা বাবা-মা’র শাসন । সবটাই তার একার । কোন শরীক নেই, ভাগীদার নেই, এমনকি ঈর্ষা
ক’রবারও কেউ নেই ।
তবে মাঝে মাঝে একজন ভাইয়ের অভাব বনলতা অনুভব করে । বিশেষ ক’রে যখন দেখে যে, তার বন্ধুরা দিব্যি ভাইফোটার দিন একটা সাজো
সাজো রব তুলে শপিং করে, এটা কেনে, ওটা কেনে, তারপর পাড়ার নানা বাড়িতে একেকটা সময়
পরে পরে শাঁখ বাজে, হুলুধ্বনি হয়, তখন ওর মনে হয়, ওদের সঙ্গে এই আনন্দ অনুষ্ঠানে
থাকতে পারলে ও বেশ একটা সার্থকতা পেতো একটা মেয়ে হয়ে জ’ন্মে । কিন্তু মানুষ যা যা চায়, তার সবই যদি মানুষ পেয়ে যায়, তবে
তো তথাকথিত দেবদেবীদের কেউ আর মূল্য দেবে না । রাজনৈতিক নেতাদের
মতো দেবতারাও বুঝে গেছেন, সব পাইয়ে দিতে নেই । ঝুলিয়ে রাখো,
দেখিয়ে রাখো--- এটা তোমার পাওনা, তোমাকে দেবো । কিন্তু এটা পেলে
ওটা । নয়তো নয়, বাবা ।
তাই এই পরিণাম বনলতা মেনে নেয় মনে মনে । কখনও তার মামাতো,
পিসতুতো বা অন্য কোনো তুতো ভাইকে ভাইফোঁটা দেবার জন্যে ও ডেকে আনে না
বাড়িতে । ও দেখতে পায়, অনেক মেয়ে, ওর বয়সী হোক বা ছোট হোক, তারা
তাদের এই অভাব পূরণ করে নানা তুতো ভাইদের নিমন্ত্রণ করে । এমনকি এটাও ও
দেখেছে যে, ওর মামাতো বোন নিজের ভাইকে ফোটা দেওয়া সত্বেও ঐ দিন অন্যান্য ভাইদেরকে
নিমন্ত্রণ ক’রে ডেকে আনে । তাদের মধ্যে হয়তো
সবারই নিজেদের বোন আছে । হয়তো কোনো প্রয়োজন নেই এমনতর ডেকে আনার । তবুও ওরা ঐ
দিনটাকে সেলিব্রেট করে একসঙ্গে । হৈ হৈ, খাওয়া-দাওয়া, সিনেমা দেখা বাড়ির ভি.সি.ডি.-তে, অন্ত্যক্ষরী, মেমরি গেম খেলে কাটিয়ে দ্যায় সারা দিন । সেটা তারা পারে,
কারণ তাদের কোনো অক্ষমতা নেই । বরং তারা একটা ভালো কাজ করে এই যে, যে ভাইদের বোন নেই, তারা
একটু বোনের সঙ্গ পায় । ‘ভগ্নীহীন ভ্রাতা বা ভ্রাতাহীন ভগ্নী’ মনে হয় মানব সমাজে একটা অন্য প্রজাতি। ফলে অন্তত ঐ
দিনটাতে তারা নিজেদেরকে অসহায় বা ভিন্ন প্রজাতি মনে ক’রে নিতে বাধ্য হয় না ।
কিন্তু এসব কৃত্রিম প্রাপ্তির তোয়াক্কা বনলতা করে না । ওর যা আছে, তাই
নিয়েই ও খুশি থাকতে চায় । অন্তত নিজের অবস্থায় খুশি থাকা ও পছন্দ করে । কোনো জোড়া-তাপ্পি
দেওয়া সম্পর্ক ওর ভালো লাগে না । তাছাড়া এমনটা ক’রলে বাবা-মা দুঃখও পেতে পারেন । তাদের মনে হ’তে পারে যে, তাঁরা
তাদের লতু-র এ বিষয়টা ভেবে দেখেননি ।
অবশ্য এ ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই । বনলতা-র ভাই নেই
যে, তা নয়। খুড়তুতো কেউ নেই । ওর বাবা তাঁর বাবা-র অর্থাৎ কিনা বনলতা-র
ঠাকুরদার একমাত্র সন্তান । বনলতা-র অবশ্য এক পিসি আছেন । কিন্তু তিনি থাকেন
জামশেদপুরে । তাই যে পিসতুতো ভাই আছে, তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়
কালেভদ্রে । বনলতা-র মাতৃকুলের সাথে আজ ওদের কোনো সম্পর্ক নেই । এর কারণ-টা অবশ্য
খুবই অপ্রীতিকর ।
বনলতা-র দাদু অর্থাৎ পিতামহ পার্টিশানের সময় চ’লে আসেন এই দেশে । সবকিছু তাঁকে ফেলে চোখ মুছতে মুছতে আসতে
হয় এক অজানা অচেনা বিদেশ বিভুয়ে । তিনি ছিলেন কোর্ট-এর ক্লার্ক । এক ছেলে আর এক
মেয়ের সংসারে তিনি আর ঘরবাড়ি কিছুই ক’রে উঠতে পারেননি । হয়তো চাকরীর প্রথম দিকে বাড়ি ক’রলেও ক’রতে পারতেন । কিন্তু একটা বড়ো
প্রতিকূলতা হ’য়ে উঠেছিলো
বনলতা-র মায়ের অসুস্থতা । বনলতা-র মা চিরকাল অসুস্থ নন । এটাও একটা ইতিহাস ।
চাকরীর প্রথম দিকে বনলতা-র বাবা বাড়ি ক’রতে একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু বনলতা-র
দাদু-দিদা তা ক’রতে দেননি । বনলতা-র দাদু-র
অর্থাৎ মাতামহর প্রভূত জমি-জায়গাসহ প্রাসাদোপম বাড়ি ছিলো । এই প্রভূত রিয়েল
এস্টেটের একটা বিরাট অংশ বনলতা-র মায়েরও প্রাপ্য ছিলো । সেই পাওনাটার
কারণেই বনলতা-র মা মিনতি দেবী-কে আর বনলতা-র বাবা অবিনাশ বাবুকে ওর দাদু-দিদা
বাসস্থান নির্মাণ করা থেকে বিরত ক’রেছিলেন । তাই ওরা ভাড়া
বাড়িতে থেকেছেন চিরকাল । কিন্তু অদূরদর্শীতা যে একটি পরিবারে কী ধরনের অশান্তি আর
অসন্তোষ নিয়ে আসতে পারে, তার বোধহয় বাস্তবসম্মত কোনো জ্ঞান ছিলো না বনলতা-র
দাদু-দিদার । হয়তো বনলতা-র বাবা-মায়েরও । দাদু-দিদা তাদের
প্রভূত সম্মতির কোন উইল ক’রে যাননি । ফলে তাদের মৃত্যুর
পর হঠাৎ কী যে হোল মামাদের মনে, তাঁরা বোন-কে অসম্মান ক’রে প্রায় তাড়িয়ে দিলো তাঁর প্রাপ্য অধিকার থেকে । মামা যে বাস্তবে
শকুনি মামা হ’য়ে উঠতে পারে, তা
বনলতা দেখলো তার জীবনে । বুঝলো, অর্থম অনর্থম । এই সত্য যদি
বনলতা-র দাদু-দিদা বুঝতেন, তবে এতোটা কুৎসিত নাটক হ’তো না । কিন্তু ঐ যে সত্য । মানুষ যা যা চায়, তা তা যদি সে সত্যি
পেতো, তবে তো হ’য়েই যেতো । তা তো হবার নয় ।
আসলে বনলতা দেখেছে, মানুষের সাথে মানুষের সম্বন্ধটা একেবারে
কৃত্রিম । যতক্ষণ একপক্ষ তা রক্ষা ক’রে চ’লেছে, ততক্ষণ তা আছে । ‘যে সয় সে রয়’ নয় । বনলতা মনে করে, এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা । আসলে যে সয়, তার
নিশ্চিত লয় । মানুষ যতক্ষণ সয়, তার বান্ধবতা আত্মীয়তা ততক্ষণ রয়। নয়তো গোল্লা । যদি কোন পক্ষ অপর
পক্ষের মন্দাচরণের প্রত্যুত্তর দ্যায়, অর্থাৎ ‘সেম কয়েন ব্যাক করে’, তবেই চিত্তির । সব প্রেম,
ভালবাসা, সমানুভূতি, দরদ, আত্মীয়তা গোল্লায় যাবে । বেরিয়ে প’ড়বে দাঁত-নখ । রক্তপায়ীর-র মতো রক্তপান ক’রতে পিছপা হবে না আপনজন বা পরমাত্মীয়, যে একদিন স্নেহ-চুম্বন দিয়েছে কপালে । তখন তাকে চেনাই
দুষ্কর হয় । কে কাকা, কে মামা, কে-ই বা পিসি-মাসী । যতোসব বিদ্যেবুদ্ধি
সব যাবে বাড়ির মদ্দি। তা নয়তো বনলতা কি ভাবতে পেরেছিল যে, ওর মামা-রা এমনটা ক’রতে পারে ! এটাই স্বাভাবিক । এর অধিক কিছু
করাটাই অস্বাভাবিক । এই অস্বাভাবিক প্রত্যাশার ছলনাতেই ম’রেছেন মিনতি দেবী আর তাঁর স্বামী অবিনাশ সেন । মাইকেল-এর কবিতাটা
ওঁরাও প’ড়েছেন স্কুল জীবনে, কিন্তু ভুলে গিয়েছেন । কবিতা যে শুধু
কবিতাই নয়, একটা বিরাট বাস্তবতা, সেগুলো যে এলোমেলো শব্দের কঙ্কাল নয়, এটা অনেকেই
বোঝে না । কিন্তু ইচ্ছে ক’রলে বাবা-মা আদালতে যেতে পারতেন, আদায় ক’রে নিতে পারতেন নিজেদের অধিকার । কিন্তু সবাই তো সবটা পারে না । এটাই তাঁদের পরিচয়
। এই না পারার মন নিয়েই তাঁরা পৃথিবীতে এসেছেন । এই চরিত্রের যে
কোন পরিণামের জন্যে সে আপনি প্রস্তুত ।
কিন্তু বনলতা-র বৈবাহিক সমস্যাটা হ’লো একেবারে স্বতন্ত্র । একথা ভাবার কোন
কারণ নেই যে, ওর কোন যৌন সমস্যা আছে ব’লে ও প্রথাগত বিয়ে পরিহার ক’রে আসছে । একটা খেলা যে একটা
মেয়ের জীবনে কী রূপান্তর নিয়ে আসতে পারে, সেটাই ওর জীবনে একটা চরম সত্য উঠেছে ।
অবিনাশ বাবু-রা আগে এখানে ছিলেন না । তিনি তাঁর
শ্যালকদের সাম্বোধনিক সার্থকতা প্রত্যক্ষ ক’রে পুরনো জায়গা ছেড়ে চ’লে এসেছেন এখানে,
এই কল্যানী-তে । যদিও তাঁর চাকরী ট্রান্সফারেব্ল, তথাপি এই বদলি তিনি চেয়ে
নিয়েছিলেন । অসহ্য লাগছিলো চন্দননগর । কথায় বলে, ‘কানের পাশে কাকের বাসা’ । তেমনি শ্বশুরবাড়ির পাশে থাকা যে এমনভাবে যন্ত্রণাদায়ক হ’য়ে উঠবে, তা তিনিও ভাবতে পারেননি । চন্দননগর শুধু
বনলতা-র বাবা-র কাছে নয়, বনলতা-র কাছেও অসহ্য লাগছিলো । ঠিক চন্দননগর নয় । গোটা টাউন গার্লস
হাইস্কুল, তার লন, তার বড়ো বারান্দা যেখানে রি-ইউনিওন অনুষ্ঠান হ’য়েছিল ডেকোরেট ক’রে, প্রতিটি সহপাঠী বা সহপাঠীনী--- সব ওর কাছে একটা অসহনীয় লাগছিলো । বাবা-কে তো ব’লতে পারেনি । সহ্য ক’রেছে । কিন্তু বাবা স’রে আসতে মনে মনে বাবা-কে থ্যাংকস দিলো বনলতা । কিন্তু কী হ’লো ! কিছুই তো হ’লো না ।
এরপরেই সম্পত্তির প্রতারণার পরিণামবশত বনলতা-র মা অসুস্থ হ’য়ে পড়েন । বিশ্বাসভঙ্গের এই চরম পরিণাম যে তাঁর জীবনে নেমে আসবে, এটা
ভাবা-র আগেই বাবা ট্রান্সফার নিয়ে চ’লে এসেছেন এই কল্যানী-তে । ওদের বাড়ি ডাক্তার পাড়া-তে । ডাক্তার পাড়ায়
প্রায় সবার জীবিকাই চিকিৎসা । কল্যাণী এমনিতেই বিধান চন্দ্র রায়ের করা একটা সম্পূর্ণ
প্ল্যান্ড সিটি। অবশ্য সেই প্ল্যান মানুষ আর রাখেনি। প্ল্যান ক’রলেই তো হয় না। তাকে তো রক্ষা ক’রতে হয়। সেটা তো আর বাস্তবে আয়ুষ্মান বি.সি.রায়-এর পক্ষে
সম্ভব নয়। তিনি তো আর একজনের প্ল্যান মতো চ’লে গেছেন আর এক সিটি-তে। সিটি অব প্যারাডাইস ।
এখানেই কমলা গার্লস হাই স্কুলের পাঠ শেষ ক’রে বনলতা কল্যাণী বি.সি. রায় কলেজে প’ড়েছে আর্টস নিয়ে । পড়াশুনোয় চিরকাল ভালো না হ’লেও মন্দ নয় বনলতা । সোশিয়লজি অনার্সে সেকেন্ড ক্লাসেই
কলেজের গণ্ডি পার হ’য়েছে । এখন কল্যাণী
ইউনিভারসিটি-তে পড়ে । এই তো ঝিলপাড় থেকে বনলতা বাস ধরে । ঝিলপাড় মানে এখন
সেখানে কোনো ঝিল-টিল নেই। কোন এক সময়ে হয়তো ছিলো । ও হেঁটেই যায়
ঝিলপাড়ে । তারপর পঁচাশি নম্বর বাস ধ’রে তিনটে স্টপেজ পার হ’য়ে ইউনিভারসিটি
স্টপেজে নামে । তিনটে স্টপেজ মানে বটতলা, কলেজ পাড়া, আর ঘোষপাড়া । বীরপুরের ডাক্তার
পাড়ায় এক প্রাক্তন শিক্ষকের বাড়িতে ভাড়া থাকে বনলতা-রা। তিনি সংস্কৃতের
পণ্ডিত । খুব ভালো মানুষ । এমন বিশেষণেই তিনি পরিচিত । অবিনাশ বাবু-র এক
কলিগ ঠিক ক’রে দিয়েছেন ।
এসব তো সাধারণ খবর বনলতা-দের সম্বন্ধে । কিন্তু বনলতা-র মা
তাঁর ভাইদের নিষ্ঠুরতা হোক, বা বিশ্বাসহীনতা--- কোনো একটা বা উভয় কারণেই নিজেকে
সামলাতে পারেননি । একটা হার্ট এ্যাটাক তাঁর হ’য়েই গেছে । শরীরে আরও নানা কম্প্লিকেশন দেখা দিয়েছে একে একে । তাঁর ট্রিটমেন্ট
ক’রতে গিয়ে বাবা অনেকটা আর্থিক যুদ্ধের
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প’ড়েছেন । সৌভাগ্য এই যে,
অবিনাশ সেনের সন্তান একটিই । এর বেশি হ’লে তাঁদের ভরণপোষণ
চালাতে বনলতা-র বাবা এই মাগ্যির বাজারে এক মহা সমস্যায় প’ড়তেন । বনলতা মনে করে, ওর বাবা একজন নির্ভেজাল সৎ মানুষ । তাই আর্থিক ঘাটতি
ম্যানেজ ক’রবার মতো যে সমস্ত রাস্তা আছে, তা তিনি
অনুসরণ ক’রতে পারেননি । তবে বনলতা-র বাবা
বলেন,
--- লতু, আমাকে কখনো সৎ ব’লবি না । সততা কোনো গুন নয় । এটা মানুষের প্রাথমিক পরিচয় । মানুষের মতো থাকবো
না !
এমন কথা অবিনাশ বাবু-র লতু আগে কখনও শোনেনি । বাবা সম্বন্ধে
একটা অদ্ভুত ধারনা ওর মনে । বাবা সম্বন্ধে সব সন্তানেরই একটা ভালো ধারনা থাকে । সব সন্তানই মনে
করে, তার বাবা জগতের সবচেয়ে ভালো বাবা । নিতান্ত মদ্যপ অত্যাচারী বাবা সম্বন্ধেও
সন্তান বলে,
--- আর যাই হোক, আমার বাবা-র হাজার দোষ । কিন্তু বাবা-র
মনটা কিন্তু খুব সরল ।
বাস্তবে সত্যিই কি তাই ? সব সন্তানই কি তা ভাবতে পারে ?
সন্তান কি তার বা তাদের বাবা-কে চেনে না ? চেনে নিশ্চয়ই চেনে । প্রায় সব সন্তানই
মনে মনে অল্প-বিস্তর লজ্জিত হয় তাদের বাবা সম্বন্ধে । অবশ্য ততদিন সে
তার বাবা-কে ভালো মনে করে, যতদিন সে অন্ধ থাকে, অজ্ঞান থাকে । বনলতা অজ্ঞান নয় । সে আজ পোস্ট
গ্র্যাজুএশনের ক্যান্ডিডেট । সে বোঝে, কী ভালো, কী মন্দ । সত্যি আজ আর ও
বাবা সম্বন্ধে কোনো গর্ব বোধ করে না । ওর বাবা-র মতো একজন যথার্থ মানুষ
সম্বন্ধে গর্ব বোধ ক’রতেও হয় না ।
কিন্তু বাবা-রও জানা নেই কেন তাদের লতু বার বার বিয়ের
ব্যাপারে বাধা দিচ্ছে । বনলতা-র সে ভাবনা নেহাতই বালখিল্য হ’তে পারে । বালখিল্য-ই তো । তখন সে তো টাউন স্কুলের মাত্র ক্লাশ
নাইনের ছাত্রী । ওদের স্কুলে রি-ইউনিয়নের অনুষ্ঠান করার একটা উদ্যোগ নিয়েছিল
সিনিয়ার স্টুডেন্ট-রা । সে অনুষ্ঠানে একটি বহিরাগত দাদা আবৃত্তি ক’রেছিল । সে হোল বনলতা-র যন্ত্রণা ।
প্রাক্তন ও বহিরাগত শিল্পী ছাত্র-ছাত্রীদের সেদিন বসানো হ’য়েছিল বনলতা-দের বাড়িতে । স্কুলের পাশেই
ওদের বাড়ি । বনলতাই নিজে হাতে চা-খাবার সব পরিবেশন ক’রছিলো প্রাক্তন দাদা-দিদি’দের এবং আমন্ত্রিত শিল্পীদের । তাদের মধ্যে একটি দাদাকে দেখে হঠৎই দুর্বল হ’য়ে প’ড়েছিল বনলতা । কাঁচা বয়সের
দুর্বলতা কাঁচা বয়সেই কেটে যেতো । হয়তো সেটা কিছুই হ’য়ে উঠত না । কিন্তু দুর্বলতা সেখানেই থেমে থাকল না । দাদা-টাও বনলতা-কে
যেন কিছুটা প্রশ্রয় দিলো ওর কথার এটা ওটা উত্তর দিয়ে । এতেই বনলতা-র
ভাগ্য তাকে নিয়ে অনেকটা পথ ছেলেখেলা ক’রলো ।
প্রাক্তনদের মধ্যে যারা মঞ্চে অনুষ্ঠানে আবৃত্তি, গান,
গল্পপাঠ ইত্যাদি ক’রবে, তাদের সাথেই
মঞ্চে সারি দিয়ে বসে গেলো দাদা-টা। বনলতা তখন একা চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিলো স্টাফ রুমের সামনে । এখানে ফ্লাড
লাইট-টার আলো এসে প’ড়ছিল না, আর
দিদিমণিদের কেউই এ তল্লাটে ছিলেন না । এখানে একটা প্রায়ান্ধকার পরিবেশ । নিজেকে বেশ লুকিয়ে
রাখা যায় অথচ এখান থেকে স্টেজটা পুরো দেখা যায় । হঠাৎ কোথা থেকে
গায়ত্রীদি এসে হাজীর । বনলতা-কে দেখেই বললেন,
--- কিরে, তুই এখানে কেন ? যা, গিয়ে বোস ওখানে । অনুষ্ঠান দ্যাখ ।
কথাটা বলে দর্শক আসন দেখিয়ে দিয়ে দিদিমণি চ’লে যেতে মনে মনে ব’লল বনলতা, ‘গায়ত্রী দি, আপনি
তো জানেন না, কেন আমি এখন একটা কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি একান্তে ।’ আসলে মঞ্চের
অতগুলো প্রাক্তন দাদা-র মধ্যে কেবল একটি দাদা যে এই প্রায়ান্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা
তরুণী হৃদয়কে বড়ো দুর্বল ক’রে দিয়েছে, তার
আপনিই কী বুঝবেন ! এ যে প্রথম দর্শণেই সর্বনাশ ।’
বনলতা যেতে পারে না মঞ্চের কাছে । মনে হয় ধরা প’ড়ে যাবে । ওর দৃষ্টি তো এখন ধরা প’ড়ে যাবারই মতো । দ্বাদশ শ্রেণীর এক দিদি অনুষ্ঠান সঞ্চালিকা ছিলো । সেই দিদি-র নামটাও
আজ আর মনে নেই বনলতার । সে ঘোষিকা হিসেবে ঘোষণা ক’রলো,
--- এবার আমাদের বিদ্যালয়ের প্রাক্তন দাদা ও দিদি এবং
আমন্ত্রিত শিল্পীদের অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে । আমি নামগুলো পর পর
জানিয়ে দিচ্ছি ।
ব’লে সেই সঞ্চালিকা
দিদি একের পর এক শিল্পীদের নাম ঘোষণা ক’রে দিলেন । কোন ঘোষণা, কোনো নাম, কোন অনুষ্ঠান বনলতার কানে ঢুকছিল না । বনলতার চোখদুটো তো
শুধু দেখছে আর দুটো চোখকে । সে কি বনলতাকে খুঁজছে ? অর্জুন যখন লক্ষ্যভেদ ক’রেছিলো, তখন বোধহয় এমন ক’রেই তাকিয়ে ছিল লক্ষ্য বস্তুর দিকে । তখন কে জানত, ঐ নামের মধ্যে একটি নাম
বনলতার স্মরণ রাখা দরকার ! নামটা জরুরী । তা নয়তো সেই নাম আর নামের মালিক তার
জীবনটাকে শেষ ক’রে দেবে ! তাহলে
তো নামটা মনে রাখা যেতো। বনলতা তো তাদের নামগুলো ভালো করে শোনেনিও পর্যন্ত। সেই বয়সে কে এমনটা
ক’রে একটা দপ্তরীয় বুদ্ধিমত্তা আয়ত্ত ক’রতে পেরেছে ! শুরু হ’ল প্রাক্তনদের অনুষ্ঠান । ঐ বহিরাগত দাদা-টা যে কবিতাটা আবৃত্তি ক’রলো, তাঁর মধ্যে কয়েকবার নিজের নামটা উচ্চারিত হ’তে শুনে একেবারে মুগ্ধ-মোহিত হ’য়ে পড়ে বনলতা । ও নিশ্চিত যে, ওকে লক্ষ্য ক’রেই এই কবিতাটা । দাদাটা নিশ্চয়ই কবি । আর সে-ও প্রেমে প’ড়েছে বনলতার । কোন না কোনভাবে সে নিশ্চয়ই ‘বনলতা’ নামটা জেনেছে আর তাই দিয়ে একটা মিষ্টি
কবিতা বানিয়ে মঞ্চে ব’লেছে। বনলতার চোখের ভাষা
নিশ্চয়ই দাদা-টা ধ’রতে পেরেছে । তাহলে বনলতা একাই
শুধু বধ হয়নি । দ্যাদা-টাও ।
দাদা-টাও বনলতা-তে ম’রেছে নিশ্চয়ই--- এই প্রত্যয়টা বনলতাকে একটা খেলার কোর্টে যেন টেনে নিয়ে যায় । একটি যুবকের
বনলতাতে না মরার কোন কারণ নেই । বনলতা জানে, সে বেশ ডাগর-ডোগর । এই শব্দদ্বৈত সে
শুনেছে ছোট বয়সেই নিজের দিদার মুখে । দিদা বারবারই মাকে সাবধান ক’রতো । ব’লতো,
--- মিনু, মেয়েটাকে সামলে রাখিস । যা ডাগর-ডোগর
চেহারা !
‘ডাগর-ডোগর’ শব্দের যথার্থ না
জানলেও প্রায় সব মেয়ের মতো এটা বুঝেছিল বনলতা যে, তাঁর শরীর বেশ উদ্ধত । তাছাড়া রং থেকে
শুরু ক’রে মাথার চুল--- সবই দেখার মতো । মাথা ঘোরাতে পারে
যে কোন কাঁচা বয়সের মানুষের । তাই আজ একটা খেলা যেন পেয়ে বসে ওকে । প্রেম না বুঝলেও
তার না জানা স্পর্শ বনলতাকে রোমাঞ্চিত করে । ও ভাবে, এই দাদা-টা নিশ্চয়ই একই অবস্থা
উপভোগ ক’রছে । তা নয়ত এত
তাড়াতাড়ি ওর নামে একটা গোটা কবিতা বানিয়ে দিলো কীভাবে ! আর নিজেকে সংবরণ ক’রতে পারে না বনলতা । তারুণ্যের চটুলতায় প্রায় নির্লজ্জের মতো
ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, উচিত-অনুচিত কিছুমাত্র বিবেচনা না ক’রে অনুষ্ঠানের শেষে চা দেবার ফাঁকে একটি কাজ গোপনে ক’রে ব’সলো বনলতা, যার
মাশুল তাকে আজও গুনতে হ’চ্ছে।
সেই দাদা-র পকেটে সবার অলক্ষ্যে একটা চিঠি ঢুকিয়ে বসে
সেদিনই । জানতেই পারেনি যে, যে কবিতাটা ঐ দাদা-টা আবৃত্তি ক’রেছে, সেটা বাংলার কোনো এক বিখ্যাত কবির রচিত কবিতা । তাকে উদ্দেশ ক’রে নয় । কতটুকুই বা বয়স তখন ! কী-ই বা বোঝে কবিতার ! কবিতা তো পাঠ্য
বইতেই থাকে । কেবল জেনেছিল, ওর বান্ধবীরা তাদের বয়ফ্রেন্ডদের থেকে নাকি
নানা কবিতার লাইন পায় চিঠিতে । কিন্তু পাঠ্য বইও ছাড়া তো কবিতা পড়ার বয়স সেটা নয় । এমনি এমনি কবিতা
ক-জনই বা পড়ে ! বিজ্ঞান আর মিডিয়ার দৌলতে তো কাব্য-সাহিত্য প্রেম চুকে-বুকে যেতে ব’সেছে । তথাকথিত শিক্ষকেরাই তো আজকাল কবিতার যাথার্থ্য বোঝে না । ক্লাসে কবিতার ভুল
ভুল ব্যাখ্যা করে । নোট বইতে যেমনটি লেখা আছে, তেমনটি চালিয়ে দ্যায় । তাছাড়া সাধারণ
মেয়েরা কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ অনুৎসাহী তো বটেই । গল্প-টল্প তাদের
অবসর কাটানোও নয়, শুধু দিবানিদ্রা দেবার আগে একটা নিদ্রালুতা আনার উপায় মাত্র।
বনলতা কিন্তু ভাবেওনি, একটা মেয়ে হওয়ার কারণে এটা করা যায়
না । একটা ছেলে ক’রলেও ক’রতে পারে । কিন্তু অন্তত এ দেশে তো মেয়েদের কাছ থেকে এমনটা একেবারেই
ভাবা যায় না । এ দেশের মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না । তার মানে এ নয় যে,
তা বলা কোন নিষিদ্ধ একটা গণ্ডি, যেটা পেরনো মেয়েদের পক্ষে সীতাদেবীর লক্ষণরেখা পার
হবার বিপদের মতো বিপদ ডেকে আনবেই । আসলে এখানেই এ দেশের নারীদের নিজস্বতা । হয়তো এটাকে সম্বল
ক’রেই নারীরা এ দেশের পুরুষের সম্পদ বা
অধীনস্থ হ’য়ে ওঠে । পুরুষরাও জানে, এই
গোপন অথচ প্রকাশিত কথাটা । এটা এক রকম ওপেন সিক্রেট ।
কবিতা শেষ হ’লেই সেদিন এক ছুটে
বাড়িতে চ’লে গিয়েছিল বনলতা । তারপর খাতার কাগজে
খসখস ক’রে কী যে লিখেছিল, তা আজ আর মনে নেই । হয়তো ‘তুমি আমার…… আমি তোমার….’ এই জাতীয় কিছু । তারপর ঘর থেকে পারফিউম এনে স্প্রে-ও ক’রেছিল তাতে । ও জানে, প্রাক্তনদের অনুষ্ঠানের পরে সবাই ওদের বাড়িতেই আসবে
। আর তখনই সর্বনাশ-টা ক’রে বসে বনলতা ।
কিন্তু সেই লক্ষ্মণরেখা পার হওয়া বনলতার জীবনে যেন
সীতাদেবীর থেকেও বড়ো বিপদ ডেকে আনলো । চিঠিতে উত্তেজনায় নিজের নামটাও লেখেনি
অথবা তখন লিখতে চায়নি। মনে নেই আজ । ফাংশান শেষ হ’লে দাদা-টা আবার মঞ্চে আসে । মাইক্রোফোন নিয়ে সোজা এ্যানাউন্স করে,
--- আজ আমি একটা চিঠি পেয়েছি । বেনামী চিঠি । যে চিঠিটা দিয়েছ,
সে আমাকে ৯৮৩০০ ২২৩২২ নম্বরে ফোন কোর । আমি তার ফোনের জন্যে অপেক্ষা ক’রবো । আমি ফাংশান শেষ হলেও চ’লে যাইনি, তার কারণ এটাই । আবার মনে ক’রিয়ে দিই, আমার
ফোন নম্বর ৯৮৩০০ ২২৩২২ ।
একবার বনলতার মনে হ’ল, বেশি সাহস দাদা-টার । মাইক্রোফোন নিয়ে এসব বলার কী দরকার ছিল ! তুমি তো জান
কার্ত্তিক, কে দিয়েছে চিঠিটা, কেই-বা দিতে পারে । ও শুধু দেখলো,
দাদা-টা স্টেজ থেকে নামতেই তাকে নিয়ে তাঁর বন্ধুরা নানা মস্করা ক’রছিলো, চিঠিটা দেখতে চাইছিল, সত্যি না মিথ্যে--- জানতে
চাইছিল । দাদা-টা কিন্তু কাউকে চিঠিটা দেখায়নি । বনলতা লক্ষ্য ক’রেছে, দাদা-টা কোন উত্তর না দিয়ে যে মোটর সাইকেলে এসেছিলো,
তাতে চ’ড়ে হুড়মুড় করে চ’লে যায় ।
বনলতা বুঝলো যে, দাদা-টা ওর জালে ধরা প’ড়েছে । তাহলে রুচিরা, মোহর, মনীষাদের মতো ওরও একটা বয়ফ্রেন্ড জুটে
গেলো । বন্ধুদের কাছে ওর স্ট্যাটাসটা তাহ’লে থাকলো । আর এ খুব হ্যান্ডসাম । তার ওপর কী ভালো
কবি ! এবার বন্ধুদের প্রেমপত্রে ও নিজেই কোটেশন সাপ্লাই ক’রতে পারবে । মনে মনে ভয়ও খুব হ’য়েছিলো এ্যানাউন্সমেন্ট শুনে । কে জানে কী ব’লে বসবে দাদা-টা ! বেঁচে গেছে এ যাত্রা । বাড়িতে এসব জানতে
পারলে বাবা খুব কষ্ট পেতো । কিন্তু ফোন তো ক’রবে, ফোনে কী ব’লবে ? এসব তো জানা
নেই । চিঠি লেখা এক, আর মুখে কথা বলা আর এক । কিন্তু একটা নেশা,
একটা কৌতূহল, একটা আসক্তি, একটা টান ওর মনের মধ্যে ওকে এ-ফোঁড় ওফোঁড় ক’রছিল । বুকের মধ্যে একটা গুড়গুড় ধ্বনি রোজ শুনতে পেতো বনলতা । শরীরে কোথায় কোথায়
কেমন কেমন যেন হ’চ্ছিল । এসব নিয়ন্ত্রণ ক’রতে পারে, সে সাধ্য কি বনলতার!
সেদিন সন্ধে হবো হবো । কোথা থেকে যে
এতোটা সাহস পেলো মেয়েটা, তা আজও জানে না । বাবার মানিব্যাগ থেকে দুটো টাকা নিয়ে
বাজারের মধ্যেকার একটা বুথ থেকে ফোনটা ক’রবে ঠিক করে । বুথটা ওদের তেমন পরিচিত না হ’লেও আশে পাশে চেনা মানুষ ঘুর ঘুর করে । এখানে ওদের তো অনেকদিনের বাস । তাই চেনা মানুষ
ওকে ফোন ক’রতে দেখতে পেলে বিপদ হ’তে পারে । চারপাশ দেখে নিয়ে বনলতা ওর দোদুল্যমান বুক চেপে ধ’রে দুম ক’রে নম্বর মিলিয়ে
বোতাম টিপে দ্যায় ৯৮৩০০ ২২৩২২-তে । কিন্তু কে জানত, কী হবে ! জীবনে কোন মেয়ে কোন ছেলের কাছ
থেকে এমন প্রত্যুত্তর জীবনে পেয়েছে কিনা, তাই বা কে জানে ! ওপার থেকে ‘হ্যালো’ শুনতেই বনলতা বলে,
--- আপনি আমাকে ফোন ক’রতে বলেছিলেন । আমি….
কথাটা শেষ ক’রতে পারেনি, ওপাশ
থেকে যুদ্ধের নানা অস্ত্র শেল, শক্তি, জাটি, তোমর, ভোমর, শূল, মুশল, মুদ্গর,
পট্টিশ, নারাচ, কৌন্ত এসব ছুটে ছুটে আসতে লাগলো । সে সব অস্ত্রের
আঘাতে জর্জরিত রক্তাক্ত বনলতা যেন মূর্ছিত হয়ে প’ড়বে, এমন অবস্থা হলো ।
ছেলেটা কড়া ভাষায় ব’লল--- আমি তোমার নামটাও জানতে চাই না । পরিচয় শুনতে চাই না । তুমি নাম ব’ললে সেদিনের চিঠিতে লিখতে । তোমার কোন
স্ক্যান্ডাল হোক, আমি তাও চাই না । তুমি একটা ভদ্রঘরের মেয়ে নিশ্চয়ই । স্কুলে পড়াশুনো ক’রতে এসেছো । এভাবে কোন ছেলের জামার পকেটে প্রেমপত্র দাও তুমি ! ছি ! ছি
! জানি না, তুমি কোন ক্লাশে পড়ো । তোমার বাবা-মা এসব জানেন ? তারা কি তোমাকে এসব ক’রতে স্কুলে পাঠিয়েছেন ? এটা কো-এড স্কুল । নিজেকে সামলে চলো । আর শোন, এই
নম্বরটা আজ থেকে ভুলে যেও । বুঝেছো ? এবার ফোন রাখো । যাও, বাড়ি যাও ।
ক্লাশ নাইনের বনলতা নীরবে নিঃশব্দে শুনে গেলো সেইসব তীব্র
কথাগুলো । ওর সারা গায়ে যেন আগুনের ছ্যাকা লাগছিলো । যন্ত্রনায় আর
জ্বালায় দগ্ধ হ’য়ে যাচ্ছিল বনলতা । এ কী অপমান ! এটা
কী ক’রলো ও ! কেন না বুঝে এমন কাজ ক’রলো ! মরণ হয় না ওর ! এমনকি একদিন ম’রতেও চেয়েছিল ও । কিন্তু আত্মহত্যা ক’রতে যে সাহস লাগে, তা বুঝেছিল সেদিন । ঘরে সিলিং ফ্যানের
সাথে সিনথেটিক ওড়না জ’ড়িয়ে ঝুলবে
ভেবেছিল । এ অপমানিত জীবন আর রাখবে না । কিন্তু সবটা রেডি
হ’য়ে গেলেই একটা আতঙ্ক গ্রাস করে ওকে । গলায় ফাঁস আটকে
থাকা ওর নিজের মৃতদেহ-টা মনে মনে এঁকে ফেলতেই আতঙ্ক ওকে একেবারে কুঁকড়ে দ্যায় । ব্যস্ । আর সুইসাইড করা
হয়নি ।
জীবনে প্রথম ভালোলাগায়, প্রথম প্রেমে এমন ধম্কি কে কবে
খেয়েছে, কে জানে ! অন্তত বনলতা তো জানে না
। সে রাত্রে খুব কেঁদেছিল বনলতা । কান্নার প্রথম
কারণ, এ্যাত বড়ো অপমান সহ্য ক’রতে পারেনি । ভাগ্যিস, আর কেউ
জানে না । কাউকে জড়ায়নি । তাই রক্ষে । তা নয়তো অন্যের
কাছ থেকেও চূড়ান্ত অপমানিত হ’তে হ’তো । কান্নার দ্বিতীয় কারণ হলো, এই প্রথম ওর মনে হলো, একটা ভয়ানক
ভুল ক’রে বসেছে ও । এটা একটা মেয়ে হ’য়ে করা যায় না। এটা একজন নব যৌবনপ্রাপ্ত মেয়ের কাছে
বিপুল লজ্জার বিষয় হ’য়ে দাঁড়ালো । বিশেষত একজন পুরুষ
মানুষের থেকে প্রত্যাখ্যান যেন বনলতাকে ক্ষত-বিক্ষত ক’রে ফেলছিল । ওর যত ক্লাসমেট ছিলো, তাদের অনেকেই প্রেম-ট্রেম করে । কিন্তু ও কথা ব’লে জেনেছে, তারা কেউই ছেলেদেরকে নিজে প্রপোজ করে নি । ছেলেদেরকে ‘না না’ ক’রে তাদের প্রপোজাল এ্যাক্সেপ্ট ক’রেছে মাত্র। হয়তো সেই এ্যাক্সেপ্ট করার পিছনে প্রপজ্ড টোপ ছিল । সেই টোপটি খেয়ে
তাদের প্রেমিকরা প্রপোজ ক’রেছে । তা থেকে বনলতা
বুঝে নিয়েছিলো, মেয়েদের প্রেম হওয়া উচিত ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি ।’ অর্থাৎ জলে নামবো, জল ছড়াবো, চুল ভিজাবো না । এসব তো পরে কালে
কালে জেনেছে, কথা প্রসঙ্গে জেনেছে ।
বনলতার যে তর সয়নি তার জীবনের প্রথম প্রেমে । তার নিজের কারণেই
তাকে এভাবে অপমান স’ইতে হলো । নিজের মধ্যেই
লজ্জায় ছিঁড়ে কুটি কুটি হ’য়েছে ও । ঠিক মতো নামটাও
শোনেনি দাদা-টার । হয়তো তার মুখটাও আজ দেখলে চিনতে পারবে না । সেই মুহূর্তে কি ও
ভেবেছিলো, একটা ছেলে ওকে এভাবে অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারবে ! বনলতা অসুন্দর নয়। তখন তো সে সবে
বিকশিত হ’চ্ছিলো একটি আসন্ন ও আকর্ষণীয় যুবতী হবার
প্রত্যাশায় । এমন একটি মেয়ে যদি কোন ছেলেকে ব’লে বসে--- ‘আমি তোমাকে
ভালবাসি’, একটা ছেলের পক্ষে মাথা ঘুরে যাওয়াই
স্বাভাবিক ব’লে মনে ক’রেছে বনলতা । কিন্তু তা হয়নি । ওর আশালতা একেবারে মুড়ে খেয়ে গেছে এক
অজানা কোন ডাইনী ।
মন বলছিল, দাদা-টা কি এনগেজ্ড ? ওর কি অন্যও কোন প্রেমিকা
আছে ? একবার তাকে সামনে পেলে একেবারে শেষ ক’রে দেবে । আবার মনে হয়, কেনই বা এমনটা ভাবছে ! তারই বা কী দোষ ! সে-ও
তো প্রেম ক’রেছে । ভালবেসেছে । তার তো কোন অন্যায়
নেই । সে তো জানে না যে, বনলতার মতো কোন মূর্খ মেয়ে-ও পৃথিবীতে
থাকতে পারে । সে-ও মন প্রাণ সব দিয়ে ব’সতে পারে তার প্রেমিককে । সেই নাম না জানা মেয়েটা তো নির্দোষ । যে সময়ে এসে বনলতা
জেনেছে যে, দাদা-টা সেদিন বিখ্যাত এক কবির আবৃত্তি কবিতা ক’রেছিল, তখন সেই কবিতা পড়ার জন্যে হন্যে হ’য়ে লাইব্রেরী-তে লাইব্রেরী-তে ঘুরেছে ও । কানে শুধু একটাই
ছত্র বেজে চলেছে, ‘আমারে দু-দণ্ড
শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’। স্টেজের আবৃত্তিতে বা পরে সেই কবিতা খুঁজে পাবার পর সেই
কবিতা প’ড়ে মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝেনি বনলতা । তবে এটা বুঝছে যে,
এটা একটা নির্ভেজাল প্রেমের কবিতা আর নায়িকা স্বয়ং ‘বনলতা সেন’ । তাই সমস্ত রাগ গিয়ে প’ড়েছে বাবা-মার ওপর । কেন এমন একটা নাম রেখেছে তাঁরা ? ‘বনলতা’ নাম কি এখন চলে ! যতসব পুরনো বাজে নাম !
মাকে গিয়ে ধ’রেওছে ।
--- মা, আমার এই বাজে নামটা কে দিয়েছে, বলতো । বনলতা ! বনলতা সেন
। কী বাজে নাম ! আর কী বাজে টাইটেল ! ‘সেন’ । বিশাল বাজে টাইটেল । তার ওপর বনলতা ।
মিনতী দেবী হেসে দেন মেয়ের কথায় । বলেন--- কী যে
বলিস তুই, লতু ! সেন টাইটেল তো কেউ সাধ ক’রে রাখেনি । এটা তো তদের পিতৃ-পিতামহের পদবী । এর আবার খারাপ
ভালো হয় নাকি ? আর বনলতা নামটা রেখেছে তোর বাবা । তুই তো জানিস না,
তোর বাবা একসময় কবিতা আবৃত্তি ক’রতেন । তখনি তাঁর প্রিয়
কবির কবিতা ‘বনলতা সেন’ থেকেই তোর নাম দিয়েছেন । কবি কে, জানিস ?
জীবনানন্দ দাশ ।
লতুর মনে প’ড়লো ওদের পাঠ্য
বইতে জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘রূপসী বাংলা’ কবিতা ও প’ড়েছে । কী বাজে কবিতা !
কোন ছন্দে মিল-ফিল নেই । যেন গদ্য প’ড়ছে । ফালতু ! আর কেন যে
লোকটা একটা মেয়ের নাম নিয়ে এমন একটা কবিতা লিখতে গেলো, বুঝে পায়নি বনলতা । নোট বইতে প’ড়েছে, লোকটা নাকি মাস্টারমশাই ছিলেন । মনে হ’য়েছিলো, এই মাস্টার মশাইরা শুধু ক্লাসেই জ্বালায় না, কবিতা
লিখেও জ্বালায় । কিন্তু মাকে এ্যাতো অল্পে ছাড়তে রাজী নয় সে । ফের প্রশ্ন করে,
--- কেন ? কবিতার বনলতা কেন ? আর কোন নাম ছিলো না ?
--- সে তোর বাবার যুবক বয়সের কথা । বনলতার মা লজ্জা
পান ।
--- যুবক বয়সে বাবার কী হয়েছিল ? এর সাথে বাবার যুবক বয়সের
আবার কী সম্বন্ধ, বুঝতে পারে না বনলতা ।
মিনতি দেবী বলেন--- তোর বাবার মনে মনে এই স্বপ্ন ছিলো যে,
তিনি বনলতা নামে কোনো মেয়েকেই বিয়ে ক’রবেন । তেমন ক’রেই একবার কাগজে
বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন । জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন তাঁর মনে একটা ম্যাজিক ক’রে রেখেছিল । কিন্তু তাঁর কপাল খারাপ, আমার সাথে দেখা হ’য়ে গেলো । বনলতার ভূত মাথা থেকে নেমে গিয়ে মিনতী পেত্নী এসে ব’সলো ।
--- তোমাদের লাভ ম্যারেজ নাকি ?
--- তুই আবার এসব তোর বাবাকে ব’লিস-ট’লিস না যেন ।
বনলতা বাবা-মায়ের প্রেম কাহিনি শোনার জন্যে উন্মুখ হ’য়ে উঠলো । মাকে ব’লল--- হ্যাঁ, বাবা
তো আমার ইয়ার-দোস্ত । তাঁর কাছে গপ্পো ক’রতে বসবো । এমন সব কথা বলোনা !
কিন্তু এই প্রেমটা আগে জানতাম না তো । কী ক’রে প্রেম হোল তোমাদের ?
--- চুপ করতো । বুড়োবুড়ির প্রেম শুনতে হবে না ।
--- আহা, বুড়োবুড়ি তো সে সময় ছিলে না । বলো, কী ঘ’টেছিলো ?
মিনতি দেবী অতীত ঘাটতে ব’সলেন । নিজের ভালবাসার কথা কে না বলতে চায় ! লজ্জা পেতে পেতেও বলে । তিনিও আপন মনে আজ
দীর্ঘ তিরিশ বছরের পুরনো স্মৃতি খুলে ধরেন আত্মজার কাছে । হাতের কাজ ক’রতে ক’রতেই ব’ললেন,
--- আমাদের বাড়িতে তো দেখছিস, কত বড়ো ক’রে অন্নপূর্ণা পুজো হয় । সেখানে সারা পাড়া
নিমন্ত্রণ থাকতো তোর দাদুর আমলে । এখন তো কোনোরকমে পুজো হয় । তোর বাবারা তো ছিল
আমাদের প্রতিবেশী । একবার তোর বাবা এসেছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি প’রে । তখন সে সবে চাকরী পেয়েছে । আমাদের বাড়িতে ঢাক
আসতো, ঢাকি আসতো । বিরাট ব্যাপার হ’তো । তুইও দেখেছিস কিন্তু তোর মনেনেই । তুই তখন ছোট । তোর বাবা যে অতো
ভালো ঢাক বাজান, তা কে জানত ! সেবার ঢাকি নাকি খুব বাজে বাজাচ্ছিল । বোধহয় ভালো ঢাকি
পায়নি সেবার । তোর বাবা বিরক্ত হ’য়ে ঢাকটা তুলে নিলেন নিজের কাঁধে ।
বনলতা বাধা দ্যায়--- ঢাক ! বাবা ! ধুতি-পাঞ্জাবি প”রে !
--- হ্যাঁ, ঐ ধুতি-পাঞ্জাবি-ই তো কাল হোল । তোর বাবা ঢাক
বাজাচ্ছেন, আর যে কাশি বাজাচ্ছিল, সে তো হিমশিম খাচ্ছে । মণ্ডপে সবাই তো
ধন্য ধন্য ক’রতে লাগলো তোর
বাবার বাজনা শুনে । পুরনো দিনে তো ঢাকই ছিলো পুজোর আসল বাজনা । তোর বাবা একেবারে
নায়কের মতো দাঁড়িয়ে, ঘাড়টা একটু বেঁকিয়ে এমনভাবে বাজাচ্ছিলেন যে, তাঁর হাত পর্যন্ত
দেখা যাচ্ছিল না । মণ্ডপে ধোঁয়ার মধ্যে তোর বাবাকে দেখে তোর মা ম’রল । আরতি চ’লছে আর তোর বাবা
বাজাচ্ছেন । আমার বাবা তো দেখে মুগ্ধ । তোর বাবা-রা
আমাদের স্বজাতি ছিলেন । আমার বাবা ঠিক ক’রে ফেললেন, এই ছেলের সাথেই তাঁর মেয়ের বিয়ে দেবেন ।
--- ঢাক বাজনা শুনে বিয়ে ! মাই গড! তা এ গল্পে তুমি কৈ ?
মানে, তখন তুমি কোথায়? বনলতা রুদ্ধশ্বাশে
ব’লল ।
--- আমি ? আমি তখন চোখ বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে তোর বাবাকে দেখছি আর
পুজোর কাজ ক’রছি । যেন কত কাজ ! আসলে
মণ্ডপে কোনোরকমে থাকবার বাহানা ক’রছি । তোর বাবাও টেরিয়ে
টেরিয়ে আমাকে দেখছিলেন । তোর দাদু আমার শ্বশুর মশাইয়ের সাথে কথা ব’ললেন । বিয়ে ঠিক হ’য়ে গেলো । আমাকে আর মনের কথা
ব’লতেও হোল না আর লজ্জা পেতেও হ’লো না । কিন্তু পরে দেখলাম, না । বনলতার ভূত তোর
বাবার ঘাড় থেকে নামেনি । তুই যখন হ’লি, তখন তোর
বাবাকে সেই বনলতা নামের ভূত আবার পেয়ে ব’সলো । একবার আমি বনলতার ভূত দূর ক’রেছি, আর একবার সেটা ক’রতে চাইলাম না । তোর নাম দেওয়া হ’লো বনলতা ।
লোভে প’ড়ে যেমন কেউ এগরোল
খায়, বা কোনো মশলা খাবার খায় রাস্তায়, আর তারপরে একটা বিস্বাদ, টক্ টক্, ঝাল ঝাল
চোঁয়া ঢেকুর তুলে মনে করে, ‘কেনই বা খেলাম !’ তেমনই বনলতা পরম আগ্রহে বাবা-মার প্রনয়গাথা শুনলো বটে কিন্তু
পরেই তার মনের কৌতূহল কেমন যেন নির্বাপিত হ’য়ে গেলো । বনলতা বুঝলো, এ তার ভবিতব্য । এখানে কারোর হাত
নেই। কিছু করারও নেই । মেনে নিতে হবে বনলতা সেন-এর ভূতকে ।
তবে একটা জিনিস খুব ভালো লেগেছে বনলতার যে, তাঁর বাবা যে
মেয়েটিকে প্রেমিকা হিসেবে পেতে চেয়েছিল, সেই নাম তার জীবনে জুড়ে গেছে । না হয় তার এই নাম
নিয়ে একটা যন্ত্রণা তাকে বহন ক’রতেই হবে । কিন্তু বাবা তো এর
জন্যে দায়ী নয় । এটা তো গর্বের ব্যাপার যে, বাবা হ’লেও কোনো একজন তো তাঁর যুবক বয়সে এই নামটির প্রেমে প’ড়েছিলো । যা তাঁর জীবনে ঘ’টেছে, তা কেবলমাত্র ওর নিয়তি । এর জন্যে দায়ী ওর অজ্ঞতা, ওর পাগলামো । তবে এটাও বেশ ভালো
লেগেছে ওর যে, ঐ দাদা-টাও ‘বনলতা’ প্রেমে আচ্ছন্ন । তা নয়তো অমন ক’রে আবৃত্তি ক’রতে পারতো না ।
এর পর থেকেই বনলতার মধ্যে একটা প্রেম বিরুদ্ধতা ভাব, বিবাহ
বিরুদ্ধতা মানসিকতা কাজ ক’রতে থাকে । কোনো সন্দেহ নেই,
অন্যান্য মেয়েদের মতই ওর জীবনেও একাধিক প্রেমপত্র নানাভাবে এসেছে । এসেছে স্কুল ও
কলেজ জীবনে । তার সবগুলো যে ফেলনা, তা নয় । কিন্তু বনলতা কোন
অবস্থাতে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি কোনো প্রেম প্রত্যাশীকে । তাদেরকে কোনো দোষ না দিয়েই বনলতা নিতান্ত নির্জীবের মতো
অবহেলা ক’রেছে । প্রেম যে একটা
ছেলেকে বা মেয়েকে অবমাননার মধ্যে ফেলতে পারে, তা নতুন কিছু নয় । কিন্তু বনলতা কী
একটা অজানা কারনে স’রে থাকে কোনো যুগল
জীবনের প্রত্যাশা থেকে ।
তাই যেদিন থেকে ওর বাবা বিভিন্নভাবে বনলতার বিয়ের জন্যে
চেষ্টা ক’রেছেন, বনলতা বাধা দিয়েছে । বিয়ে নয় । চাকরী আগে । মনে মনে ঠিক ক’রে রেখেছে, এই চাকরীর নাম ক’রেই বিয়েটা এ্যাভয়েড ক’রে চ’লবে । বিয়ে ওর দ্বারা এ্যাতো সহজে হবে না । কেন হবে না, তা
নির্দিষ্ট ক’রে ব’লতে পারে না বনলতা। কিন্তু বিয়ের কথা ভাবতে গিয়ে, একজন
যুবকের কথা ভাবতে গিয়ে, যে যুবক ওর জীবনের সাথে যুক্ত থাকবে, ওর সাথে এক টেবিলে
খাবে, এক বিছানায় শোবে, তখন বনলতা কোনো পাত্রকে মেনে নিতে পারে না । ঐ প্রায় ভুলে
যাওয়া মুখ তাকে রক্তাক্ত করে, দগ্ধ করে, ক্ষত-বিক্ষত করে ।
ঐ ঘটনার পরে বারবার ভুলতে চেয়েছে বনলতা এই তিক্ত অভিজ্ঞতা । ভুলেও গিয়েছিলো। কিন্তু যেদিন থেকে
ছুটছাট প্রেমপত্র আসতে শুরু ক’রেছিলো, সেদিন
থেকে বনলতার মনে সেদিনকার অপমান যেন কোন দিকভ্রান্ত হাওয়ার মতো ব’ইতে শুরু ক’রেছে । কিছুতেই মন থেকে
সেইদিনের কথা স’রিয়ে দিতে পারছে
না । বার বার সেই দাদার মুখ ভেসে ওঠে একটা আধো আলো অন্ধকারের
মধ্যে । সেখানে কোনোকিছুই স্পষ্ট নয়, মূর্ত নয়, দৃষ্ট নয় । কিন্তু তাকে দূর
করার চেষ্টা যেন স্নানের জলে ডুব দেবার আগে জলের ওপরকার মলিনতা দূর করার চেষ্টার
মত এক ব্যর্থ প্রয়াস ব’লে মনে হয় ওর । সে চেষ্টা অনেকবার
ক’রেছে বনলতা । অনেকবার । ভেবেছে, ঐ মুখ, ঐ
দিন, ঐ সমস্ত কিছু সে মন থেকে ভুলে যাবে । কিন্তু হয়নি । হওয়াতে চাইলেই যে
হবে, তারই বা মানে কী ! ঐ যে ইংরেজি প্রবাদ --- ম্যান প্রপোজেজ বাট গড ডিস্পোজেজ । মন কি মানুষের
আয়ত্তে থাকে ! মন কি কারোর কেনা ! বনলতাও সেই মুখ দেখতে চায়না । ভুলতে না পারলেও
যে সেই মুখ স্পষ্ট হ’য়ে সামনে এসে
দাঁড়ায়, তাও নয় । একটা ছায়া, একটা অবয়ব যেন দাঁড়িয়ে থাকে নিজেকে ভুলতে না
দেবার জন্যে । মানুষ যা চায়, তা সে পায় না । ঠিক তেমনি যা সে
চায় না, তা থেকে মুক্তিও সে পায়না ।
এ এক যন্ত্রণা বনলতার । কাঁচা বয়সের সেই
বোকামি আজ যে ও মনে রাখতে চায় না, তা-ও কি বিধাতা বুঝবেন না ! তবে তিনি কী বুঝবেন
! তিনি নাকি অন্তর্যামী ! মানুষের মনের খবর তিনি শুধু জানেনই না, সেই মনের খবর
তিনিই নাকি তৈরী করেন ! তবে বনলতা কোন পাপ ক’রেছে যে, তাকে এমন একটা অভিশপ্ত অতীত নিয়ে কাটাতে হবে ! একি নামের পাপ ! সীতা
নাম দিলে নাকি মেয়ের জীবনে নানা কষ্ট নেমে আসে। কিন্তু বনলতা ?
তেমন তো কেউ জানে না, শোনেনি কেউ । মাঝে মাঝে বনলতার চীৎকার ক’রে কাঁদতে ইচ্ছে হয় । আর বলতে ইচ্ছে হয়, ‘ কেন প্রেম দিলে এ প্রাণে?’ রবিঠাকুরের ‘কেন প্রেম দিলে না প্রাণে’ গানের চরণটা নিজেই পালটে নিয়ে এভাবে
ব’লতে ইচ্ছে হয় ।
বড়ো হ’য়ে
কাব্যে-সাহিত্যে প’ড়েছে বনলতা, প্রেম
নাকি মানুষকে ব্যথাই দ্যায় । কিন্তু তা কি এই ব্যথা ? এই যন্ত্রণা ? বনলতা যে কষ্ট
পাচ্ছে, যন্ত্রণা পাচ্ছে, সে কি সেই যন্ত্রণা ? কিন্তু এমনটা তো আগে কেউ কখনও
পায়নি । কলেজ জীবন শুরু হওয়া থেকে বাংলা সাহিত্যে আর কাব্যে নিজেকে
ঢেলে দিয়েছিলো বনলতা । যদিও ওর সাবজেক্ট ‘সোশিয়লজি’, তবুও রবিঠাকুর,
শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমবাবু শেষ ক’রে ফেলেছিল
জীবনটাকে জানবার জন্যে । কিন্তু একটা রাহা উত্তর পায়নি ও । এ তো গল্পের মতো
ওর জীবনে গেঁথে আছে । ছাড়ালে না ছাড়ে, কী করিবো তারে !
এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির একটাই রাস্তা বনলতা খুঁজে পেয়েছে । কিন্তু সেটা তো
আরো দুর্গম, আরো দুঃসাধ্য, আরও অনিশ্চিত । তার জন্যে ঐ লোকটিকে সামনে পেতে হবে । তবে যদি গা-এর ঝাল
মরে । কিন্তু কোথায় সে ! সে তো হারিয়ে গেছে একশো দশ কোটির ভিড়ে । না জানা আছে তার
নাম, না ঠিকানা, না অন্যও কোনো পরিচয় । কোথায় খুঁজবে তাকে ! আজ সেই পুরনো দিনের
রি-ইউনিয়নের কথা কে-ই বা মনে রেখেছে ! কেনই বা মনে রাখতে যাবে ! একটা ক্লাশ মেটের
সাথে কন্ট্যাক্ট নেই আজ । হয়তো তাদের সবার বিয়ে পর্যন্ত হ’য়ে গেছে । একবার ভাবে বনলতা, ও খুঁজে খুঁজে যাবে পুরনো সহপাঠিনীদের
বাড়িতে । ঠিক যেমন করে রি-ইউনিয়নের জন্যে খুঁজে খুঁজে বের করা হয়
পুরনোদের, তেমনি ক’রে বের ক’রবে তাকে । জেনে নেবে, কে সে । কিন্তু তখনই মনে পড়ে, সকলেই তো সেদিন
এ্যানাউন্সমেন্ট শুনেছে । যদি ওকে প্রশ্ন ক’রে বসে, ‘তুই ! তুই সেই
মেয়ে ! তুই একটা চিঠি ঢুকিয়ে দিয়েছিস একটা ছেলের পকেটে! ছি ছি ছি ! তোর কোনো
লজ্জা-শরমও নেই ! মেয়েদের একেবারে ভিখিরি বানিয়ে দিলি !
এভাবে তারা আদর্শ লজ্জাবতী নারীর কতই না দৃষ্টান্ত তুলে ধ’রে ওকে আরও ভূলুণ্ঠিত ক’রবে ! তাই সঙ্গে সঙ্গে চুপসে যায় বনলতা । ও জানে, এর থেকে
ওর মুক্তি নেই । ঐ ছায়া ছায়া মুখটা ওকে জ্বালাবে । সারাজীবন জ্বালাবে
। না দেবে ওকে বাঁচতে, না দেবে ওকে ম’রতে । মুক্তি যে একটা আপেক্ষিক শব্দ, তার যে কোনো বাস্তবতা নেই,
মুক্ত যে কেউ নয়, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বনলতা । বাড়ির মানুষের
সামনে দাঁড়াতে ভয় হয় ওর। বিয়ের কথা বাবা বা মা ব’লবেই । এমনকি আজকাল বাড়িতে কোন মেয়ে বন্ধু আনা পর্যন্ত বন্ধ করে
দিয়েছে ও । পাছে কেউ অন্য কিছু সন্দেহ ক’রে বসে । আজকাল তো এমন বিকৃতি-র নানা খবর মানুষ পায় মিডিয়াতে। একদিনের একটা
বোকামি ওকে যে সারা জীবনের জন্যে মাশুল গোনাতে বাধ্য ক’রবে, তা কি ও জানত ? সেটা যে বয়ঃসন্ধি কালের একটা পদস্খলন
মাত্র । পদস্খলনও তো একে বলে না । একটা আবেগঘন
মুহূর্ত । একটা ভুল বড়জোর । তাই এই ধন্ধটা ওর মনকে আচ্ছন্ন ক’রে রেখেছে, গ্রাস ক’রে রেখেছে । নিজেকে একবার ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হয় ওর । একবার নিজের জন্যে
মায়া হয় । একবার ভাবে, বাবাকে ধ’রে কোন একজন কাউন্সেলরের কাছে যাবে । তাহলে হয়তো সমস্যাটা আর ওকে জ্বালাবে না । সমাধান হ’য়ে যাবে । কিন্তু পরক্ষণে মনে হয়, সেটা আবার এই আধবুড়ো বয়সের বালখিল্য
হবে না তো ? তাতে আর একটা ভুল ক’রে ব’সবে না তো ? সাত পাঁচ ভেবে থেমে যায় আবার । অব্যাহতি দ্যায়
নিজেকে নতুন ভাবনা ভাবা থেকে । একবার ভাবে, বাবাকে জানিয়ে দেবে ঘটনাটা । আবার সংকোচ বাধা
দ্যায় । একবার ভাবে, এবার বিয়েটা ক’রেই ফেলবে। নিজেকে মিথ্যের জাল থেকে বাঁচাবে । আবার মনে হয়, এটাও
ঠিক যে, একটা মিথ্যে সাজালে হাজারটা মিথ্যে দিয়ে তাকে সামলাতে হয় । সে কি ও পারবে ?
না । যে ভুল একবার ক’রে ব’সেছে, তাকে ঢাকতে ভুলের পাহাড় আর গ’ড়বে না ও । তার চেয়ে যন্ত্রণা ভালো। সে যন্ত্রণা নিজের
একার যন্ত্রণা । কেউ তার খবর তো রাখে না । নতুন ক’রে তো লজ্জা পেতে হবে না। আসলে যা সওয়ার নয়,
তা তো বলারও নয় । তাকে নিয়ে তো সমস্যা হবেই । জেনে হোক, বা না
জেনে--- একবার যখন মাটি খেয়ে ফেলেছো, তখন ‘থুঃ’ তোমাকেই ক’রতে হবে । অথবা তোমাকেই তা গিলতে হবে মুখ প্রসন্ন রেখে । কাউকে দুষতে পারবে
না । তবু একটা মুক্তির রাস্তা খুঁজছে বনলতা সেন । খুঁজতে ওকে হবেই । হয়তো সারা জীবন ধ’রে খুঁজবে । অনেকটা ‘ক্ষ্যাপার পরশ
পাথর খুঁজে বেড়াবার’ মতো । তা পাওয়াও যাবে
না, আবার অব্যাহতিও নেই । খুঁজে যেতে হবে । দুম্ ক’রে কোন সিদ্ধান্ত আর নয় ।
------------------
এইসব
বিহঙ্গেরা
পরিচ্ছেদ - ২
হন হন ক’রে তোড়া
ইউনিভারসিটিতে ঢুকছিলো। হঠাৎ পাশের চা-এর দোকান থেকে সন্তু ডেকে ব’সলো।
--- এই তুরি!
ওরা ওখানটায় ব’সে থাকে আর মেয়ে দ্যাখে। তোড়াও মেয়ে। কিন্তু ওকে ওরা দ্যাখে না। আসলে দ্যাখা
তো ও নিজেই দ্যায়। আলাদা ক’রে দেখতে হয় না।
চুরি ক’রে খাওয়ার একটা অন্য মজা থাকে। কিন্তু
সেধে দেওয়া খাবার--- কেমন যেন তার
আস্বাদ ম্যাড়মেড়ে। চুরি ক’রে দেখাটা তো
তোড়ার ক্ষেত্রে খাটে না। ওদের সঙ্গে তোড়া আড্ডা দ্যায় ব’লেই হয়তো ওকে দেখে ওদের বা ওদের মতো অন্য কোন উটকো ছেলেদের
মুখে সিটি বা টিজিং আসে না। ওকে ওরা যখন-তখন ডেকে বসে, একসাথে চা খায়, এরাও
খাওয়ায়, ও-ও খাওয়ায়।
এই চা-এর দোকানটাতেই ওদের যত আড্ডা। এটা মন্টু দা-র চা-এর
দোকান। মন্টু দা এ পাড়ারই বাসিন্দা। এক সময়ে তাদের অবস্থা বেশ ভালো ছিলো। তখন
এখানে থাকতো না। গল্প ক’রেছে। অবশ্য
লোকটার চেহারা দেখলেও গল্পটা কতটা সত্যি, তার বেশ খানিকটা বোঝা যায় বটে। কিন্তু
গ্রহের ফেরে আজ তাকে একটা ঘুমটি বানিয়ে গোটা দশেক বয়াম সাজিয়ে রেখে তাতে সস্তা
বেকারির নানা বিস্কুট আর চা বেচতে হ’চ্ছে। তাছাড়া মন্টু দা-র বৌ বানিয়ে দ্যায় ঘুগনি আর আর আলুর দম। তার খুব
নাম-ডাক আছে এ তল্লাটে। অভিজাতদের কাছে নয়।
ভ্যানওয়ালা, রিকশওয়ালা, সব্জিওয়ালা, পাশের কারখানাটার লেবারগুলো, আর ঐ
বেকার ওখানে ব’সে প্রায় সারাদিন
আড্ডা মারা অকর্মের ঢেঁকি ছেলেগুলোর কাছে। পাউরুটি ঐ আলুর দমের ঝোলে চুবিয়ে তো
একেবারে অমৃত। তা-ই চা-এর সঙ্গে বেচে মন্টু দা-র সংসার চলে। আসলে মন্টু দা বড়ো
পরিবারের ছেলে ছিলো। মসৃণভাবে জীবন কাটাতে পারতো। কিন্তু তার মনের মধ্যে যে একটা
মর্যাদাবোধের দস্যি পোকা আছে, সেটা সে টের পেলো সেদিন, যেদিন তার বড়োভাই পুলিশের
হাতে ধরা প’ড়লো এক অপকর্মের জন্যে। মন্টু দা-র ভেতর
থেকে কে যেন ব’লে উঠলো, ‘ভাগ মন্টু। ভেগে যা। এই অপমান তুই মেনে নিতে পারবি না।
কষ্ট করে বাঁচ কিন্তু লজ্জা ক’রে বাঁচিস না।’ ব্যস্, মন্টু দা পালিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। সে তো আজ অন্তত
বছর কুড়ি আগের ঘটনা। মন্টু দা নিজেকে ডিক্লাসড ক’রে নিয়েছে।
এখান দিয়েই যে কমলা গার্লস স্কুলের মেয়েরা, ইউনিভারসিটির
মেয়েরা যায়-ফেরে। এটাকেই যুবক, প্রাক যুবক ছেলেরা একটা ঠেক বানিয়ে নিয়েছে। একটা
অলিখিত চুক্তি মেনে যেন পালা ক’রে তারা এখানে
আড্ডা জমায়। কখনও বড়োদের সাথে ছোটদের ক্ল্যাশ হয় না। চা-এর দোকানের মালিককে ‘কে ছোট, কে বড়ো’ ভাবতে নেই। এটা তার ব্যবসা। তাই মন্টু দা চুপ ক’রেই থাকে। মোটামুটি সবাই-ই তো তার থেকে বয়সে ছোট। বয়স্করা
তো এখানে বসে চা খেতে বা আসর জমাতে আসে না। কিন্তু মন্টু দা মাঝে মাঝে ব’কেও দ্যায় ওদেরকে যখনই কোনো মেয়েকে এরা কিছু বলে। কিন্তু
সেটা তেমন মার্গে যায় না। সে চাওয়ালা। তাকে তো এদেরকে নিয়েই ক’রে খেতে হবে। তবে ইউনিভারসিটি-র মেয়েদের তেমন কোন টিজিং
শুনতে হয় না। তারা তো মোটামুটি সিনিয়র। যা কিছু শোনে, সব স্কুল আর কলেজের মেয়েরা।
তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পাত্তা দ্যায় না, কেউ কেউ মুচকি হাসে, কেউ কেউ আরো শুনবার
জন্যে বিরূপ মন্তব্য করে। তবে তোড়া রেহাই পায় না। ওকে তো টিজিং করে না কেউ। দেখলেই
পেছন ডাকবে, ‘এই তুরু!’ বা ‘এই ছুন ছুন!’ ওরা জানে, তোড়া ওদেরকে এ্যাভয়েড করে না। ওদের সাথে তোড়ার
বন্ধুত্বও। ওদেরকে সে ভালোবাসে। কিন্তু মাঝে মাঝে তোড়া খড়্গ হস্তও হয়। ঝাঁঝিয়ে
ওঠে। আজও হঠাৎ এমন ডাকে সন্তুর ওপর রাগ হয় তোড়ার। ঝাঁঝিয়ে উঠলো,
--- তোরা কি সময় অসময় জ্ঞান ক’রবি না, সন্তু দা! পেছন ডাকলি কেন?
তোড়ার মাথা গরম দেখে কানে হাত দ্যায় সন্তু। বলে--- সরি
বাবা! সরি! ভাবলাম, তোর সাথে দেখাই হয় না। একসাথে চা মারবো। সরি!
--- চা মারব মানে! আমি ব’লে খেয়ে-দেয়ে ক্লাশে যাচ্ছি। আর তোদের সাথে ব’সে এখন ভরা পেটে চা গিলতে হবে! অনুযোগ করে তোড়া।
--- না, আসলে আমাদের তো আর ক্লাশ-ফ্ল্যাশ নেই। তাই মনে থাকে
না।
--- খুব শিখেছিস। সেন্টিমেন্টাল টক ক’রতে না তোর জুড়ি নেই, সন্তু দা। মেয়েদের থেকে এক কাঠি বেশি।
চোখ পাকায় তোড়া।
--- ক-টায় ক্লাশ তোর, বল। বিশু ঝুলে প’ড়ে বলে।
--- এগারোটায়।
--- দ্যাখ, ক-টা বাজে। দশটা পঁচিশ।
--- আমি লাইব্রেরীতে যাবো।
--- রাজু মন্তব্য করলো--- অয়! একটা মিথ্যে বানিয়ে
নিলো।
বিশ্বনাথ ছাড়ে না। এরে তর্ক জুড়ে দ্যায়--- চা খেতে আর কত
সময় লাগবে! তাছাড়া জেনে রাখ, বা দীপ্ত দা-কেও জিজ্ঞেস করিস, হেভি ফুড নেবার পরে এক
কাপ লিকার চা হেলদি টু বডি। একটা সাইন্স ম্যাগাজিনে প’ড়লাম। জানিস কিছু! খালি জ্ঞান দিস!
মাথার দুপাশে হাত তুলে হাতের চেটো মেলে আত্মসমর্পণের
ভঙ্গিতে বলে তোড়া--- ওকে, ডক্টর বিশ্বনাথ। শিখলাম। ধন্যবাদ। থ্যাঙ্ক ইউ। তবে যদি
এই পেছন ডাকা-টা তোদের দীপ্ত দা-কে বলি না, তবে চা নয়, চাটা খাবি।
বিশ্বনাথ এ্যাক্টিং করে তোড়া-র সাথে--- এই যে তুই ‘ডক্টর বিশ্বনাথ’ ব’লে ডাকলি না, সেটা আমার কানে একটা
কোকিলের থেকে অনেক মধুর আর মিষ্টি শোনালো। কেউ তো ডাকে না। সব তো ‘এ বিস্বনাত!’ ব’লেই ডাকে। তোর এই সম্ভাষণের কোটি টাকা দাম।
তোড়া বোঝে, এরা ছাড়বে না আজকে। তাই কৃত্রিম রাগ ক’রে বলে--- ব্যস্ ব্যস্। বুঝেছি ডক্টর বিশ্বনাথ। তুমি এখন
অনেক দেবদাস মার্কা ডায়লগ দেবে। তোমাকে তো চিনি। এ্যাতকাল তো দেখছি। ব’লে কোমর দিয়ে বিশুকে একটা ঠেলা দিয়ে বেঞ্চে, পাশে গিয়ে বসে।
ধাক্কা দিয়ে বলে--- নে, চ বল্। খেয়েই দেখি, তোর সাইন্স কী ব’লছে। আমরা তো সাইন্স নই। আর্টস। একটু কম বুঝি। বাট দাম
কিন্তু আমি দেবো। রোজ রোজ মেয়েদের পেছনে পকেট খসাস না। করিস তো কটা টিউশন।
--- তুই কি মেয়ে নাকি, বে! বলে সন্তু। তুই তো আমাদের
ফ্রেন্ড। জিগ্রি ফ্রেন্ড।
--- তাহলে আমি কী?
--- তুই আসলে কোন সেক্সে পড়িস না, তোড়া। অনলি তোড়া। ব্যস্।
মেয়েরা তো সব লবঙ্গলতিকা। একটা আওয়াজ দিলে ঝ’রে ঝ’রে পড়ে। শীতের হাওয়ায় যেন পাতা ঝ’রে গেলো। আর তুই যে এসে তোর কোমর দিয়ে ঠেলা মেরে বসলি না,
এতে আমাদের অহংকার হয়। আমরা যে কেউ বা কিছু--- বেশ বুঝতে পারি। তুই আলাদা। তোর কোন
ছোঁয়াছানির ভয় নেই, ঘেন্না নেই, অবজ্ঞা নেই।
--- ব্যস্, ব্যস্। আর ব’লিস না। ফেটে মরে যাবো। এমনিতেই একটু মুটিয়ে যাচ্ছি। আর না রে দাদা। তোড়া এসব
কথা পছন্দ করে না ব’লেই ওদেরকে চুপ
করায়। প্রসঙ্গ পালটে বলে--- দাম আমি দেবো, ব্যস্। রাজী? না হলে ফোটো। চা খাবো না।
পাশ থেকে রাজু বলে--- এ্যাত অবজ্ঞা কেন, রাধে! আমরা না হয়
বেকার মানুস। কিন্তু আমরা কি একটু চা-ও খাওয়াতে পারি না! এ্যাতো অসহায় নাকি!
টুইসানি করি। তিনটে কেলাস ফাইভ।
ফোঁস করে তোড়া--- দ্যাখ রাজু দা, বলেছি না, ‘স’ ছাড়তে পারিস তো
আমার সাথে কথা ব’লবি। নয়তো ব’লবি না। তালব্য ‘শ’ টা শেখ না, বাবা।
--- ওকে গুরু। সরি, গুরু মা। এটুকু ব’লে আবার নিজেই জিভ কেটে নিজেকে সংশোধন ক’রে নেয়--- সরি, গুরু সিস্টার। অবশেষে নিজের সম্বোধনের
অক্ষমতায় নিজেই বিরক্ত হ’য়ে যায়। বলে---
ধ্যাত্তেরি! কী যে হচ্ছে! আচ্ছা, এখানে কোন অভিভাষণটা হবে বলতো?
এরপর রাজুর ঘাড়ে, মাথায়, পেটে, পিঠে যেখানে সেখানে তোড়ার
চপেটাঘাত ঘন ঘন এসে প’ড়তে থাকে। এটা
নিত্যকার নাটক। আর রাজু চা-এর দোকানের পাশের কুকুরটার মতো কান-মাথা ঢেকে অনর্গল
মার খায়। এটা মন্টু দা-র দোকানের চেনা ছবি। তোড়া রাজুর চেয়ে অনেক ছোট। কিন্তু
রাজু তা মনে রাখে না। রাজু প্রায়ই খায় চড়টা চাপট-টা। তোড়ার হাতেই খায়। কেন খায়,
কেউ তা জানে না।। তা নয়তো ইচ্ছে ক’রে কেনই বা ব্লান্ডার
করে! তোড়া চ’লে গেলে দোকানের
মালিক মন্টু দা মন্তব্য করে,
--- রাজু তোড়া দিদির কাছে ঠাণ্ডা। এই যে খেলো, এর এ্যাকশন
থাকবে এক সপ্তাহ। তার পরে আবার একদিন খাবে।
আসলে ইচ্ছে করেই ‘শ’কে ‘স’ বলে রাজু। ও ব’লতে পারে না, এমন নয়। এটা একটা খেলা রাজুর কাছে। ওদের
বাড়িতে কোন মেয়ে নেই, মানে রাজুর সাতকুলে কোন বোন নেই। তাই ও তোড়াকে ভালোবাসে।
তোড়া চলে গেলেই ব’লবে,
--- ভালো লাগে, মন্টু দা। তোড়া যে আমায় শাসন করে, আমার বেশ
লাগে। শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। ওর সোহাগটা দেখলে না!
তোরা এদের সঙ্গে মেশে আজ নয়। বহুকাল। তার মানে এই নয় যে, সে
মেয়েদের সঙ্গে মেশে না। মেয়েদের সাথে মেয়েদের মতই সমান তালে ও আড্ডা দ্যায়। তখন কে
বুঝবে, তোড়া চা-এর দোকানে ব’সে সমাজ
পরিত্যক্ত, রোখা মেজাজ, ঠোকা কপালের এই ছেলেগুলোর সাথে জ’মিয়ে আড্ডা দিতে পারে! শুধু আড্ডা নয়, ওদের ভাষাও ওর অধিগত।
ছেলেগুলোকে ভালো লাগে তোড়ার। ওদেরকে কেউ চায় না। ওদেরকে কেউ ভালোওবাসে না। কিন্তু
ওদের কী দোষ, তা তোড়া বুঝতে পারে না। ওরা তো কেউ অশিক্ষিত নয়। ওদের মধ্যে
গ্র্যাজুয়েশন করা শুধু নয়, ছোট মোট অন্যান্য ডিগ্রীধারীও আছে। বিশু ভালো তবলা
বাজায়। রবি দা ভালো আবৃত্তি করে। কত সুন্দর রবিদার কণ্ঠ। ওদের দোষ হলো, ওরা চাকরী
পায়নি। ওরা বেকার। তাই ওদের অস্তিত্বটাও যেন বেকার সবার কাছে, ওদের পরিবারের
সদস্যদেরও কাছে। তাদের চোখে ওরা যেন বাতিল। একটা বাতিল রেকর্ড বাজলে যেমন
শ্রোতাদের কানে সেই শব্দ ঢুকে গা-টাকে রি রি ক’রিয়ে দ্যায়, তেমনই ওদের কোন ভয়েস নেই ফ্যামিলি-তে। অথচ অনেকের থেকে ওদের
মানসিকতা সুন্দর আর নিষ্পাপ। যথেষ্ট কোয়ালিটি আছে ওদের অনেকের মধ্যে। কিন্তু সে
টুকু ভেবে দেখতেও একটা বীতরাগ আছে ওদের আত্মীয়-পরিজনদের মনে, ভাইদের, বোনেদের
কাকাদের বা বউদিদের মানসিকতায়। কাদের নয়! ওরা কথা ব’ললেও মনে হয়, ফাল্তু কেউ ব’কছে, আবার না ব’ললেও মনে হয়, এ্যাতচুড দ্যখাচ্ছে। ওদের অলক্ষ্য নয়, সামনেই
বলে অনেকে,
--- বাবা পেটে ঢুঁ মেরে বিদ্যেটুকু ঢুকিয়ে দিয়েছিলো, তাই
বর্তে গেলি। তা নয়তো তো কবে ফুরিয়ে যেতিস। পড়ে থাকতো দাঁত, নখ আর চুলটুকু।
কেউ কেউ বলেন--- এ এক অদ্ভুত প্রজন্ম। কোন কাজ নেই, কোন
চিন্তা নেই, কোন দায়বদ্ধতা নেই। দিব্যি খাচ্ছে, দাচ্ছে আর বগল বাজিয়ে বেড়াচ্ছে।
কেউ কেউ বলেন--- এই চা-এর দোকানগুলো হয়েছে যত সর্বনাশের
আখড়া। ঐ দোকানগুলো এই প্রজন্মকেও খেয়েছে, এবার সামনের প্রজন্মকেও খাবে।
এ কথাও বলা হয়--- আরে বাবা, চাকরী না পাস, ছোট মোট ব্যবসাও
তো ক’রতে পারিস। বাবার পাশে দাঁড়াতে ইচ্ছেটাও
কি হয় না! আর কিছু না পারিস, একটু আধটু সমাজসেবা-টেবাও তো ক’রতে পারিস।
তোড়া এই মানুষগুলোকে চেনে। হাড়ে হাড়ে দেখেছে এদের পুরনো দিনের খাওয়া হাতের পাতায় বা
খাওয়ার কথা শোনা হাওয়ায় মাখনের গন্ধ শুঁকতে। হয়তো মাখন জীবনে চোখেই দেখেনি। মাখনের
পাতা চেটেছে আর ব’লেছে,
--- এদের জন্যে গোটা দেশ রসাতলে গ্যালো। বুড়ো বাপের দিকেও
এদের দৃষ্টি নেই, সংসারটা কী করে চ’লছে, তার কোনো খবর
নেই। বাপের হোটেলে খাচ্ছে, আর ফুর্তি মারছে।
কিন্তু তোড়ার মেয়েদের সাথে আড্ডা দিয়ে যেটুকু আনন্দ লাগে,
তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ লাগে এদের সাথে, মানে এই সন্তু দা, বিশুদা, রাজু দা,
রবিদাদের সাথে কথা ব’লতে। কোন রাখ-ঢাক
নেইই ওদের। কথায় কোন ভাঁজ নেই। যেমন কিছু পাবার কোনো প্রত্যাশা নেই তেমনি কোনো
হারাবার আতঙ্কও নেই ওদের মনে। মেয়েদের আড্ডা ব’লতে তো ফ্যাশন, লিপস্টিক, শাড়ি, বা অন্য কোন ড্রেস মেটেরিয়ালস। এর ওপরে গেলে
বড়োজোর বয়ফ্রেন্ডদের কাহিনি। ছোটবেলা এদের কথা, এদের দুঃখ শুনে শুনেই ও বড়ো
হয়েছে।
তোড়াকেও এইজন্যে নানা কথায় প’ড়তেও হয়। পাড়ায়, ইউনিভারসিটিতে, বন্ধুমহল থেকে শুরু ক’রে আত্মীয়মহল---সর্বত্র ওর নামে নানা কটু মন্তব্য ওঠে।
ছেলেদের সাথে নাকি হ্যংলামো করে ও, এটা নাকি আজকের ছেলেদের বা মেয়েদের একটা ট্রেন্ড,
কি একটা রোগ। তাছাড়া আজকাল নাকি ভদ্রঘরের ছেলে বা মেয়েরা নিচুতলার দিকে মেলামেশা ক’রবার একটা বিশেষ ভাইরাসে আক্রান্ত হ’চ্ছে। সেদিন তো অঞ্জলি বৌদি ডেকেই বলে বসলো,
--- হ্যাঁরে তোড়া, ঐ চা-এর দোকানের ছেলেগুলোর মধ্যে নিশ্চয়ই
এক্স-ফ্যাক্টর আছে, বল্। তা নয়তো তুই ওদের টানে ওখানে ছুটিস কেন? তুই তো একজন
টিচারের বোন। হ’লোই বা তোর দাদা
প্রাইভেট টিচার। তাতে কী! টিচার তো টিচারই।
প্রাইভেট টিচার যেন কোনো টিচারই নয়, এটাই যেন বলে দেবার
একটা চেষ্টা ক’রছিলো অঞ্জলি
বৌদি। চাকরী পেলেই তবে যেন ‘টিচার’ খেতাব পাওয়া যায়। এমন একটা কিছু বলার চেষ্টা ক’রছিলো মহিলা। গা-টা জ্ব’লে যাচ্ছিলো তোড়ার। এই মহিলাই হাজব্যান্ড অফিসে বেরিয়ে গেলে দিব্যি রং মেখে
সেজেগুজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে একটা বিশেষ উপায়ে একটা বিশেষ উপার্জনের ধান্ধায়।
শুধু অঞ্জলি বৌদি কেন! ওদের পাড়ায় একাধিক মহিলা, অবিবাহিতা মেয়ে এমন একটা জীবিকা
অর্জনের জন্যে বেরিয়ে পড়ে বেলা এগারোটা বাজলেই, আর ফিরে আসে চারটের মধ্যে।
হাজব্যন্ড বাড়ি ফিরে দ্যাখে, তার সাধের স্ত্রী দিব্যি ভাতঘুম দিচ্ছে। বিজনেস
অর্ডার ধ’রিয়ে দেওয়া, বিনিদ্র রাতের ক্লান্তি দূর
করা--- এমনি আরও কত কাজ করে এরা! এসব এক ধরনের সমাজসেবা। এর জন্যে আজকাল রাত লাগে
না। এরা সব দুপুরের বিবি পায়রা। যে কোনভাবে আরও উপার্জন ক’রতে হবে। আবার তারাই মানুষের, বিশেষ ক’রে এই ছেলেগুলোর মধ্যে একটা নোংরামো দ্যাখে। আসলে এরা সব
নোংরা ঘাঁটতে ঘাঁটতে সব সময়ই মনে করে--- সর্বত্র বড়ো নোংরা। গা-এ লেগে যাবে।
এমন কোনো ভাব তোড়ার হয় না। কেন হয় না! মেয়েরা নাকি এই
রাস্তা, এই চা-এর দোকান পার হ’তে গেলে নানা
মন্তব্যের মুখোমুখি হয়। একে বলে টিজিং। ইভটিজিং। কৈ? কখনও তো তোড়াকে টিজ্ড হতে হয়
না! কেন? তোড়া কি টিজ্ড হবার যোগ্য নয়? ওর মধ্যে কি কিছু কম আছে টিজ্ড হবার
দৃষ্টি-তে? বাড়িতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে নিরাবরণ দাঁড়িয়ে তোড়া নিজেকে মাপতে
চেষ্টা করে। না, কোন সন্দেহ নেই, ও একটি সম্পূর্ণ নারী। তাহলে এর গোপন কথাটা কী?
মাঝে মাঝে ওদের কাছে এমপ্লয়মেন্ট বুলেটিনগুলো নিয়ে হাজীর
হয় তোড়া। চেঁচামেচি করে--- তোড়া এই খবরটা
দেখেছিস? রেলে গ্রুপ-ডিতে লোক নিচ্ছে দেড় হাজার। তোরা এ্যাপ্লাই ক’রছিস না কেন?
বিশু হতাশ হয়। বুঝে পায় না, এর কী উত্তর দেবে। কোন উত্তর
আছে কি? তবু বলে--- দ্যাখ তোড়া, একটা কম্পিটিটিভ এক্সাম দিতে গেলে খরচ জানিস? কোচিং
লাগে, রেফারেন্স লাগে, গাইড বই লাগে, পোস্টাল অর্ডার লাগে। সবচেয়ে বড়ো কথা, একটা
স্টাডি এনভায়রন্মেন্ট লাগে। একটা চারজিং এলিমেন্ট লাগে। কোথায় পাবো,বলতো?
সন্তু বলে--- রাইট। এ সব পরীক্ষা দিতে গেলে তো বাড়িতে একটা
ক’রে তোড়া লাগে, একটা ক’রে দীপ্তদা লাগে। পাবো কোথায়, বল তো? আমাদের বাড়ির পরিবেশ
তো জানিস না। বিনা পয়সায় পারো, তো করো। তা নয়তো রাস্তা দ্যাখো। চাকরীর পরীক্ষাতে
যে একটা খরচ আছে, তা কে মানবে! বাপ-ঠাকুরদাদেরকে তো জোর ক’রে ঢোকানো হ’য়েছিলো নানা
চাকরীতে। তাই আজ ক’রে খাচ্ছে। খাটতে
তো হয় নি। জানে না, আজকের অবস্থাটা কী।
রাজু হতাশ কণ্ঠে জানায়--- বাবা-মা যখন বুঝিয়ে দ্যায় যে,
তাঁরা যে সন্তান পালন করে, তা তাঁদের কাছে সন্তানের একটা ঋণ, আবার অনেক সো কল্ড
বিরাট মাপের মানুষ তাঁকে সাপোর্ট করে, তখন গোটা-টা একটা জালি ব্যাপার লাগে। এই
শ্রদ্ধা, পারিবারিক বন্ধন, স্নেহ, মায়া, মমতা সব ঝুটমুট লাগে রে। সব ফালতু, বোগাস।
আসলে আমরা সব একগাদা জোকার্স। আমাদের অস্তিত্ব যেন শুধু বাতাস দেবার জন্যে।
বাড়িতে অলক্ষ্মী ঢুকলে আমাদের ভর ক’রে বাতাস দিয়ে
বিদায় করো। ব্যস্।
তোড়া কান্না লুকোয়। এদের এই সমস্ত আলোচনা ওর ভালো লাগে না।
চোখে জল আসে। দাদা শিখিয়ে দিয়েছে, কিভাবে চোখের জল অন্তর্লীন ক’রতে হয়। তোড়ার চোখও গিলে নেয় তোড়ার অশ্রু। ওর চোখ পড়ে রবি
দার দিকে। আজকে অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ্য ক’রেছে তোড়া, রবি দা যেন একটু অন্যমনস্ক। এরা তো এ্যাতোটা ব্যক্তিত্ব ধ’রে রাখতে পারে না। ঠাট্টা ইয়ার্কি ক’রতে ক’রতে এদের জীবনটাই
একটা ঠাট্টা যেন। কিন্তু আজকে এ্যাত কথাবার্তা হ’য়ে যাচ্ছে, অথচ রবি দা-টা একটু কেমন কেমন মুডে র’য়েছে! তোড়া ধাক্কা দ্যায়,
--- কীরে রবি দা, তোর কী হয়েছে রে?
রবি এদের মধ্যে একটু বেশি সিনিয়র। চাকরী পাবার একেবারে
অন্তিম লগ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। সরকারী চাকরীর জন্যে সম্ভবত আর একটা বছর বড়োজোর সময়
আছে রবি দা-র। হায়ার কাস্ট। তাই এরপর কোনো একটা প্রাইভেট-টেট ছাড়া আর কোনো গতি
থাকবে না।
রবির কোনো উত্তর না পেয়ে ফের তোড়া জানতে চাইলো--- কী রে,
রাজু দা। রবি দা হঠাৎ মৌনীবাবা স্টাইল নিয়েছে যে? কী কেস?
এবারে মুখ খুলল রবি--- তোর সাথে আমার একটা জরুরি কথা আছে।
পাঁচ মিনিট সময় নেবো।
সাথে সাথে মুখ চাপা দিয়ে উঠে যায় বিশু। আসলে ও হাসছে, না
কাঁদছে, ধ’রতে পারলো না তোড়া। তাই আবার জিজ্ঞেস
করলো--- বল না, কী হয়েছে? দ্যাখ, তোরা যেই সিরিয়াস হ’স, আমার হেভি ভয় লাগে। বুক ধক ধক করে। মনে হয়, কী বলতো?
চড়াইপাখি কুবোপাখির গলায় ডাকছে। একটু খোলসা কর, ভাই।
রাজু বলে--- না না। সে রকম কিছু না। ও একটা রোমানটিক কেস।
আসলে রবি একটা এ্যাফেয়ারে ফেঁসেছে। তার সাথে এটাও জুড়ে দ্যায়--- তোকে একটু হেল্প ক’রতে হবে কিন্তু, তোড়া।
আকাশ থেকে পড়ে তোড়া।--- আমাকে! কেন? আমাকে হেল্প ক’রতে হবে কেন? আমি এ্যাফেয়ারের দালাল নাকি? কার না কার পেছনে
তোড়া লেগে প’ড়বি, আর আমাকে
সামাল দিতে হবে! তাহ’লে এই ধান্ধা
নিয়েই আমার সাথে তোরা বন্ধুত্ব করিস, বল। তোড়া এসব বিষয়কে কোন প্রশ্রয় দ্যায় না।
সোজা জানিয়ে দ্যায়--- দ্যাখো ভাই, প্রেম-ফ্রেম করবে নিজের দায়িত্বে। তোড়া এসব
ব্যাপারে নেই। এমনি আমি ‘খারাপ মেয়ে’ ব’লে বদনাম খাই। তার
ওপর এসব উট্কো ঝামেলা কেউ নেয় নাকি!
--- তুই তো আসল কথাটাই শুনলি না।
--- কী শুনবো বলতো! কী শুনবো? তোড়া কি মনে করিস? এভাবে জীবন
কাটাবি? আর তোদের প্রেমে মেয়েরা গ’লে যাবে? এটা কি
হিন্দি সিনেমা নাকি? চাকরী নেই, চাকরির জন্যে কোনো চেষ্টা নেই, জীবিনের কোন স্থিতি
নেই। কেন বলতো, একটা মেয়ের জীবন সর্বনাশ ক’রতে যাচ্ছিস? যা ক’রিস, ক’রিস, আমার টাইম খারাপ ক’রিস না। এসব ব্যাপারে আমি নেই, ব্যাস্।
--- আরে মেয়েটা কে শোন তো।
রাজু দা-র আবেদনে ছাড়া ছাড়া ক’রে বলে তোড়া--- কে।
তোড়ার প্রতিবাদ শুনে অবধি রবি চেপে গেছে তার মনের কথা। বুঝে
গেছে যে, এখানে ব’লে আর লাভ নেই।
কিন্তু রাজু উত্তর দিয়ে চ’লেছে--- ঐ যে,
তোরই তো বান্ধবী। ঐ যে ঘাড় পর্যন্ত চুল কাটা। বেশ বড়লোক ঘরের। বাবা বোধহয় কোনো
নেতা-ফেতা হবে।
--- বাঃ! ভালো মেয়ে পাকড়াও ক’রেছ তো। তোড়া কি জানিস, মেয়েটার এ্যকাডেমিক রেজাল্ট কি? রবিদা কে কেন সে
পাত্তা দেবে বল তো? তারপর ওর বাবা যেদিন ধ’রে ফেলবে না, মার খেয়ে ম’রবি। ভাবিস কি
তোড়া নিজেদেরকে? নায়ক নাকি। এখানে ব’সে মেয়েদেরকে টিজ ক’রবি, আর মেয়েরা সব
গিলে নেবে? তোদের প্রেস্টিজে লাগে না?
--- তোদের প্রেস্টিজ দেখেই তো ক’রি, বস। আমরা আমাদের সম্মান দেখলে তো তোদের অসম্মান হয়।
আমরা এসব বলবো, তবেই তো তোদের সাজুগুজুর দাম।
--- থাক। আমাদের সম্মান আমরাই দেখতে পারবো, ভাই। তোদের
দেখতে হবে না। তোদের চোখে যেটা সম্মান, সেটা অন্যের কাছে তো বিপদ হ’তে পারে। এটাই ভাব।
রাজু আর তোড়া যখন কলহে মত্ত, তখন কখন যেন রবি সেখান থেকে
উঠে চ’লে যায়। অনেকটা পরে ব্যাপারটা ওদের চোখ
পড়ে। রাজু এবার একটু ধৈর্য হারায়। বলে ওঠে--- তুই ব’লেই রবি কথাটা ব’লেছে। অন্য কেউ হলে বোলতো? এভাবে রিএ্যাক্ট করার কোন দরকার ছিল না। রবিটা কোন
দিকে হাঁটা দিলো, এখন আবার দেখতে হবে। কিছু হলে কিন্তু তুই দায়ী থাকবি, বলে দিলাম।
--- হ্যাঁ। আমাকে বলে উদ্ধার ক’রেছে। রবি দা কোথায় গ্যালো জানার কোনো দায় নেই আমার। শুনে
রাখ, কোনো দায় নেই। ঝাঁঝিয়ে ওঠে তোড়া। আমি যা ব’লেছি, বেশ ক’রেছি। এসব অন্যের
কাঁধে ভর ক’রে হয় না। এটা নিজের ব্যাপার। নিজের
কেরামতিতে প্রেম-ফ্রেম কর। আমাকে কেন?
হঠাৎই তোড়া দেখতে পায় যে, মঞ্জুলা, রমিতা, বনলতা একসঙ্গে
ক্যাম্পাসে ঢুকছে। ও চেঁচিয়ে ওঠে--- রমিতা, দাঁড়া। আমি ক্লাসে যাবো। তারপর ওদের
দিকে তাকিয়ে জানিয়ে দ্যায়--- চলি রে, রাজু দা। রবি দা-কে বলিস, প্রেম একটা সাধনা।
এভাবে চা-এর দোকানে ব’সে ব’সে প্রেম হয় না।
হা করে তাকিয়ে থাকে ওরা। দিব্যি একটা সুনীল আকাশ হঠাৎ এভাবে
যে মেঘে ঢেকে যেতে পারে, ভাবে নি ওরা। তোড়া তাঁর ক্লাসমেটদের সাথে ঢুকে গেলো
ইউনিভারসিটির মধ্যে। ওর নীল বুটিদার ওড়নাটা হুস ক’রে হাওয়ায় একটা আন্দোলন তুলে অদৃশ্য হয়ে গেলো ক্যাম্পাসের আড়ালে। মাঝে মাঝে
মনে হয় সন্তুদের, এর চেয়ে মেয়ে হ’য়ে জন্মালে ভালো হ’তো। নো টেনশান। অন্যের পয়সায় ফুটুনি করো, আর চ’রে বেড়াও। ভবিষ্যৎ নিয়ে নো চিন্তা, ডু ফুর্তি। একদিন এক
রাজপুত্র এসে তুলে নিয়ে যাবে আদর ক’রে। তাঁর অপেক্ষায়
থাকো আর নিজেকে সাজাও গোছাও ঘটা ক’রে। তারপর এক নতুন
জীবন। তবে মাঝে মাঝে এ কথাও মনে হয় যে, তোড়ারা, মানে মেয়েরাও ঠিক সেফ নয়, সিকিওর্ড
নয় ছেলেদের মতো। ওদেরকেও অনেক জ্বালা পোহাতে হয়। সে জ্বালা তো ছেলেদের পোহাতে হয়
না। কিন্তু তোড়া ওদের চোখে আলাদা। ও দীপ্ত দা-র বোন। দীপ্ত দা-র মতই ওর নেচার।
বড্ড ঝাল কথায়। কিন্তু ওদেরকে এই মেয়েটা একাই বোঝে। ভালোবাসে। আজ যা ব’লল তোড়া, তা তো পুরোটা মিথ্যে নয়। রবি প্রেম ক’রবে, তো তোড়া কী ক’রবে! সত্যি তো। তোড়াকে এসব ব্যাপারে জড়ানো কেন! না হ’ক, একটা মেয়েকে ভালো লেগেছে রবি-র। একটা মিডিয়া হ’লে হয়তো সুবিধে হয়। কিন্তু এসব ব্যাপারে কি এ্যাতো সহজ পথে
এগোতে হয়? সুবিধে নিয়ে কি প্রেম চলে? এর অনেক ব্যাপার আছে। প্রেম ফ্রেম কঠিন
ব্যাপার। সে সব নিজেকে বইতে হয়। কারোর ঘারে উঠে হয় নাকি?
সন্তু তো বলেই ফেলল--- রবি-র বাচ্চা তোড়া কে এসব বলে ঠিক
করেনি। ও আর আসবে ঠেকে? গ্যারান্টি দিচ্ছি, আসবে না। কোনো বন্ধুকে এভাবে ইউজ ক’রতে নেই। রবি-টা তোড়া কে ইউজ ক’রতে চেয়েছে। তুই কি তোড়ার কন্সেন্ট নিয়ে প্রেম ক’রতে গেছিস?
বাধা দ্যায় বিশু। বলে--- চুপ করতো। ইউজ কীরে! বন্ধু যদি বন্ধুর
সাহায্য না চায়, তবে কাকে ব’লবে! হেল্প ক’রতে পারবে, না পারবে না, সেটা আলাদা কেস। এর মধ্যে ইউজ আসছে
কোথা থেকে?
শেষে ওরা এই সিদ্ধান্তে এলো যে, এবারে রবিকে একটু খুঁজে
দেখা দরকার। দেবদাস কোথায় গেলো তো জানতে হবে। এসব রোমান্স ফোমান্স ওদের চোখে বেজায়
ঝামেলার জিনিস। একটা ফ্যাচাং। এসবে জড়াতে নেই। এই খুল্লাম খুল্লা জীবনই ভালো।
সাধ ক’রে ল্যাগেজ নেবার কোনো মানে নেই। শেষে
ওরা এঁকে অপরকে একটু চেঁচিয়েই বলে,
--- আরে ওঠ্ না। চল না। দেখি, রবিটা গেলো কোথায়। শালা শেকড়
গ’জিয়ে গেলো নাকি?
মন্টু দাও তাগাদা দিলো--- হ্যাঁ, তাই যাও। রবি তো এমনি
একটু লেংচে আছে। ওকে সামলাও।
ওরা টুকটাক করে উঠে চ’লে যায় বাজারের দিকে। দোকান একা প’ড়ে থাকে। দোকানের বেঞ্চগুলো যেন একটু হাঁফ ছাড়ে। গত তিনটি ঘণ্টা ধ’রে এরা কজন তার ঘাড়ে যে দলাই মলাই চালাচ্ছিলো, এবারে তাদের
একটু রেহাই। এবার সেগুলো একটু রোদ পুইয়ে নেবে। একটু পরেই কারখানার থেকে কিছু কিছু
ক’রে শ্রমিক নাইট ডিউটি সেরে আসবে। চা
খাবে, সাথে আলুর দম আর একটা ক’রে কোয়াটার রুটি।
কেউ কেউ ঘুগনির খদ্দের। নীলিমা, অর্থাৎ মন্টু দা-র বৌ ইতিমধ্যে সেসব বানিয়ে একটা
ভ্যানে পৌঁছে দিয়েছে দোকানে। মন্টু দা বেঞ্চগুলোকে আবার একচোট সাজিয়ে নিলো।
দোকানের সামনেটা একটু ঝাড়ু মেরে নিলো। সিগারেট আর বিড়ির টুকরোয় গোটা জায়গাটা ভ’রে থাকে। এদের জন্যে মন্টুকে একটু জেনুইন খদ্দের
স্যাক্রিফাইস ক’রতেই হয়। এদেরকে
দেখলে অনেকে দোকানে আসে না। কিন্তু এরা পাড়ার ছেলে। তাছাড়া বিপদে আপদে তো এরাই
দ্যাখে তাদের মন্টু দা-কে। সেবার ধর্মঘটের দিন, দোকান খুলেছিলো মন্টু দা।
পার্টির কয়েকটা ছেলে দোকানের ঝাপ ভেঙ্গে দিতে চেষ্টা ক’রেছিলো। কিন্তু ওরা পাশে ছিলো। পারেনি। ওরা না থাকলে সেদিন
অন্তত কিছু গুনেগার দিতে হ’ত মন্টু দা-কে।
দোকানটা না খুললেই বা বাড়ির লোককে খাওয়াবে কী? তাই ওরা আসে, আড্ডা মারে, চাও খায়,
বাকিও খায়, আর মন্টু দা সহ্য করে। এটা একটা অলিখিত আপোষের ব্যাপার। শুধু মন্টু
দা কেন? সব চা-এর দোকানেই তাই। এবারে মন্টু দা আপোষ ছেড়ে ব্যবসায় মন দ্যায়।
-----------------
এইসব
বিহঙ্গেরা
পরিচ্ছেদ – ৩
আজ তোড়াদের দুটো ক্লাশ সবে
শেষ হ’য়েছে। ওমনি তাড়াতাড়ি সব বেরিয়ে এসেছে
বাইরে। যেন গরু ছাড়া পেয়েছে গোহাল থেকে। আবার দুটো ক্লাশ অফ্। তিনটেতে আবার
ক্লাশ। পাশের হলেই এখনও অন্যদের ক্লাশ চ’লছে। বাইরে বেরিয়ে এসে তোড়াদের গ্রুপ ঠিক ক’রলো, আজ আর ক্লাশ ক’রবে না। ক্যাম্পাসে
ব’সে অনেকে আড্ডা দ্যায়। ওরাও যে দ্যায় না,
তা নয়। তবে তা কখনও সখনও। আজও আড্ডা দেবে। মঞ্জুলা, রমিতা, তোড়া সবাই মিলে
সিদ্ধান্ত হ’তেই তাড়াতাড়ি
ক্যাম্পাসের লোভনীয় স্থানটা বেছে নেয় যাতে হাত বাড়ালেই আলু-কাবলি মেলে। এখানে একটা
বেশ বড়সড় কদম গাছ আছে। ভালো ছায়া তার তলাটায়। যেহেতু এখানটা বিল্ডিং বা ক্লাশ
কোনটাই চোখে পড়ে না, অনেকেই ব’সে আছে একটু ঢাকা
বা ঘেরা জায়গায়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। পাঁচিল-এর ওপাশেই একটা আলু-কাবলি বসে। বসে তো না,
দাঁড়ায়। একটা বাঁশের তৈরি ইংরেজি X -এর মতো একটা
ঝাঁকার মাথায় কাঁধ নিচু একটা বিরাট ঝুড়িতে তার আলু-কাবলি। হাজার রকম তার মশলা ছোট
ছোট বয়ামে সাজানো। তার কাছ থেকে চট্পটা আসে। যেহেতু ওরা মেয়ে খদ্দের, সেহেতু
বুড়োটা একটু স্পেশাল মশলাদার খাবার দ্যায় ওদের। সব মেয়েকেই দ্যায়। এখানে ব’সলেই গান, স্বরচিত গল্পও, কবিতা পাঠ, আবৃত্তি এইসব নানা
বিষয় ওঠে ওদের আলোচনায়।
তোড়া আগেভাগেই ব’লে বসে--- আলু-কাবলি ছাড়া আড্ডা কিন্তু জমে না, বল্?
এসব খাওয়ানো-টাওয়ানো চাঁদা তুলেই হয়। তবে বেশির ভাগ সময়ে
মঞ্জুলার পার্সই হাল্কা হয়। ও পছন্দও করে খরচা ক’রতে। আজও ও ব’ললো,
--- তাহলে দাঁড়া, আগে আলু-কাবলির অর্ডার দিয়ে আসি। ব’লেই মঞ্জুলা পাঁচিলের গায়ে চ’লে যায়। ও পাশেই আলু-কাবলি।
দু-একটা ছেলে ব’সেছিলো অদূরে। তারাও ছুঁড়ে দিলো--- মঞ্জুলা, আলু-কাবলি আমরাও লাইক ক’রি কিন্তু।
--- ক’রিস তো পার্স বের
কর না। বিদ্রূপ করে মঞ্জুলা।
রৌদ্রস্নাত ইউনিভারসিটি বিল্ডিং থেকে লন দিয়ে একটু এগিয়ে
গেলেই বাঁ হাতে ডান হাতে বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে বাগান। প্রথম দিকটা ফুল, তার পরে
কদম গাছ, দেবদারু গাছ, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া গাছ দিয়ে বেশ সুন্দর ছায়া ঘেরা বাগান।
ভালোই আড্ডা দেওয়া যায়। এখানে অনেকে বসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কেউ কেউ ব’সে প্রেমও করে। খাতা বই খুলে প্রেম করে। বোঝার কোন উপায় নেই
যে, প্রেম ক’রছে। ‘ক্লাশের আলোচনা ক’রছি’--- ব’লে দেওয়া যায়।
ব’সতে ব’সতে রমিতা চেঁচিয়ে বলে--- আজ কিন্তু বিলটা তুই দিবি,
মঞ্জুলা।
মঞ্জুলা চেঁচিয়ে বলে--- ডান। তবে তোড়ার সাথে কিন্তু শর্ত
আছে। পপরে বলছি। তারপরে আবার চেঁচায়--- এই, বনকুল আছে। খাবি? মশলা-ফশলা দেওয়া।
হেভি কিন্তু।
--- নিয়ে আয়। নিয়ে আয়। নিয়ে আয়। কোরাস জানায়।
কানে কানে রমিতা তোড়াকে বলে--- দ্যাখ্, এই যে মঞ্জুলা
আমাদের ম্যাক্সিমাম দিন ট্রিট দ্যায়, এতে কিন্তু ওর কোনো সময় একবার মনে আসেনা, কেন
আমি রোজ রোজ খাওয়াবো। ওর মনটা কিন্তু ভাই আমাদের থেকে বড়ো। যাই বলিস।
--- যাই বলিস মানে! আমি কি কিছু ব’ললাম নাকি! তবে চোখ দিস না। শনি লেগে যাবে। তাছাড়া এতে
এমনটা ভাবার কী আছে! এটা তো বন্ধুদের ব্যাপার। ও পারে তাই দ্যায়। তুই বা আমি পারি
না। তাই দিই না। পারলে দিতাম। যেমন যেদিন পারি, সেদিন দেই।
---- দাঁড়া, আমি আগে একটু লালা ফেলে আসি। একে তো আলু-কাবলি,
তার ওপর বনকুল! এসব কিনতে দেখলেই আমার জিভ টসটস করে রে।
রমিতার কথায় সবাই হেসে ওঠে। তোড়া বলে--- মাইরি, এ্যাতো
ছোঁচা আমি জীবনে দেখিনি। মশলার নাম শুনলেই জিভে জল আসে।
মঞ্জুলা আলু-কাবলির অর্ডার দিয়ে ওদের কাছে এসে বলে--- আমায়
তো বিল দেবার ব্যাপারে ডান ব’লতেই হবে, ভাই।
তোরা তো ব’সে গান শোনাস, কবিতা ব’লিস, চুটকি কাটিস, স্বরচিত কবিতা শোনাস। আমার তো ছাতা ওসব
আসে না। আমার তো কোন এক্সট্রা ক্যারিকুলার নেই।
মঞ্জুলার ঠাট্টায় সবাই হাসে। তোরা বলে--- রাখ। মেয়েদের আবার
ক্যারিকুলার! বিয়ের জন্যে ‘কী গাবো আমি কি
শোনাবো….’। ব্যস্। আর বড়জোর রান্নার রেসিপি।
হঠাৎই রমিতা ব’লে ওঠে--- ও হরি! মঞ্জুলা আর তোড়া, তোরা তো কাল আসিসনি ক্লাসে। তোরা তো জানিস
না। কাল জয়ন্ত না মনিদীপাকে অন্য একটা স্পেশাল ট্রিট দিয়েছে।
--- জয়ন্ত! ট্রিট! মানে?
--- শুধু ট্রিট নয়। স্পেশাল। মানে প্রপোজ ক’রেছে।
সবাই চেঁচিয়ে ওঠে--- বলিস কি রে! আমাদের ন্যালাক্ষ্যাপা
জয়ন্ত! মণিদীপাকে? কখন?
--- কাল ক্লাশের মধ্যে। মনিদীপার নোট্স খাতা প’ড়ে যায় মাটিতে। জয়ন্ত তুলে দ্যায়। খাতা খুলে মনিদীপা দ্যাখে
জয়ন্ত কি সব লিখেছে। ব্যস্, কী কান্না!
--- কেঁদে ফেলেছে! কে? মনিদীপা? কী ব’লছিস! ও মাই গড!
--- এমা! ও কি স্কুলের মেয়ে নাকি? বেশি ন্যাকা!
--- আরে কান্না মানে যে সে নয়। হেঁচকি তুলে কান্না। একেবারে
সোজা পি.পি. ক্লাসে ঢোকা পর্জন্ত।
--- পি.পি. মানে….. পেছন পাকা? সর্বনাশ!
মাথায় হাত দ্যায় তোড়া।
ইউনিভারসিটিতে নানা টিচারকে নানা সম্বোধন করে মেয়েরা।
ছেলেরা এসবে নেই। এসব তারা তো ক’রতো স্কুলে বা
কলেজে। অধ্যাপক পরিমল পালকে সংক্ষেপে মেয়েদের মহলে ‘পিপি’ ডাকা হয়।। তা থেকেই পেছন পাকার জন্ম।
রমিতা বলে--- একে রাম র’ক্ষে নেই, তায় সুগ্রীব দোসর। এমনিতেই পিপি অলটাইম ঝুলে থাকে মনিদীপার ওপরে,
তার ওপরে আবার সে দেখে ফেলেছে যে, তার মনের মনিদীপা অশ্রুসিক্তা। ব্যস্।
গায়ে-মাথায় হাত দিয়ে একেবারে ‘কী হয়েছে? কী
হয়েছে? মানে কে মেরেছে, কে ধ’রেছে, কে দিয়েছে
গাল….’ আর তাতে মনিদীপা আরও চেঁচিয়ে কাঁদতে
শুরু ক’রেছে।
--- মানে! এতো একেবারে পাঠশালা রে!
--- বোঝ্। শেষে বৈশাখী মনিদীপার হ’য়ে উত্তর দ্যায়--- স্যার, ওর বুক ব্যথা ক’রছে, স্যার। মানে ধরফর ক’রছে। খুব ধরফর স্যার। ব্যস্, অমনি গোটা ক্লাসে খুক খুক ক’রে হাসি শুরু হোল। পিপি অমনি হাত স’রিয়ে নিয়ে সোজা ডায়াসে।
--- বোঝো! বলে তোড়া।
এর মধ্যে মঞ্জুলা আলু-কাবলি নিয়ে গাঁ গাঁ ক’রে ছুটে আসে।ওদেরকে হেসে লুটিয়ে পড়তে দেখে বলে--- কী হ’য়েছে? কী হ’য়েছে? আমাকে বল্।
আমাকে বাদ দিয়ে কী সব ব’লে ফেললি! এটা
কিন্তু খুব খারাপ।
রমিতা ওকে আবার সংক্ষেপে বলে কী কী হ’য়েছে। মাথায় হাত দ্যায় মঞ্জুলা--- এটা খুব পারশিয়াল কিন্তু।
যেদিন আমি ক্যাম্পাসে আসবো না, সেদিনই একটা কিছু না কিছু ঘ’টবে। থিস ইজ আনফেয়ার। এই জন্যে আমি এ্যাবসেন্ট হই না। আর
দ্যাখ, আমি এলাম না, আর এমন একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘ’টে গেলো।
তোড়া হেসে বলে--- ওকে। আমি জয়ন্তকে আর একবার মনিদীপাকে তোর
সামনে প্রপোজ ক’রতে বলবোখন। হোল?
ওদের কথাবার্তার মধ্যে পারমিতা কখন এসে হাজীর হয়েছে। কিন্তু
ওরা কেউই তাকে লক্ষ্য করে না। আসলে ওকে ওরা খুব একটা লক্ষ্য ক’রলেও লক্ষ্য ক’রতে চায় না। বরং একটু পরিহার ক’রেই চ’লতে চায়। সকলে হামলে পড়ে আলু-কাবলির ওপরে। মঞ্জুলা বড়লোকের
মেয়ে। ও যখন কোনো খাবার আনে তো বেশ বেশি ক’রেই আনে। ফলে পারমিতা এসে ভাগ নিতে চাইলেও তেমন কিছু যায় আসে না। বরং রমিতা
বলে,
--- এ্যাতোগুলো আনিস কেন? এইসব খাবার না এ্যাতো দেখলে খুব
খেতে ইচ্ছে করে বটে। কিন্তু এসব চাট খাবার বা মশলা খাবার অল্প অল্প খেতে হয়। তা
নয়তো মজা থাকে না। খাবার খেয়েও আশ অপূর্ণ থাকতে হবে। তবেই তো মজা। পেট ভ’রে কেউ আলু-কাবলি খায় না।
--- তুই খাস না ভাই। আমি পেট ঠেসে খতেই ভালোবাসি। জানায়
মঞ্জুলা। আমি তো লাস্ট বিয়েবাড়িতে ডিনারই নিই নি। শুধু ফুচকা। পেট ভ’রে।
--- হ্যাঁ, ঐ জন্যেই তো মাসে দুবার ক’রে ইউনিভারসিটি আসিস না। তখন প্যান ভ’রে………
--- প্যান ভ’রে মানে? কেন আসি
না, বল।
--- প্যান ভ’রে ‘এ্যা’ হয় বেদম। হাতের
জল শুকোয় না।
--- ছিঃ। খাবার সময়ে এসব ব’লবি না তো। কী পিচাশ রে বাবা!
পারমিতা কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে কেউ ব’সতেও বলে না, চ’লে যেতেও নয়। হঠাৎই তোড়া বনলতা কে দেখতে পায়। ওমনি চেঁচিয়ে ওঠে,
--- বনলতা দি! এইদিকে। এই যে।
বনলতা লাইব্রেরি থেকে ফিরছিলো মাথা নিচু ক’রে। তোড়ার ডাকে দাঁড়ায়। তোড়া আবার চেঁচায়--- এই তো, এই
দিকে। কদম গাছের তলায়।
--- দ্যাখ, বনলতা একটু কেমন যেন মহিলা, না? কেমন যেন রিজারভ্ড।
চুপচাপ। কারোর সাথে কথা-টথা তেমন বলে না। রমিতা মন্তব্য করে।
--- মহিলা কেন বলছিস? তুই কি কনফার্মড, উনি বিবাহিতা?
--- না, তা নয়। তবে কেমন যেন ‘বিবাহিতা বিবাহিতা’ ভাব। যেন একজন ডিভোর্সি লেডি। তাই না? ভালো ক’রে দ্যাখ।
ওরা সকলে মন দিয়ে বনলতাকে পর্জবেক্ষণ ক’রতে থাকে। তখনো পারমিতা দাঁড়িয়ে আছে আর ওদের সবাইকে দেখছে।
কিছু ব’লছে না। বেশ বুঝতে পারছে, ওকে ওরা
এ্যাভয়েড করছে। তবু ও স’রে যাচ্ছে না। যেন
একটা কিছু বোঝাপড়া ক’রতে চায়। বনলতা
আসে। রমিতা মেয়েটাকে মেপে নিতে থাকে। ইউনিভারসিটি-তে এদের সকলের সাথে ও তেমন বন্ধুত্ব
ক’রে উঠতে পারে নি। বয়সেও ও একটু সিনিয়ার।
তোড়াদের সমানে সমানে বাচ্চামো ক’রতে ঠিক পারে না।
তোড়া বলে,
--- আলু-কাবলি খাবে গো? আমরা খাচ্ছি। বোসো না। আমাদের সাথে
তো তুমি আড্ডা দাওই না। আমরা ব্রাত্য নাকি গো?
বনলতা ব’সেই বলে--- এসব
আবার কী কথা! ব্রাত্য কেন হবে? তোমাদেরকে ব্রাত্য বানাবার কীইবা ক্ষমতা আমি রাখি,
বলো? আর এটাই বা কেমন বলো তো! আমি তো তোমাদের ক্লাশমেট। আমাকে ‘দিদি’ কেন? আমি কি
দেখতে খুব বুড়ি বুড়ি?
তোড়া হেসে দ্যায়। বলে--- এমা! না না। তুমি বুড়ি কেন হবে? অন্তত রমিতার থেকে তো তুমি অনেক
বেশি সিজলিং। তবে তোমাকে আমার না কেমন যেন ‘অধ্যাপিকা অধ্যাপিকা’ বা ধরো ‘দিদি দিদি’ মনে হয়! কেন,
জানি না। তবে মনে হয়। তুমি কিন্তু রাগ ক’রোনা। আসলে কিছু মানুষ থাকে না? তাদের কাউকে কাউকে দেখতে কেমন যেন ‘কাকু কাকু’ লাগে। আসলে সে
হয়তো মেসোমশাই। কিন্তু মেশোমশাই ব’লতে গেলে কেন জানি
আটকে যায়। তেমনি তোমাকে নাম ধ’রে ডাকতে গেলে
আমার তো বাবা কেমন বাধো বাধো লাগে।
--- বাঃ! আমরা একই ইয়ারে প’ড়বো, অথচ আমাকে সিনিয়ার বানিয়ে দেবে! এটা কেমন কথা, বলো তো!
কৃত্রিম আপত্তি করে বনলতা। কিন্তু ও নিজে তো জানে যে, ও
এদের থেকে একটু বেশি সিনিয়ার। কেননা ও মাস্টার্স ক’রতে এসেছে একটু লেটে। চাকরী আর স্টাডি--- এই দুটোর মাঝখানে একটু ধন্ধে ছিলো ও।
তাতেই কিছুটা লেট হ’য়ে গেছে। আসলে
ধন্ধটা সেখানে ছিলো না। ছিল ঐ দুটো অজুহাতে বাবাকে আর মাকে কোনোরকমে থামিয়ে রাখা।
এমন সময় মনসীজ এসে জানিয়ে যায়,
--- আজকে আর ক্লাশ হবে না, মেয়েরা। প্রফেসররা সব ছুটছে
সেমিনারে।
তাতে ওরা হাতে বেশ সময় আর স্বাধীনতা পায়। আলু-কাবলি ভাগ হয়।
--- তোড়া যে আমায় একবারও ডাকলি না? কেন রে? পেছনে এ্যাতক্ষণ
নীরবে দাঁড়িয়ে শেষে কথাটা ছুঁড়ে দ্যায় পারমিতা।
--- ওমা! তুই কখন জুটলি! তুইও আলু-কাবলির শেয়ার নিবি! ও গড!
--- দেখে না দেখার ভাব করলে তো কিছু বলার নেই। আমি ঝারা
দশটা মিনিট তোদের পেছনে দাঁড়ানো। আমাকে দেখিস নি, এটা কি কেউ বিশ্বাস ক’রবে, বল। আমি তো আর তোদের আলু-কাবলি খেতে আসিনি।
এবারে ওকে আক্রমণ করে রমিতা--- আমরা কে কে জানি না, তবে তুই তো জানিস, তোকে অন্তত আমি তো এ্যাভয়েড করি। কারণটা
সবাই দেখুক। পেছন ঘোর। সকলেই দেখতে পাবে, তোর ভেতরের ম্যাপটাও দেখা যাচ্ছে। ফ্রন্ট-টা
দোপাট্টায় ঢেকে রেখেছিস, কেননা তোর শখ আছে, কিন্তু তুই এ্যাতটা সাহসী নোস্। একটা
পাতলা আদ্দির পাঞ্জাবি তোর গায়ে। আওয়াজ তো শুনতে হবে রে আমাদের। অবশ্য তুই তো
আওয়াজের জন্যেই এটা ক’রছিস।
পারমিতাও চিমটি কাটে--- রাখ রাখ, রমিতা।
আকাশে উড়ছিস, ওর। দৃষ্টিটা আমার ইনারগুলোয় কেন রে? তুই তো লেস্বি নোস্। তাছাড়া
কে কে কোথায় নেচে বেড়ায়, আমি কি আর জানি না? কিন্তু আমি ব’লি না। এটা তো যার যার পারসোনাল ব্যাপার।
--- কিন্তু তুই যেখানে ব’সবি, ইউইনিভারাসিটির ছেলেগুলো তো তোকেই গিলবে। সাথে আমাদেরও। ছাড়বে?
--- আস্তে কথা বল্ না। রমিতাকে ধাক্কা দ্যায় মঞ্জুলা।
পার্থও-রা তো ওখানটায় ব’সে আছে। শুনতে
পাবে।
--- শুনতে পাবে, কী ব’লছিস! রোজ তো দেখছে। রোলমডেল পারমিতা ধর এবং তার ড্যাশ ড্যাশ ড্যাশ।
--- তুই না ভীষণ ছোটলোক হ’য়ে গেছিস। ফের রমিতা ধাক্কা মারে।
তোড়া রেগেই যায় এসব আলোচনায়। বিশেষত, বনলতা দি-কে নিজে ডেকে
এনে এখানে ব’সিয়েছে। মহিলা কী
ভাববে! এবার ডাকলে কি আর আসবে? তাছাড়া কে কী ড্রেস প’রবে, সে তো তার ব্যাপার। রমিতা এ্যাতো মাথা ঘামাচ্ছে কেন,
বোঝে না ও। এটা কি স্কুল নাকি? তাই রমিতাকে থামাতে বলে,
--- তাহলে তুই এক কাজ কর, রমিতা। কাল থেকে তুইও পাল্লা দিয়ে
ওরকম পর। ব্যাস্। আর কোন জেলাসির ব্যাপার থাকে না। ঝামেলার কী দরকার, বলতো? ছাড়
না। এমন সাধের এ্যাটমসফিয়ারটা মাঠে মারছিস। সামনে এসব খাবার ফেলে তুই এসব বলার
এনার্জি পাস কোথা থেকে, বলতো?
পারমিতার বিষয়ে এমনতর নানা রটনা ইউনিভারসিটিতে আছে। মেয়েদের
আর ছেলেদের দঙ্গলে আলাদা আলাদা ক’রে কান পাতলে
আলাদা আলাদা ‘পারমিতা প্রসঙ্গ’ শোনা যায়। এসব পারমিতা কি জানে না? বিলক্ষণ জানে। এরা এসব
বলে এবং বলবে--- এটাও জানে পারমিতা। তবু এদের সাথে বসে আড্ডা দিতে চায়। একটা কোথাও
তো ব’সতে হবে, জ’মতে হবে। ‘আমি স্বতন্ত্র’ ব’লে অহংকার ক’রলেও তো সবার সাথে না হোক, কারোর কারোর সাথে রং মেলাতে হয়।
মনে মনে ভাবে পারমিতা, ‘ওকে নিয়ে গোটা
ক্যাম্পাসে যে আলোচনা, এটা বোধহয় মেনে নিতে পারে না রমিতা। তাই রাগ। ঠিকই তো ব’লেছে তোড়া। তুই কাল থেকে এসব পর না, বাবা। কে মানা ক’রেছে! তোকে নিয়েও ছেলেরা আলোচনা ক’রবে।’ কিন্তু মুখে এসব
কিছু বলে না।
পারমিতার একটা ইতিহাস আছে। ও জানে, ওর নিজের জীবনের
ব্যবস্থা ওকে নিজেকেই ক’রতে হবে। যথেষ্ট
বয়স হ’য়েছে ওর। মেঘে মেঘে বেশ বেলা হ’য়েছে। এখানে ও মাস্টার্স ক’রতে আসেনি। এসেছে জীবনের মাস্টার্স স্ট্রোক-টা মারতে। ও এটা জানে যে, ‘রূপে তোমায় ভোলাবো না, ভালবাসায় ভোলাবো….’এসব কবিতায় হয়। রিয়ালিটিতে নয়। সবচেয়ে বড়ো কথা, ও নিজে
সুন্দরী নয়। কোন ছেলে ওকে দেখে যে গ’লে যাবে, তা মোটেই হবে না। ওর যা আছে, তা হোল শরীর। সেটাতে ও হ্যান্ডড্রেডে
হ্যান্ডড্রেড। স্কিন কালার থেকে শুরু করে শেপ। ওর এই সবটা অন্য যে কোন মেয়েকে
বহুদূরে ঠেলে দিতে পারে। সেটাকেই ক্যাশ ক’রতে হবে। নিজের বয়সটা যে তরতরিয়ে বাড়ছে, সেটাও ও দেখে ফেলেছে। বাবাকে দিয়ে তো কিছু
হবে না। দিদা-কে দিয়ে যে হবে, তারও কোন লক্ষ্মণ নেই। তাই আপনা হাত জগন্নাথ। রূপে
সাদামাঠা হ’লেও লাইফ পার্টনারের বিষয়ে ওর স্বপ্নটা
একটু আকাশছোঁয়া। ছোটমোটো পাত্রে ওর চ’লবে না। তাছাড়া বাড়িতে ওকে শাসন ক’রবার মতও তো কেউ নেই। ফলে অনেকটা স্বাধীন ও। কে ওর বেশভূষা নিয়ন্ত্রণ ক’রবে! মনে মনে জানে ও যে, সব মেয়েই নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে, তুলে ধ’রতে চায়। কারোরটা স্পষ্ট, কারোরটা প্রচ্ছন্ন। এই তো। ওকেও
ওরটা ক’রে নিতে হবে। এইসব ভেবে পারমিতা রাগ
দেখিয়ে বলে,
--- ঠিক আছে, বাবা।আমি চ’লেই যাচ্ছি। তোদের ডিস্টার্ব করতে চাই না।
ব’লে ও পেছন ঘুরতেই
মঞ্জুলা ডেকে ওঠে--- এই-ই পারমিতা, বাবা বাবা! কী রাগ তোর, ভাই। একটু রসিকতাও করা
যাবে না! বোস্ বোস্। অনেক আলু-কাবলি। আরও কেউ এলেও যাবে আসবে না। আর তুইও পারিস,
রমিতা। ঠাট্টা বড়ো সিরিয়াসলি ক’রিস তুই।
সকলেই বুঝলো যে, মঞ্জুলা বিষয়টা খারাপ দিকে যেতে দিলো না।
এটা মঞ্জুলার গুন। ও কোন ঝামেলা নিতে পারে না। একটু ভীতু, একটু রিজার্ভড, একটু
লাজুক। কিন্তু সরল, সোজা আর নির্ঝঞ্ঝাট। তোড়াও উঠে যেতে চাইছিলো। এ সব আলোচনা
তোড়ারও ভালো লাগে না। তাই সাধারণত মেয়েদের এড়িয়েই চলে ও। কিন্তু আজ এড়ানো গেলো না।
ও কিছু বলার আগেই মঞ্জুলা ব’লল,
--- তোড়া, তুই কি ঐ কবিতাটা রমিতাদের শুনিয়েছিস? আমার তো
দারুণ লেগেছে। তুই কিন্তু ব’লেছিস, আজকে
সবাইকে শোনাবি। ক্লাশের মধ্যে পিন পিন ক’রে কী যে শুনেছিলাম, ভালো ক’রে শুনিনি। তবে
ওভারঅল ভালো লাগছিলো। এবার হয়ে যাক।
--- থাক না রে। স্কুলের বাচ্চাদের মতো ফালতু ঝগড়া ক’রলো, আর মুডটা খারাপ হ’য়ে গেলো।
--- দিস ইজ নট ডান, তোড়া। এটা কিন্তু কথার খেলাপ হ’চ্ছে। আমি কিন্তু শর্ত দিয়েছিলাম। আজকে আর ক্লাশ ক’রবো না ভেবেছিলাম শুধু এটার জন্যে।
রমিতাও বায়না করে আর তার সাথে যোগ দ্যায় পারমিতাও। ফলে
তোড়াকে শোনাতেই হয় একটা কালো মেয়ের অহংকারের কাহিনি। কবিতা ‘মেজাজ’। আবৃত্তি ক’রেই শোনায়। বনলতা যে সেটা শুনছে না, উশখুশ ক’রছে, এটাও আবৃত্তি ক’রতে ক’রতে টের পেলো তোড়া। কবিতা শেষ হ’লে সকলেই ক্ল্যাপ দিলো বটে, কিন্তু বনলতা নিঃস্পৃহ। এমনকি
দূরে বসা কয়েকটা ছেলেও শুনেছে। তাদের ক্ল্যাপও শোনা গেলো। কিন্তু বনলতা যেন এখানে
থেকেও এখানে নেই। চুপচাপ একটা দুটো আলু তুলে তুলে খেয়েছে। আবৃত্তি শেষ হ’তে রমিতা আবার ব’লল,
--- একটা জিনিস তোরা লক্ষ্য ক’রেছিস কিনা, জানি না, একটা ছেলে, আমি খোঁজ নিয়েছি,
কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট-এর, তবে নামটা জানি না। ঐ ছেলেটা না প্রায় সময়েই আমাদের
মার্ক করে। একটু আগে…. তোরা খেয়াল করিস নি, এখান দিয়ে চ’লে গেলো। তখন তোড়া আবৃত্তি ক’রছিলো। ঠিক তাকিয়ে তাকিয়ে আমাদের দেখছিলো। কেসটা কী বল তো?
মঞ্জুলা ব’লল--- সে আবার কী!
এটা ইউনিভারসিটি। একটা ছেলে কেন? অনেকগুলো ছেলে তো যেতেই পারে। অবাক হ’চ্ছিস কেন?
--- এটা যে ইউনিভারসিটি, সেটা আমিও জানি, বস্। কিন্তু এটা
একটু আলাদা না হ’লে আমি ব’লতাম না।
তোড়া একটু উব্জেই ধ’ম্কে উঠলো--- এই জন্যেই আমি তোদের সাথে ব’সি না। তোদের চারদিকে চোখ খোলা। কেন রে?
আড্ডাতেই বেজে যায় চারটে। এবার উঠতে হবে। আর আড্ডা নয়।
বাড়িতে ঢোকার বিপদসীমা তো পেরোলে চলে না। সকলের না হোক, মঞ্জুলার তো একটা সীমারেখা
আছে। তাই সে তোড়াকে ব’লল,
--- আমায় একটু এগিয়ে দিবি, তোড়া? বেশি দূর তো নয়।
এটাতেই ক্ষেপে যায় তোড়া। বলে ওঠে--- বেশি দূর তো নয় যখন
বুঝিস, তখন আমার এগিয়ে দেবার কি আছে, বল। তুই কি আমার ভরসায় বাড়ি থেকে বেরোস? না
তোর বাবা আমায় পেমেন্ট করে? এক নম্বরের ন্যাকা।
--- প্লীজ তোড়া।
--- না, পারবো না। নিজ নিজ শরীর নিজ দায়িত্বে রাখো, মা।
আমার কাজ আছে।
আসলে তোড়া এখন অন্য কাউকে সময় দিতে পারবে না। ওকে যেতে হবে
ইউনিভারসিটির মোড়। যদিও সেখান অবধি যাবে বনলতা নিজে। ফলে তাকে বাসে টা টা ক’রে দিয়ে তবে মুক্তি। তাই একেবারে না-কোচ ক’রে দিলো মঞ্জুলাকে।
মঞ্জুলার বাড়ি শ্রী পল্লীতে। অবশ্য তোড়াদের বাড়ির উল্টোদিকে
সেটা। ওকে এগোতে গেলে তোড়াকে উল্টো পথে যেতে হয়। অনেকটা হাঁটতেও হয়। মঞ্জুলা ভাবেও,
এতোটা আশা করাই অন্যায়। সত্যি তো। ওর ভরসাতে তো মঞ্জুলা পথে বেরোয় না। এরকম কোন
এগ্রীমেন্ট তো করা নেই। নিজে নিজেই ভাবে, যাক, তাহলে ওকে একাই ফিরতে হবে। ঠিক ক’রে নেয় মঞ্জুলা, আর কোনদিন কাউকে ব’লবে না এগিয়ে দিতে। কিন্তু একা ফেরা মানেই তো সেই ছেলেটা
সঙ্গ নেবে। ছায়ার মতো ওর পেছনে পেছনে ঘোরে। কী যে অস্বস্তিকর! অগত্যা একা একাই
রওয়ানা দিলো। মনে একটু একটু ভয় বুকটাকে দুরু দুরু করাতে লাগলো বটে। তাই মনে মনে ব’লেও নিলো, ‘সাহস ক’রলে ভাগ্য সঙ্গ দ্যায়।’ তাই ঘটলো। ওর কপাল ভালো। রাস্তায় ওদের ক্লাশের কয়েকটা ছেলের সাথে দেখা হয়ে
গেলো। তারা হেলতে দুলতে ফিরছিলো। তাদেরকে দাঁড় ক’রিয়ে বকর বকর ক’রতে ক’রতে ফিরল মঞ্জুলা। বেঁচে গেলো আজকের মতো। তারাও বাঁচলো একটা
মেয়েকে তাদের সঙ্গে পেয়ে।
তোড়া আর বনলতা একসাথে ফিরছিলো। শীত পড়ি পড়ি এখন। অনেকের
গায়ে হাল্কা সোয়েটার বা হাল্কা চাদর উঠেছে। এখানে ওখানে নানা বাড়ির ছাদে, বাড়ির
সামনে, বারান্দায় মানুষ দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ ক’রে একটু রোদ্দুরে আয়েশ ক’রছে। মেয়েরা
সাধারণত এ্যাত কম শীতে কোন গরম পোশাক ব্যবহার করে না। তাতে তাদের বাহারি ড্রেস
ঢাকা প’ড়ে যায়। প্রাক শীতের পড়ন্ত দুপুর একটু
যেন বিশ্রাম ক’রছে।
ওদিকে তোড়ার বাড়ি নয়। ওকে যেতে হয় অফিস পাড়ায়। ওখানেই ওদের
বাড়ি। সেটা তো উল্টোদিকে, ইউনিভারসিটি স্টপেজ থেকে ডানদিকে যেতে হয়। আর বনলতা তো
বাস ধ’রবে। দুজনে চুপচাপ হাঁটছিলো। তোড়া আর
বনলতা। যেন দুজনেই দুজনকে কিছু একটা ব’লতে চাইছিলো। যেন দুজনেই বুঝতে পারছিলো সেটা। কিন্তু শুরুটা ঠিক ধ’রতে পারছিলো না। কী দিয়ে কে শুরু করবে, তারই যেন একটা
টানাটানি চ’লছে? শেষে তোড়াই শুরু করলো,
--- তুমি যে আবৃত্তিটা শুনে কোন রি-এ্যাক্ট করলে না, বনলতা
দি? পছন্দ হয়নি বুঝি?
--- আমি তো ব’লিনি এসব। কিন্তু আমি কবিতা শুনি না, ভাই। দরকার হ’লে পড়ি। যেন বিরক্ত হ’য়ে উত্তরটা ছাড়া ছাড়া ক’রে দ্যায় বনলতা।
তোড়া জীবনে এমন কথা শোনেনি। এ কেমন মেয়ে! ‘এ তো মেয়ে মেয়ে নয়, দেবতা নিশ্চয়।’ কবিতা শোনে না, দরকার হলে প’ড়ে। কবিতা আবার দরকার হয় নাকি? তাছাড়া পড়া আর শোনায় তফাৎটাই বা কী হ’লো? কিন্তু সেরকম কিছু ব’লতে যেন ওর সাহস হ’লো না। শুধু ব’লল,
--- কেন? আবৃত্তি তো একা একা পড়ার থেকে বেটার। তাই না?
নিষ্প্রাণ শব্দগুলোকে তো বড়ো বড়ো শিল্পীরা একটা প্রাণ দেন। না হয়, আমি ভাল পারি
না। কিন্তু বাঙ্গলায় তো ভালো ভালো আবৃত্তিকার আছেন। তাঁদের কারোর আবৃত্তি তুমি
শুনেছো? কৌতূহল প্রকাশ করে তোড়া।
বনলতা হেসে ফ্যালে। বলে--- তুমি কি মনে করো, তোড়া, কবিরা যে
সমস্ত কবিতা লিখেছেন, তা আবৃত্তিকারদের কণ্ঠে প্রাণ সঞ্চারিত হবে ব’লে তাঁরা অপেক্ষা ক’রে বসে আছেন? না, তাই ভেবে ভেবে সারা হন তাঁরা?
--- না তা কেন? তবু এটা যে একটা আর্ট, তা কি তুমি অস্বীকার
করো? হাল ছাড়ে না তোড়া। মহিলাটিকে কালটিভেট ক’রতেই হবে ব’লে ওর মনে হয়।
--- আমি তো ব’লিনি কিছুই। এটা আর্ট বা আর্ট নয়--- কোনটাই তো ব’লিনি। আমি ব’লেছি, আমি আবৃত্তি
শুনি না। এটা তো আমি ব’লতে পারি, নাকি?
এটা তো আমার পারসোনাল ব্যাপার। আর আমি আর্ট-এর কী-ই বা বুঝি, বলো? আমি তো আর্টিস্ট
নই তোমাদের মতো। আমি শুধু এই পড়াশুনো নিয়েই থাকি। তাও নিতান্ত সাধারণ ছাত্রী ব’লে বেশি বেশি প’ড়তে হয়। এলেবেলে দুধভাত।
তোড়া তো ছোট্ট একটা মেয়ে নয়। হয়তো বনলতার থেকে অনেকটাই ছোট।
কিন্তু সেও তো পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের ছাত্রী। ও বেশ বুঝতে পারে, কোথায় যেন কী একটা
সুর খুব বেসুরো বাজছে। কী একটা গণ্ডগোল যেন গানের না-মনে-পড়া কলির মতো খট্কা
লাগাচ্ছে। জানতে হবে। জানতে হবে। তাই একটু খোচা মেরে ব’লে ওঠে,
--- বাবা! তুমি তো কোনো একটা ব্যাপারে বেশ চটে আছো ব’লে মনে হয়। কার ওপর রেগে আছো গো? স্বয়ং কোন কবি, নাকি
আবৃত্তিকার?
চোরের মন বোচকার দিকে দিকে। চোরের পুলিশ দেখলেই মন বলে ‘ঠাকুর ঠাকুর’। তাই তোড়ার দিকে
একটা সন্দেহজনক দৃষ্টি ফেলল বনলতা। মুখে ব’লল--- প্লীজ, এসব আলোচনা আমার না ভালো লাগে না। তুমি নিজেই কিন্তু আমাকে দিদি
বানিয়েছো। দিদির সাথে এসব আলোচনা কি ভালো, বলো। তার চেয়ে আমি একটা কথা ব’লি? শুনবে?
তোড়া হাঁ ক’রে তাকিয়ে থাকে।
বুঝতে চেষ্টা করে ব্যাপারটা।
--- বোলবো কি? আবার প্রশ্ন করে বনলতা।
--- আমি তো এমনিই নো প্রফিট নো লস পারসন। আমাকে কেউ কিছু ব’লতে সঙ্কোচ করে না। তুমি এ্যাত অনুমতি নিচ্ছো কেন? বলোই না।
।
--- তুমি আমার ছোট বলেই ব’লছি। তুমি চা-এর দোকানে বসে আড্ডা দাও কেন? তোমার কোন ইরিটেশন হয় না? কী ক’রে ওখানে বসো তুমি? আমাদের কাউকে কখনো অমন জায়গায় ব’সতে দেখেছো? তুমি না একজন ইউনিভারসিটির ছাত্রী! ওটা যে
মেয়েদের বসার জায়গা নয়, তা কি তুমি জানো না?
আজকে মনে মনে ঠিক ক’রে রেখেছিলো বনলতা যে, এটা আজ ওকে ব’লতে হবে কেননা বনলতা দেখেছে যে, ঐ চা-এর দোকানে ব’সে থাকা একটি ছেলে বা তোড়ারই এক বন্ধু মঞ্জুলাকে ফলো করে।
তোড়া বোধহয় নিজেই এটা জানে না। আজ তোড়া ওকে নিজে সুযোগ দিয়েছে বলার। বনলতাকেও তো
জানতে হবে, এই মেয়েটা থেকে কতটা নিরাপদ দূরত্বে তাকে থাকতে হবে। একটা তো সোর্স
চাই। মেয়েটার যে চলাফেরা, তাতে রাস্তাঘাটে ওর সাথে কথা বলাও তো একটা কোয়েশ্চেন
ফ্যাক্টর। কাল হয়তো ঐ ছেলেগুলোর কোন একটা বনলতার কাঁধেই হাত রেখে ব’সবে! ঠিক কী?
কিন্তু তোড়া খুব কঠিন ক’রে জবাব দ্যায়--- ইউনিভারসিটি তো কী, বনলতা দি? কোন হাতির পাঁচ পা আমি দেখেছি
বা তুমি দেখেছো? আর কী থেকেই বা ওরা বঞ্চিত? ব’লতে পারো? ওসব ইলিউসন দিদি, ওসব একেবারে ইনসিগ্নিফিক্যান্ট ফ্যাক্টর। আসল হ’লো বেসিক পোটেনশিয়ালটি।
--- তা হ’লেও তো একটা
স্ট্যান্ডার্ড থাকবে তো, নাকি? মানুষ কি সব জায়গায় যায়, না সবার সাথে গলাগলি করে?
--- সবার সঙ্গে নয়, আমি ওদের সাথে মিশি। এটাও তো পারসোনাল হ’তে পারে, নাকি? নাকি আমার সিদ্ধান্ত বারোয়ারি ঢাক? যে আসবে,
পিটিয়ে যাবে? কৈ? আমার বাড়ির মানুষ তো এতে কোনো আপত্তি করে না! আর তুমিই বা হঠাৎ ব’ললে কেন এ কথা? তুমি তো এসব কথার মধ্যে জেনারেলি থাকো না?
কেউ তোমায় টেম্পটেড ক’রেছে নিশ্চয়ই? কে
গো?
বনলতা একটু অস্বস্তিতে পড়ে। তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামলাতে
বলে--- এমা, তা কেন হবে? কে আবার আমাকে টেম্পটেড ক’রবে! আমি কি বাচ্চামানুষ নাকি? তুমি কি রাগ ক’রলে? তাহলে ভাই ব’লবো না।
--- তা নয়। জানতে চাইছি। হঠাৎ ব’ললে কিনা, তাই।
তোড়ার থেকে সহজ উত্তর পেয়ে বনলতা ফের আক্রমণ করে--- তবে এটা
কিন্তু পারসোনাল নেই আর, তোড়া। তুমি কি জানো, মঞ্জুলা কেন তোমাকে ওর সঙ্গে যেতে ব’লছিলো?
--- না, জানতেও চাই না। ওরা সব ন্যাকার দল। রাস্তায় বেরবেও
আবার ছুতমার্গও থাকবে ওদের। এটা হয় না, বনলতা দি।
--- কেন! রাস্তায় বেরিয়ে কি তুমি নোংরা বাঁচিয়ে হাঁটো না?
থাকেনা ছুতমার্গ? এটা কোনো যুক্তি হলো? বনলতা বুঝতে পারে যে, তোড়া ক্ষেপে যাচ্ছে।
তবু ওকে আরও ক্ষেপিয়ে দ্যায় ও। ক্ষ্যাপা ওর দরকার। সত্যটা ওকে জানাতে হবে।
কিন্তু তোড়া যখন তাকায় বনলতার দিকে, ও বুঝতে পারে, তোড়া হয়
একটুও রাগে নি, অথবা না রাগার ভান ক’রছে। তোড়া শুধু ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে একবার মুছে নিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে
বলে--- শেম শেম!
এই ‘শেম শেম’ বলার কারণটাও বনলতা বুঝতে পারে না। তাই সরাসরি বলে--- তুমি
কি জানো, তোমার ঐ চা-এর দোকানের একটি বন্ধুই মঞ্জুলাকে সবসময় ফলো করে? ওকে ডিস্টার্ব
করে?
বনলতা ভেবেছিলো, তোড়া এ কথায় একটু অবাক হবে। বিস্মিত চোখে
ওর দিকে তাকাবে। ছেলেটার হুলিয়া জানতে চাইবে। কিন্তু তোড়া তেমন কিছুই ক’রলো না। বলে দিলো--- সো হোয়াট! হ’তেই পারে। এ্যান্ড দ্যাট ইজ মঞ্জুলাস প্রব্লেম। আমি তো
ওদের বডিগার্ড নই। দে আর মাই ফ্রেন্ডস। এই তো। তোমাদের মতই ওরা বন্ধু। ব্যস্। আর
তো কিছু না।
হাঁ হয়ে যায় বনলতা। বলে কি মেয়েটা! তাই ওকে ব’লতেই হয়--- আমাদের মতো ওরা তোমার বন্ধু! আমাদের মতো! কোন
ফারাক নেই? এভাবে তুলনা ক’রলে! আমরা আর ওরা
কি তোমার কাছে এক হ’লাম?
--- কেন নয়, বনলতা দি? তুমি ‘আমরা-ওরা’ ক’রছো কেন, আমি তো বুঝতে পারছি না। তুমি কি আলাদা? তুমি নিজেই
কি নিশ্চিত ক’রে জানো, তুমি
আলাদা? তুমি কি জানো, ওদের মধ্যে কার কী এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন আছে? ওরা সব কোন
কোন বাড়ির ছেলে?
তোড়া এইটুকু ব’লে কেমন যেন শক্ত হাতে বনলতাকে ধ’রে দাঁড় করায়। তারপর বলে--- দাঁড়াও, বনলতা দি। এসব কথা চ’লতে চ’লতে হয় না।
দাঁড়িয়ে বলো।
বনলতার বাস স্টপেজ এসে গেছে। ও এখান থেকেই বাস ধরে। তোড়া
সময় নষ্ট না করেই ব’লল--- আজকে পরের
বাস না হয় ধ’রো। এবার বলতো,
তোমার কোনো ভাই-টাই কিছু আছে? তারা কি সব চাকরী-বাকরী করে, নাকি এখনো ফ্যা ফ্যা ক’রে ঘুরছে? যদি থাকতো, আর যদি তাদের চোখের দিকে একবার ভালো ক’রে তাকাতে, স্টাডি ক’রতে, তবে একটা সত্য বুঝতে পারতে। আলাদা এই যে, ওরা একটা ‘নেই রাজ্যের বাসিন্দা।’ আমরা কত সেফ, কত সিকিওর্ড! আমি ওদের কাছ থেকে দেখেছি, বনলতা দি। রোজ দেখি।
আই নো দেম বেটার দ্যান আই নো ইউ।
একটু ঘাবড়েই যায় বনলতা। এমন কঠিন কঠিন সংলাপ শোনার জন্যে
প্রস্তুত ছিল না ও। এতোটা আশঙ্কাও করেনি। একবার ভাবে, ব’লে দেবে, ‘তাহলে ভাই, আমার
সাথে তোমার জ’মলো না। কিন্তু
তোড়া এমন অনেক কথা ব’লল, যা বনলতাকে
বেশ নাড়া দিলো। ও জানে, ওর পিসতুতো ভাই আজও বেকার। ওরা থাকে জামশেদপুরে। তাই
নিয়মিত কন্ট্যাক্ট হয় না। একবার ভাবে, সেও হয়তো কোন এঙ্গেজমেন্ট না পেয়ে এমনই
কোন চা-এর দোকানে ব’সে ব’সে দোকানবাজ হ’য়ে গেছে। তবু এ যুদ্ধে নিচে প’ড়েও হাড় মানে না
ও। বলে,
--- তাই ব’লে রাস্তায় ব’সে ব’সে মেয়েদেরকে টিজ
ক’রবে! হোয়াট ইজ দিস, তোড়া! তুমি একে
সাপোর্ট ক’রতে পারো না।
--- সাপোর্ট ক’রছি, কে ব’লল? তুমি কি কখনও
ওদের সাথে কথা ব’লে দেখেছো? বলোনি?
কেন, বলতো? আমরা বাংলার আদর্শ নারী। আমাদের ফিলজফিতে বলে, আমাদের সংস্কারে বলে, ‘ছেলেদের সাথে কথা বলতে নেই।’ কিন্তু আমার ফিলজফিটা যে অন্য, বনলতা দি। ওরা কিন্তু আমায় টিজ করে না। কেন
বলো তো? আমিও তো তোমাদের মতো মেয়ে। আই এ্যাম নট এ ইউনাচ। আমিও তো রাস্তাঘাটে ঘুরি
একা একা।
পিট পিট ক’রে বনলতা দ্যাখে
তোড়াকে আর ওর কথা শোনে। ‘ইউনাচ’ শব্দটার ঠিকঠাক মানে কি, জানা নেই ওর। কিন্তু রিস্ক নিয়ে
তোড়াকে জিজ্ঞেসও করেনি। একটা ভয়ঙ্কর কিছু অর্থ হবে নিশ্চয়ই। তাই শুধু তাকিয়ে
দ্যাখে তোড়াকে। যেন ভূতে পাওয়া একটা মেয়ে। বনলতা শুনছে, কি শুনছে না--- জানতেও চায়
না মেয়েটা। শুধু ব’লতে থাকে,
--- আসলে আমি ওদের সঙ্গে মিশি, বনলতা দি। ওদের ভালোবাসি।
ওরা আমার বন্ধু। শুধু ডাকনামে নয়, রিয়ালি বন্ধু। আজ আমার কোনো বিপদ হ’লে আমার আত্মীয়-পরিজনদের আগে ওরা ঝাঁপিয়ে প’ড়বে। আমি জানি। তুমি কি আমার জন্যে পারবে?
--- মানলাম। বনলতা স্বীকার ক’রে নেয়। তাই বলে একটা মেয়ের প্রব্লেম একটা মেয়ে হ’য়ে তুমি বুঝবে না, এটা কি কোন কাজের কথা?
--- আমি তো বললাম, এটা মঞ্জুলার প্রব্লেম। এটা ওকেই সল্ভ ক’রতে হবে। মঞ্জুলাকেই বুঝতে হবে। আমি তো মঞ্জুলার হ’য়ে খেয়ে দিতে পারি না বাঃ ওর হ’য়ে কেঁদে দিতে পারি না। ওকে ঐ ছেলেগুলোকে বুঝতে হবে, জানতে
হবে। মজাটা দ্যাখো, আমরা ছেলে মেয়ে এক পাড়াতে জন্মালাম, খেলাধুলো ক’রলাম, আর যেই বড়ো হ’লাম, অমনি ওদেরকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না! আর ওদের সাথে কথা বলা যাচ্ছে না।
বরং বাড়ির মানুষেরা ওদেরকে পরিহার ক’রে চ’লতে ব’লছে। কী অদ্ভুত মজা, না? ওরা কিন্তু ওরাই ছিলো। কিন্তু আমরা ওদেরকে ভিন্ন
বানিয়ে দিলাম নিঃশব্দে। একটা বিরাট পাঁচিল গ’ড়ে দিলাম ওদের আর আমাদের মধ্যে। কী মজা, না? ওরা হ’য়ে গেলো রাস্তার মানুষ, আর আমরা হ’য়ে গেলাম ঘরের। কী বিরাট বিদ্রূপ, না?
এবারে দোষ স্বীকার ক’রে নেয় বনলতা নিজে--- আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। আমারই ঘাট হ’য়েছে। এত রাগ ক’রতে হবে না। এবার আমি বাস ধরি? কেমন? আর আমার জন্যে কিন্তু তোমাকে দাঁড়াতে হবে
না। আমি একা পারবো। কাল দেখা হবে। আর আমার কথায় রাগ কোর না কিন্তু।
ব’লে হাতের চার
আঙ্গুল গুচ্ছ ক’রে তোড়ার চিবুক
ছুঁয়ে চুম্বন করে বনলতা। দৃষ্টি পালটে ফ্যালে তোড়া। বনলতার এক স্পর্শে চোখ বুজে
মুচকি হাসে। হঠাৎই বনলতার বাস এসেও যায়। ও উঠে পড়ে। চেঁচিয়ে তোড়া জানায়,
--- তুমিও আমার ওপর রাগ করো না কিন্তু, বনলতা দি।
বনলতা থ্যাংকস জানায়। বাস ছেড়ে দ্যায়।
-------------------------------
এইসব
বিহঙ্গেরা
পরিচ্ছেদ - 4
আজ মঞ্জুলার প্রাইভেট পড়া শেষ
হ’তে হ’তে আবার একটু দেরী হ’য়েছে। প্রায় সন্ধে
সন্ধে। যদিও অনেক লোকজন অফিস ছুটির পর বাড়ির দিকে চ’লেছে। একটু একটু ক’রে রাস্তায় লোক
বাড়ছেও। তথাপি মঞ্জুলা ভাবে, তারা তো তাদের মতো চ’লেছে তাদের গন্তব্যস্থানের দিকে। তাদের তো কোন দায় নেই কোথায় কে কাকে ফলো ক’রছে দেখার। ওকে তো বাড়ি যেতে হবে সেই একা একা। এ কথাটা
ভাবলেই গায়ে জ্বর আসে মঞ্জুলার। আবার পেছন পেছন আসবে ছেলেটা।
এ একটা মহা সমস্যা ওর। সেদিন
তো তোড়া ব্যাপারটা বুঝতেই চাইলো না। তোড়ার তো কোন প্রব্লেম হয় না। রাত-বিরেতে
দিব্যি প’ড়ে বাড়ি ফিরে যায় ও। অবশ্য তোড়া প্রাইভেট
পড়ে অন্য জায়গায়। কিন্তু সব পাড়াতেই ইয়াং ছেলেদের সাথে ওর ওঠা বসা। দিব্যি ব’সে পড়ে ওদের সাথে! কী ক’রে যে তোড়া পারে, কে জানে! ডিস্টার্ব করার এলিমেন্টগুলোই তো ওর জানাশোনা।
মঞ্জুলা ভাবে, দারুণ একটা পলিসি তোড়া নিয়েছে কিন্তু। খোদ বেড়াল-কেই মাছ পাহারা
দিতে ব’সিয়ে দ্যায় তোড়া। তাই ও মঞ্জুলার
প্রব্লেমটা বুঝতেই চায় না। ওর মতো সম্ভব নয় মঞ্জুলার পক্ষে। সবাই তো সবটা পারে না।
আজ মঞ্জুলা একটু বেশি
সেজেগুজেই বেরিয়েছে। আজকাল এমন ক’রে একটু বেশিই
সাজছে ও। কেন যে এমনটা ক’রছে, মঞ্জুলা
নিজেই জানে না। যবে থেকে এই ছেলেটা ওর পেছন পেছন ঘুরছে, মঞ্জুলা কেমন যেন নিজেই
একটা অজ্ঞাত কারণে একটু মডেল মডেল সাজ ক’রে রাস্তায় বেরোয়। বার বার মনে ক’রেছে, কাল থেকে এভাবে সাজবে না। কিন্তু কেমন যেন হয় ওর মনের মধ্যে! হয়তো ভাবে,
তবু তো ওকে এক্সক্লুসিভ্লি দেখার মতো কেউ আছে। তাই সেজেই নেওয়া ভালো। আবার ভাবে, কেনই
বা সাজবে না? ঐ ছেলেটা ফলো করে ব’লে নিজেকে
হত-কুৎসিত ক’রে রাখার কী মানে?
এভাবে নিজেকে নিজেই নানা কথা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ও সেজেগুজেই বেরোয়।
মঞ্জুলা রক্ষণশীল বাড়ির মেয়ে। বাড়ির বাইরে কোনো ছেলের সাথে
কথাটুকু ব’লতে দেখলে অবধি বাবা এই পড়াশুনো বন্ধ ক’রে দেবে। তাই নিজের রেকর্ড-টা ভালো রেখে বাড়িকে হাতের মধ্যে
রেখেছে মঞ্জুলা। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে ওর স্যারের একটা বিরাট ভূমিকাও আছে। তাও মাঝে
মাঝে বিয়ে নিয়ে হাজার বায়না ওঠে। বিশেষ ক’রে যখন পিসিমনি বাড়িতে আসে, তখনই এমনটা হয়। এটা লক্ষ্য ক’রেছে ও। কে জানে, পিসিমনি বাবাকে উত্যক্ত করে কিনা। কিন্তু
এ্যাত সকাল সকাল এই ইউনিভারসিটির আড্ডা, হৈ হৈ, সেমিনার, ক্লাশ কেটে সিনেমা, চাট,
মশলা খাবার ইত্যাদি জীবন ছেড়ে রান্নাঘর, স্বামী-বাচ্চা, ক্যান ক্যান ঘ্যান ঘ্যান
কার ভালো লাগে! কিন্তু এই ছেলেটা একটা প্রব্লেম হ’য়ে উঠছে ক্রমশ। অবশ্য বাবাকে ব’ললে তো এক মিনিটে
কেস সল্ভ হ’য়ে যাবে। কিন্তু
বাবাকে বলা যাবে না।
ঘটনা হ’লো, মঞ্জুলাকে
একটা ছেলে ফলো করে সব সময়। সব সময়। ইউনিভারসিটি-তে আসার পথে, প্রাইভেট প’ড়তে যাবার পথে, ফেরার পথে। সব সময়। যেন মঞ্জুলার পেছন পেছন
হাঁটা ছাড়া আর কোন কাজ নেই ওর। এমনকি মঞ্জুলার ডেইলি রুটিন যেন ওর মুখস্ত। যদিও
কিছুই বলে না। শুধু ফলো। আজ মাস তিন-চারেক হ’য়েছে। ইউনিভারসিটির গেটে, স্যারের বাড়ির গেটে সব জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।
এটা নিয়ে কাউকে তো মঞ্জুলা কিছু ব’লতেও পারবে না। ও
যে ওকেই ফলো ক’রছে, তার তো কোন
প্রমান নেই। এমনকি বাবার সাথে গেলে অবধি রেহাই নেই। সেখানেও হাজীর। একটা নিরাপদ
দূরত্ব রেখে চ’লবে। চুপচাপ। এর
মধ্যে ব্যাপারটা অনেকের চোখেও প’ড়েছে। মানুষ তো
সবই দ্যাখে, সবই বোঝে। বরং একটু বেশিই বুঝে নেয়। কেউ কেউ এটা নিয়ে হাসাহাসিও করে
ওর সাথে। ফলে ছেলেটা মুখে কিছু না ব’ললেও ইতিমধ্যে মঞ্জুলার জীবনের সাথে প্রায় লেপ্টে গেছে।
মঞ্জুলাকে ইউনিভারসিটিতে আসতে হয় সেই শ্রীপল্লী থেকে। হাঁটা
পথে একটু দূর। তবে হেঁটেই আসা যায়। বাবা গাড়ি নিতে বলে। কিন্তু মঞ্জুলা মাকে
বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাবাকে নিরস্ত ক’রেছে। ওর বাবা
কল্যাণীর বিরাট ব্যবসায়ী। জনশ্রুতি আছে, তার নাকি হাজারটা ব্যবসা। তবে বাড়ির মানুষ
জানে, প্রমোটারি, তিনটে রাইস মিল, গোটা তিনেক স-মিল, গারমেন্টস
এক্সপোর্ট-ইম্পপোর্ট আছে। অন্তত লোকে তো ঠাট্টা ক’রে হোক বা হিংসে ক’রে, বলে ‘হাজারটা’। এই শ্রীপল্লীরও
কয়েকটা মেয়ে এই ছেলেটাকে লক্ষ্য ক’রেছে। তারা তো
কনফার্ম্ড, ছেলেটা মঞ্জুলাকেই ফলো করে। লাবনী মাসীর ছোট মেয়ে শ্রাবণী-টা তো একদিন
ব’লেই ব’সলো,
--- মঞ্জু দিদি, কে গো লোকটা? তোর পেছন পেছন ঘোরে? চিনিস?
--- কোন লোকটা? কৈ? কার কথা ব’লছিস? তারপর ছলনা ক’রে পেছনে তাকিয়ে বলে--- ভ্যাট! স্বপ্ন দেখিস নাকি?
--- তুই চাপছিস, মঞ্জু দিদি। শ্রাবণী দাবি করে।--- চাপ।
চেপে যা।। মজা বুঝবি যেদিন মেসোমশাই জানতে পারবে।
এসব কথা শুনে গা-টা জ্ব’লে যায় মঞ্জুলার। বাচ্চা মেয়ে! পাকা পাকা কথা! বেশি সাহস। তাই ধম্কে বলে---
তুমি অন্তত তোমার চরকায় তেল দাও, সোনা। আমার বাপীর কান বেকার গরম ক’রে দিও না।
মঞ্জুলা জানে যে, বাপী জানা মানে তো ‘চলো, ঘরে গিয়ে বোসো, বিয়ে করো, বিদেয় হও।’ প্রথম প্রথম মঞ্জুলা ভেবেওছিল যে, বাবা হয়তো টাকা দিয়ে লোক
লাগিয়েছে ওর পেছনে যাতে মেয়েকে কেউ অসম্মান ক’রতে না পারে। পরে যখন দেখলো, ছেলেটা চা-এর দোকানে বসে, আর তোড়াকেও চেনে, তখন ঐ
সন্দেহটা চ’লে যায়। বাপী জানলে ছেলেটা মারধোর খাবে
ডেফিনিটলি। কিন্তু এসব ওর ভালো লাগে না। মারামারি, রক্তপাত একদম নিতে পারে না
মঞ্জুলা। এই কারণে হিন্দি সিনেমার ধার ঘেঁষে না। এমনকি বাপী যে এ্যাত বড়লোক, এটাই
ভালো লাগে না মঞ্জুলার। তাছাড়া ছেলেটা তো নিরীহ। একজনকে মারার তো একটা যুক্তি চাই।
টাকা থাকলেই ‘সুপারি বিটার’ দিয়ে মারানো ঠিক নাকি? সেটা তো গুণ্ডামি। মেয়েদের পেছনে
নীরবে ঘোরা তো অন্তত আইনত দণ্ডনীয় নয়।
একটা বিষয়ে নিশ্চিত মঞ্জুলা, ছেলেটা নির্ঘাত বেকার। তা না হ’লে সব সময় ফলো করেটা কী ক’রে? তবে চোয়ারে মার্কা ছেলে নয়। বেশ ফর্শা, ছিপছিপে, মাথায় বেশ কায়দা করা
চুল। বেশ হিরো হিরো ভাব নেয়। রট্ন তো নয়ই, বরং বেশ ভদ্র ভদ্র দেখতে ছেলেটাকে।
কিন্তু ওর সিভি-টা তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখতে চাওয়া যায় না। প্রথমটায় ভেবেছিলো
মঞ্জুলা, বাবা তো ব্যবসায়ী। আবার রাজনীতিতে পদার্পণ ক’রে ব’সে আছে। বিধানসভা,
না লোকসভায় দাঁড়াবে, শুনেছে মঞ্জুলা। সুতরাং ছেলেটা কোনো শত্রুপক্ষের নয় তো? পরে
অবশ্য কনফার্ম্ড হ’য়েছে যে, এটা ওকেই
ফলো। মানে রোমান্টিক ফলো। মেয়েদের একটা বিশেষ সেন্স থাকে, যেটা দিয়ে তারা ছেলেদের
চোখ, মন সব প’ড়ে ফেলতে পারে।
তেমনটাই পেরেছে মঞ্জুলা তার সহজাত ক্ষমতা দিয়ে। অবশ্যই সেটা তাৎক্ষণিক পড়া। মানুষ
মানুষের সম্বন্ধে গভীরে যেতে পারে না। সেটা পারলে তো ছেলেদের হাতে মেয়েরা বার বার
প্রবঞ্চিত, প্রতারিত বা লাঞ্ছিত হ’ত না। সাবধান হ’য়ে যেতো। মনে মনে বলে মঞ্জুলা, ‘জানো না তো বাচ্চু, কাকে ফলো করছো। কবে মার খেয়ে ম’রে যাবে।’ কিন্তু যেহেতু
এটা স্পষ্টত রোমান্স কেস, আর রোমান্সে মানুষের সব কাজের দোষ ধ’রতে নেই, সেহেতু ওর বিরুদ্ধে কোন স্টেপ নিতে চায় না ও।
কাউকে কিছু ব’লতেই পারে না ও। কারণ ছেলেটা তো ওকে কিছুই বলে না। নো টিজ, নো কল, নো লেটার। শুধু ফলো। মনে মনে যুক্তি
সাজায় মঞ্জুলা, একটা ছেলের একটা মেয়েকে তো ভালো লাগতেই পারে। সেটা তো কোন অপরাধ
নয়। এটা তো বোঝে মঞ্জুলা। কে না চায়, আমাকে দেখে অন্য কেউ মুচ্ছো যাক! কিন্তু
ছেলেটা বোঝে না যে, এভাবে শুধু ফলো ক’রে বা স্মার্ট লুক মেইনটেইন ক’রে কোনো
প্রেম-ফ্রেম হয় না। একটা মেয়েকে তো কিছু ব’লবার মতো পোটেনশিয়ালিটি থাকতে হবে, নাকি। একটা মেয়ের পেছনে পড়ে আছিস, কিন্তু
কী তোর কোয়ালিটি? মেয়েটাকে কী বলবি? একটা চা-এর দোকানে রাতদিন ব’সে থাকিস আর মনে মনে স্বপ্ন দেখছিস, একটা ইউনিভারসিটির
মেয়ের সাথে প্রেম ক’রবি! ভারী আহ্লাদ
তো! কোনো কোনো সময় ভাবে মঞ্জুলা, ছেলেটা যদি মুখে কিছু বলে, তবে তো একটা ভালোমন্দ
পদক্ষেপ নেওয়া যায়। অথচ সবাই দেখছে, বুঝছে আর একটা স্ক্যান্ডাল ছ’ড়িয়ে যাচ্ছে। একদিন তো নানা কথা নানা জায়গা থেকে শুনে
প্রাইভেট স্যার বলেই বসলেন,
--- দ্যাখো, যদিও তোমরা সিনিয়ার। আমার হয়তো সব বিষয়ে কথা
বলা উচিত নয়। বিশেষ করে যদি তা আমার বাড়ির বাইরে ঘটে। কিন্তু আমি তো তোমাদের বাবার
বয়সী। তাই বলছি। তোমাদের কারো কারো নামে কিন্তু ছোট-বড়ো রটনা শুনছি। একটা মেয়ের
নামে স্ক্যান্ডাল ছড়ালে কিন্তু তাতে মেয়েটির দায় কম থাকে না। স্ক্যান্ডাল সামলে
চলো।
মঞ্জুলা তো জানে, ও একা নয়। কালপ্রিট আরও অনেকে আছে। স্যার
কাকে কাকে যে মীন ক’রলেন, কে জানে।
তাই পরোক্ষ অভিযুক্তেরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিজের থেকে অপরের বিষয়টাকে বেশি করে
হাইলাইট ক’রে দেবার ব্যর্থ চেষ্টা ক’রলো। মঞ্জুলা মনে করলো, এ কথাটা তো তাকেও মীন ক’রতে পারে। স্যার সকলের খবর রাখেন না নিশ্চয়ই। কিন্তু কী
করবে ও! কী-ই বা ক’রতে পারে! ছেলেটা
যতক্ষণ ওকে ডেকে-ডুকে না ফেলছে, তার আগে দুম ক’রে কিছু বলা যায় নাকি! আর সে বুকের পাটাও ওর নেই। আর কিছু জিজ্ঞেস ক’রে ব’সলেও যদি ছেলেটা
অস্বীকার করে?
ছেলেটাকে পেছনে দেখতে দেখতে কেমন যেন একটা গা সওয়াও হ’য়ে যাচ্ছে আজকাল। কিন্তু মনের ভয়টা যাচ্ছে না। মঞ্জুলা নিজে
জানে, ও আহা মরি সুন্দরী নয়। হ্যাঁ, গায়ের রং-এ চটক আছে। তার চেয়ে বরং ছেলেটা অনেক
বেশি হ্যান্ডসাম। তবু ভয় হয়, ছেলেটা সত্যি যদি কোনদিন ডেকে বসে? কী ব’লবে মঞ্জুলা?
ছেলেটাকে ইউনিভারসিটির কাছে চা-এর দোকানটাতে দেখেছে
মঞ্জুলা। সেই কারণেই ও নিশ্চিত যে, তোড়া ওকে চেনে। এই কারণে তোড়াকে খুলে কিছু বলে
না ও। তোড়া ব্যাপারটাকে ভালভাবে নেবে না। অবশ্য তোড়াকে ছেলেটার সাথে কথা-টথা ব’লতে কখনও ও দ্যাখেনি। তোড়া ইউনিভারসিটি-তে বেশিক্ষণ থাকে
না। কোথায় একটা যায় ব’লে মনে হয়।
কিন্তু কেউই জানে না, কোথায় যায়। যেতেও
কেউ কখনও দেখে নি। কিন্তু যায় শিওর। তবে বাড়িও যেতে পারে।। ওকে ওর দাদাকে
রান্না-বান্না ক’রে দিতে হয়। ওর তো
বাবা-মা নেই। তাই তোড়াটা ওরকম লাগাম ছাড়া। এই কারণেই তোড়া মঞ্জুলার সমস্যাটা জানেও
না, বোঝে না, বুঝতে চায়ও না। কারোর পারসোনাল ব্যাপারে ও থাকেই না।
সুতরাং আজও একা ফিরতে হবে মঞ্জুলাকে। একটু সন্ধে সন্ধে হ’য়েছে। একটু ভয় ভয়ও ক’রছে। ও নিশ্চিত যে, ছেলেটা কিচ্ছুটি ক’রবে না। তবু ব’লে তো একটা
ব্যাপার থাকে। স্যারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বোঝে যে, ছেলেটা পিছু
নিয়েছে। মঞ্জুলা ছাড়া আর সকলে তো নিজের নিজের মতো হেঁটে চ’লেছে। কেউই ভাবছে না, একটা মেয়ে একটা ছেলের কারণে একটু
সহজভাবে হাঁটতেও পারছে না। এরই মধ্যে আশে পাশের দোকানগুলো খুলে গেছে। রাস্তার পাশে
ব্যাপারীরা তাদের পসরা সাজিয়ে ব’সেছে। ঐ টুকুই তো
ওদের বাঁচা-মরার উপায়। ঐ টুকুই তো ওদের জীবিকা। এখানে ছোট বড়ো কোন দোকান সারাদিন
খোলা থাকে না। দুপুরে বন্ধ হ’য়ে যায়। আবার
বিকেলে খোলে।
অভ্যাস মানুষকে এমন একটা অবস্থায় এনে ফেলে যে, সে নিজেই
বুঝতে পারে না, কখন তার পুরনো চরিত্রটা হারিয়ে গিয়ে একটা নতুন চরিত্র খাড়া হ’য়েছে। হঠাৎ সেটা আবিষ্কার ক’রে সে নিজেই একদিন চমকে যায়। নিজেকে নতুন ক’রে চিনতে পারে। আজ মঞ্জুলার তাই হ’লো। মাথায় একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেলো। ওর পার্সে সব সময় কম সে কম শ-তিনেক
মতো টাকা থাকে। প্রাচুর্য থাকলে যা হয়। আজকে তাই বাড়ির পথে পা না চালিয়ে চ’লে গেলো রিজেন্ট মার্কেটের দিকে। টেড়িয়ে দেখে নিলো, ওর
বডিগার্ড ওর পেছনে আছে কিনা। দেখলও, ও আসছে। আজ প্রথম ভাবলো মঞ্জুলা, সেদিন
পারমিতা ঠিকই ব’লেছিলো, ছেলেটা
আলটিমেটলি ওর বডিগার্ড-ই হয়ে উঠেছে। রাস্তায় চট্ ক’রে ওর কোনো ক্ষতি হবার কোন চান্স নেই। এবার একটু চালাকিও ক’রলো মঞ্জুলা। যাবার সময় হঠাৎ যেন চপ্পলটার ফিতেতে কিছু একটা
হ’য়েছে, এমন ভান ক’রে দাঁড়িয়ে প’ড়লো। লক্ষ্য ক’রলো, ছেলেটাও
দাঁড়িয়েছে। একটা সিগারেট ধরালো। এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন সিগারেট ধরাবার জন্যেই
দাঁড়িয়েছে। বেশ বুঝলো মঞ্জুলা, আজও মুক্তি নেই। তাই ও সোজা রিজেন্ট মার্কেটের
মধ্যে একটা কস্মেটিক্সের দোকানে ঢুকে গেলো। কিছুক্ষণ এটা-ওটা কিনলো। দরকার নেই,
তবু কিনলো। দোকানের শো কেসের আয়নায় দেখলো, ছেলেটা একটা ব্যাগের দোকানে দাঁড়িয়েছে।
যেন ব্যাগ-ট্যাগ কিছু কিনছে। হঠাৎ আবার একটা দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় খেললো। ও টুক ক’রে ছেলেটার অলক্ষ্যে ঢুকে প’ড়লো দোকানটার একেবারে ভেতরে। সেলস গার্লটার পাশে। দোকানের মেয়েটাকে ব’লল ছেলেটার দিকে চোখ রাখতে, আর ওকে ব’লতে, ছেলেটা কী ক’রছে। এতে যে বাজারে সে নিজে হাল্কা হ’চ্ছে, এটা আর মাথাতে খেললো না মঞ্জুলার। দুষ্টু খেলাটাই ওকে পেয়ে ব’সলো। মেয়েটাও মজা পেয়েছে এতে। এই কিনুন, ঐ কিনুন--- ব’লতে ব’লতে সেও ক্লান্ত।
তার কাছেও এটা একটা খেলা। একটা রিসেস। মঞ্জুলাকে দোকানের মেয়েটা বিলক্ষণ চেনে।
মঞ্জুলা এই দোকানের রেগুলার কাস্টমার। তাই মেয়েটা পুট পুট ক’রে ধারাভাষ্য দিতে লাগলো ছেলেটার গতিবিধির। এবারে ছেলেটা
মঞ্জুলাকে দেখতে না পেয়ে পাগলের মতো এদিক-ওদিক খুঁজতে শুরু করলো। মঞ্জুলার এটা
শুনে বেজায় হাসি পেলো। আজকে বেশ একটা ভালো মজা হ’য়েছে। রোজ ছেলেটা ওকে ভোগায়। আজ ওকে মঞ্জুলা ভুগিয়ে দিলো। মনে মনে বেশ আক্ষেপ
হোল, আগে কেন এসব ওর কথা মাথায় আসেনি! সমস্যাটা একটা খেলা হ’য়ে ওর যাত্রাপথ অনেক আনন্দময় ক’রতো। আজকের মতো। বড্ড হাসি পেলো মঞ্জুলার। যেইমাত্র দোকানের
মেয়েটা ব’লেছে, ছেলেটা মার্কেটের বাইরে গেছে, অমনি
টুক ক’রে বেরিয়ে মঞ্জুলা মার্কেটের পেছন দিয়ে
মার্কেট-এর বাথরুম-টাথরুম নাক বন্ধ ক’রে পেরিয়ে সোজা গা ঢাকা দিলো জন সমুদ্রে। দোকানের মেয়েটাকে ভুলভাল বুঝিয়ে দিয়ে
ব’লল, ‘বাবার পাঠানো বডিগার্ড। আজ ওকে নাকানি-চোবানি খাওয়াবে।’ মেয়েটা কী বুঝলো, কে জানে। মঞ্জুলা সোজা বাড়ির পথে হাঁটা
দিয়েছে। আজকে বেশ একটা উত্তেজনা হ’চ্ছিলো। রোজ একই ‘পান্তাভাতে বেগুন পোড়া’ খেয়ে খেয়ে যেমন মুখটা হেজে যায়, মঞ্জুলার তেমনই হ’য়ে যাচ্ছিলো। আজ বেশ মজা হ’য়েছে। উত্তেজনায় এই হাল্কা শীতেই ও প্রায় ঘেমে উঠছিলো।
কিন্তু পাড়ায় ঢুকতে গিয়ে দেখে, মূর্তিমান দাঁড়িয়ে। ছেলেটা
একেবারে ওদের গলির মুখে। পাঁচিলের অন্তরালে দাঁড়িয়ে একটু গা ঢাকা দিয়ে ব্যাপারটা
দেখে নিলো মঞ্জুলা। এখানে কতক্ষণ দাঁড়াবে! কখন কে এসে পড়ে আর বলে, ‘এখানে দাঁড়িয়ে তুই কি ক’রছিস রে! কিন্তু কিছু করার নেই। ওকে তো ওর সামনে দিয়েই যেতে হবে। আর তো পথ
নেই। কী সাহস! ‘বাপী জানতে পারলে
না তোমার একটা হাড়ও গোটা থাকবে না রোমিও---।’ মুখে না, মনে মনে কথাটা ব’লল মঞ্জুলা। এবারে
তো ওর বুক ধরাস ধরাস ক’রতে শুরু হ’য়েছে। তবু ভেতরে ভেতরে বেশ হাসছিলো মঞ্জুলা। আজ জোর বোকা
বানিয়েছে ওকে। ‘আর ফলো ক’রবি, বডিগার্ড?’ মঞ্জুলার আজকে নিজেকে একটা সিনেমার নায়িকার মতো লাগছিলো। এমন একটা ঘটনা কোন
একটা বাংলা সিনেমায় ও দেখেওছিলো, মনে প’ড়লো। কিন্তু এখন? এখন কী হবে? বাড়ি যেতেই হবে। এমনিতেই দুষ্টু খেলা খেলতে গিয়ে
দেরী হ’য়ে গেছে। মা হাজারটা প্রশ্ন ক’রবে। তাই অন্তরাল থেকে বেরিয়ে মাথা নিচু ক’রে বাড়ির পথে হাঁটা দিলো। ওকে দেখে ছেলেটা একেবারে যেন
অমাবস্যার রাতে চাঁদ দেখেছে, এ রকম একটা হাসি দিলো। কিন্তু এবারে গা-টা জ্ব’ললো না মঞ্জুলার। মনে মনে ব’লল, ‘পালাও রোমিও। ম’রবে।’ কিন্তু এটা আজকে
পরিষ্কার হোল ওর কাছে যে, ছেলেটা ছোটলোক নয়। ভদ্র। একটা মেয়েকে ওর ভালো লাগতেই
পারে, তাকে অনুসরণ ক’রতেই পারে। তাতে
কেউ ছোটলোক হ’য়ে যায় না। আসলে
চা-এর দোকানে ব’সে ইনি যতই ফোটান
না কেন, ইনি মেয়েদের কাছে নিতান্ত গো-বেচারা। সাহস ক’রে মেয়েদের সাথে কথাটা বলার মতো বুকের পাটা নেই। অবশ্য
এইটাই তো ভদ্রতা। একে ভয় পাবার কিস্সু হয়নি। বুকে একটু সাহস হোল মঞ্জুলার। তাই ও
হাঁটা দিলো বাড়ির পথে।
হাঁটা না দিয়ে তো উপায় নেই। ভয় পেলেও তো হাঁটা দিতে হবে।
মূর্তিমান যে গলির মুখে। কিন্তু একটা ভয় র’য়েই গেলো। যদি ছেলেটা এখন ডেকে-টেকে বসে, তবে বিপদটা আরো
বেশি। এটা পাড়া। পাঁচজনে দেখবে, সন্দেহ ক’রবে, পরে বাপীকে ব’লবে। মনে মনে ভেবে
নিলো, এ মালকে হটাতে হবে। যে ভাবে হোক, হটাতে হবে। এবারে বুক ভরতি হাওয়া ভ’রে নিয়ে যেন বুক ভরতি সাহস ভ’রে নিলো ও। পা চ’লল। মনে হলো, আজ
ওকে ফেস ক’রতে পারবে। যে কোন কঠিন কথা ব’লে ফেলতে পারবে। আর লাগবে না তোড়াকে। তাছাড়া ঐ তো কালুকাকার
মুদীখানা। হৃষ্টপুষ্ট কালুকাকা ব’সে আছে। এখান
থেকেই তো ওদের মাস কাবারী গ্রসারি যায়। ভয় কি!
কিন্তু বেশি নির্ভয়তাও ভালো নয়। কোথায় বলে, ‘ফুলস্ রাশ দেয়ার হোয়ার দ্য এ্যাঞ্জেলস ফিয়ার টু ট্রেড।’ তেমনটাই হ’লো। মঞ্জুলা বেশি
সাহস দেখাতে গিয়ে একেবারে গোল খেলো। ছেলেটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মঞ্জুলা গলাটা বেশ
ভারী ক’রে ব’লে ফেললো,
--- আপনি কি আমাকে চাইছেন?
ব’লেই মনে হোল, এটা
কী ব’লল! আসলে ও তো ‘চাইছেন’ ব’লতে চায়নি। ও ব’লতে চেয়েছে ‘খুঁজছেন’। কী মুশকিল! কী ব’লতে কী বেরিয়ে গেলো! ছেলেটা তো বেকায়দা উত্তর দিতে পারে। যদি দ্যায়, তবে তো
বেকায়দা জবাব দেবার ক্ষমতাও নেই ওর। কিন্তু ছেলেটা এবারেও পরীক্ষায় পাশ ক’রে গেলো। সে বুঝিয়ে
দিলো যে, সে প্রকৃতই ভদ্র। বরং মঞ্জুলার এই আকস্মিক প্রশ্নে বেশ ভয় পেয়েছে, মনে
হোল। একেবারে কেঁপে-টেপে উত্তর দিলো,
--- না…..মানে……আমি….মানে….এমনিই দাঁড়িয়ে আছি।…এমনিই।…আপনাকে কেন চাইবো?..... এমনিই……
বেশ হাসি পেলো মঞ্জুলার। কিন্তু মোটেই হাসলো না এবার।
নিজেকে কঠিনভাবে সংযত ক’রলো। ধমকে দিলো নিজেকে,
‘একদম ফিক ফিক হাসি নয়। গম্ভীর হও,
মঞ্জুলা। ফাজলামো ক’রো না।’ এবারে ও গম্ভীরভাবে ব’লল,
--- আর একদম আমাকে ফলো ক’রবেন না। যদি দেখি ফের ফলো ক’রছেন, তাহলে
কিন্তু ভালো হবে না।
--- ক’রিনি তো। না না।
ফলো কেন ক’রবো!
--- হ্যাঁ-অ্যা। মনে থাকবে?
ছেলেটা এবারে আর মুখে কিছু না ব’লে মাথাটা হেলালো একপাশে। যেন ব’লল, ‘আমি আর কোনোদিন
ফলো ক’রবো না। যেন একটা ধরা পড়া অপরাধী। অপরাধ
স্বীকার ক’রে ক্ষমা চাইছে। ব’লছে, ‘আর কক্ষনও ক’রবো না।’ কিন্তু মঞ্জুলা
দেখলো, ছেলেটা কিন্তু এক পা-ও নড়লো না সেখান থেকে। ঠায় দাঁড়িয়ে র’য়েছে। মঞ্জুলা আবার ধমক দিলো,
--- যান। এক্ষুনি চ’লে যা-আ-ন। এখানে দাঁড়াবেন না।
কথাটা ব’লে কোনদিকে ছেলেটা
যাবে, সেদিকে নিজের হাতও দেখালো মঞ্জুলা। বোধহয় আবেগে ওর গলাটা চ’ড়ে গিয়েছিলো। এমন তো কখনও আগে করেনি। এই প্রথম। বেশ একটা
সাহস হ’য়েছিলো মনে। তাই পরিণামটাও ভাবে নি।
কিন্তু ওর গলা শুনে দোকান থেকে কালুকাকা চেঁচিয়ে উঠলো,
--- কী হ’লো, মঞ্জু? কিছু হ’য়েছে?
আবার একবার মঞ্জুলার বুকটা ধরাস ক’রে উঠলো। কেন ধরাস ক’রলো, তার কোন কারণ খুঁজে পেলো না ও। জানিয়ে দিলো শুধু--- না গো, কাকুকাকা,
কিছু না।
মঞ্জুলা জানে, কালুকাকা একটু ঈশারা পেলে এসে ছেলেটার দাঁত
ভেঙ্গে দেবে। কিন্তু কেন? ছেলেটা তো কিছুই করেইনি। বরং মঞ্জুলাই তো ওকে নিয়ে একটা
খেলায় মেতেছে। বেশ ভালো লাগছে আজ নিজেকে নতুন ক’রে চিনতে পেরে। নিজের পিঠ নিজেই চাপ্ড়ে নিতে ইচ্ছে ক’রছে। ব’লতে ইচ্ছে ক’রছে, ‘হবে, তোমার হবে।
তুমি পারবে, মঞ্জুলা।’ কিন্তু ছেলেটা
যেন কালুকাকাকে মোটেই ভয় পেলো না। বরং অনেক সমীহ ক’রলো মঞ্জুলাকে। সবিনয়ে ব’লল,
--- আপনি আগে বাড়ি যান। কথাটা ব’লে ছেলেটা অনেকটা হোটেলের গার্ড যেভাবে কাস্টমারকে হোটেলে
প্রবেশ করার জন্যে হাতটা বাড়িয়ে দ্যায়, যেভাবে ঘাড়টা কাৎ ক’রে পথ দেখায়, সেভাবেই যেন আমন্ত্রণ জানালো। যেন ওর নিজেরই
বাড়িতে প্রবেশের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
বলে কী! কিন্তু এ কী হ’লো মঞ্জুলার? ছেলেটার কথাগুলো যেন একটা রুদ্রবীণার মতো বেজে উঠলো ওর কানে। চ’ম্কেই গেলো মঞ্জুলা। কেন এমন হ’লো! সেকি এই প্রথম ছেলেটাকে কথা ব’লতে শুনে? হ’তে পারে। মঞ্জুলাও
তো এই ছেলেটা কেন, কোন অচেনা ছেলের সাথে এই প্রথম কথা ব’লল। বিশেষ করে চা-এর দোকানে আড্ডা দেওয়া কোন ছেলের সাথে
এভাবে রাস্তায়……! এবার তোড়াকে
দু-চার কথা শুনিয়ে দেওয়া যাবে। হঠাৎ মনে প’ড়লো, ‘ওরে বাবা! বাবা জানতে পারলে একেবারে
কচুকাটা ক’রবে। ছেলেটাকে আর মঞ্জুলাকেও। পাড়ার মুখে
দাঁড়িয়ে…….।’ মঞ্জুলা তাড়াতাড়ি বাড়িতে চ’লে যায়।
মঞ্জুলাদের বাড়ি একটা গলির মধ্যে। এই গলিটায় গোটা পাঁচেক
বাড়ি। কিন্তু মঞ্জুলার বাবা তার গ্যাঁটের কড়ি খ’সিয়ে গলিটার রাস্তাটাকে নিজে বাঁধিয়েছেন। পাশের বাড়ির পাঁচিলগুলোকে ছোট ক’রিয়ে তাতে ফুলের আর পাতা বাহারের নানা টব ব’সিয়ে বেশ একটা বাহারি রূপ দিয়েছেন। প্রতিবেশীরা কেউ আপত্তি
করেনি, কারণ এতে তাদের বাড়ির ফ্রন্ট বিউটি বেড়েছে, বৈ কমেনি। অবশ্য আপত্তি করার
সাহসও কারোর নেই। ওর বাবা-র ভয়ে বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খায়। রাজনীতির ভয়। গলির
শেষে ওদের বিশাল গেট দেওয়া বাড়ি। এই গেট দিয়েই ওদের তিনখানা গাড়ি ঢোকে আর বের হয়।
গেটের মুখেই ‘বি ওয়ার অফ ডগ’ বোর্ড টাঙ্গানো। বাড়িতে আছেও দুটো বাঘের মতো কুকুর। টম আর
ডেভিল। বাইরের লোকের কাছে তারা সাক্ষাৎ কালান্তক যম। গেট খুললেই লম্বা লন। তাতে
নানা বাহারি গাছ। ওদের তিনতলা বাড়ি।
মঞ্জুলা থাকে দোতলায়। একেবারে দক্ষিণ দিকে ওর ঘর। ঘরের
সামনের জানলা দিয়ে নিজেদের পুরো বাড়িটা দেখা যায়। সামনের রাস্তাটাও দেখা যায়
পরিষ্কার।। বাবা হয়তো এইসব ছেলেঘটিত কারণেই ওকে গাড়ি ক’রে ইউনিভারসিটি যাওয়া-আসা ক’রতে ব’লেছিলো। কিন্তু বায়না ক’রে মঞ্জুলা বন্ধ ক’রেছে কারণ তাতে বন্ধুদের সাথে একটা দূরত্ব গ’ড়ে ওঠে। ওদের সাথে আড্ডা দেওয়া যায় না। ওর এ্যাত প্রাচুর্য ভালোও লাগে না।
হয়তো প্রাচুর্য আছে ব’লেই এমনটা মনে হ’চ্ছে আজ। দারিদ্র থাকলে হয়তো বিপরীত মনে হোতো। বাবা ওকে
একটা মোবাইল ফোন নিতে বাধ্য ক’রেছে ব’লেই একটা থাকে ব্যাগে। কাকেই বা ও ফোন ক’রবে! সেটা চুপচাপ প’ড়েই থাকে ব্যাগে। তাতে অনর্গল কোম্পানির মেসেজ আসে। মাঝে মাঝে ফালতু কল।
কোম্পানী বা রং নাম্বার। মঞ্জুলা তা খুলেও দ্যাখে না।
বাড়িতে ঢুকে মঞ্জুলা একছুটে ঘরে গিয়ে জানলায় এসে দেখতে
চেষ্টা ক’রলো ছেলেটিকে। কিন্তু দেখতে পেলো না। চ’লে গ্যাছে বোধহয়। মঞ্জুলার হঠাৎ মনে হ’লো, কেনই বা ও ছেলেটাকে দেখতে এলো! এরপর চেঞ্জ ক’রতে ক’রতে, খেতে বসে,
পড়ার টেবিলে ব’সে, শুতে গিয়ে,
ঘুমোতে না পেরে বারান্দায় এসে দাঁড়াতে বার বার আজকের অভিজ্ঞতা আর ওই ছেলেটার বোকা
বোকা মুখটা ভেসে উঠতে লাগলো। এটা ও বুঝলো, ও নিজে চাইছে না, অথচ বার বার মনের
মধ্যে এসে এই দুটো দৃশ্য উঁকি দিচ্ছে। কেন এমনটা হ’চ্ছে, তার কোনো হদিশ পেলো না। কিন্তু এটার তো কোন সদুত্তর না পেলে আলটিমেটলি
ঘুমই আসবে না। শেষে কি ঘুমের ওষুধ খেতে হবে! এ তো মহা মুশকিল!
এটাও বুঝতে পারলো মঞ্জুলা, ছেলেটা বোকা বোকা হ’লেও আজ বেশ সাহস দেখিয়েছে। আজ তিন-চার মাস ছেলেটা ওর পেছনে
ঘুরছে। একটা দিনের জন্যেও কোন কথাটি বলেনি--- মানে ব’লতে সাহস করেনি। আর আজ একেবারে ওদের পাড়ার মুখে দাঁড়িয়ে
স্মার্টলি কথা ব’লে দিলো! তার মানে
ছেলেটা বোকা নয়। বোকার ভান ক’রে থাকে। বোকা
হবেই বা কী করে? চা-এর দোকানে আড্ডা মারা ছেলেরা কি বোকা হয়! বেশ চৌকশ হয়। তবে এটা
বেশ মজাও হ’য়েছে। ছেলেটা অন্তত মঞ্জুলার কাছে
গো-বেচারা। মঞ্জুলা এটা ভেবেও খুব শান্তি পেলো মনে মনে যে, ওর নিজেরও বেশ সাহস
আছে। আগে শুধু শুধু ভয়ই পেয়েছে ও। এবার আর একা একা চ’লতে ভয় হবে না। আর তোড়ার কাছে অনুনয় ক’রতে হবে না একটু এগিয়ে দেবার জন্যে। এ্যাতদিন বেকার ভয়ে
কাঁটা হ’য়ে জীবনটাকে নষ্ট ক’রেছে। আজ ফাড়া কেটে গেছে।
এই কথাটা মনে আসতেই বেশ আরাম বোধ ক’রলো মঞ্জুলা আর কোথা থেকে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো ওর দু-চোখে।
রাত কেটে গেলো নিশ্ছিদ্র নিদ্রায়।
-------------------------
এইসব
বিহঙ্গেরা
পরিচ্ছেদ – ৫
আজ কার মুখ দেখে যে উঠেছিলো বনলতা, কে জানে। সকাল থেকে
একটার পর একটা অঘটন ঘ’টে চ’লেছে ওর সাথে। যেগুলো ঘ’টবার কথা ছিলো না, সেগুলোই ঘ’টে চ’লেছে। প্রথমেই মায়ের শরীরটা আজ ব্রেক করে। তখনও বনলতা ঘুম
ত্থেকে ওঠেনি। আজকে ঘুম থেকে বাবা ওকে ডেকে তোলেন। ঘুম ভেঙ্গে যেতে মায়ের শরীরের
কথাটা শুনে খুব ঘাবড়ে যায় ও। কী আবার হোল! মা এমনিতেই অসুস্থ আজ আট-ন বছর। মামাদের
বিশ্বাসঘাতকতা মার মনটাকে একেবারে ভেঙ্গে দিয়েছিলো। মায়ের হার্ট এ্যাটাকটা যদিও
খুব জোর হয়নি, তথাপি মায়ের মনের জোর একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছিলো। তারপর বাবাকে
চন্দননগর ছেড়ে কল্যাণীতে চ’লে আসতে মূলত মা-ই
বাধ্য ক’রেছিলো। এরপর থেকে মা প্রায়ই অসুস্থ হ’য়ে পড়ে। হয়তো একে ডিপ্রেশন পেশেন্ট বলে।
আজ সকালে বাবা চা বানিয়ে ডাকতে গিয়ে দেখেন, মা-র জ্ঞান নেই।
বাবা খুব জোর ঘাবড়ে যান। কোনো রিস্ক না নিয়েই ডেকে তোলেন বনলতাকে। বনলতা উঠে
বাবা-মার ঘরে যায় তাড়াতাড়ি। মার চোখে-মুখে জল দিয়ে চেষ্টা করে জ্ঞান ফেরাবার। একটু
সুবিধে হয়। কিন্তু হাত-পা বেশ অবশ হ’য়ে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ডাকা হয়। তিনি এসে আবিষ্কার করেন যে, শীতের রাতে
যে একটু গ্যাস ফর্ম করার টেন্ডেন্সি থাকে, তাতেই এমনটা ঘ’টেছে।
তিনি জানালেন--- শীতের লোভনীয় সবজি আর গা-এর কম্বল কিছুটা
গ্যাস ফর্ম ক’রতে এনকারেজ করে।
ভাববেন না।
ডাক্তার গেলে একটা মহা মুশকিল হয়। বাবা অফিস যাবেন, না
বনলতা ইউনিভার্সিটিতে যাবে। আজকে ইউনিভারসিটিতে ওর সব ক্লাশ ইম্পরট্যান্ট থাকে।
নোট্স চাই-ই চাই। বাবা-ই বললেন,
--- আমি আজ বাড়িতে আছি। তোর যদি কোন ইম্পরট্যান্ট ক্লাশ
থাকে, তবে তুই ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারিস।
বনলতা আপত্তি করে। বলে--- তুমি অফিস কামাই করবে! অফিস বেশী
জরুরী নয় কি?
বাবা জানান--- তোর তো কোন টিউটর নেই। তোর একটা ক্লাশ মিস হ’লে তো ক্ষতি হবে। তুই না হয় তাড়াতাড়ি ক্লাশ সেরে আয়। আমি
সামলে নেবোখন। তুই ভাবিস না।
এরপর মায়ের সাথে কথা ব’লে আর মাকে কয়েকটা সাবধান বানী দিয়ে বনলতা রেডি হ’য়ে বেরিয়ে যায়। বাসে উঠে আর এক বিপত্তি ঘটে। এই বাসে উঠতে
ওর খুব অস্বস্তি হয়। কারণ, এই বাসের ম্যাক্সিমাম প্যাসেঞ্জার গ্রামের মানুষ। মূলত
শ্রমজীবী। তাদের গায়ের গন্ধে পাশে বসা যায় না। পুরুষ হোক বা মহিলা--- একই ব্যাপার। যে কাপড় বা জামা প’রেছে পনেরো দিন আগে, তা হয়তো আজো ছাড়েনি। হয়তো তা-ই প’রেই রাতে শুয়েছে। কাচাকাচির বালাই তো নেই। কাচবেই বা কী ক’রে! দু-বেলা খাবার জোটাতেই তো ওদের জীবন ঝুঁকে পড়ে। গা-এ
সাবান পড়ে না। শীতে একরকম। কিন্তু গরমে তো অসহ্য। বনলতা এসব বোঝে না, তা নয়। এটাও
বোঝে যে, এই মানুষগুলো বেশ ভালো। কোন বিরক্তির কারণ হয় না। সরল সোজা। ও উঠলে ওরা
যেন বোঝে, ওদেরকে একটু সাবধানে স’রে স’রে বসতে হবে, বা দাঁড়াতে হবে। কিন্তু এসব তো উদারতা বা
প্রগতিশীলতার কথা। রোজ এমন কো-প্যাসেঞ্জার হ’লে তো মহা অসুবিধা হয়। এ কথা কেউ স্বীকার করুক, না করুক। এটা নিষ্ঠুর সত্যি।
বাসটা আসে পাল পাড়া থেকে। বনলতা জানে, অন্ধকে অন্ধ, অথবা খোঁড়াকে খোঁড়া ব’লতে নেই। কিন্তু না ব’ললেই তো সে ভালো হ’য়ে যাবে না। তাই
মনে মনে সত্যি কথাটা স্বীকার ক’রতে ওর কোন সঙ্কোচ
হয় না। সত্যি কথাটা হোল, ওদের গায়ে বিকট গন্ধ। খেয়েদেয়ে বা না খেয়ে বাসে উঠলে
নিজেকে সামলানো মুশকিল।
কিন্তু আজ হোল অন্য যন্ত্রণা। বনলতাদের স্টপেজ থেকে আরো
দুটো স্কুলের মেয়ে ঐ বাসটাতে ওঠে। স্কুলে যায় ওরা। প্রায় রোজই ওদের সাথে দেখা হয়।
একই স্টপেজে নামে। কমলা গার্লস হাই স্কুল তো ইউনিভারসিটির থেকে একটু ওপাশে। আজকে
ওদের সাথে ঠেলে-গুঁতিয়ে বাসে উঠলো কয়েকটা চ্যাংড়া ছেলে। এরা রোজই ওঠে। কিন্তু গেটে
ঝোলে। আজ একেবারে মেয়ে দুটোর গা ঘেঁষে আপত্তিকরভাবে উঠলো বাসে। বনলতা সব দেখেছে।
বোঝা যাচ্ছে, ওরা বদমায়েশি ক’রতে উঠেছে, কিন্তু
কিছু না করা পর্যন্ত কিছু বলা যায় না। তাই এখনই বলার কিছু নেই।
বাসে যাত্রী ভরা ছিল। কিন্তু ছেলেগুলো স্কুলের মেয়েগুলোর
গা-এর কাছে যেন জোর ক’রে দাঁড়িয়ে ছিল।
বাচ্চা দুটো বেশ একটা বিপদে প’ড়ে যেন সিটিয়ে
ছিলো। দু-একবার আপত্তিও ক’রেছে। কিন্তু লাভ
কিছু হয় নি। বনলতা ভাবলো, কী আর হবে। কটা স্টপেজ তো মোটে। বাসে লেডিস সীট প্রায় ভ’রতি ছিলো। শুধু তার মধ্যে একটি বৃদ্ধ ভদ্রলোক ব’সেছিলেন। বনলতা লক্ষ্য করে, বৃদ্ধটি সম্ভবত অসুস্থ। তাঁকে
মোটামুটি ভদ্র পরিবারের ব’লেই মনে হোল।
বনলতা তাঁকে লেডিজ সীট ছেড়ে উঠতে বলেনি। এটা ও কখনই করে না। এবারে ঐ প্রায় যুবক
ছেলেগুলো স্কুলের মেয়ে দুটোকে বসাবার জন্যে বৃদ্ধটিকে হ্যারাস ক’রতে শুরু ক’রলো। বনলতা ওদেরকে
সংযত ক’রতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না।
ছেলেগুলো বৃদ্ধটিকে উদ্দেশ ক’রে ব’লে ওঠে,
--- কি দাদু, খুব আরাম লাগছে, না? লেডিজ সিটে পেছন ঠেকিয়ে
আছেন। একটু পেছনটা তুলুন।
ভদ্রলোক মুখটা বিকৃত ক’রে হয়তো কোন এক দুরারোগ্য বেদনা চেপে উঠতে যাচ্ছিলেন, বনলতা বাধা দ্যায়।
বনলতার মনে একটা ভয় বাসা বাঁধছিল কারণ এসব ঘটনার সাথে ও বিলক্ষণ পরিচিত। কিন্তু
একেবারে কিছু নান বলার তো কোন মানে হয় না। তাই অগত্যা ও ব’লেই দ্যায়,
--- কেন ওনাকে উত্যক্ত করছেন? উনি বৃদ্ধ মানুষ। বাবার বয়সী।
উনি বসুন। আমরা ব’সবো না। আপনাদের
এ্যাতো মাথাব্যথা কেন?
একটা ছেলে উত্তর দ্যায়--- আপনার জন্যে নয়, দিদি। আপনি লাইট
পোস্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকুন। আপনি ছাড়া কি
বাসে লেডিস নেই?
আর একটা ছেলে ফের বৃদ্ধকে বলে--- কি দাদু, কান দুটো কি
বাড়িতে রেখে এসেছেন?
আর একজন ব’লল--- আরে ঠানডি
মে গরমি কা এহ্সাস। তাই না দাদু?
ভদ্রলোক কাঁপছিলেন। ভয়ে, না অপমানে--- বুঝতে পারে না বনলতা।
এটা বুঝতে পারে যে, ছেলেগুলোর টার্গেট ঐ মেয়ে দুটো। কিন্তু ও কী ক’রবে, বুঝতে পারে না। বাসের সবাই যেন নীরব দর্শক। বনলতার মতো
একটা একা মেয়ে এ অবস্থায় কী ক’রতে পারে!
ছেলেগুলোর চেহারা মোটেই ভালো নয়। ওর মনে হয়--- এভাবে মেয়েগুলো পড়াশুনো ক’রবে কী করে! রাস্তাঘাটে বেরনোই তো ওদের কাছে একটা আতঙ্ক হয়ে
উঠবে। ভয় হয়--- আজ যদি তেমন কিছু ঘ’টে যায়, কে
বাঁচাবে বাচ্চা দুটোকে! বনলতার মনে পড়ে, ওদের স্কুলজীবনে তো এতোটা অসভ্যতা ছিল না।
এতো মাত্রা ছাড়া হ’য়ে যাচ্ছে। কেউ
কিছু ব’লছেও না। অবশ্য ও জানে, এসব ব্যাপারে কেউ
রিস্ক নেয় না আজকাল। কদিন আগেও ইভটিজিং থেকে বাঁচাতে গিয়ে এক পুলিশের লোক জখম হ’য়েছে। কাগজে বেরিয়েছিল।
অবশেষে বৃদ্ধটিকে জোর ক’রে উঠিয়ে দিয়ে তবে ওরা নিষ্কৃত হয়। প্রায় জোর ক’রেই মেয়েদুটোকে ব’সিয়ে দ্যায় সীটে।
ব্যাপারটা বনলতার কাছে ক্রমশ বেশ আতঙ্কজনক হ’য়ে উঠতে থাকে। ও খুব লক্ষ্য ক’রে ছেলেগুলোকে
চিনে রাখতে চায়। কিন্তু মনে রাখতে পারে না। মাথাটা ওর কাজ ক’রতে চায় না। সকাল থেকে যা সব ওলট-পালট ঘটে চলেছে! ওদের
উদ্দেশ্য যে আরো আরো মন্দ দিকে এগোচ্ছে, সে বিষয় বনলতা নিশ্চিত হয়। কিন্তু এ
অবস্থায় কী ক’রবে, তা বুঝতে
পারে না। চুপ ক’রে মেনে নেয়। ও
কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। স্কুলের মেয়ে দুটোর দিকে বেশ ভয়ে ভয়ে তাকায়
বনলতা। মেয়েদুটোও খুব ঘাবড়ে গেছে। ওদের চোখমুখে একটা সাহায্যের প্রার্থনা ফুটে
উঠেছে। একটা অস্বস্তি হ’তে থাকে বনলতার
শরীরে।
এরপর ঘটে তৃতীয় দুর্ঘটনা। সেটা ভালো হোল, না মন্দ, তখনই
বুঝতে পারে না বনলতা। বটতলা স্টপেজের কাছে এসে বাসটার টায়ার পাঙ্কচার হ’য়ে যায়। এতদিনে এ্যাতোগুলো ঘটনা যে ঘ’টতে পারে, তা কল্পনা ক’রতে পারে না বনলতা। এরই নাম ‘মিস্ফরচুন নেভার
কাম্স এ্যালোন’। তাই ওর মনে হয়,
কার মুখ দেখে যে সকালে ঘুম থেকে উঠেছিলো। আসলে আজ তো ঘুম থেকে উঠে বাবারই মুখ
দেখেছে বনলতা। বাবার মুখ যদি আনলাকি হয়, তবে তো জীবনে অনেকবার বাবা ওকে ঘুম থেকে
ডেকে তুলেছেন। তাহলে তো অনেক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার সাক্ষী ওকে হ’তে হোতো।
এখনও তিনটে স্টপেজ যেতে হবে। বাসের ভাড়া ফেরত নিতে গিয়ে কোন
লাভ নেই। অনেক প্যাসেঞ্জার। দেরী হবে। বাচ্চাদুটোকে বনলতা বলে--- আমার সঙ্গে পা
চালিয়ে আয়।
সঙ্গে এসে যে কী হবে, তা জানে না ও নিজেই। স্কুলের মেয়ে
দুটোকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে থাকে বনলতা। অন্তত মিনিট কুড়ি তো লাগবেই। যদি একটা
অটো-টটো জুটে যায়। পরের বাস আসতে আসতে ওরা পৌঁছে যাবে। এখানে বাস চলে প্রায় কুড়ি
মিনিট অন্তর অন্তর। মাঝে মাঝে গাদিয়ে অটো চলে। তাও ঠিক মতো চলে না। ওরা হাঁটতে
শুরু ক’রলে ছেলেগুলো ওদের সঙ্গে হাঁটা শুরু ক’রে দিলো।
গণ্ডগোলটা এবার বেঁধে গেলো বনলতার সাথে। বনলতা আর নিতে
পারছিলো না। নিজেকে একটা ভীরু, অমানুষ, আর ঘরে ছুটে বেড়ানো একটা ছুঁচো বলে মনে হ’চ্ছিলো ওর নিজেরই। বনলতা আজো জানে না, যদি না এর মধ্যে মোটর
সাইকেলে চ’ড়ে একটি ভদ্রলোক সেখানে এসে হাজীর না হ’তেন, তবে শেষে কী ঘ’টতো। ভদ্রলোক মোটর সাইকেল থামিয়ে বনলতাকে জিজ্ঞাসা ক’রলেন,
--- কী হ’য়েছে ম্যাডাম? কী
ব্যাপার?
বনলতা দেখলো, লোকটার একমুখ দাড়ি-গোঁফ, পরণে
পায়জামা-পাঞ্জাবি এবং চোখে চশমা। সবচেয়ে বড়ো কথা, ভদ্রলোকটির শারীরিক গঠন খুব একটা
ভরসাযোগ্য নয়। অসভ্য ছেলেগুলোর সংখ্যা মত জনা পাঁচেক। কোনোভাবে হাতাহাতি লেগে
ভদ্রলোকটির বোধহয় অবস্থা ভালো থাকবে না। বেশ একটা অজানা ভয় ক’রছিলো বনলতার। এখান থেকে যে ঘটনা কোথায় যাবে, কে জানে।
আজকাল তো ছোটমোটো কোনো ব্যাপার চ’লে যায় রাজনৈতিক
দলের হাতে। পড়ে সেটা নিয়ে নানা বিশ্রী বিশ্রী ঘটনা ঘ’টতে থাকে। কিন্তু কিছু তো করার নেই।
বনলতার কাছ থেকে সংক্ষেপে সব শুনলেন ভদ্রলোকটি। এবার ও
দেখলো, লোকটির সাথে ওদের বাক-বিতণ্ডা একটা হাতাহাতির জায়গায় চ’লে যাচ্ছে। বনলতা ভাবলো, যদি এটা আটকে দেওয়া যায়। ভাল
মানসিকতা দেখিয়ে ও মাঝখানে প’ড়তেই লোকটি ধম্কে
বনলতাকে চ’লে যেতে ব’ললেন। একটা কথা শুধু কানে এলো ওর। লোকটা ব’লছেন,
--- আমি হাত খুললে কিন্তু তোদের খুঁজে পাওয়া যাবে না রে।
ইউনিভারিসিটির পথে গুটি গুটি হাঁটা দিয়েও ফিরে ফিরে পেছনের
ঘটনা না দেখে থাকতে পারে না ও। হঠাৎ দ্যাখে, আর একটা মোটর সাইকেল সেখানে পৌঁছলো।
তাতে আসে দুটো ছেলে। বড়ো বড়ো। তারপর কি সব কথা হয় ওদের মধ্যে, সব বনলতার কানে এসে
পৌঁছয় না। ততক্ষণে ও দাঁড়িয়ে পড়েছে। ও দ্যাখে যে, কি একটা অজানা কারনে রট্ন
ছেলেগুলো টুকটাক ক’রে স’রে প’ড়লো এদিক ওদিক।
যেন ভূত দেখেছে চোখে। বনলতার মনে প’ড়লো, যে ছেলে দুটো
মোটর সাইকেলে চেপে এলো, তাদের মধ্যে একজন র’য়েছে যে, মঞ্জুলাকে ফলো করে। বনলতা খেয়াল করেনি, ওরা কী একটা নামে যেন ডাকলো
ওই চাপদাড়ি লোকটিকে। তখন মাথার মধ্যে বোঁ বোঁ ক’রছে ওর। ও আরো অবাক হয় দেখে যে, যে লোকটা মোটর সাইকেলে এসে ওদেরকে রেস্কিউ ক’রলেন, তিনি ওদেরকে কিছুমাত্র না ব’লে ধোঁয়া উড়িয়ে দারুণ জোরে চ’লে গেলেন।
অবাক হ’য়ে গেলো বনলতা। এ
কী লোক রে বাবা! কোনো কথা নেই, বার্তা নেই--- মোটর সাইকেল নিয়ে একেবারে একজন
উদাসীন ত্রাতার মতো চ’লে গেলো। ওর অবাক
লাগলো--- কল্যাণীতে কোন লোক কি একটু ভদ্রতা, একটু সৌজন্য বোধ শেখেনি! ওরা যখন
প্রথম এখানে এলো, তখন থেকেই দেখেছে, এখানকার মানুষগুলো কেমন যেন আচার-আচরণ করে!
এমনকি দোকানদারগুলো পর্যন্ত কেমন যেন উদাসীন আচরণ করে! দেখে মনে হয়, ওদের যেন
জিনিস-পত্র বিক্রি ক’রবার কোন আগ্রহ
নেই। কাস্টমারদের সাথে যে নরম ব্যবহার করা উচিত, অন্যথায় তাঁরা অন্য দোকানে চ’লে যাবে, তা যেন একেবারেই জানে না্ বা ভ্রূক্ষেপ করে না।
বিশেষ ক’রে যে দোকান থেকে ওদের মুদিখানার মালপত্র
কেনা হয়, এই লোকটা তো সব সময় একটা নিদ্রালু ভাব নিয়ে দোকানে বসে থাকে। যেন খদ্দের
না এলেই ভালো হয়। তাহলে সে একটু ঘুমোতে পারে। গ্রীষ্মও, বর্ষা, শরৎ--- সব সময় একটা
শার্ট আর প্রয়োজনে তাঁর ওপরে একটা হাফ সোয়েটার চাপিয়ে থাকে। কিন্তু সব ঋতুতেই ওর
চার ইঞ্চি পেট বের ক’রে দিয়ে গভীর
নাভিটা শো-কেসে শো ক’রে রাখার মতো
দৃশ্যমান ক’রে রাখে। দোকানে মালপত্র কিনতে যেতে কী
অস্বস্তি হয়! অসহ্য লাগে ওর সামনে দাঁড়াতে! কিন্তু কী করা! সেই তো পাড়াতে সবেধন
নীলমণি, একমাত্র মুদি। গা জ্বলে যায় দেখলে। কিন্তু দেখতে হবে। ওকে দেখে বনলতার মনে
হ’তো--- যাই, আমিও বাড়ি গিয়ে একটু ঘুমিয়ে
নিই। তবে অবশ্যই ওর মত পেট আর নাভি বের ক’রে নয়।
এই লোকটাও তেমন। বলা নেই, কওয়া নেই, ধাঁ ক’রে অন্য মোটর বাইকটার সাথে খানিকটা নীলচে ধোঁয়া উড়িয়ে দিয়ে
চলে গেলো। বনলতা থ্যাংকসটুকু জানাবার অবসর পর্যন্ত পেলো না। তবে এটা বুঝলো যে,
লোকটা বেশ দাদা গোছের হবে হয়তো। তা নয়তো দ্বিতীয় মোটর বাইক এসে কী ব’লতে ওই রট্ন ছেলেগুলো ওভাবে ভেগে গেলো কেন? এরপর একটা
দিনের জন্যে ওই ছেলেগুলো ঐ বাসেই ওঠেনি। কেন? নিশ্চয়ই লোকটা দাদা গোছের।। যাকগে,
যে হয় সে হোক। ওদের কাজ তো মিটে গেছে। ব্যস্। বাচ্চা দুটোকে ব’লে দিলো বনলতা,
--- তোরা বাড়ির কাউকে না নিয়ে, মানে মা, বা মাসী কাউকে ছাড়া
রাস্তায় বের হ’বি না। আর রাস্তায়
বেরিয়ে একদম খিলখিল ক’রবি না। গম্ভীর হ’য়ে চলাফেরা ক’রবি। এখন বড়ো হ’চ্ছিস। বুঝলি?
ওদের মধ্যে একটা মেয়ে তো ব’লেই বসলো--- কেন দিদি? আমাদের কি স্বাধীনতা নেই? আমরা কি মানুষ নই? আমরা কি
বন্দি নাকি?
বনলতা একটা ধমক দিলো--- যা ব’লছি, তাই ক’রবি। বেশী পাকামি
ক’রবি না, ব’লে দিলাম। নইলে আমি তো রোজ বাঁচাতে আসবো না।
মেয়ে দুটো কী বুঝলো, কে জানে। মুখ বন্ধ ক’রে চ’লে গেলো ওদের
স্কুলের দিকে। বনলতা বুঝলো, ওদের মধ্যে নিশ্চয়ই ওই একটা প্রশ্ন মাথা খুড়ে ম’রছে। ‘আমাদের কি
স্বাধীনতা নেই? আমরা কি মানুষ নই?’ সত্যিই তো। ওরা
কি স্বাধীন নয়? একটু হাসাহাসি ব’ই তো নয়। কেন
ওদেরকে রাস্তায় সেই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে লাগাম টানতে হবে! এটাই তো উচ্ছ্বলতার বয়স।
ওরা তো বনলতার মতো বুড়ি নয়। কিন্তু ওদের প্রশ্নের উত্তর ওর কাছে অন্তত নেই। বনলতা
আশ্চর্য হ’লো ওর নিজেরই কথায়। ও কেন ব’লে বসলো, ‘আমি তো রোজ
বাঁচাতে আসবো না।’ ও কি বাঁচিয়েছে
নাকি? ওর জন্যে কি ওরা বেঁচেছে? তা তো নয়। লোকটা তো বনলতাকেও চেনে না। বনলতাও চেনে
না লোকটাকে। ওকে তো লোকটা পাত্তাও দিলো না। বরং উল্টে ওকেই ধমক দিয়ে দিয়েছে। কে
জানে, মেয়ে দুটো কী ভাবলো।
মেয়ে দুটো স্কুলের দিকে রওনা দিলে বনলতা ইউনিভারিসিটিতে
ঢুকলো। আজকের ঘটনা নিয়ে কাউকে কিছু ব’লল না। কি জানি, কে কোন কথার কী অর্থ ক’রে বসে! একটা খোরাক তো পাবে ওকে নিয়ে নানা রঙ্গ-রসিকতা করার। এ সুযোগটা ও দ্যায়
না ব’লেই রক্ষে।
তখন বেলা প্রায় দুটো। দুপুরের শুনশান রাস্তা। এ সময় না
স্কুলের মেয়েরা ফেরে, না কলেজের। সুতরাং বাইক পিক আপে তুলতে কোনো অসুবিধে হয় না।
রাস্তাটা যেন নিরুপদ্রব বুক পেতে থাকে তাদের জন্যে যারা একটু বেপরোয়া বা
কারণে-অকারণে জোরে চালাতে চায়। ফুলহাতা সোয়েটারটাকে পেটে বেঁধে নিয়ে পিঠে হাল্কা
শীতের রোদ মাখতে মাখতে পেয়ারা বাগানের ক্লাসটা শেষ ক’রে হাই স্পীডে মোটর বাইকে ফিরছিলো দীপ্ত। আজকাল পাঞ্জাবির
সাথে ফুলহাতা সোয়েটার পরে অনেকে। এটাই ফ্যাশান। সেটাই কপি করেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি
যেতে হবে কারণ তুতু ব’লেছে আজ দুপুরে ওর
সঙ্গে খাবে। আজ নাকি ক্লাশ
একটু আগেই শেষ হবে। মেয়েটার সাথে একসঙ্গে খাওয়া কিছুতেই হয় না। মেয়েটা বড়ো হ’য়েছে। এখনও তুতু যখন বাড়িতে থাকে, তখন ক্লাসে ব্যস্ত থাকে
দীপ্ত। তুতু রান্না ক’রে চ’লে যায় ইউনিভার্সিটিতে। দীপ্ত ফিরে এসে খেয়ে নেয়। আবার
বেরিয়ে যায় চারটেতে। মেয়েটা ফিরে একাই বাকি কাজ সারে। দীপ্ত ফেরে রাত সাড়ে
দশটা-এগারোটায়। ততক্ষণে তুতুর খাওয়া হ’য়ে যায়। ও স্টাডিতে থাকে। একটা রান্নার লোক রাখার জন্যে বার বার ক’রে ব’লেছে দীপ্ত।
কিন্তু তুতু কিছুতেই তা চায় না। দাদাকে রান্না ক’রে খাওয়াতে ওর ভালো লাগে। এই দাদাই তাকে কন্যা সন্তানের মতো বড়ো ক’রেছে। বাব-মা এক বছরের গ্যাপে চ’লে গেছেন ওদেরকে একা ফেলে। তখন তুতু পড়ে মাত্র ক্লাশ টেনে।
দীপ্ত তখন সবে মাস্টার ডিগ্রী ক’রেছে। দুজনেই
ক্যান্সার পেষেন্ট ছিলেন। দীপ্ত নিজে শোক করার সুযোগটুকু পায়নি। একটা শোক সামলাতে
না সামলাতেই আর একটা নেমে এসেছে। তখন বোনকে বুকে লেপটে রাখতেই ওর শোক-দুঃখ ধুয়ে
মুছে গেছে। গোটা কাজটা একা হাতেই সম্পন্ন ক’রে ফেলতে হ’য়েছে। অবশ্য
কাকা-জ্যাঠা-পিসিরা ছিলেন। কিন্তু তা আর কতক্ষণের জন্যে!
দীপ্ত আর চাকরীর জন্যে পড়াশুনো ক’রতে পারেনি। বাবার মনের ইচ্ছে ছিলো ব’লে প্রাইভেট পড়াতে পড়াতেই এল.এল.বি. ক’রেছিলো। কিন্তু বছর দুয়েক প্র্যাকটিস ক’রে বুঝতে পেরেছিলো, এ জীবিকা ওর চ’লবে না। এটা ওর জন্যে নয়। বাবা যে এ্যাডভোকেটদের দেখেছিলেন,
তাদের পেশাগত অবস্থান, আর আজ--- এক নয়। তাদের একটা ইডিওলজি ছিলো। জীবিকাকে তাঁরা
শ্রদ্ধা ক’রতেন। ওর বাবার এক বন্ধু ক্রিমিনাল
কোর্টের এ্যাডভোকেট ছিলেন। তিনি কখনও স্বীকার করেননি যে, তিনি আদালতে দিনকে রাত,
আর রাতকে দিন ক’রতেন। জেনুইন
আসামীকে বেকসুর খালাস ক’রিয়ে দিলেও বাইরে
এসে পর্যন্ত ব’লতেন যে, তাঁর
মক্কেল আসামী নয়, কারণ কোর্ট তা মেনে নিয়েছে। কিন্তু আজ এটা একটা অসভ্যতায় এসে
দাঁড়িয়েছে। ল-ইয়াররা আজ লড়াই থেকে গট-আপ গেম খেলে বেশি। দু-পক্ষের থেকে টাকা খেয়ে
জীবিকাকে একটা হীন জীবিকায় পর্যবসিত ক’রেছে। এটা দীপ্ত পারবে না। আর তাই ওর কোন উন্নতিও হবে না। তবে বার
এ্যাসোসিয়েশনের মেম্বারশিপটা রেখেছে এখনও। অনেক কাজে লাগে অনেক সময়। অন্তত ওর
উপ-নামকরণটাকে কাজে লাগাতে তো লাগেই।
তাই স্টুডেন্ট লাইফে ও যে প্রাইভেট টিচিং ক’রতো, সেটাকেই জীবিকা ক’রে নিতে হ’য়েছে নিজের
অজান্তেই। অল্প বয়সে কাঁধে এসে প’ড়েছে বোনের
দায়িত্ব। তাকে পড়াশুনো করানো, তার নিজের মতো জীবন গ’ড়ে দেওয়া--- সবটাই বাবার মতো বহন ক’রতে হ’য়েছে দীপ্তকে। নিজের দিকে তাকাবার
সময়টুকু পায়নি। তবে দীপ্ত সব সময় মাথায় রেখেছে যে, তার বোনকে জীবনে অবলম্বন নিয়ে
নয়, একা চ’লতে শিখতে হবে। ওকে একা বাঁচার মতো
বাঁচতে দিতে হ’লে একা চলার জন্যে
সমর্থ ক’রে তুলতে হবে। তা নয়তো পাঁচটা মেয়ের মত
ঠোক্কর খেতে খেতে চ’লতে হবে।
আদরে-গোবরে কথায় কথায় আহা-উহু ক’রে লবঙ্গলতিকা হ’য়ে বাঁচা কোন বাঁচা নয়। পথে-ঘাটে একা চ’লতে হবে, আর তাই পথের মানুষকে জানতে হবে, চিনতে হবে। একদল
পথের কুকুরের মধ্যে যেমন একটা শৌখিন কুকুর বাঁচতে পারে না, তাকে লোম কেটে খাটো ক’রে নিয়ে পথের কুকুর সাজতে হয়, ডি-ক্লাশড হ’তে হয়, তা নয়তো পথের বে-ওয়ারিশ কুকুরের কামড় খেতে হয়, তেমনি
তার বোনকেও ক’রতে হবে। তা নয়তো
মুক্তি নেই। বাবা, দাদা, দিদি--- কেউই একটা মেয়ের জীবনে সর্বসময় তার রক্ষাকর্তা হ’য়ে বাঁচতে পারে না। বাঁচতে হয় নিজেকে। দাদাকে তাই বাবার মতো
মনে ক’রে তুতু।
এমন একটা অনিশ্চিত জীবিকায় দাঁড়াতে দীপ্তকে বেশ বেগ পেতে হ’য়েছে বটে। তবু এটাকেই দীপ্ত এঞ্জয় করে। কত ছেলে-মেয়ের জীবন
তৈরী ক’রে দেবার গুরু দায়িত্ব কাঁধে নেয় ও। এ
জন্যে ওর একটা বিরাট পপুলারিটি আছে অঞ্চলে। এক ডাকে পাঁচটা মানুষ চেনে ওকে। আজ
ওদের আর্থিক অবস্থা ফিরেছে। ভালোই উপার্জন করে আজ। তাছাড়া ‘বিপদতাড়ন পাচন’ নামে সকলেই চেনে দীপ্তকে। বেকার জীবন থেকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র এই দীপ্ত
রায়। অভিভাবক থেকে শুরু ক’রে সবে কলেজের
গণ্ডি পার হওয়া ছেলে কিম্বা মেয়ে--- সকলেই জানে, দীপ্ত রায় হাত না দিলে চাকরী
জুটবে না। তাই চব্বিশ ঘণ্টায় চোদ্দ ঘণ্টা ব্যস্ত থাকতে হয় ওকে। রাতে পর্যন্ত
প্রায় দিনই তুতুর সাথে একসাথে খাওয়া হয় না। এই কারণে তুতুর এই বায়না হয় মাঝে মাঝে,
আর তা রাখতে হয় কন্যা সন্তানের অকৃতদ্বার পিতাকে। বোনের স্টাডি থাকে। দাদা ব’লে রেখেছে, স্টাডির সাথে নো কম্প্রোমাইজ। তাই আজ একটু দৌড়ে
দাপিয়ে ফিরছে দীপ্ত। তায় আবার আজ সকালে এমন একটা ঝামেলায় জ’ড়িয়ে গেলো যে, দেরি হ’য়ে যাওয়াটা এড়াতে পারলো না দীপ্ত। আজকাল লোকালিটির পর লোকালিটি ছেলেগুলো বড্ড
রট্ন হ’য়ে উঠেছে। আজ যদি বটতলা স্টপেজে ও ঠিক
সময়ে গিয়ে না পৌঁছতো, তবে একটা ঝামেলা তো ঘ’টেই যেতো।
ছেলেগুলো খুব সম্ভবত স্টেশন রোডের। সন্দেহ নেই, স্টেশন
চত্বরটা একটু রিস্কি হ’য়ে উঠেছে। কিন্তু
অত চিন্তা ক’রলে তো
বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো রাস্তাঘাটে বের হ’তেই পারবে না। দীপ্ত শিওর, ছেলেগুলো সিনিয়ার মেয়েটিকে টার্গেট করেনি। বাচ্চাগুলোই
ছিল ওদের টার্গেট। মনে মনে ভাবছিলো দীপ্ত, একদিন গোটা পনেরো ছেলেকে নিয়ে হানা দেবে
স্টেশন চত্বরের ঠেকগুলোতে। একটু দাবাই চাই ওদের। বড্ড বেড়েছে ওরা। তা নয়তো এটা
বাড়তে বাড়তে খারাপ জায়গায় যাবে। হয়তো রাজনীতি জড়িয়ে আছে এর সাথে। তাতে দীপ্ত রায়ের
কিছু যায় আসে না। ও যে নন্-পলিটিক্যাল, তা সকলেই জানে। পলিটিক্স ও পরোয়া করে না।
ও কোন পার্টির নেতা-ফেতাও মানে না। ওর পেছনেই প্রতি বছর তিনশ ছেলেমেয়ে থাকে। আর
সেটার সংখ্যা বছর বছর বাড়তেই থাকে। ওকে রুলিং বা এগেন্সট--- কোন পার্টি ঘাঁটায় না।
বরং একটু তেল দিয়েই চলে। ওর হাতে যে প্রতি বছর তিনশো ছেলেমেয়ে থাকে। তারা এটাও
জানে, দীপ্ত রায়ের অরগানাইজিং ক্ষমতা কতটুকু। তাই বরং ওকে হাতে রাখতে চেষ্টা করে
দু-পক্ষই। একটু বড়ো আসন দিয়েই চলে।
বাস্তবে কিছু মানুষ থাকে যাদের একটা নিজস্ব আইডেন্টিটিটি
থাকে। কোনো কোনো মানুষ স্বয়ং একটা ইন্সটিটিউট হয়। তাদের কাউকে লাগে না, কোনো দল
লাগে না। তাকে লাগে অন্যের। তাছাড়া ‘বিপদ তাড়ন পাচন’ নামে দীপ্তর একটা
পরিচয়ও আছে। কার বাড়ির মানুষ অসুস্থ, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, তো দীপ্ত তার
ছেলেপুলে নিয়ে হাজির। কোথায় ব্লাড ডোনেশান ক্যাম্প হবে, কোথায় আই ট্রিটমেন্ট ক্যাম্প
ক’রতে হবে, কোন বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে ঝামেলা---
সব ব্যাপারেই দীপ্তদা হাজির। শিবহীন যজ্ঞ যেমন হয় না, তেমনই দীপ্ত দা ছাড়া কোন
ফ্যামিলি কোনো জট ছাড়াতে পারে না। এর জন্য যে কোন এন.জি.ও. ক’রতে হয় না, তার
উজ্জ্বল প্রমান দীপ্তিময় রায়। সে বাবারও দীপ্ত দা, ছেলেরও দীপ্ত দা। দীপ্তিময় রায়
হোল কমন দীপ্ত দা।
এই কল্যাণীতে বিশেষ ক’রে কম্পিটিটিভ এক্সাম ক্যান্ডিডেটদের নয়নের মনি দীপ্ত দা। তিন-চারটে স্পটে ও
ক্লাশ করে। অন্তত শ-তিনেক ছাত্রও-ছাত্রীকে ও পড়ায়। তাদের ভবিষ্যৎ ওর হাতে। আজ দশ
বছর ধ’রে কল্যাণীতে এই জীবিকায় একছত্র আধিপত্য
চালাচ্ছে দীপ্তিময় রায়। সবাই যে চাকরী পায়, তা নয়। তবে বেশ গুড-উইল আছে দীপ্তর।
সকলে চোখ বুজে দীপ্তর কথা শুনলেও দীপ্ত কিন্তু তার বোন তুতুর কথায় ওঠে বসে। তাই ও
আজ একটু দৌড় লাগিয়েছে বাড়ির দিকে। চারটেতে আবার ক্লাশ। শুধু যাবার সময় রবির বাড়িতে
একটা খবর দিতে হবে। ওদের এগ্রিকালচার ডিপারটমেন্টের পরীক্ষাটা ঝুলে ছিল। একটা কেস
চ’লছিলো। কিছু ক্যানডিডেট পাশ না ক’রে পরীক্ষায় ম্যানিপুলেশন হ’য়েছে ব’লে সরকারের এগেন্সটে কেস ঠুকে দিয়েছিলো।
যারা পাশ করেছিলো, তারা মনে মনে ভেবেছিলো, এবার বেকার স্ট্যাম্পটা ঘুচবে। তাদের
একটা হিল্লে হ’য়ে যাবে। কিন্তু
আদালত……। দীপ্তর ন-জন ক্যান্ডিডেট এ রকম ঝুলে
আছে। এ পাড়ায় আছে রবি।
রবিটা তো জীবনে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলো। আর কিছু হবে না।। ওর আর
বয়সও নেই। তাই আর কোন পরীক্ষায় ব’সবার কোন প্রশ্ন
ছিল না। চা-এর দোকানে ব’সে ব’সে জীবনটাকে নষ্ট ক’রে দিতে হতো। বড়ো মায়া হয় ওদের জন্যে দীপ্তর। কী ক’রবে ছেলেগুলো। ওদের মনগুলো বড়ো ভালো। তাই বোনকে শিখিয়েছে
ওদের সাথে একটা বন্ধুত্ব ক’রে চ’লবার জন্যে। ওরা যেন নিজেদেরকে অপাংক্তেয় মনে না করে। তুতুও
তার দাদার কথাকে বেদবাক্য মনে করে। ও বুঝে নিয়েছে, ওর জীবনে নির্মাতা এই দাদা।
বাবা-মাকে ও পেয়েছে কতটুকু! তাঁরা থাকলে তুতুকে এভাবে হয়তো তথাকথিত রাস্তার
ছেলেদের সাথে মিশতে দিতেন না। হয়তো এম.এ.-টাও ক’রতে দিতেন না। ধ’রে ক’রে বিয়ে দিতেন। কিন্তু দাদা ওর গুরুদেব, ওর আইডল।
কিন্তু তুতুর সমস্যা হ’লো, দাদা একটা বিয়ে ক’রছে না। ওর তো যে
কোনোদিন বিয়ে হ’য়ে যেতে পারে। তখন
দাদাকে কে দেখবে? তাই দাদার একটা হিল্লে না হ’লে ওর তো যাওয়াও হবে না। দীপ্ত মাঝে মাঝে ওর ধমক খায়, বায়না শোনে, বিয়ে করার
জন্যে নানা দিব্যি দ্যায় বোন। সব শুনতে হয় ওকে। কিন্তু ও তো বোঝে না। ওর দাদার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। একটা বিরাট
বোঝা ও বুকে ব’য়ে বেড়াচ্ছে। তুতু
দাদার বিয়ের কথা পাড়লেই শুধু দাদার মুখে শোনে কিছু দুর্বোধ্য কথা,
--- সবার সব কাজ করার অধিকার থাকে না রে। কোন কোন মানুষকে
একটা ভুলের জন্যে প্রায়শ্চিত্য ক’রতে হয় গোটা জীবন।
এসব তুই বুঝবি না।
এই একটা বিষয় দীপ্ত তুতুর সাথে শেয়ার ক’রতে পারে না। এটা ওর নিজের। একান্ত পারসোনাল যাকে বলে।
মানুষের তো একটা ব্যক্তিগত কিছু থাকেই। কমলালেবু যেমন পুরো ছাড়িয়ে নিয়ে খেতে ব’সতে হয় না, যতটুকু খোলার দরকার ততটুকু খুললেই চলে, তেমনি
দীপ্ত পুরো খুলতেও পারে না। তাহলে তো তার নিজস্বতা, অস্তিত্ব, বিপন্ন হয়। তাই
তুতুকে ওইটুকু বলে ক্ষান্ত ক’রতে হয়। তুতু মাঝে
মাঝে নানাভাবে জানতে চায় দাদার মনের কষ্টটা। কী কষ্ট বুকে ব’য়ে বেড়ায় তার শিবের মতো বড়ো ভাইটা। দীপ্ত জানতে দ্যায় না।
এই ভারটা সে একা রেলিশ করে।
শুধু সুখ নয়, বেদনাও রেলিশ করে মানুষ। তাই বেদনার সাথে
মানুষের এ্যাতো অন্তরঙ্গতা। শখ করে সে বেদনার কাহিনি পড়ে, বেদনার চলচ্চিত্র
দ্যাখে। যখন একা দীপ্ত ব’সে থাকে, তখন
নিজেকে ধিক্কার দ্যায়, শাসন করে, শাস্তি দ্যায়।। তাই নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে
দীপ্ত। যেন কোনো কথা ওর মনে না পড়ে। এটা ও বোঝে, নিজে কষ্ট পাওয়া আর অন্যকে কষ্ট
দেওয়া অনেক আলাদা। সম্পূর্ণ আলাদা।
এইসব এলোমেলো নানা কথা ভাবতে ভাবতে দীপ্ত সবে বাইকটাকে
টার্ন ক’রিয়েছে ইউনিভার্সিটির পাশ দিয়ে, হঠাৎ
দ্যাখে, একটা মেয়ে ওকে হাত দেখাচ্ছে। থামতে ব’লছে। ঘড়ি দেখলো দীপ্ত। দুটো। মেয়েটাকে চেনে না কিন্তু শাড়িটা যেন চেনা চেনা।
কোথায় যেন দেখেছে দেখেছে। ডিপ নীলের মধ্যে সাদা কুচি কুচি বুটি। বেশ আন কমন।
ঘ্যাঁচ ক’রে দাঁড়ায় তার সামনে।
--- ডু ইউ মীন মি? জানতে চায় দীপ্ত।
বনলতা বেশ বুঝতে পারে, এটা লোকটার এ্যাক্টিং। আজ সকালেই
দ্যাখা হ’য়েছে অথচ মনে হ’চ্ছে যেন চিনতেই পারছে না। কোনো কোনো মানুষ এরকম এ্যাটিচুড
দেখায়। বনলতাও চার্জ করে,
--- আপনি তো বেশ মানুষ! চিনতেই পারছেন না যেন! নাকি না
পারার ভান ক’রছেন?
--- সরি। আমি ঠিক…. মানে… আপনার শাড়িটা কেমন
চিনি চিনি ব’লে মনে হ’চ্ছে। কিন্তু
আপনাকে তো….. নির্ভেজাল সত্য
বলে দীপ্ত। ও এরকমই বলে। মেয়েদের সামনে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না ও।
--- শাড়িটা চেনেন, আর মানুষটাকে চেনেন না! আজ সকালেই দেখা
হোল আর এখনই ভুলে গেলেন? সত্যি দারুণ তো আপনার স্মরণ শক্তি। বনলতা মনে করাবার
চেষ্টা করে।
এবার দীপ্ত যেন মনে ক’রতে পারে। ঐ স্কুলের মেয়েগুলোর সাথে এই মহিলা ছিলেন। তাই শাড়িটা চেনা চেনা
লাগছিলো। এবার ও বলে--- হ্যাঁ, এবার ধ’রতে পেরেছি। আজ বটতলা স্টপেজ। তাই না? তো বলুন। আমার কাছে কী চান?
--- মানুষ শুধু আপনার কাছে চায় নাকি? আর কোনো কারণে কি
মানুষ আপনার সাথে সাক্ষাৎ করে না? বেশ ঝাঁঝালো স্বরে বলে বনলতা।
আসলে সকালের রাগটা ওর মনে বেশ দাগ কেটে আছে। একটা মানুষ
একটা মহিলাকে যে এভাবে আন্ডার এস্টিমেট ক’রতে পারে, তা যেন সহ্য হয় না। এটা মহিলা সেন্টিমেন্ট-এর গভীর তত্ব। একটা ছেলে
একটা মেয়েকে টিজ ক’রলে যতটা মন্দ
লাগে, তার থেকে যেন এই নিরুত্তাপতা অনেক বেশি আঘাত করে।
দীপ্ত বলে--- এক্সকিউজ মি। আমি একটু তাড়াতাড়ির মধ্যে আছি।
আসলে প্যালাতে চায় ও। ও জানে, এরপর কী ঘ’টবে। এসব আর ভালো লাগে না। শুনতে শুনতে ক্যান পচে গেছে ওর।
--- মানুষ তো একটা শিভালরি নামে ব্যাপারকে মেনে চলে। আমায়
তো একটা…..
বনলতাকে বাধা দ্যায় দীপ্ত। ওর কথাটাকে কেড়ে নিয়ে বলে---
শিভালরির যে পরিচয় সকালে ছেলেগুলোর থেকে পেয়েছেন, তার পরেও অন্যকে তা জানানো চাই?
কী ব’লবেন? থ্যাংকস? সো কাইন্ড অফ ইউ? আপনার এ
উপকার জীবনে ভুলবো না? ভাগ্যিস আপনি ছিলেন? এইসব তো? আর ভালো লাগে না, ম্যাম। আই
ফিল টায়ার্ড।
দীপ্তর কথাগুলো যেন কাঁটা দিয়ে আঘাত ক’রছিলো বনলতাকে। ও রেগেমেগে ব’লেই দিলো---কল্যাণীতে কি কেউ একটু সৌজন্য জানে না? এই কারণেই কি ছেলেগুলো এমন
অসভ্যতা ক’রছিলো? একজন মহিলাকে…..
দীপ্ত অসন্তুষ্ট হয়। বেলা দুপুর। পেট চুই চুই ক’রছে। এখন আর কোনো অবস্থাতেই দাঁড়ানো চলে না। শুধু শেষ কথাটা
ব’লে যায়--- ম্যাম, একটা কথা ব’লে যাই। একটু আমাদের মতো সৌজন্যহীন মানুষদের সাথে একটু
মেলামেশা ক’রে দেখবেন, খুব একটা সৌজন্যহীন নই আমরা।
চলি।
ব’লে বাইক পিক আপে
তুলে এক তাল নীলচে ধোঁয়া ছেঁড়ে দিয়ে হুস্ ক’রে বেরিয়ে যায় দীপ্ত। প্রায় সকালের মতো বনলতাকে আরো খানিকটা রাগিয়ে দিয়ে চ’লে যায়।
কোনো কোনো দুপুর, কোনো কোনো রাত, এমনকি কোন কোনো ঋতু পর্যন্ত
কোনো কোনো মানুষের মনটাকে নিয়ে যা তা খেলা খেলে। মনটাকে কেমন যেন খারাপ ক’রে দ্যায়। ভালো কথাও ভালো লাগে না সেই সময়। কেউ কিছু না ব’ললেই যেন ভালো হয়। আজও দীপ্তর মনটা হয়তো তেমনই ছিলো। ঝোঁকের
মাথায় কিছুদূর এসে মনে হয়, এ্যাতোটা কঠিন না হ’লেও হ’তো। কেন যে ও এমন কঠিন হ’য়ে যায় মাঝে মাঝে, ও নিজেই বুঝতে পারে না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ
ক’রতে পারেনা। ব’লেও ফেলবে কঠিন কথা, আবার পরে তার জন্যে মন খারাপও লাগবে।
কিন্তু স্বভাব যায় না ম’লে। বার বার নিজের
কাছে প্রমিস ভেঙ্গে ফ্যালে দীপ্ত। তাই বাইকটা ঘুরিয়ে নেয় আবার। কিন্তু গিয়ে দেখলো,
মহিলাটি নেই। নিশ্চয়ই চ’লে গেছে। মনে মনে
ঠিক করে, পরে একদিন না হয় ক্ষমা চেয়ে নেবে। আবার বাইক ঘুরিয়ে রওয়ানা দ্যায় রবির
বাড়ির দিকে। বাড়িতে যেতে হয় না। রাস্তাতেই দ্যাখা হ’য়ে যায়। চা-এর দোকানে এখনও ব’সে ওরা। এ্যাতো
বেলাতেও বাড়ি যায় নি। ফের রাগ হয়। একটা ধমক দ্যায় ওদের,
--- কী রে, তোদের বাড়ির লোকগুলোর কি খেয়ে ব’সে কাজ নেই? তোদের ভাত আগলে নিয়ে ব’সে থাকবে?
সবাই একটু ঘাবড়েই যায়। এমনভাবে দীপ্ত দার সঙ্গে দেখা হবে,
ভাবেইনি ওরা। দীপ্ত মনে মনে ঠিক ক’রে নেয়, রবিকে খবরটা
গোপনে দিতে হবে। ভালো খবর অন্যের মনে বিপরীত প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে। সকলের
অবস্থাই তো ঝুলন্ত। এদের একটা ছেলেও তো কোন এস.সি. কোটায় নেই। সব জেনারেল। তাই রবিকে ডাকে,
--- রবি, এদিকে আয় তো একবার।
এমনিতে রবির সকলের ওপর খুব হম্বি-তম্বি। কিন্তু দীপ্ত দার
সামনে সব গরুচোর। তাই চোরের মতোই রবি আসে। যেন কোন বিরাট অপরাধ ও ক’রে ফেলেছে।
--- আমি যা বোলব, তাতে লাফালাফি ক’রবি না। চুপচাপ শুনবি। ওয়ার্নিং দ্যায় দীপ্ত।
রবি কোন জবাব দ্যায় না। চুপ ক’রে মাথা নাড়ে। দীপ্ত নিচু স্বরে জানায়--- তোর শিকে বোধহয়
ছিঁড়ল রে। তোরা কেসে জিতে গেছিস। এগ্রিকালচারে তোদের চাকরীটা বোধহয় হ’য়ে গেলো। এখন কিন্তু কাউকে কিছু বলা যাবে না। আগে ব্যাপারটা
ফাইনাল হোক। আমি লোক লাগিয়েছি। এখন চুপচাপ বাড়ি চ’লে যা।
আবার মাথা নাড়ে রবি। যেন বাধ্য ছেলে। হঠাৎ রবিকে আবার
জিজ্ঞাসা করে--- হ্যাঁরে, বটতলায় ঐ ছেলেগুলোকে সকালে তুই কী বললি রে? ওরা যে
ছুটছাট ভেগে গেলো?
রবি বেকায়দায় পড়ে। ব’লতে বাধ্য হয়--- ও কিছু না। তুমি বাড়ি যাও তো। দুটো বাজে। তুতু তো ব’সে আছে তোমার জন্যে। তাছাড়া তোমার তো আবার চারটেতে ক্লাশ,
নাকি?
--- বল্ না, ব্যাটা। কী বললি। চেপে ধরে দীপ্ত।
ব্যাজার মুখ ক’রে রবি জানায়--- বললাম, বেশি তেল দেখাস না। দীপ্ত দা কিন্তু ব্ল্যাক বেল্ট।
ব্যস্। আর কিছু না।
--- ওভাবে মস্তানিটা প্রচার না ক’রলেই কি চ’লছিলো না, না রে?
--- মস্তানি কেন? ভেবে দ্যাখো, দীপ্ত দা। আমি ভালোই ক’রেছি। তোমাকে ওরা নিশ্চয়ই চেনে না। আজকাল-কার ছোঁরা তো। ওরা
আরো মস্তানি মারতো আর তোমার হাতে আলটিমেটলি মার খেতোই। আমি ওদের বাঁচিয়েই দিলাম।
বলো। রবি সাফাই দ্যায়।
--- খুব পেকেছিস! যা। শাসন করে রবিকে। এবার চেঁচিয়ে ডাকে
দীপ্ত--- এই সন্তু!
সচকিত হয় সন্তু নামে আর একটি ছেলে। সন্তু অন্য পাড়া থেকে
মাঝে মাঝে এসে বসে এই অঞ্চলে। দীপ্ত শুনতে পায় না, সন্তু বিড় বিড় ক’রে ব’ললো, ‘কেলো ক’রেছে! আমাকে
ক্যালাবে নাকি রে বিশু?’ কিন্তু দীপ্ত ওকে
পরিষ্কার জানায়,
--- তোকে আজকাল স্টেশন রোডে আড্ডা মারতে দ্যাখা যায় কেন রে?
কী ব্যাপার? সন্তু ততক্ষণে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের বিভীষিকা দীপ্ত দার
সামনে। দীপ্ত ওর কান টেনে ধ’রে বলে--- খুব
দাদা হ’য়েছো না? আর একদিন স্টেশন রোডে দেখবো, তো
চুলের মুঠি ধ’রে তুলে নিয়ে আসবো
পাড়ায়। এই দোকানে বসাও বন্ধ ক’রে দেবো।
মাথা নিচু ক’রে মেনে নেয়
সন্তুর মতো ক্ষেপাটে ছেলে। দীপ্ত দাকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। না মেনে ওর কোনো উপায়
নেই। যা ব’ললো লোকটা, তাই ক’রে ব’সবেখন। ঘাড় কাত
করে তাই। বাধ্য সন্তানের মতো বলে--- আমি তেমন যাই না, দীপ্ত দা। মাইরি!
মাথা গরম করার ভান করে দীপ্ত। বলে--- কথা বাড়াবি না। আমার
নেটওয়ার্ক ব’লছে, তুই ওখানে ব’সিস। যা ব’লছি, শোন চুপচাপ।
সামনের সপ্তাহের মধ্যে আমার লাইনের জনা পনেরো ছেলে চাই। স্টেশন রোডে একটু দাবাই
দিয়ে আসতে হবে। যদি না পেয়েছি, তবে আমার স্টুডেন্টসরা অপারেশনে যাবে কিন্তু। আর
জানিস তো, আমি কোন এম.এল.এ, এম.পি, পার্টি, নেতার ধার ধারি না। মনে থাকে যেন। সামনের সপ্তাহে।
সন্তু বুঝলো, এর অন্যথা হ’লে আর কিছু না হোক, ওর সাড়ে সর্বনাশ। তাই মাথা হেলিয়ে সায় দিলো।
এবার দীপ্ত অতো বড়ো দানবের মতো বাইকটাকে ময়ূরের পালকের মতো
হাল্কা চালে ঘুরিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায়। সন্তু বলে,
--- শালা ঝড় ব’ইয়ে দ্যায়।
রবি বলে--- ঝড়টাই দেখলি! মনটা দেখলি না!
নান্টু মন্তব্য ক’রলো--- কাজে-অকাজে সেই দীপ্ত রায়কেই তো লাগে সবার, শালা। তখন তো এই ঝড়টাই কাজ
করে রে। মনে নেই, তোদের বাড়িতে ভাড়াটে তোলা নিয়ে কী ক্যাচাল হ’য়েছিলো? কে সামলালো? ওই ঝড়টাই তো। তাই শুধু ঝড় না ব’লে বল ‘সাইক্লোন’।
------------------------
এইসব বিহঙ্গেরা
পরিচ্ছেদ – ৬
সবে ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোবে পারমিতা, এমন সময় গেটের পাশ
থেকে কে যেন ব’লে উঠলো,
--- হ্যালো! একটু কথা ছিলো।
দাঁড়িয়ে প’ড়েছে পারমিতা।
বুঝতে পেরেছে, কে ডাকছে। এ গলাটা তো ওর অচেনা নয়। কিন্তু পেছন তাকায়নি ও। মাথাটা
নিচু ক’রে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো। আজকে তোড়ারা চ’লে গেছে আগে। পারমিতার লাইব্রেরিতে কিছু নোট নেবার কথা
ছিলো। তাই ওদেরকে ও ব’লেও দিয়েছে আগে চ’লে যেতে। তাতে ওদের কিছু যায় আসে না হয়তো। আসলে ওরা ওকে
তেমন পাত্তা না দিলেও পারমিতা কেন জানি
প্রায় বেহায়ার মতো ওদের সঙ্গেই লেগে থাকে। এই কারণেই আজ ও একা। এবার গেটের পেছন
থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে রনি।
রণি ইউনিভারসিটির যেমন গুণ্ডা কে গুন্ডা, তেমনি বিগত পঞ্চাশ
বছরে ইউনিভার্সিটি-তে এমন মেধাবী ছাত্র আসেনি। ও ফিজিক্স ডিপারটমেন্টের ছেলে। তাই
শুধু নয়, রনির চেহারা বেশ আতঙ্কজনক। ও ভালো মতো শরীর চর্চা করে। ও যে ইউনিভারসিটির
পাণ্ডা, তার জন্যে ওর যথেষ্ট যোগ্যতা আছে। ওর ফিজিক আর মেরিট--- দুই-ই ওকে
ইউনিভারসিটির পাণ্ডা ক’রে তুলেছে। রনির
পুরো নাম রণজয় চৌধুরী।
ওর গলা শুনে পারমিতা আবার কাঁপতে শুরু ক’রেছে থর থর ক’রে। ভেতরে ভেতরে ঘেমে এক্সা হ’চ্ছে পারমিতা।
সেদিন যা ঘ’টেছে, তাতে ছেলেটার সামনে মাথা তুলে
দাঁড়াবার মতো অবস্থা নেই ওর। ভাগ্যিস ওরা দুজনে একই ডিপার্টমেন্টের নয়। মনে মনে
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দ্যায় পারমিতা। ঘটনাটা কাউকে ব’লতে পারে নি ও। ব’লেও কোন লাভ নেই।
কেউ মেনে নেবে না। বিশ্বাস ক’রবে না। এক নম্বর
কারণ, রনির ওপরে কোন ছেলে কথা ব’লবে না। দুই,
প্রফেসররা তো বিশ্বাস ক’রবে না, রণজয়
এমনটা ক’রতে পারে। ওর এমন কোন রেকর্ড নেই।
স্টুডেন্ট হিসেবে ইউনিভারসিটিতে রনির যে রেকর্ড, তাতে পারমিতাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ক’রে দেবার যথেষ্ট কারণ আছে। পারমিতার রেকর্ড তো ওর
ক্লাশমেট-দের কাছেই ভালো নয়। কিন্তু কেউই তো জানে না, এইসব ভালো ছেলেরা এমন কিছু ক’রতে পারে, বা করে বসে, যা সাধারণ স্তরের ছেলেমেয়েরা স্বপ্ন
দেখতেও পারে না, ক’রতে তো ভয় পায়ই।
ভালো ছেলেদের তো হারাবার কোন ভয় নেই। বাজারে তাদের বেশ ভালো ইম্প্রেশন। ফলে তাদের
নামে কোনো কমপ্লেইন্ট জানালে মানুষ ব’লবে, ‘হতেই পারে না। রনি! ভ্যাট। আজগুবি কথা
বলিস না। একটা আর্টিফিশিয়াল স্ক্যান্ডাল ছড়াচ্ছিস।’
ফলে ওদের তো পোয়াবারো। তাই তো এমনটা ঘটালো রনি। কৈ? অন্য
কোন ছেলে তো কোনদিন এমনটা ক’রতে সাহস পেলো না।
তোড়া বা রমিতা সেদিন শুধু নয়, মাঝে মাঝেই ওরা বলে পারমিতার ড্রেস নিয়ে। পারমিতা
ইউনিভারসিটিতে আসে জিন্স আর পাঞ্জাবি প’রে। অনেকেই আসে কিন্তু পারমিতা সাধারণত আদ্দি আর হ্যান্ডলুম পরে। তার মানে এই
নয় যে, সে মোটেই শাড়ি-টারি পরে না। অবশ্যই পরে। তবে অকেশনাল। সবাই হয়তো ভাবে, এটা
ওর একটা ইয়ুথ ডিসপ্লে। কিন্তু সেটা একদম মিথ্যে না হ’লেও সেটাই একমাত্র কারণ নয়। বাড়িতে শুধু দিদা। ফলে সেখানেও
ও ছেলেদের স্যান্ডো গেঞ্জি ব্যবহার করে। কেউ তো দেখার নেই। আসলে ওর এটাই হ্যাবিট।
মেডিক্যাল কারণ যে নেই, তা নয়। শীতকালেও ওকে ফ্যান চালিয়ে গায়ে ঢাকা দিয়ে ঘুমোতে
হয়, একটা জানলা খুলে রাখতে হয়। ডাক্তার ওকে ব’লেছেনও যাবতীয় ঠাণ্ডা খাবার খেতে। কিন্তু হটফুড বা ফাস্টফুড দেখলে যে পারমিতার
নাল ঝরে। মাঝে মাঝে দিদাও রেগে যায়। বলে,
--- কীরে তুই! তোর কি একটু লজ্জা-শরম নেই, নাকি! এ রকম হাতা
কাটা গেঞ্জি প’রে থাকিস? এদিক
থেকে বেরিয়ে থাকে, ওদিক থেকে বেরিয়ে থাকে।
পারমিতা খিল খিল ক’রে হেসে বলে দিদাকে--- তাতে কী! ও তোমার যা আছে, আমারও তাই আছে। তাতে এতো
লজ্জা পাবার কী আছে?
--- তাই ব’লে তুই তা ঢেকে
ঢুকে রাখবি না! এইভাবে আমার সামনে ঘুরবি! বাবা-মা’র সামনে ঘুরতে পারতিস?
--- পারতাম না ব’লেই তো তোমার সাথে থাকি, সোনা। আমার পাক্কু সোনা। ব’লে দিদাকে আদর করে পারমিতা। কিন্তু দিদার সাবধান বাক্য বা
তোড়াদের বিদ্রূপ না শুনে যে পরিণামটা ও ফেস ক’রেছে, তাতে রনির ডাক শুনে ঘাবড়াবার তো কথাই বটে। ডাকটা শোনামাত্রই কাঠ হ’য়ে দাঁড়িয়ে প’ড়েছে পারমিতা। রনি বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় পারমিতার সামনে। কিন্তু বেশ বুঝতে পারে,
এ রনি তো সেই রনি নয়। কোথায় সেই অহংকার? কোথায় সেই বীরদর্প! কেমন যেন গুটিয়ে গেছে ছেলেটা! মাথা নিচু ক’রে দাঁড়িয়ে বলে,
--- আমি কি ক্ষমা চাইতে পারি? আমার কি সেই অধিকার আছে?
পারমিতা চুপ। কী ব’লবে ও? ব্যাপারটা দেখে শুনে ও তো হতবাক। এসব কী ব’লছে রনি! ওর কি মাথা-টাথা খারাপ হোল! নাকি ওর ওপরে
বিবেকানন্দ ভড় ক’রেছে।
পারমিতাকে চুপ থাকতে দেখে রনি আবার বলে--- আপনি তো কিছু না
ব’ললে আমি নিজেকেই মাফ ক’রতে পারছি না। যদিও আমি জানি, আমি যা ক’রেছি, তার কোন মাফ হয় না। একজন মেয়ে তো কখনই এই কাজকে মাফ ক’রতে পারবে না। তবু আমি তো ক্ষমা চাইছি। ক্ষমাপ্রার্থীকে তো
শুধু মেয়েরাই ক্ষমা ক’রতে পারে। আমি
ক্ষমা চাইছি। প্লীজ, অন্তত মাথা নেড়ে একটা সিগনাল দিন।
এবার পারমিতা বাধ্য হ’য়ে মাথা হেলিয়ে রনির ভাষায় সিগনাল দিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে গেল। মনে মনে
ভাবে পারমিতা, ক্ষমা ক’রবে নাই বা কেন!
রনি যা ক’রেছে, তা শুধু ওর পক্ষেই করা সম্ভব। আর
যা ও করেনি, তাও শুধু ওর পক্ষেই না করা সম্ভব। পারমিতার সিগনাল পেয়ে আর ওকে এগিয়ে
যেতে দেখে সাথে সাথে রনি জানায়,
--- ম্যাডাম, আমায় যে আপনি কী অবস্থা থেকে বাঁচালেন, তা
আপনি জানেন না। এই দেখুন।
ব’লে রনি ওর জামার
হাতা তুলে যা দেখালো, তা দেখার জন্যে পারমিতা মোটেই তৈরী ছিল না। রনি একটা ব্লেড
দিয়ে ওর হাতের কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত চিরে চিরে ফেলেছে দু থেকে তিনবার। সেটা
দেখিয়ে আবার ব’লল,
--- নিজেকে বিরাট একটা কোন শাস্তি না দিয়ে শান্তি পাচ্ছিলাম
না।
দৃশ্যটা দেখে শিউরে উঠেছে পারমিতা। কী ক’রে একটা মানুষ এভাবে নিজেকে নিজে শাস্তি দিতে পারে, ও ভেবে
পায় না। এতো সেই ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের মানিকলাল চরিত্র, যে নিজের আঙ্গুল কেটে
দস্যুবৃত্তির শাস্তি নিয়েছিলো নিজেই। এটাও বুঝলো পারমিতা যে, রনি সবই পারে।
পরীক্ষায় টপ ক’রতেও পারে, কাউকে মেরে
নাক-মুখ ফাটিয়েও দিতে পারে, আবার অন্যায় ক’রে ক্ষমাও চাইতে পারে। ওর কোয়ালিটি আছে। এবার পারমিতা ধীরে আবার গেটের দিকে
হাঁটা দ্যায়। এখান থেকে যেতে পারলে যেন ও বাঁচে। একটা মেয়ের পক্ষে ঐ ঘটনা ঘটার পর
সেই ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কতটা অস্বস্তিকর, সেটা একজন মেয়েই অনুধাবন ক’রতে পারে। রনির যতই কোয়ালিটি থাকুক, মেয়েকে বুঝতে হ’লে তো ওকে মেয়ে হ’য়ে বুঝতে হবে। অন্তত সেটা তো রনি পারবে না। কিন্তু ওকে রনি আবার ডেকে দাঁড়
করায়। বলে,
--- পেছন ডাকলাম ব’লে কিছু মনে ক’রবেন না। একটা কথা
বোলব?
পারমিতা একজন নারী। পুরুষের দৃষ্টিকে নারী যদি বুঝতে চায়,
তবে তার পক্ষে তা তেমন বড়ো খেলা নয়। এটা নারীর জন্মগত গুন। যার এ গুন নেই, সে
দুর্ভাগা। তার কপালে অনেক দুর্গতি হ’তে পারে। তাই পারমিতা বুঝে নিলো, রনিকে এই মুহূর্তেই কাৎ করা যায়। ওকে কাৎ করা
ছাড়া অন্য কোন অপশন খোলা নেই পারমিতার কাছে। যা ওর দেখার নয়, তা ও দেখে ফেলেছে।
অনধিকার দৃশ্য। জীবনে কেবল একটি পুরুষই পায় সেই অধিকার। সেটা দায় ওকেই গছাতে হবে।
একটা মেয়ের এরপর নিজস্ব আর কী থাকে! তাছাড়া রনি ভালো ছেলে তো বটেই। ওর ভবিষ্যৎ
যথেষ্ট উজ্জ্বল। তাই এবার পারমিতা কথা বলে,
--- বলুন।
--- যদি কিছু মনে না করেন, আমরা কি বন্ধু হ’তে পারি না?
এটা বুঝতে পারে পারমিতা যে, রনিকে আর কোন বিশেষ চেষ্টা
ছাড়াই কাৎ করা যাবে। ও অলরেডি কাৎ হ’য়েই আছে। অথবা ও প্রায়শ্চিত্ত ক’রতে চাইছে। অথবা একটা ক্ষতিপূরণ ক’রতে চাইছে। তাই পারমিতা নিজে এক কদম এগিয়ে জিজ্ঞেস ক’রলো,
--- শুধু বন্ধুত্ব তো?
মনে মনে এমনিতেই দগ্ধ হ’চ্ছিলো রণজয়। যা ও ক’রতে চায়নি, একটা
নেশা লেগে যেতে তা ও ক’রে ব’সেছে। এটা অন্যায়। কিন্তু পারমিতাকে কথাটুকু ব’লতে দেখে অনেকটা হাল্কা হয় ও। অনেকটা নিশ্চিন্ত হ’য়ে বলে--- এখন তো দিটেল্স বলতে পারবো না। সেটা পরে বিচার ক’রে দেখে নেবোখন আমরা। শুধু সেই দিনটা আমরা ভুলে যাবো। রাজী?
--- ওক্কে। আমি রাজী।
--- তাহলে এই ফ্রেন্ডশিপটা সেলিব্রেট করা যায় না?
--- সেলিব্রেট? কীভাবে? সেটা তো শুনি।
--- এই একটু কোথাও যদি ঘুরে আসি। আপনার কি অসুবিধে হবে?
--- তা হবে না? আমাকে তো বাড়ি যেতে হবে। বাড়ির লোক ভাববে না
বুঝি?
--- আমি পৌঁছে দেবো...। ব’লেই জিভ কাটে রনি। আবার নিজেকে সংশোধন ক’রে বলে--- আসলে আমি না মেয়েদের সাথে ঠিক কথা ব’লতে জানি না। আমার তো কোন গার্লফ্রেন্ড নেই। আমাকে তো সবাই ভয় পায়। বন্ধুত্ব
করে না। আপনিই প্রথম, আমাকে ভয় পেলেন না। আসলে আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে, তবে
আপনাকে দেরী হ’লে বাড়ি পৌঁছে
দিতে পারি।
পারমিতা বেশ বোঝে যে, প্রেম মানুষের জীবনে কীভাবে আসে, কেউ
ব’লতে পারে না। পারমিতা বা রনি কি
বুঝেছিলো, এমন একটা অভাবনীয় ঘটনা থেকে ওদের মধ্যে এমন একটা সম্পর্ক এসে যেতে পারে?
অবশ্য এখনও পারমিতা আর রনির মধ্যে তেমন কিছু গ’ড়ে উঠতে পারে নি। সে অবস্থারও সৃষ্টিও হয় নি। কিন্তু ওর কিছু করার নেই ব’লেই ওকে চেষ্টা ক’রতে হবে। তবে রনি অমন ঘটনা ঘ’টিয়ে ফলেই প্রেমে
প’ড়ে গেছে। তাই ও জানতে চায়,
--- কোথায়? কতদূর?
রনি
ভাবতেই পারেনি যে, ঠাস্ করে একটা চড়ের পরিবর্তে এমন একটা ইতিবাচক প্রশ্ন আসবে।
মার দাঙ্গা অনেক ক’রেছে ও। করেও। নাক
ও টাক ফাটিয়ে দেওয়া ওর কাছে একটা খেলার বিষয়। কিন্তু কোন মেয়ে নিয়ে ক্যাচালে এই তো
প্রথম। মেয়েদেরকে নিয়ে আজ পর্যন্ত ওর বাইকে তুলে কোথাও যায় নি। এই প্রথম। বেশ
ভালো লাগছিলো একটা মেয়ের সাথে কথা ব’লতে। সেদিন চপলরা ওর মাথাটা গরম ক’রে দিয়েছিলো। তা নয়তো এসব ওর নিজের মাথাতেও আসেনি। শুধু একটু ভয় দেখাতে গিয়ে
অনেকটা দূর চ’লে গিয়েছিলো।
নিজেকে সামলাতে পারেনি। সামলেছে একেবারে শেষে। তখন তো ড্রপ সিন ফেলা প্রায় ওর
নিজেরই হাতের বাইরে । তাই আজকে আবেগে বলে,
--- কোথাও একটা। বলুন না কোনো একটা জায়গা। ঐ যে মেয়েরা
ছেলেদের সাথে যায় না? ফুচকা-টুচকাও তো খেয়ে আসতে পারি, নাকি?
--- তাই! বলে পারমিতা। আমি কিন্তু টাকা-পয়সা সেরকম আনিনি।
আজকে আপনি দিন। পরের দিন আমি দেবো।
ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয় রনি। তাহলে পরের দিনেও বেরনো হবে।
তাই মহানন্দে ব’লে দিলো--- সেকি,
আপনি কেন পার্সে হাত দেবেন! আমি তো আছি। নো চিন্তা।
এটুকু কথা বলে অনেকটা সহজ হয় পারমিতা। তড়বড় ক’রে বলে--- বাবা, আপনি তো বেশ ম্যাস্কুলেনিস্ট! আপনি আছেন ব’লে আমি পার্সে হাত দেবো না! সেটা কী কথা! আজকাল ওসব চলে না,
স্যার। আগে তো চলুন।
সকলের অলক্ষে ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েই ওরা বাস ধরে নেয়
যেটা সামনে আসে। যেখানে খুশি নেমে যাবে। বিশেষ কোথাও যাবার তাড়া নেই ওদের। সোজা
পাঁচটা স্টপেজ ছেড়ে ওরা গিয়ে নামে রবীন্দ্র ভবনের সামনে। কল্যাণীর কি একটা গ্রুপের
নাটক চ’লছে? রনি জিজ্ঞাসা করে,
--- নাটক দেখবেন?
--- নাটক! এই সময়?
--- কেন? এটা তো বিকেল। নাটক তো বিকেলেই হয়।
--- না, মানে আমি সকাল বিকেল ব’লছি না। আমরা আজকে আমাদের বন্ধুত্ব সেলিব্রেট ক’রতে এসেছি। আর দেখবো নাটক! একেবারে মুখে দরজা দিয়ে? কী
জ্বালা! এটুকু ব’লেই পারমিতা সুর
পালটে বলে--- আচ্ছা, আমরা ‘দেখবেন’, ‘যাবেন’, ‘মাপ করবেন’--- এসব ব’লছি কেন! এসব কি
বন্ধুত্বের সম্বোধন?
তোতলায় রনি--- না... মানে আমি খুব ভয় পেয়েই ব’লিনি। ভয়ে ভয়ে তো ‘আপনি’ ব’লছিলাম।
--- হ্যাঁ, কত ভীতু আপনি! ভয়ে একেবারে কাঁপছেন।
রনি অকপটে জানায়--- না না, সত্যি। আমি খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম।
বর্ষাকালে দামোদরের সামনে দাঁড়িয়ে দেখবে, কেমন লাগে। দারুণ, কিন্তু ভয় লাগে।
--- এই তো বেশ। দিব্যি ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ তে নেমে এসেছো।
চমকে তাকায় রনি। ঘাবড়ে গিয়ে বলে--- আমি ‘তুমি’ ব’লে দিয়েছি, না?
--- এবার বল তো। যদি মনে এ্যাতো ভয়, তাহলে ওরকম অসভ্যতা ক’রলে কেন। কপট ধমক দ্যায় পারমিতা।
--- আসলে মাথাটা না কেমন যেন খারাপ হ’য়ে গেলো।
--- মাথাটা কি খারাপ হ’লো আমাকে দেখে? নাকি অন্য কারণে?
--- না না। তা নয়। প্ররোচনা।
--- তাহলে ভয়টা কীসের হোল?
--- ভয় হবে না! তুমি যদি কমপ্লেইন্ট ঠুকে দাও! আজকাল
আইন-কানুন খুব খারাপ। আমার তো কেরিয়ার খতম হ’য়ে যেতো। একটা কেরিয়ার বানাতে কত সময় লাগে! আর একটা দাগে সব শেষ হ’য়ে যেতো। চপল, সুমিত ওদের পক্ষে এসব কেরিয়ার ফেরিয়ার কোন
ব্যাপার নয়। কিন্তু আমায় তো একটা কিছু ক’রতে হবে। আমার মা আমাকে কোলে নিয়ে বিধবা হ’য়েছে। অনেক কষ্ট ক’রে আমাকে মানুষ ক’রেছে। কোনো অভাব বুঝতে দ্যায় নি। মা-কে তো আমায়ই একটু
সুখ-সাচ্ছন্দ দিতে হবে। তোমার নালিশে সব শেষ হ’য়ে যেতো। মা এসব জানলে ম’রে যেতো। তোমাকে
আমি মনেপ্রাণে ধন্যবাদ দিই, তুমি আমার মা-কে বাঁচিয়ে দিয়েছো। মা-র মুখটা মনে প’ড়তেই আমি বুঝতে পারলাম, আমি ভুল ক’রছি।
পারমিতা সান্ত্বনা দেবার অছিলায় ব’লল--- হ্যাঁ, আমার কথায় যেন কেউ বিশ্বাস ক’রতো। রণজয় চৌধুরী ইউনিভারিসিটির টপার। সে কোন খারাপ কাজ ক’রতে পারে, কে মানবে বলো? আমাকেই নানা কথা শুনতে হোতো। তবে
এই শেষ কিন্তু। যদি দেখি, অন্য কোন মেয়েকে শাস্তি দেবার জন্যে এসব ক’রেছো, তবে তোমাকে সত্যিই শেষ ক’রে দেবো।
--- যথা আজ্ঞা দেবী। ব’লে কান ধরে রনি। সঙ্গে সঙ্গে পারমিতাকেও বলে--- কিন্তু তোমাকেও কথা দিতে হবে।
তুমি আর কোনদিন ওরকম ড্রেস প’রে ইউনিভারসিটিতে
আসবে না। জানো, এটা আমি না হ’লে, অন্যও কেউ হ’লে কী হতো? তোমার সর্বনাশ।
--- ভালোই হতো। তাহলে আমি আজকে অন্য একটা ছেলের সাথে ফ্রেন্ডসিপ
ক’রে এখানে বেড়াতে আসতাম।
হঠাৎ ক্ষেপে ওঠে রনি--- সরি। তখন কেউ আর এই রনির মতো
ক্ষমা-টমা চাইতো না। সোজা হাত ধুয়ে ফেলতো। প্রমিস করো, এসব ড্রেস প’রে ইউনিভার্সিটিতে আসবে না। বলো ‘প্রমিস’?
--- ওক্কে। প্রমিস। তবে আমি বোরখা প’রতে পারবো না কিন্তু।
থিয়েটারে না গিয়ে ওরা বসে একটা রেস্তোরায়। রেস্তোরাটা খুব
বিখ্যাত। রনিই অর্ডার দ্যায়--- দুটো চিকেন হাক্কা চাওমিন আর দুটো কোক।
পারমিতা রেস্তরায় তেমন যায় না। তাই বলে--- হাক্কা চাওমিন!
সেটা কী গো? চাউমিন শুনেছি। কিন্তু হাক্কা চাউমীন... কে জানে কী।
--- দেখোনা। হ্যাভ ফেইথ অন মি। কোক দিয়ে একটু একটু ক’রে খাবে। হেভি।
পারমিতা আবার রসিকতা করে--- তুমি অন্য ছেলের কথা শুনে হঠাৎ রেগে গেলে কেন?
--- ও সব আজেবাজে কথা শুনলে কার না মাথা গরম হয়!
--- কেন? মাথা গরম হবে কেন?
--- কত জনের সাথে ঘুরবে তুমি? কতজন?
--- কেন? তোমার কি একটাই বন্ধু নাকি? কৈ! আমি তো কিছু ব’লছি না! চালাকি করে পারমিতা।
কৈফিয়ত দ্যায় রনি--- আজ্ঞে না। একজনই আছে। মেয়ে বন্ধু তো
একজনই। দেন হোয়াই শুড ইউ হ্যাভ মোর? যদি কেউ তোমার গায়ের কাছেও আসে, আই উইল কিল
হিম, পারমিতা। আই প্রমিস।
ব্যঙ্গ করে পারমিতা--- বাবা! পসেজিভনেস!
--- হ্যাঁ, ভালোবাসার অপর নাম।
--- তাহলে কি আমার ঐ অবস্থাটাই তোমার ভালোবাসা!
মেয়েদের মতো মাথা নিচু করে রনি। চুপ ক’রে থাকে। পারমিতা বুঝতে পারে, রনি ঐ দিনের ঘটনাটা ভুলতে
পারেনি। হয়। কারোর কারোর জীবনে কোন কোন ঘটনা এমন একটা রেখাপাত ক’রে যায় যে, তাকে ভুলতে পারা সম্ভব হয় না। এমন একটা ঘটনাই তো
পারমিতার নিজের মা-র জীবনে ঘ’টেছে।
ওর মা বিয়ের আগে একটা ছেলেকে ভালোবাসতো। অবশেষে সাহস ক’রে একদিন নিজের মার কাছে ব’লে ফেললেও জোর ক’রতে পারে নি। সে
তো আর আজকের সময় নয়। সে সময় মেয়েরা আজকের মতো এ্যাতোটা ডেসপারেট ছিল না। বিশেষ ক’রে গ্রাম-গঞ্জে তো নয়ই। মায়ের প্রেম কেউ মানেনি, কেউ
শোনেনি। বাড়ি থেকে জোর ক’রে বাবার সঙ্গে
বিয়ে দিয়েছে মায়ের। পারমিতা জানে, ওর বাবা কোনো আহামরি নয়। কিন্তু তখনকার রীতিই
ছিল--- বিয়ে ক’রে স্বামীকে ভালবাসা,
বা না-বাসা, সেটা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিন্তু বিয়ের আগে ভালোবাসা কিছুতেই চ’লবে না। ওটা অশ্লীল আর অসামাজিক। স্বামীর সাথে ভালোবাসা তো
কোনো কোনো পরিবারের পুরুষ বা নারীরা কল্পনাই ক’রতে পারতো না। স্বামীর সাথে রঙ্গ, রসিকতা ইত্যাদি নিষিদ্ধ। স্বামী তো প্রভু।।
প্রনম্য। সে শুধু তোমাকে আশ্রয় ক’রে সন্তানের জন্ম
দেবে। এইতো তোমাদের দাম্পত্য জীবানের একমাত্র ঐহিক সম্বন্ধ। তাই তোমাকে আনা হ’য়েছে। তুমি সেই সন্তান বহন ক’রবে। তুমি তো তাতেই ধন্য। গ্রন্থে কে কী লিখেছেন, সেটা বড়ো বিষয় নয়। এসব কোন
কোনো পরিবারের নিজস্ব অলিখিত অ অনিবার্য নিদান। অবশ্য আজকের অনেক শিক্ষিত বাড়ির
মহিলারাও এমন কথা বিশ্বাস করে যে, মা হওয়াই তার জীবনে পরম প্রাপ্তির বিষয়। অনেক
পরিবারে স্বামীর মায়েরা তো ছেলেকে তার স্ত্রীর কাছে নৈশকালে পাঠাতো শুধু তার সাথে
শোবারই জন্যে। কিন্তু স্বামীর সাথে ভ্রমণ বা বিহার অত্যন্ত গর্হিত।
পারমিতা জানে, ওর মাকে হয়তো চোখ মুছতে মুছতে একটা অন্য
পুরুষের জীবনসঙ্গিনী নয়, অঙ্কশায়িনী হ’য়ে আর নিজের ঈপ্সিত মানুষটাকে মনের মধ্যে চেপে ধ’রে বাড়ি ছেড়ে চ’লে গিয়েছে। সত্যি এমন ক’রে ঝুলিয়ে দেওয়াকে
কি জীবনসঙ্গিনী হওয়া বলে! ভদ্র ভাষায় ব’ললে ব’লতে হবে, কেবল সংসারসঙ্গিনী। মেয়েদের যে
কতোটা ধইর্য রাখতে হয়, মাকে দেখলে বুঝতে পারতো পারমিতা। কিন্তু মা সেই চিঠিগুলো
ফেলে দেয়নি। মা-র মন থেকে মা-র পুরনো প্রেমিক বোধহয় মোটেই মুছে যায় নি।
তখন পারমিতা ছোট। ছোট ব’লতে খুবই ছোট। প্রেম-ভালবাসা কিছুই বোঝার বয়স নয় সেটা। ও শুধু মা-কে প’ড়তে দেখেছে চিঠিগুলো। মা একটা লাল পুটুলিতে বেঁধে রাখতো
চিঠিগুলো। মাঝ মাঝে বের ক’রে প’ড়তো। একদিন মা চিঠি প’ড়ছে। এমন সময় আচমকা বাবা চ’লে আসে অফিস থেকে।
সেটা বাবার ফিরে আসবার সময় ছিল না। মা সাত তাড়াতাড়ি চিঠিগুলোকে পুটুলিতে ঢুকিয়ে
দ্যায়। তারপর আলমারিতে রেখে ছুটে আসে জানতে, বাবা এমন অসময়ে ফিরলো কেন। কিন্তু
মা-র অলক্ষ্যে একটা চিঠি প’ড়েই থাকে মাটিতে।
চিঠিগুলোকে চিনতো পারমিতা। ফলে মা-র বিরাট উপকার ক’রতে গিয়ে সেই চিঠি বাবার সামনেই মা-কে এনে দ্যায় পারমিতা। এর চেয়ে যে মা-কে
একপাত্র সেঁকোবিষ এনে খাওয়ানো ছিলো ভালো, তা তো বোঝার বয়স নয় তার। মা-র অপরাধ হ’য়েছে মেয়েকে ছোট দেখে তার সামনে চিঠিগুলো পড়া। শিশুর মনে যে
তা কী প্রতিক্রিয়া হ’তে পারে, তা মা
যদি ভাবতো, তবে কি পারমিতাকে দিদার কাছে এসে থাকতে হয়!
এরপর থেকে মা-র সাথে বাবার নিয়ত বিবাদ, কলহ, এমনকি হাতাহাতি
শুরু হ’য়ে গেলো। মা ইচ্ছে ক’রলেই বাবাকে ঘোল খাওয়াতে পারতো। কিন্তু মা পারেনি। কেন? কে
জানে। বড়ো হ’য়ে একদিন পারমিতা
এতো বিবাদের জন্যে মা-কে চারকথা শুনিয়ে দিয়েছে। পারমিতা থোরি জানতো যে, সে নিজেই
এই বিবাদের কারণ। তখন মা ব’লেছে,
--- তুই-ই তো আমার ঘর ভেঙ্গেছিস। তুই সেই চিঠি আমাকে না
দিয়ে বাবার সামনে আমাকে দিতে গেলি কেন?
সেদিন পারমিতা জানতে পারে ঘটনাটা। জেনে সে হাত কামড়ায়
কিন্তু তখন হাতের ঢিল তো বেরিয়ে গেছে।। আর
তো সে ফিরবে না। ভুল করে অঙ্ক ক’ষে একবার যদি পরীক্ষকের সামনে দিয়ে দাও, তবে আর সেই খাতা সংশোধনের জন্যে ফিরে
পাবার কোনও চান্স থাকে না। সত্যি, মায়ের জীবনটা ও নিজে হাতেই ধ্বংস ক’রেছে। ওর দুঃখ হয়, ও যদি একটু বেশি পাকা হতো, যেমনটা ওর
অনেক সঙ্গী সাথি ছিল, তবে মায়ের সংসারটা ভাঙতো না। প্রথম প্রথম মা-কে মুখ দেখাতে
পারতো না মায়ের পারু। লজ্জা ক’রতো। মায়ের ঐ একটা
কথা ‘তুই আমার ঘর ভেঙ্গেছিস...’ স্রাজীবন বোধহয় ওকে তাড়িয়ে বেড়াবে। ঘর যে মায়ের কোনোদিন
ছিল না। যা ছিল, সেটা একটা শুধু বাড়ি, তা তো মা বোঝার মতো শিক্ষিত ছিলো না। ঘুমের
মধ্যেও মা যেন ওকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ব’লতো, ‘তুই আমার ঘর ভেঙ্গেছিস।’ যন্ত্রণায় ছটফট ক’রতো পারমিতা। মা বুঝলো না, তার মেয়ে শিশু। শিশু কী বোঝে এইসব জটিল সম্পর্কের
কথা! মা নিজের ঘরটাই দেখলো! শিশুর অবোধ মনের সন্ধান ক’রলো না, নিজের ভুলটি যে কোথায়, তা দেখলো না! তাই একদিন এই
দম বন্ধ করা অবস্থা থেকে অব্যাহতি পেতে ও পালিয়েছে আলিপুর দুয়ার থেকে। চ’লে এসেছে দিদার কাছে। মা-ও যেমন তার প্রেমিককে ভোলেনি,
তেমনি এ ঘটনাও পারমিতা ভোলেনি। সব তো ভোলা যায় না। আজও সে ঘটনা ওকে কুরে কুরে খায়।
রনিও হয়তো কোনদিন ভুলতে পারবে না সেই ঘটনা। পারমিতা খোঁচা দ্যায়,
--- সেদিন আমাকে ওভাবে পেয়েও ছেড়ে দিলে কেন? তুমি তো আমাকে
শাস্তি দিতে চেয়েছিলে।
মাথা নিচু ক’রে রনি ব’লেছে--- তাহলে আমাকে শাস্তি কে দিতো? লজ্জা থেকে মুক্তি
পেতে রনি আবার ব’ললো--- এখন খাবার
খাও তো। কফিটা ঠাণ্ডা মেরে যাবে।
ওদিনের কথা তুলে রনিকে বেশ অপ্রস্তুত করে দেওয়া যায়, বুঝলো
পারমিতা। একটা ছোট্ট ছেলের ওপরে পীড়নের মত ওকে পীড়ন করা যায়। পারমিতা অনেকবার
ভেবেছে, রনি ওকে হঠাৎ ভালোবাসলো কেন? সে কি শুধু ওকে অমন হেনস্তা ক’রেছে ব’লে, তার
ক্ষতিপুরন? নাকি ভালোবাসা শরীর থেকেও উদ্ভূত হয়? সেক্স গ্রোজ ফ্রম লাভ, না লাভ
গ্রোজ ফ্রম সেক্স?
সেদিনটা ছিল সরস্বতী পুজো। ইউনিভার্সিটিতে এর আগে সরস্বতী
পুজো হয়নি কোনদিন। ফ্রেশাররা হঠাৎ এটার আয়োজন ক’রেছে। তার মধ্যে পারমিতারও হাত ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিদ্যাদেবীর
আরাধনা। যথেষ্ট চাঁদা ওঠে এই পুজোতে। বেশ জাঁকিয়েই পুজোটা হয়। সকলের মনেই এই
পুজোটার জন্যে একটা বাসনা ছিল, সেটা জানা গেলো পুজোটা আয়োজনের পর। পুরনো কয়েকজন
আসা যাওয়ার পথে এই পুজোতে এসেওছিলো। তাদের মনে আক্ষেপ, কারণ তারা পায়নি এই
পরিবেশ।। যেচে আলাপ ক’রতে এসেছিলো
নতুনদের সাথে। তাদেরকে কনগ্র্যাচুলেশনস্ও জানিয়েছে তারা। ব’লেছে,
--- তোমরা কত ফ্রী! আমরা তো এ্যাতোটা মুক্ত ছিলাম না। আজো
নই। আমরা কলেজে বা স্কুলে সরস্বতী পুজো ক’রতাম। ব্যস্। ঐ পর্যন্তই। কত আনন্দ হোতো তাতে! সেই পরিবেশ ইউনিভারিসিটিতে
পেলে কী ভালোই না হ’তো! আমাদের
মাথাতেই আসেনি এসব। তোমরা ভালো ক’রেছো। যতদিন ছোট
থাকা যায়, ততদিনই আনন্দ।
স্কুলে কোথাও পুজোর দিন পোলাও, কোথাও খিচুরি, কোথাও লুচি-আলুর
দম খাওয়ানো হয়। হয়তো তাতে নুন বা মিষ্টি কমই হোল। কী খাওয়া হোল, সেটা তো বড় কথা
নয়। প্রচুর আনন্দ হোল, হুল্লোড় হোল। এই তো জীবন। মেয়েরা প্রজাপতির মতো ওড়ো, আর
ছেলেরা ছোঁকছোঁক ক’রে বেড়াও। কিন্তু
ভার্সিটিতে তো সকলেই সিনিয়ার, পরিণত। মেপে কথা বলো, মেপে চলো। নামের পরে তোমাদের
সাথে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন খেতাব দেগে যেতে ব’সেছে। সাবধান। কোন বাচ্চামো নয়, কোন বালখিল্য নয়। কিন্তু যারা ফুর্তি ক’রতে চায়, তাদের কাছে কী-ই বা মহাবিদ্যালয় আর কী-ই বা
বিশ্ববিদ্যালয়! তারা ফুর্তি ক’রেই থাকে। তা নয়তো
ইউনিভার্সিটিতে বাচ্চাদের মতো সরস্বতী পুজো! ঠিক হ’য়েছিলো বিরিয়ানি হবে। গম্ভীরভাবে সকলেই নানা কাজে ব্যস্ত। রাতে একটা ফাংশানের
ব্যবস্থাও ছিল। ইউনিভার্সিটির কয়েকজন শিল্পী আর বাঙ্গলা ব্যান্ড ‘ভোরের পাখি”।
তোড়া, মঞ্জুলা, রমিতারা তখনো আসেনি ক্যাম্পাসে। কিন্তু
পারমিতা এসে গেছে। ও জানেও না
যে, এখনও আসেনি তোড়ারা। তাই ব্যাগ খুলে মোবাইল বের ক’রে রমিতার নম্বর সার্চ করে।
--- হ্যালো! কীরে! তোরা এখনও আসিস নি? কখন আসবি?
রমিতা--- এই তো, বেরিয়েছি। তুই চ’লে এসেছিস?
--- হ্যাঁ তো। এ্যাতোক্ষণ বাড়িতে কী ক’রিস রে? খুব সাজছিস বুঝি?
--- তা সাজবো না! এই তো একটা দিন। এর জন্যেই তো এ্যাতো
আয়োজন রে। সাজবোও, ইউনিভারসিটিতে কলেজের মেয়েদের মতো উড়েও বেড়াবো।
--- দেখিস। উড়তে উড়তে আবার হারিয়ে যাস না।
রমিতা--- আমরা কজন একটা ট্যাক্সি নিচ্ছি। গেটে থাকিস। আমরা
পৌঁছলাম ব’লে।
--- ওকে।
ফোন কেটে দ্যায় পারমিতা। হঠাৎ চপল নামে একটা ছেলে এসে
পারমিতাকে খবর দ্যায়, ওদেরই ডিপার্টমেন্টের ঈশিতা নাকি ডাকছে পারমিতাকে। চপলকে
চেনে পারমিতা। ফাজলামোর সম্পর্ক নয় ওদের মধ্যে। তবু জানতে চাইলো পারমিতা,
--- কোথায় রে?
--- ঐ তো, ক্যান্টিনের ওখানে।
--- ক্যান্টিন! সে কি রে! ক্যান্টিন তো আজকে বন্ধ।।
--- সে আমি কী ক’রে বলবো, বল? দেখলাম, ওরা যেন কী সব খাচ্ছে। তোদের মেয়েদের ব্যাপার। আমাকে ব’লছিস কেন? আমাকে ব’ললো, ‘চপল, পারমিতাকে দেখলাম। ও এসেছে। একটু
ডেকে দিয়ে চলে যা না।’ কথাগুলো ব’লে চপল বেমক্কা মেজাজ দেখিয়ে চ’লে গেলো। যেতে যেতে ব’ললো--- পরে আবার বলিস না, আমি বলি নি।
ওর হাবভাব দেখে মোটে সন্দেহের অবকাশ র’ইলো না যে, ওর যাওয়া উচিত, না অনুচিত। মনে মনে একবার ভাবলো
পারমিতা, আজকে তো উপোস ক’রে থাকবার কথা। ও
নিজে না হয় উপোস-টুপোস করে না। সে তো ক’রতে পারে না। আবার ভাবলো, যাই দেখে আসি। কী ব্যাপার। ওরা আবার কী নাটক ক’রছে। ক্যান্টিন দোতলার পশ্চিম দিকে একটা কোনে। পারমিতা
হাঁটা দ্যায়। তর তর ক’রে দোতলায় উঠে যায়
পারমিতা। ক্যান্টিনের কাছে যেতে হঠাৎই কে যেন ওকে পেছন থেকে জাপ্টে ধ’রে আর মুখে একটা হাত চাপা দিয়ে দ্যায়। পারমিতা ছাড়াবার
আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু বেশ বোঝে যে, যে ধ’রেছে, তার সাথে গায়ের জোরে পেরে ওঠা ওর কম্ম নয়। যে ধ’রেছে, তাকে দ্যাখাও যাচ্ছে না। ছেলে তো বটেই। কিন্তু নিজেকে এ্যাতোটা পেছনে রেখেছে যে, পারমিতার
পক্ষে দ্যাখাও সম্ভব হোল না, কে। তবে সে যে একটা ছেলে, এটা বুঝলো পারমিতা। ছেলেটা
একেবারে অবলীলায় ওকে তুলে নিয়ে যায় সোজা ক্যান্টিনের মধ্যে। ক্যান্টিন আজ বন্ধ।
কিন্তু দরজা কী করে যেন ছেলেটা ক্যান্টিনের দরজা খুলেছে! তারপর পারমিতাকে ঢুকিয়ে
নিয়ে ক্যান্টিনের দরজাটাও বন্ধ ক’রে দিতে ছেলেটার
কোন অসুবিধে হয় না। ছেলেটার প্রচণ্ড চাপে
পারমিতার হাত ক্রমশ অবশ হ’য়ে পড়তে থাকে।
গায়ের যাবতীয় শক্তি ও হারাতে থাকে। তারপর যেই পারমিতাকে একটা ঝটকায় একটা বেঞ্চে
ফেলে দ্যায়, তখন অবশ শরীরে ও দেখতে পায় আততায়ীকে। বেঞ্চে চিত হ’য়ে প’ড়ে অবিশাস্য চোখে
ও দেখে যে, ক্যান্ডটা ক’রছে ফিজিক্স
ডিপার্টমেন্টের রনি। রণজয় চৌধুরী।
এই নামটা জানা সম্ভব ছিলো না ওর কেননা ওদের ডিপার্টমেন্ট
আলাদা। কিন্তু এই নামটা সকলের মুখে মুখে ফেরে। এমনকি টিচারদের মুখেও বার বার
উচ্চারিত হয়। তাই রনিকে অন্য সকলের মতো পারমিতাও চেনে। কিন্তু এটা ওর কাছে
অবিশ্বাস্য মনে হয়। রনি ইউনিভারসিটির এক নম্বর ছাত্র। কোন ব্যাড রেকর্ড তো নয়ই, ওর
এ্যাকাডেমিক রেজাল্ট ওকে সকলের সামনে এনে দিয়েছিলো। সে নাকি ইউনিভারসিটির সম্মান
বৃদ্ধি ঘটাবে। তাই রনিকে এমন ক্ষুধার্ত জন্তুর মতো ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে প’ড়তে দেখে ও বেশ অবাক হ’য়েছে। শুধু অবাক হয়নি, বেশ হতভম্ভ অবধি হ’য়ে গেছে। ফলে পারমিতাকে কায়দা ক’রতে অনেকটাই সুবিধে হ’য়ে গেলো ওর।
কিন্তু রনি কেন এভাবে ওকে আক্রমণ ক’রলো, কিছুই বুঝতে
পারল না পারমিতা। চোখ ফেটে ওর জল এসে গেলো। মনে মনে রনিকে শুধু ও নয়, গোটা
ইউনিভারসিটি সকলে অন্য চোখে দ্যাখে। তখনও রনি পারমিতার মুখে চেপে ধ’রে আছে। গায়ে ওর অসুরের মতো জোর। নিয়মিত জিম করা ছেলে ও।
তাছাড়া আরো কীসব যেন চর্চা-ফর্চা করে। ইউনিভারসিটি ক্যাম্পাসেই একবার একটা
সিনিয়ার ছেলেকে কোন মেয়েকে টিজ করার ব্যাপারে নাকি বেধড়ক মেরেছিলো টিচারদের সামনে।
ততক্ষণে রনি এক ঝট্কায় পারমিতার হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবিটা
ছিঁড়ে ফেলে। মুখে গজরাতে থাকে--- শালী, ইউনিভারসিটিতে যৌবন দেখাতে আসবি? ছেলেদের
মাথা খারাপ ক’রবি? তাহ’লে তোর যা চাই সেটাই তোকে দিচ্ছি, নে।
ব’লতে ব’লতে রনি নিজের একপায়ে পারমিতাকে চেপে ধ’রে রেখে নিজের জিন্সটাও খুলে ফেলে। পারমিতা ভয়ংকর সর্বনাশের
জন্যে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। ও কি তাহলে ওকে রেপ করবে? তাই শুধু দুই হাত জোর ক’রে তাকিয়ে থাকে রনির দিকে। শুধু দেখতে পায়, রনি একটা কালো
শর্ট প্যান্ট পরা। বিরাট পেশীবহুল আর হাল্কা লোমশ লোভনীয় ওর শরীর। এবারে রনি
পারমিতার পরনের জিনস্টা চেন টেনে খুলে নেয়। বেরিয়ে পড়ে ওর রক্তবর্ণ প্যান্টি।
লজ্জায় লাল হ’য়ে যায় পারমিতা।
শরীরের ওপরের ভাগে শুধু ব্রা আর নিচে
প্যান্টি টুকু। এবারে আর বুঝতে কোন অসুবিধে হয় না, কি ঘ’টতে চ’লেছে। কিন্তু আর
যেন ওর কিছু করার কোন ক্ষমতা নেই। এবারে শুধু কাঁদতে কাঁদতে বলে,
--- প্লীজ রনি, এরকম ক’রো না। আমার সর্বনাস ক’রো না। আমি মুখ
দেখাতে পারবো না। আমি আর কোনদিন এভাবে ড্রেস ক’রবো না। কথা দিছি। প্লীজ, আমার এমন ক্ষতি কোর না। আমি তো তোমার বোনের মতো।
আমাকে ছেড়ে দাও। আজকে আমাকে যেতে দাও।
কথাগুলো কেবল মনে মনেই বলে পারমিতা। একটা কথাও সশব্দে মুখে
থেকে বেরোয় না। শুধু ওর জোড় করা হাত উঠে আসে রনিকে উদ্দেশ ক’রে। কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বর কি মানুষের কোন কথায় কান দেন! মানুষ
তো তাঁর কাছে কতই প্রার্থনা জানায়, ‘আমার একমাত্র পুত্রকে কেড়ে নিও না, আমাকে এই গঞ্জনাময় বেকার জীবন থেকে মুক্তি
দাও, কিম্বা হে ঠাকুর দিন তো গেলো/সন্ধ্যা হ’লো/পার করো আমারে।’ ঈশ্বর কি শোনেন?
আর রনি তো এখন স্বয়ং শয়তানের প্রতিমূর্তি। ওর তো কোন কথা শোনার নয়। শুনলোও না। ওর
মধ্যে যেন একটা দানব চেপে ব’সেছে। এবার মনে
মনে হাত জোড় ক’রে পারমিতা ভগবান
কৃষ্ণকে ডাকতে থাকে। ওর মনে পড়ে, দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের সময় তো সে সেই
রাধা-মাধবকেই তো ডেকেছিল। তিনিই তো বাঁচিয়েছিলেন। সম্মান রক্ষা ক’রেছিলেন নারীর। তিনি কি পারমিতাকে বাঁচাতে আসবেন না! রনিকে
ঠেকানো ওর নিজের কম্ম নয় জেনে পারমিতা একমনে ভগবান কৃষ্ণকে ডাকতে থাকে। আর কোনো
বাধা দ্যায় না রনির বলপ্রয়োগে।
ও জানে, কেউ রনির বিরুদ্ধে কোন কথা বলবে না। চপল যে ওকে এমন
খবর দিলো, তার পেছনেও রনির চক্রান্ত। এটা পরিষ্কার একটা চাল। হয়তো ওরা সবাই আশে
পাশে পাহারা দিচ্ছে। রনি এবার এক টানে পারমিতার ব্রা-টা উপড়ে নেয়। ইলাস্টিকের
অন্তর্বাস। আবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেয়ে
যেন ছিটকে উড়ে যায়। আর এক স্তুপ স্পঞ্জের
মতো পারমিতার সম্পদ বেরিয়ে আসে। পারমিতা আর বাধা দেবার কোন অর্থ খুঁজে পায় না। ও
এবারে নিজের হাত-পা ছেড়ে দ্যায়। একেবারে নিশ্চল হ’য়ে থাকে। এরপর ওর কপালে কী কী জুটবে, তা পরিষ্কার বোঝে ও। আজ যে ওর চরম সর্বনাশ,
তাতে আর কোন সন্দেহ নেই। কেউ বাঁচাতে পারবে না। এই সাত সকালে ইউনিভার্সিটি তে
প্রায় কেউ আসেনি। হয়তো শুধু রমিতা, তোড়া, মঞ্জুলারা এতক্ষণে ক্যাম্পাসে এসে গেছে।
ওরা ব’ললো তো যে, ওরা বেরিয়েছে। রনি ভালো
সুযোগটা নিয়েছে। আর কী-ই বা বাধা দেবে! ওকে তো প্রায় অর্ধ বিবস্ত্র ক’রেই দিয়েছে। আর কী-ই বা বাকি থাকে! বাধা দিয়ে আর হবেই বা
কী! শুধু দুই চোখ বুজে ‘হা কৃষ্ণ! হা
কৃষ্ণ!’ ক’রতে থাকে পারমিতা।
রনি বুঝতে পারে যে, ওর শরীরের প্রত্যঙ্গে একটা উষ্ণতা ক্রমশ
বেড়ে চ’লেছে। কিন্তু নিজেকে এমনটা ক’রে আবিষ্কার ক’রতে আজ চায়নি ও। ও পারমিতাকে একটা ভয় পাওয়াতেই চেয়েছিলো মাত্র। মেয়েটা যত সব
আজেবাজে পোশাক প’রে ইউনিভারসিটিতে
আসে। ছেলেগুলোর মাথা চিবিয়ে খায়। ওরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, ভেতরে ভেতরে পুড়তে
থাকে। ওর পাতলা পাঞ্জাবির আড়ালে থাকা শরীরটাকে গেলে ওরা। ক্যাম্পাসের বাতাবরণ
উত্তেজক হ’য়ে ওঠে। এরই একটা বিহিত চেয়েছিলো রনি।
শুধুমাত্র একটা ওয়ার্নিং দিতে চেয়েছিল। কিন্তু দরজাটা বন্ধ ক’রতে ও যেন নিজেরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে থাকে। শরীরে
উষ্ণতার পারদ চ’ড়তে থাকে ওর। একটা
জান্তব বাসনা ওকে চেপে বসে। কিন্তু যেই পারমিতার অন্তর্বাসটা খুলে ফেলেছে, আর ওর
অপুর্ব দুটি স্তন বেরিয়ে এসেছে, অমনি কেমন এক ভাবান্তর হলো রনির মনে। মনে হোল,
দুটো পদ্মফুল যেন ওর সামনে উন্মীলিত। অপুর্ব, সুন্দর ও নিষ্পাপ। একটা নারীর স্তন
যে এমন সুন্দর হ’তে পারে, তা জানা
ছিল না আগে। পড়াশুনো, খেলাধুলো, শরীর চর্চা--- এই সবই ছিল ওর একমাত্র সাধনা। মাকে
একটু সুখের মুখ দেখানো, যে কষ্ট ক’রে ওর মা ওকে লালন
ক’রেছে, তার বিনিময়ে মাকে একটু স্বস্তি
দেওয়াই ছিল ওর লক্ষ্য। কিন্তু আজ এ কী হোল! এইটুকুই তো পারমিতার সম্পদ। এইটুকু
নিয়েই তো ওর অহংকার। সেই অহংকারটুকু এভাবে দ”লে মুচড়ে শেষ ক’রে দিতে যে ও
উদ্যত হ’য়েছে, তাতে এইমাত্র ও নিজেই যেন গুটিয়ে
গেলো। মনে মনে একবার ভেবে নিলো, এ সব তো ও ক’রতে চায়নি। এমন উদ্দেশ্য ওর কোনকালে ছিল না। তাহলে আর সেদিন প্রণবকে শুধুমাত্র
একটা মেয়েকে টিজ করার জন্যে ওভাবে মারধর ক’রলো কেন? সবটা গুলিয়ে যেন ‘গ’ হ’য়ে যায় রনির। একটা
সুন্দর জিনিসকে মানুষ তো অন্যকে দেখাতে নানা কারনে অল্প-বিস্তর উৎসাহী হ’তেই পারে। কেন, কোন অবস্থায় পারমিতা একটা মেয়ে হ’য়েও তার সম্পদ অন্যদের মতো আগলে চলে না, কে জানে। মানুষের
মনস্তত্ব কেই বা সম্পূর্ণ বোঝে! কিন্তু তাকে এইভাবে ছিঁড়েকুটে ফেলার তো কোন মানে
হয় না। পারমিতাকে কেন জানি এই মুহূর্তে ওর খুব ভালো লাগতে থাকে। মেয়েটা অসহায়ভাবে
প’ড়ে আছে বেঞ্চের ওপর। অক্ষম, দুর্বল। এতো
একটা মেয়ের চরম অমর্যাদা। কেন এমন কাজ ক’রবে রনি! ও তো অমানুষ নয়, বিকৃত নয়। তাহলে ও কেন এই পাপের দায়ভার নেবে! তাছাড়া
নারী শরীর তো রক্ত, মাংস, মেদ, মজ্জা, শিরা, উপশিরার সমন্বয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এর
জন্যে কেন নিজের কাছে নিজে অপরাধী হ’য়ে থাকবে চিরকাল! এর মধ্যে তো দুষ্প্রাপ্য কোন লোভনীয় কিছু নিহিত নেই। আবৃত
থাকে ব’লেই মানুষের কাছে তা কৌতূহল, পিপাসা আর
প্রলোভনের বিষয় হ’য়ে দেখা দ্যায়। কৈ কোনো কোনো আদিবাসীদের মধ্যে যে রমণীরা গায়ে কোন আবরণ
রাখে না, উন্মুক্ত বক্ষ তাদের ধারা। সেখানে তো নারীবক্ষ সম্বন্ধে পুরুষের এ্যাতো
আকর্ষণ থাকে না! তাহলে এর জন্যে রনি চৌধুরী তার একটা বিরাট ভালো রেকর্ড, একটা
ব্রাইট কেরিয়ারের সর্বনাশ ক’রতে চায় না। মাত্র
এই দুটো স্তনের জন্যে অথবা এই লাল প্যান্টির নিচে সুরক্ষিত থাকা প্রত্যঙ্গ টুকুর
জন্যে রনি চৌধুরী নিজের এই বিরাট ক্ষতি ক’রতে পারবে না। আর এইটুকুই তো পারমিতার সম্বল। মাত্র এইটুকু। পারমিতা তো মনে
করে, এইটুকু গেলে ওর সর্বস্ব চ’লে যাবে। তাই তো
হাতজোড় ক’রে এভাবে চোখ বুজে প’ড়ে আছে। ও বুঝতে পেরেছে, গায়ের জোরে ও পারবে না রনি চৌধুরীর
সাথে। তাই এখন ও প্রার্থনাকেই অবলম্বন ক’রেছে। এখন ওকে ছিঁড়ে খুড়ে ফেলাটা একেবারে বাজে ব্যাপার হবে। শিক্ষা তো ওর হোল।
এবারে ছেড়ে দেওয়াই ঠিক। তাছাড়া এমন প্রেমহীন কামনাকে কোনোভাবে মেনে নিতে পারে না
রনি। মনে মনে ও ঠিক ক’রে নেয় যে, রেপিস্ট
হ’তে ও পারবে না।
মনের মধ্যে এই মিশ্র প্রতিক্রিয়া ওকে কেমন যেন উদাস ক’রে দ্যায়। ঈশ্বর তো নিজে নেমে এসে কাউকে রক্ষা করেন না।
তিনি কোনো না কোনো ভাবে মানুষকে বাঁচান বা মারেন। হয়তো পারমিতার প্রার্থনা তাঁর
কানে গিয়ে পৌঁছেছে। উঠে পড়ে রনি পারমিতার গায়ের ওপর থেকে। তখনও পারমিতা চিত হ’য়ে প’ড়ে কেঁদে চ’লেছে। বুক তার নিরাবরণ, নিম্নাগে লাল টকটকে প্যান্টি। যেন কোন
বাধা দেবার জন্যে আর তৈরি নেই ও। যেন এমন একটা ঘটনার জন্যেই ও এখানে এসেছিলো। রনি
উঠে গেছে ওর শরীরের ওপর থেকে। তবুও পারমিতা ওঠেনি। চিত হ’য়েই প’ড়ে আছে।
পারমিতা দেখেছে, একটা মহিলা যতদিন একটা পুরুষের সামনে
নিরাবরণ হ’য়ে দাঁড়াতে বাধ্য না হচ্ছে, ততদিনই তার
লজ্জা। ততদিনই নারীর ভূষণ তার অঙ্গে, চোখে, মুখে, স্বভাবে, ব্যবহারে প্রকাশ পায়।
ততদিনই তার কথাবার্তা একটা পরিমিতি বোধ মানে। কিন্তু বিবাহের পর একবার যে মেয়ে
পুরুষ সঙ্গ ক’রেছে, তার যেন
মুখের আগোল খুলে যায়। একটা মেয়ে অন্য একটা মেয়ের সাথে এমন সব প্রসঙ্গ আলোচনা করে, যা
সাধারণত পুরুষেরাও বিবাহের পর করে না। ওর যে মাসীকে ও দেখেছে বেশ রিজার্ভড,
গম্ভীর--- সেই মাসীরই বিয়ের পরে কেমন যেন প্রগলভতা, কেমন যেন একটু খোলা খোলা ভাব,
বেশ লোকচক্ষে স্পষ্ট হ’য়ে উঠেছিলো। ওর
চোখেও। ভাষা, ইঙ্গিত সব কিছুতে কেমন যেন রক্ষণশীলতা ছুটে গিয়ে একটা স্বাধীনতা
প্রকট হ’য়ে উঠছিল। আজও যতক্ষণ না রনি ওকে এভাবে
একটা চূড়ান্ত অবস্থায় টেনে নিয়ে গিয়ে ওঠেনি, ততক্ষণ ও ল’ড়ে গিয়েছে নিজেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায়। কিন্তু উন্মুক্ত
বক্ষ নিয়ে, প্রায় উন্মুক্ত নিম্নাঙ্গে এই মাত্র পারমিতার যেন মনে হ’য়ে উঠলো, ‘কী আর বাকি রইলো!
অনধিকারের, বা নিষিদ্ধতার সীমা অনেকটাই পার ক’রে গেছে রনি। এখন আর যেন বিশেষ কিছু বাঁচাবার মতো অবশিষ্ট র’ইল না পারমিতার। তাই একেবারে মৃতদেহের মতো প’ড়ে থেকেছে বেঞ্চের ওপরে।
রনি কখন যেন পারমিতার মুখ থেকে নিজের চাপা দেওয়া হাত স’রিয়ে নিয়েছে। এখন পারমিতা চাইলেই চিৎকার ক’রতে পারে। কিন্তু পারমিতা নীরব, নিস্পন্দ, আর নিঃসাড়। যেন
রনি হাত সরালেই বা কী, আর না সরালেই বা কী। একই বিষয়। কখন যেন রনি ওকে ছেড়ে দিয়ে
উঠে চ’লেও গেছে। যাবার সময় নিজের শার্টটা ফেলে
দিয়ে গেছে ওর গায়ের ওপর। পারমিতার আদ্দির পাঞ্জাবিটা তো ছিঁড়েই ফেলেছিলো একটানে।
এটাও ও বুঝে গেছে যে, ওটা পারমিতা আর প’রতে পারবে না। তাই নিজেরটা রেখে গেছে। দরজা খুলে রনি বেরিয়ে যায়। চোখ ঘুরিয়ে
দ্যাখে পারমিতা। কিন্তু নড়ে না। অর্ধোলঙ্গ অবস্থায় প’ড়েই থাকে। শেষে এক সময় বেঞ্চি ছেড়ে উঠে জামাটা গায়ে দিতে
দ্যাখে যে, তাতে নাম না জানা একটা জংলি পারফিউম আর রনির ঘামের গন্ধ। উত্তেজক, কেমন
যেন একটা নেশা ধরানো চাপ চাপ গন্ধ।
রনি দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কাছেই আগ্রহ নিয়ে
দাঁড়িয়ে ছিলো চপল। প্রচণ্ড উত্তেজনায় ও রনির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিস ফিস ক’রে বলে--- কী গুরু? খেল খতম? কিন্তু তোমার জামা কোথায়?
কোন উত্তর দ্যায় না রনি। একবার তাকায় চপলের দিকে আর শুধু
বলে--- ওকে যেতে দিবি। আটকাবি না। তার চেয়ে ভালো, এখান থেকে চ’লে যা।
চপল প’ড়লো আকাশ থেকে।
গুরুর হলো কী! তবু দূরে দাঁড়িয়ে গোটা নাটকটা দেখতে ছাড়লো না। দেখলও, পারমিতা বেশ
খানিকটা পরে ধীরে দরজা খুলে একবার চারদিক তাকিয়ে কেউ আছে কিনা দেখে বেরিয়ে এলো। ওর
গায়ে রনির ডিপ নীল রঙের জিনসের শার্ট। তারপর পারমিতা চুপচাপ চ’লে গেলো ক্যাম্পাসের বাইরে। চপল দেখা দিলো না। আড়ালে
দাঁড়িয়ে বিষয়টা দেখে নিলো। রাস্তায় নেমে পারমিতা একটা বাস ধ’রে সোজা বাড়ি। পরের বেশ কিছুদিন ইউনিভারসিটিতে আসেনি ও।
কিন্তু যেদিন এলো, সেদিন ও যেন এক নতুন পারমিতা। ইউনিভারিসিটি দেখলও, পারমিতা
বিধাতার অঙ্গুলি হেলনে যেন কী ক’রে প্যান্ট নয়,
শাড়ি প’রে এসেছে। সকলে অবাক হ’লেও কেউ কিছু মন্তব্য করেনি। রনি এরপর বহুদিন ওর সামনে
আসেনি। সামনে আসার তেমন কোনো কারণ নেই। ওদের ডিপার্টমেন্টই আলাদা। কিন্তু আজ সেই
রনি তার জীবনের পার্টনার হ’য়ে গেলো।
পারমিতার আজ মনে হয়, ইজ্জত বা লজ্জা একটা নারীর জীবনে
আপেক্ষিক বিষয়। যা ছিল গোপন, তা যেইমাত্র একজনের সামনে খুলে গেছে, অমনি ওর মনে
বে-আব্রু যন্ত্রণা হওয়া থেকে অনেক বড়ো ক’রে দেখা দিয়েছে সেই মানুষটাকেই সেই আবরণ রক্ষার দায়িত্ব তুলে দেওয়া যে কিনা
একবার আবরণ উন্মোচন ক’রেছে। পৃথিবীর
যাবতীয় সামাজিক যৌনতা তো এরই ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বেড়ালই নিয়েছে মাছ পাহারার দায়ভার। কিন্তু পারমিতা এই
ঘটনার পর থেকে কেমন ক’রে যেন একটা
অতিরিক্ত বস্ত্রাবরনপ্রিয় হ’য়ে উঠেছে। এ হয়তো
ওর মতিভ্রম। কিন্তু ঘটনাটা প্রকট হ’য়ে প’ড়েছে গোটা ইউনিভার্সিটিতে। এক সময় ওকে নিয়ে যে আলোচনা ছিল,
সেই আলোচনা আজ ব’দলে অন্য এক রূপ
নিয়েছে।
রনি আবার তাগাদা দিলো--- কৈ! খেয়ে নাও। আজকাল তুমি এমন
অন্যমনস্ক হ’য়ে যাও কেন? উঠতে হবে না?
পারমিতা উত্তর দিলো না কিছু। ওর যে মার মুখটা মনে প’ড়ছিল। মা-টা বড়ো দুঃখী। জীবনে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে তো
পেলোই না। একটা অন্যও মানুষের সাথে কাটাতে হ’লো এক অসুখী জীবন। একটা সন্তান, কিন্তু সে-ও পাকেচক্রে মাকে ছেড়ে কত দূরে প’ড়ে আছে। খুব কান্না পাচ্ছিলো পারমিতার। চোখ থেকে রুমাল দিয়ে
একটু জল মুছে নিয়ে মনে মনে ঠিক ক’রেও প্রকাশ্যে আপন
মনে ব’লে ফেললো,
--- কালই মাকে দেখতে যাবো।
--- তুমি মার কাছে থাকো না?
রনির প্রশ্ন শুনে অপলক চোখে রনির দিকে তাকায় পারমিতা। শুধু
বলে--- না। আমি দিদার কাছে মানুষ।
রসিকতা করে রনি--- সত্যি মানুষ তো? নাকি...।
-----------------------
এইসব বিহঙ্গেরা
পরিচ্ছেদ – ৭
একা ক্যান্টিনে ব’সেছিলো সম্বিৎ। ওর জানা নেই, কতদিন ওকে এভাবে একা বসে থাকতে হবে। ইউনিভার্সিটি
আসে, ক্লাশ করে, হয়তো ভালোভাবে পাশ ক’রবেও। চাই কি, ফার্স্ট ক্লাশ পাবে। কিন্তু ও তো এসব ক’রতে চায় না। কী হবে এম.এস.সি. ফেম.এস.সি. করে! ও তো এমনিতেই এম.বি.এ. ক’রে ব’সে আছে। চাকরী তো ও ক’রবে না। ওর বাবা অপরেশ মিত্র বিরাট বড়ো মাপের ব্যবসায়ী। তাঁর সম্পত্তিও বিপুল।
ও মাত্র একটিই ছেলে। একটি মেয়েও আছে। মেয়ে মানে তো সম্বিতের দিদি। বিয়ে হ’য়ে গেছে আজ তিন বছর। জামাইবাবু সফ্টওয়্যার এঞ্জিনীয়ার। এখন
সেট্ল ক’রেছেন ক্যালিফোর্নিয়া-তে। ওরাক্ল-এ
সার্ভিস করেন।
সম্বিৎ মনে করে যে, এটা একটা ইম্পেরিয়ালিস্ট ট্র্যাপ।
স্টাইলটা আজ বদলে গেছে শুধু। এইসব ডেভেলপ্ট দেশগুলো হাতে নয়, ভাতে মারবে তৃতীয়
বিশ্বের দেশগুলোকে। টোপ দিয়ে দিয়ে ডেভেলপ্ড কান্ট্রিগুলো এ দেশের যত মাথাগুলোকে
নিয়ে ফেলছে ওদের দেশে। ব্রেইন ড্রেইন চ’লছে। এ দেশের ব্যাঙ্ক টাকা লোন দ্যায়, ছেলেমেয়েগুলো পড়ে সেই এই দেশের টাকায়।
তারপর এ দেশের মায়া কাটিয়ে চ’লে যায় সাজানো
গোছানো একটা স্বপ্নের দেশে। ওখানে গিয়ে তারা নতুন স্বপ্ন গ’ড়বে। চাই কি, এ দেশের নয়, একটা সাদা চামড়ার ছেলে বা মেয়েকে
বিয়ে ক’রে নেবে একদিন। ব্যস্। ওদের সন্তান হবে
ট্যাঁস। ব্যক্তি আরামটাই ওদের কাছে সবচেয়ে বড়ো। অনেক বাবা-মা’ও তাদেরকে সেই কাজেই তোল্লাই দিচ্ছে। বুঝছে না, একটা বিদেশীয় বা বিজাতীয় ভাবধারা তারা
বানিয়ে দিচ্ছে ওদের মধ্যে। ফলে কাল ওরাই বাবা-মাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ক’রবে। এমনিতেই তো আজকাল ছেলে-মেয়েদের নো কমিটমেন্ট, নো
রেস্পন্সিবিলিটি। ঠিক যেমন ক’রে একটা ছেলে তার মা-র হাত ধ’রে বড়ো হ’য়ে মেলা দেখে,
মা-র কাছে ব’সে সহজ পাঠ অথবা
ওয়ার্ডবুক পড়ে, পরে একদিন জরাজীর্ণ মা-কে টাটা ক’রে হাত নেড়ে চ’লে যায় কোনো এক
শহরের একটা ফ্ল্যাটে গতি-প্রগতি-অগ্রগতির জন্যে, আর বেচারি মা হাঁ ক’রে দ্যাখে--- তার সন্তান তার প্রতি কোন মমতা বুকে না রেখে
অট্টালিকার দেশে অট্টালিকা বানাতে চ’লে যাচ্ছে। আবার সে সন্তানের স্বপ্ন দ্যাখে, সন্তান হয়, আবার তাকে হাঁ ক’রে তাকিয়ে দেখতে হয় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। কিছু করার নেই।
বিজ্ঞান আর অঙ্ক মানুষকে হিসেব ক’ষতে শিখিয়েছে।
হিসেব ছাড়া সে চ’লতে পারে না।
ভালোবাসাও সে হিসেব ক’রে নেয়। এখন তো
বেহিসেবি হ’লে চ’লবে না। আকাশের গ্রহ, নক্ষত্র, উপগ্রহ, ধূলিকণা, গ্যালাক্সি, ব্ল্যাকহোল আদি
মহাশৌন্যিক যা কিছু, তারা হিসেব জানুক, না জানুক মানুষকে হিসেব ক’ষতে হবে, কারণ সে তো তার অর্জিত-উপার্জিত অর্থে এই অঙ্ক
শিখেছে। তা তো বিফলে যেতে পারে না।
সম্বিত কিন্তু এমনটা ভালবাসে না। একটা ব্যবসায়ীর ছেলে হ’য়েও, বাবা-কে নিয়ত হিসেব ক’ষতে দেখেও ও নিজেকে এমনটা ক’রে গ’ড়ে তুলতে পারে নি। পড়াশুনোটা মন দিয়ে ক’রেছে। গ্র্যাজুয়েশন উতরেছে প্রথম শ্রেণীতে। কেমিস্ট্রি
অনার্স। শতকরা পঁচাশি নম্বর পেয়ে পার ক’রেছে কলেজের গণ্ডি। বাবা প’ড়িয়েছেন, কিন্তু
তাঁর আত্মজ যে একটা গর্বের ফল ক’রেছে, তার জন্যে
যেন তার কোন দৃকপাত নেই। এও সম্বিতের জীবনে আর এক গেঁড়ো। ছেলে যে ভালো রেজাল্ট ক’রেছে, তার জন্যে তিনি মোটেই উল্লসিত নন্। উল্লাস করার মত
সময়ও অবশ্য তাঁর নেই। আজ কনফারেন্স, কাল মিটিং, পরশু, কিম্বা তরশু টেন্ডার পর্যবেক্ষণ---
আরও কত কাজ! বাড়িতে মা-টা একা। একরাশ সোনার গয়না প’রে সেই গল্পের বন্দিনী রাজরানির মতো এ মহল, সে মহল ক’রে বেড়ায়। সম্বিতের বাবা ভালোমানুষ। না আছে তাঁর কোন
নেশা-ভাং, না কোন চরিত্রের দোষ। এমনকি কর্মচারিদের পর্যন্ত তিনি কোন দুঃখকষ্ট দেন
না। তাদের বোনাস্, ইনক্রিমেন্ট, নানা ভাতা, ক্ষণে-অক্ষণে নানা আর্থিক অনুদান,
ইনশিয়োরেন্স--- সবকিছু তিনি নিজে হাতে ক’রিয়ে দিয়েছেন। ছেলের জন্যে রেখে যাচ্ছেন বিশাল এক বহুমুখী বাণিজ্য সাম্রাজ্য।
কিন্তু তিনি শুধু ভালো--- এমনটা দিয়ে তো জগত চলে না। চাই
সত্যিকারের মানুষ, সত্যিকারের বাবা। ভাতের অভাব কেন, গাড়ি বা নিয়মিত ফ্লাইটের অভাব
কোনোদিন সম্বিতের হবে না। সোনার চামচ মুখে নিয়ে সে জন্মেছে। চোখ খুলেছে, দেখেছে---
সোনার বিছানা, সোনার থালা, সোনার চিরুনি। এক স্বর্ণময় জীবন। কিন্তু সেটাই কি সব? মাঝে মাঝে ভয় হয় সম্বিতের। যদি ও
কোনদিন দ্যাখে, ওর ভাতের সোনার থালায় যে ভাত বামুনদি বেড়ে পঞ্চব্যঞ্জনে সাজিয়ে
নিয়ে এসেছে, সেগুলো সোনার! তবে কী হবে? তাই সোনার পাহারে ব’সে সোনার উজ্জ্বলতায় নিজের চোখ মাঝে মাঝে ঢাকে সম্বিত, যাতে
সোনার সূর্যের আলো প’ড়ে ঠিকরে আসা
রশ্মি ওর চোখদুটোকেই অন্ধ না ক’রে দ্যায়।
এই কারণেই ইউনিভার্সিটির পেটি-বড়োলোকী ক্লাসমেটদের ধনী-ধনী
শো-ম্যানশিপ ওর পছন্দ নয়। সাধারণ, অত্যন্ত সাধারণদের সঙ্গ ভালো লাগে ওর। ওর
গার্লফ্রেন্ড-ও একদম সাধারণ, সোজা-সাপটা একটা মেঠো মেয়ে। কোনো ভাঁজ থাকে না ওর
কথায়, কোন কৃত্রিমতা ও বোঝে না, বোঝে না কোন ঘুরিয়ে বলা কথার মানে। সোজা পায়ে সোজা
পথে চলে। এই জটিল অষ্টাবক্র পৃথিবীতে ও যেন একমুঠো ভাঁটফুল, যাকে এই ব্রহ্মাণ্ডে
একমেবাদ্বিতীয়ম পৌরুষের প্রতীক কেবল শিবের জন্যেই অর্পণ করা হয়। মাঝে মাঝে ভাবে
সম্বিত, ‘ও শিবের মতো সত্য-শিব-সুন্দর পুরুষ হ’য়ে উঠতে পারবে তো? ওর জংলীপনায় ওর গার্লফ্রেন্ড তৃপ্ত হবে
তো?’
যদিও ও জংলী কিন্তু সম্বিত আজ একেবারে মৌনী তাপস। যেন
ধ্যানে মগ্ন ধূর্জটি। প্রণয়িনীকে পাবার তপস্যায় যেন গভীর তপের তাপস। ‘প্রণয়িনী’ শব্দটা বেশ পছন্দ
ওর। বড়োজোর ‘প্রেমিকা’। আজকের সকলের মুখে যে ‘গার্লফ্রেন্ড’ শব্দ শোনা যায়,
তাতে ওর ঘোর আপত্তি। ‘গার্লফ্রেন্ড’ প্রেমিকা হোল কী ক’রে? গার্লফ্রেন্ড তো গার্লফ্রেন্ড। প্রেমিকাকে গার্লফ্রেন্ড ব’ললে সম্বিতের মনে হয় যে, একটা পুরুষের যেন প্রেমিকা ছাড়া
অন্য কোন গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে না। ওর মনে হয়, এটা তো অন্যায় বায়নাক্কা।
কিন্তু সম্বিত জানে, ওর প্রেমিকা একদম আলাদা। আর পাঁচটা মেয়ের
মতো সে নয়। সে শুধু সাধারণ নয়, অনন্যাও বটে। সেই যে... সে বার সরস্বতী পুজোয়
বাসন্তী রঙের কাপড় প’রে বেরিয়েছিলো
রাস্তায়... সেই থেকে ওদের রিলেশন। ওকে সম্বিতের প্রথম প্রপোজ করা, ‘এই মেয়েটা, আমার সাথে বন্ধুত্ব করবি?’ সে তো আজ ইতিহাস। আজ সাত বছর। ছোট যখন ছিল, টুকটাক ওদের
দেখা হ’তো। আশ্চর্য! সে সময়টা ছিল একটা খেলা।
কিন্তু আজ ওর কাছে মেয়েটা যেন একটা একবুক বাতাসের মতো। শয়নে, স্বপনে, নিদ্রায়,
জাগরণে তাকে না হ’লে চলে না
সম্বিতের। সম্বিতের মনে হয়, সারা রাজ্য ও জয় ক’রতে পারে যদি ওকে পাশে পাওয়া যায়। আজ একটা মুহূর্ত যেন ওকে না হ’লে চলে না। আর তাই ব্যবসা ছেড়ে ভর্তি হ’য়েছে এই এম.এস.সি.-তে, যাতে ওর সাথে
সাক্ষাৎ হয় নিয়মিত। যেন নিজেকে একা একা মনে না হয়। মা-র মতো একা।
তোড়া ওর প্রেমিকা। বিয়ে তো এখনই ক’রতে পারে সম্বিত। কিন্তু তোড়ারই আপত্তি। ওর ‘বাবা’ বলা যাক, ‘মা’ অথবা অন্য কেউ---
সবই নাকি ওর দাদা। তাঁর একটা গতি না হ’লে নাকি ও চ’লে এসেও শান্তি
পাবে না, মুক্তি পাবে না।। অথচ দাদাকে এই সম্পর্কের কথা জানানো-তে ওর বিরাট
আপত্তি। আপত্তি, না ভয়--- সেটাও বোঝে না সম্বিত। মুখে বলে, দাদা নাকি ওর অদ্বিতীয় বন্ধু। অথচ তাঁকে সামলে
চলে। কেন? সম্বিত কয়েকবার নিজের মোটর সাইকেল থেকে সেই চাপদাড়ি মোটর সাইকেল আরোহীকে
দেখেছে। শুনেছে, সে নাকি ব্ল্যাকবেল্ট। কৈ? ভয়ঙ্কর তো মনে হয় নি মোটে! সম্বিত ঠিক
বোঝে না, আসলে ওঁর প্রেমিকার সংশয়টা কোথায়? মাঝে মাঝে ভয় হয়, ওকে ছেড়ে অবশেষে তোড়া
অন্য কোথাও চ’লে যাবে না তো?
মেয়েদেরকে বিশ্বাস নেই। তারা অনেকটা জলের মতো। যে পাত্রে দাও, সে পাত্রের রং নিয়ে
নেবে। দেখেছে সম্বিত।
সারাদিনের পরে এই ক্যান্টিন-এ ওদের দেখা হয়। চা খেতে খেতে
কথা হয়। ব্যস্, ওইটুকুই। এটাই ওর সারাদিনের এনার্জি। আজ এখনও তোড়া আসে নি।
বন্ধুদের বিদেয় ক’রে তবে ওর ছুটি,
তবে ওর অবসর মিলবে। বন্ধুদের সামনে যে ওর কী লজ্জা, কে জানে। আজো একটা বন্ধুও জানে
না ওর এই গোপন অভিসারের কথা। একটা অনন্য কৌশলে ঢেকে রেখেছে আজ এতদিন। অবশ্য
ভালোবাসা সঙ্গোপনেই মধুর। এমনকি সকলে জানলেও তো সব জিনিস সকলের সামনে ক’রতে হবে, এমন কথা নেই।
আপত্তি করে নি সম্বিত। ওক্কে! অপেক্ষাই সই। হয়তো তোড়া ওর
একটা পরীক্ষা নিচ্ছে। তবে আজ মুডটা সম্বিতের খুব ভালো। আজ ঠিক ক’রেছে, ওকে নিয়ে একটা ড্রাইভে যাবে। আজ ওর সাথে নতুন বাইক।
এই বাইকটা বাবা নোতুন কিনে দিয়েছে। হাঙ্ক। বুলেটের থেকে হেভি গাড়ি। আগেরটা ব্যবহার
ক’রেছে দীর্ঘ পাঁচ বছর। প্রচুর সার্ভিস দিয়েছে গাড়িটা। বাবাই ব’ললো,
--- তুমি একটাও এ্যাক্সিডেন্ট করো নি এতদিনে। ইউ ডিজারভ এ
ক্রেডিট। তোমার একটা দামী মোটর বাইক পাওয়া উচিত। তাছাড়া তুমি এম.বি.এ. ক’রেছো। কিন্তু তুমি
কোন কমপ্লিমেন্ট পাও নি। কথাক’টা ব’লে হাঙ্ক-এর চাবিটা ছুঁড়ে দিয়ে ব’লেছেন--- ক্যাচ।
বাইকটা পেয়ে খুশী যে হয় নি ও, তা নয়। বাবা-র বিরুদ্ধে তো ওর
কিছু বলার নেই। পয়সা হ’লে মানুষ যা যা
করে, বাবা তার একটাও রপ্ত করে নি। বাবা শুধু নিজেকে অনেকটা আপগ্রেড আর আপডেট ক’রে নিয়েছে। এমনটা তো তার অবস্থা ছিলো না। স্টেপ বাই স্টেপ
বাবা ওপরে উঠেছে। কিন্তু মা প’ড়ে থেকেছে একই
জায়গায়। বাবা-র সহধর্মিণীর ধর্ম মা পালন ক’রতে পারে নি। ফলে একটা দুস্তর ব্যবধান গ’ড়ে উঠেছে ওদের মধ্যে। মা যা যা করে একজন হাউজ ওয়াইফের মতো, বাবা তাতে যোগদান ক’রতে পারে না। আর বাবার মনের তল পায় না মা। বাবা অদ্ভুত কথা
বলে,
--- সোমু, টাকা করো। কিন্তু টেনশান নেবে না। ভোগ ভালো,
কিন্তু তাঁর জন্যে দুর্ভোগ ঘাড়ে নিয়ো না। যদি পারো, তবে তোমাকে আর ব্যায়াম-ট্যায়াম
ক’রতে হবে না। টেরামাইসীন,
স্ত্রেপতোমাইসীন, ক্লোরোমাইসীন--- এসবের মতো কোনো ‘মাই সীন’ মানে ‘আমার পাপ’-এর খপ্পরে প’ড়তে হবে না। শরীর আপনি ভালো থাকবে।
বাবারও কোন প্রেশার, সুগার, এ্যাসিডিটি কিছুই নেই। বয়স হ’লো ওভার পঞ্চাশ। এতো অর্থের আর ব্যবসার মালিক হ’য়েও কী ক’রে যে একটা মানুষ
টেনশান করে না, সেটা একটা বিরাট সিক্রেট সম্বিতের কাছে। এর মধ্যে তোড়া ঢোকে হুড়মুড়
ক’রে। ঢুকেই বলে,
--- বাব্বা! সব বিদ্যায় ক’রে এলাম। বলো, কফি বল।
সম্বিত ভয়ে ভয়ে ব’লে বসে--- আজ ব’সবো না। চলো না,
আজ একটা ড্রাইভ মেরে আসি। তুমি তো আমার নতুন বাহনকে দ্যাখোইনি।। দারুণ চলে। যাবে?
--- তুমি জানো, তুমি ব’ললে আমি রিফিউজ ক’রতে পারি না। তবু
বলো। জানো না, আমার কী সমস্যা! দাদা জানলে না, আগে আমাকে বাড়ি থেকে বিদেয় ক’রবে। ব’লেই দেবে, ‘কেন তুই আমাকে জানাস নি?’ দাদা এমনিই বলে, ‘বেশী বয়সে বিয়ে ক’রতে নেই রে, তোড়া।’ বোঝো, তাতে নাকি পরে ক্ষতি হয়।
--- তাহ’লে তো মিটেই যায়।
আমার ইউনিভার্সিটি পরিক্রমা বন্ধ হয়। বাবাও তাগাদা দেন খালি ব্যবসা বুঝে নেবার
জন্যে। মানুষের নাকি নিশ্বাসে বিশ্বাস নেই। এই সাম্রাজ্য কে সামলাবে তখন? আমাকে
শিখে নিতে হবে। তারপর না হয় তোমার দাদাকে আমরাই জোর ক’রে ব’সিয়ে দেবো পিড়িতে।
--- না না। দাদার কিছু না হ’লে আমার মুক্তি নেই। তুমি দাদাকে চেনো না। বাইরে থেকে এসব হয় না। ঘরে ব’সে ব’সে দাদাকে
ব্ল্যাকমেল ক’রতে হবে। আর তাই
আমার থাকা দরকার।
--- তাহলে?
--- তার চেয়ে চলো, তোমার নতুন বাইকে লং-ড্রাইভ দিয়ে আসা
যাক। এটা বরং অনেক সহজ।
তোড়া নিরস্ত ক’রতে চেষ্টা করে সম্বিতকে। তা নয়তো ওর বায়না অনেক দূর যাবে। আজ বছর কয়েক ও অপেক্ষা
ক’রে আছে। মাঝেই মাঝেই কথাটাকে ও রিচার্জ
করে। তার চেয়ে ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওর মাথা থেকে এই ভূতটা নামানো অনেক বেশী
প্রয়োজন। এমনটা তো তোড়াকে ক’রতেই হবে। ও বুঝবে
না। ছেলেরা বোঝে না।
গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে সম্বিত। উত্তেজিত হ’য়ে বলে--- যাবে! সত্যি!! চলো। এক কাজ করো, তোমার ওড়নাটাকে
ফিয়ে মাথাটা ঢেকে নাও টাইট ক’রে। আর আমার
সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে নাও। ব্যস্। আর কেউ ট্রেস ক’রতে পারবে না।
--- তুমি দীপ্তিময় রায়কে চেন না, তাই এমন ব’লছো। একটি জ্যান্ত ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো।
--- এই তো! তুমি আবার আমাকে ভয় দেখাচ্ছো। ব’লেছি, লোকটার নাম শুনলে আমার ল্যাট্রিন চাপে...। আর তুমি
ঘুরে ফিরে আমাকে ঐ নামটাই শোনাবে!
গাড়িতে একটা মিষ্টি গম্ভীর আওয়াজ তুলে মাখনের মতো এগিয়ে যায়
সম্বিতের হাঙ্ক। তোড়া ওকে জ’ড়িয়ে ধ’রে ব’সেছে। সম্বিত মুখে
দিয়ে একটা তৃপ্তির শব্দ ক’রে ব’লে ওঠে--- আ-হা! এ কী আনন্দ!
--- কী গো! তুমি, আবার রবীন্দ্রসঙ্গীত! হোল কী তোমার! তার
চেয়ে তুমি বলো, ‘আহা কী আনন্দ
আকাশে বাতাসে...।
--- কেন? আমি কি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারি না! কী মনে করো
তুমি? আসলে রবীন্দ্রসঙ্গীত কি আমার স্মৃতি থেকে বেরোল? ঐ যে তুমি আমার পৃষ্ঠলগ্ন হ’য়ে বক্ষলগ্না হ’লে..., তাইতেই তো ওমন গান বেরোল। এ তোমার স্পর্শের জাদু, প্রিয়ে।
তোড়ার মনে হয়, আজ যেন প্রথম অনুভব ক’রলো, সম্বিত একটা পুরুষ, ওর জীবনের সঙ্গী। এতদিন ও ছিলো
শুধুই বন্ধু। এর আগে কখনও ওকে এভাবে জড়িয়ে বসেনি। একটু সিরিয়াস হয় তোড়া,
--- তুমি খুব অশ্লীল তো! ব’লেই সুর পাল্টে পুরনো সেই প্রেমিকার সংশয়ের কথায় চলে যায়--- আচ্ছা সম্বিত, তোমার বাড়ির মানুষেরা
আমাকে গ্রহণ ক’রতে পারবেন তো?
--- না পারলে বাড়ি আমাকে ছাড়তে হবে। আর আমাকে ছাড়বে মা!
হাঃ! তাহ’লেই হ’য়েছে। এসব নিয়ে তুমি ভাবছো!
--- আমি তোমার বাবা-র কথা ব’লছি। আমাদের মতো ছাপোষা ঘরের মেয়েকে তিনি মানতে পারবেন কিনা...।
--- আরে বাবা-র এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। বাবা শুধু জানবে,
মা খুশি কিনা। বাবা-র আর কোনো মাথাব্যথা নেই। বাবা জানবে, আমার বৌ পড়াশুনোটা জানে
কিনা। অশিক্ষিত মুচ্ছোওয়ালী কাউকে বাবা বাড়িতে এ্যালাউ ক’রতে চায় না।
--- মুচ্ছোওয়ালী মানে? সেটা আবার কী?
ভি.আই.পি. রোডে গাড়ি তুলে
দিয়ে সম্বিত বলে--- ওমা! সে গল্প জানো না? তাহলে শোন। একটা কুকুর একটা বেড়ালনীর
প্রেমে প’ড়েছে। এবার কুকুরের বাবা ব’লেছে মেয়েকে দেখাতে। তারা ভাববে, বিয়ে দেবে কিনা। কুকুর তো
বেড়ালনীকে বাড়িতে এনেছে সাজিয়ে গুছিয়ে। কুকুরের বাবা মা মেয়ে দেখে জানিয়েছে যে, চ’লবে না। বেড়ালনী এই কথা শোনামাত্র কেঁদে উঠে প্রশ্ন ক’রেছে,
--- মিউ? মানে ‘কিউ?’
বাবা কুকুর সোজা জানিয়ে দিয়েছে--- মুচ্ছোওয়ালী লেড়কি নেহি
চলেগি।
তোড়া হাসতে হাসতে বাইক থেকে প’ড়ে যাচ্ছিলো আর কি। সম্বিত ধ’রে সামলে নিতে ব’লেছে---কোথায় পাও
এসব?
তোড়া মাথাটাকে ওর দোপাট্টা দিয়ে ঢেকে দাঁতে কামড়ে নিয়েছে।
চোখে সম্বিতের সানগ্লাস। বাইকের আয়নায় একবার নিজের মুখ দেখে নিয়ে ব’লেছে--- দ্যাখো, মনে হচ্ছে, কোন জঙ্গী।
--- না না। লিঙ্গে ভুল কোর না। জঙ্গিনী।
তোড়া শুধরে দ্যায়--- থাক, একেবারে বাঙ্গলায় অনার্স। এমনিতে
তো বাংলা মায়ের এ্যাংলো সন্তান। জঙ্গিনী! সেটা কোন ডিকশনারিতে পাওয়া যাবে, শুনি।
বড়জোর হ’তে পারে মহিলা জঙ্গি। আবার তোড়া পুরনো
প্রসঙ্গে ফিরে আসে--- কিন্তু সম্বিত, আমি তোমার বাবা-র অক্ষমতার কথা ব’লছি না। তোমার বাবা-র কি পুত্রবধূ সম্বন্ধে কোন ড্রিম নেই?
কোন প্যাশন নেই?
সম্বিত তোড়াকে শুধ্রে দিয়ে বলে--- একটা স্তরের পর মানুষের
এসব বিষয়গুলো মামুলি লাগে, তোড়া। তুমি বুঝতে পারছো না। বাবা এসবের ঊর্ধে। তোমার
বোঝারই বা কী দরকার? আমরা একসাথে জীবনটা কাটাতে চাই। ব্যস্। বাবা কিভাবে চাইলো,
কাকা কিভাবে চাইলো--- এসব তো ইম্মেটেরেরিয়াল। আসল কথা হ’লো, মা কিভাবে চাইলো। মা-ই তো বাড়িতে থাকবে। তোমাকে তো
মা-রই বান্ধবী হ’য়ে থাকতে হবে।
বাবা যদি দ্যাখে যে, মা খুশি, তবে বাবাও খুশি। বাবা-রা এসব নিয়ে মাথা-টাথা ঘামায়
না বস্।
ফুলবাগান পেরিয়ে সম্বিতের বাইক হু হু ক’রে ’ছুটেছে শিয়ালদার
দিকে। অবশেষে ধর্মতলা স্ট্রীট ধ’রে ছুটেছে
আকাশবাণীর দিকে। পুরুষালি বাইক যেন মহিলা সওয়ার পেয়ে গতি পেয়েছে। তাই মাখনের মতো চ’লেছে, যেন তার আরোহীর কোন কষ্ট না হয়। সম্বিত ব’ললো,
--- আমি তোমার মতো নই। মা-কে আমি সবটাই ব’লে দিয়েছি। তুমি কে কী, কবে কেন কোথায়--- সব।
--- আর মা?
--- মা তো হেভি খুশি। আমাকে তো মা হরদিন জ্বালাচ্ছে, ‘কবে আনবি, কবে দেখবি?’ আসলে মা তো বড়ো একা। একটা সাথি চায় মা, একটা বন্ধু। তুমি কিন্তু তোড়া, চাকরী
ক’রো না। আমার মা-র বন্ধু হ’য়ে থেকো। অবশ্য আমারও। তবে মা বেশী। তা নয়তো মা-টা বড়ো
অসহায় হ’য়ে প’ড়বে। মুখে তো কিছু ব’লবে না।
--- বাবা! তুমি এতদূর এগিয়েছো! কিন্তু মা-কে বন্দীদশা থেকে
মুক্তি দিতে গিয়ে আমাকে হোস্টেজ কেন করছো? আমাকে বাড়িতে বন্দিনী রাজকন্যা বানাবার
প্ল্যান ক’রেছো, বলো? তোমার আমাকে দরকার নেই। মা-র
জন্যেই আমাকে নিয়ে যাওয়া? কিন্তু আমার দাদা যে এ্যাতো কষ্ট ক’রে আমাকে এতোটা লেখাপড়া করালো, তার কী হবে?
--- তুমি পড়াবে। মা-কে পড়াবে। একজন অশিক্ষিতাকে আসল
শিক্ষিতা ক’রে তুলবে। মা যে ঘরে প’ড়ে প’ড়ে পচছে, তা থেকে
তাকে মুক্তি দেবে। একটা সৃষ্টির ভার তোমার ওপর। মা-কে তুমি গ’ড়বে। একদিন মা যেন বাবার সামনে বেরিয়ে আসতে পারে, বাবা-র
সাথে এখানে সেখানে যেতে পারে। একজন নারী হ’য়ে একজন নারীকে তার স্বামীর সাথে মিলিত ক’রবে। এর চেয়ে ভালো কাজ তো হয় না, তোড়া। বাবা মা-কে দেখে যেন চমকে যায়।
ইউনিভার্সিটিতে ক্লাসে বা বাড়িতে দাদা-র সামনে তোড়া বকে, আর
সকলে শোনে। কিন্তু সম্বিতের সাথে বেরিয়ে তোড়া চুপ ক’রে থাকে। সম্বিত ব’কতেও পারে। তোড়াও
কিছু বলে না। একটা মানুষ অনেকটা বক বক ক’রলে তার ভেতরের অনেক কথা বেরিয়ে আসে। ওঁকে তোড়া চিনতে পারে। তাতে তোড়ার যদি সুবিধে
হয়, তাই তোড়া চুপ ক’রে থাকে।
সম্বিতের বাইক এসে থামে গঙ্গার পারে। খুব সাবধানে বাইকটাকে
পাশে দাঁড় ক’রিয়ে বাইকের
ক্যারিয়ার থেকে কয়েকটা পুরনো নিউজ পেপার বের করে সম্বিত। বসার জন্যে পেতে দ্যায়
মাটিতে। নিজেই আগেভাগে তাতে বসে। তারপর বলে,
--- আরে তোমাকে তো বলাই হয় নি। ইট্স এ সারপ্রাইজ, তোড়া।
--- কীসের সারপ্রাইজ?
--- আরে তোমাদের ঐ মেয়েটা। কী যেন নাম...। ঐ যে আন্ডার
গার্মেন্টস শো করা ড্রেস পড়ে রে বাবা!
তোড়া খুব রেগে যায়। মুখ ঝামটে বলে--- ছিঃ! ওসব আবার কী কথা!
ইউনিভারসিটিতে ঐ ক’রতে আসো বুঝি?
ওরকম পাপী চোখ কেন তোমার? কার কোথায় কী দেখা যাচ্ছে?
--- আরে ভাই, দেখি নি। দেখিয়েছে। রোজই দেখায়। আমার কী দোষ!
--- কে? কার কথা বলছো? পারমিতা?
--- ইয়েস ইয়েস। পারমিতা। আরে তার তো বিয়ে হ’য়ে গেছে।
কথাটা শুনে হতবাক হয়ে যায় তোড়া। ও বলে--- কার বিয়ে হ’য়ে গেছে? পারমিতার?
--- ইয়েস ম্যাম। আর তুমি কী ক’রছো?
--- কবে? কবে হয়েছে?
--- সে আর আমি কী করে ব’লবো? আমায় তো নিমন্ত্রন করে নি।
তোড়াও বিদ্রূপ করে--- তবে কি বিয়ে ক’রে তোমায় প্রণাম ক’রতে এসেছিলো? দেখলে কী ক’রে?
কথাকটা ব’ললো বটে কিন্তু
মনে মনে বেশ বুঝতে পারলো, এই জন্যেই পারমিতা গত কয়েকটা দিন ইউনিভার্সিটিতে আসছে
না। কিন্তু হঠাৎ বিয়ে ক’রে বসলো মানে!
একেবারে চুপচাপ বিয়ে! ব্যাপারটা ঠিক হজম হলো না ওর। মনে মনে এও ভাবলো, সম্বিত কী
দেখতে কী দেখেছে! ওর যেমন নামে গণ্ডগোল হয়, তেমনি উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়েও
দ্যায়। তাই আবার জানতে চায়,
--- তা কাকে বিয়ে ক’রলো? সেটা কি দেখেছো?
রসিকতা করলো সম্বিত--- একটা ছেলেকে। আবার ছেলে না হ’য়ে লোকও হ’তে পারে।
--- ধ্যাৎ! বলো না। জানো? কাউকে কি ওর সঙ্গে দেখেছো?
--- শিয়োর। দেখেছি মানে! একেবারে পারমিতার বক্ষ লগ্না হ’য়ে উড়তে দেখেছি। তাহলে গল্পটা ব’লি। আমি ক’টা বই কিনতে কলেজ
ষ্ট্রীটে গিয়েছি। এ্যাতো দূর থেকে তো রোজ যাওয়া যায় না। গুছিয়ে-টুছিয়ে নিয়ে ন-মাসে
ছ-মাসে যেতে হয়। বই কিনছি সরস্বতী বুক স্টল থেকে। হঠাৎ পাশে দেখি, পারমিতা।
তোমাদের বন্ধু। চিনে নিতে একটু অসুবিধে হয় নি।
--- বিয়ে হ’য়ে গেছে? মানে
মাথায় সিঁদুর-টিন্দুর ঐ দেওয়া?
--- হ্যাঁরে বাবা।
---ঐ রকম?
--- ঐ রকম মানে?
--- মানে ঐ রকম আন্ডার গার্মেন্টস?
--- না। সেটাই তো তাজ্জব। জাতে মাতাল তালে ঠিক। দিব্যি
শাড়ি-টারি পরা। সুন্দর লাগছে।
--- উম্ম্! ব’লে তোড়া সম্বিতের পিঠে চড় মারে। আবার বলে--- সুন্দর-টুন্দর তোমায় দেখতে হবে
না। পারমিতাকে ওর বর সুন্দর দেখুক। আসল কথাটা বলো। তারপর?
--- তারপর আর কি! আমাকে দেখে টুক ক’রে গা ঢাকা দিলো। চোখ ঘুরিয়ে আর দেখতে পেলাম না। ভ্যানিশ।
--- গা ঢাকা দিলো! কেন? তার মানে সব সিঙ্কিং সিকিং
ড্রিঙ্কিং ওয়াটার! কিন্তু গা ঢাকা দিলো কেন?
--- দেবে না! বর যে আমাদের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের রনি,
মানে রণজয়। দ্য প্রাইড অফ ইউনিভার্সিটি।।
--- রনি! বল কী? সোজা রনি! কী মেয়ে দ্যাখো! একেবারে এক টোপে
বোয়াল মাছ ধ’রেছে!
--- তাহ’লেই বোঝো। তোমরা
কিস্সু ক’রতে পারলে না। আমি কবে থেকে ব’লছি! চলো, চলো, চলো। আমরা বিয়েটা সেরে নি। তুমি শুনলে
তো...!
গঙ্গার পাড়ে তখন একটু একটু ক’রে সন্ধে নামছে। এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটোনো আরো প্রেমিক-প্রেমিকা ব’সে আছে। তাদের দিকে চোরা চোখে তাকায় তোড়া। দেখতে পায়
সম্বিত। হেসে দ্যায়। বলে,
--- তাকিয়ো না। এখানে অনেক এ্যাডাল্ট সীন হয়। জানো? তুমি
কি এখানে আগে এসেছো? মানে অন্য কারোর সাথে?
রেগে গিয়ে তোড়া ব’লে ওঠে--- ঠাস্ করে একটি চড় মারবো। অসভ্য!
--- জানো কি, আমাদের বাপ-ঠাকুরদাও এখানে এখানে ব’সে প্রেম ক’রেছে। এটা প্রেমের
জন্যেই স্ট্যাম্প মারা জায়গা। সরকারী লাইসেন্স প্রাপ্ত। এখানে কত মানুষের প্রেম গ’ড়েছে, কত মানুষের
প্রেম ভেঙ্গেছে! কত মানুষ কেঁদেছে, আর কত মানুষ হেসেছে--- তার ইয়ত্তা নেই, জানো?
এসো, এখানে ব’সো।
তোড়া সম্বিতের গা ঘেঁষে বসে। এ তল্লাটে তোড়া এই প্রথম।
পাশেই লঞ্চ ঘাট পারাপার ক’রছে। নানা মানুষের
ভিড় সেখানে। সবাই ব্যস্ত। অফিস থেকে ফিরছে কাতারে কাতারে মানুষ। ছোট ছোট লঞ্চে
এ্যাতো মানুষ নিয়েছে যে, যে কোনো বিপদ হ’তে পারে যখন তখন। কিন্তু তাদের বাড়িতে তাদের জন্যে ব’সে আছে তাদের ঘরের মানুষ। সারাদিন দপ্তরে একই একঘেয়ে কাজ ক’রতে ক’রতে যখন ওদের
হৃদয়, মন আর শরীর ক্লান্ত, অবসন্ন, তখন তাদের ছুটি হয়। আর তারা ছোটে বাড়ির পথে,
ঊর্ধ্বশ্বাসে। কে আগে যেতে পারে, তারই যেন প্রতিযোগিতা চলে। সেখানে তাদের জন্যে
কোনো মণ্ডা-মিঠাই অপেক্ষা ক’রে ব’সে নেই। হয়তো বৌ-এর হাতে করা ভুলভাল চা। বড়োজোর
রুটি-তরকারি। এরপর ছেলে-মেয়েদের নিয়ে হয়তো পড়াতে বসা, অথবা টেলিভিশনে কোন একটা
পুরনো বহুবার দেখা সিনেমা দ্যাখা, বা খবর শোনা। এমনকি হয়তো বৌ-এর সাথে সিরিয়াল, না
সিনেমা? কী দেখা হবে--- এই নিয়ে বচসা। সন্ধেবেলা ঘরের মেয়েরা টেলিভিশন আগলে ব’সে থাকে নানা সিরিয়াল দেখার জন্যে। বাবা-মা’র ওপর সন্তানের অবিচার, শ্বশুর বা শ্বাশুড়ির সাথে পুত্রবধূর
অসভ্য ব্যবহার, কিম্বা খল কোন মহিলার চক্রান্ত। এও যেন এক জীবন। পেটি কিন্তু সুখী।
এই তাদের জীবন, এই তাদের আনন্দ, এই তাদের সুখ। তারই টানে
খেয়া পারাপার ক’রে ছুটছে ঐ সমস্ত
মানুষগুলো। তোড়ার ইচ্ছে হয়, ভুলভাল চা বানিয়ে আর রুটি-তরকারি দিয়ে থালা সাজিয়ে
সম্বিতকে খাওয়াতে। ও বেশ ফিরবে সারাদিন অফিসে কাজ ক’রে। গাড়ি-ফারি ক’রে নয়। বাসে বা
ট্রেনে বা খেয়ায়। তোড়াও সিরিয়াল দ্যাখে। তবে যে কোন সিরিয়াল নয়। দাদার সাথে ব’সেই প্রতি বুধবার দুটো সিরিয়াল দ্যাখে। ‘অগর তুম হ’তি’ আর ‘লোগোকা বাত’। দাদা ঐ দিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে। শুধু বোনের সাথে টেলিভিশন
দেখবে ব’লে। কিন্তু... হঠাৎ তোড়ার সম্বিত ফেরে
সম্বিতের ডাকে,
--- কি গো, কোথায় চ’লে যাচ্ছো?
তন্ময় হ’য়ে নেশাগ্রস্তের
মতো তোড়া বলে--- তোমার মুখে এই ‘কিগো’ কথাটা কী সুন্দর শোনালো!
--- হ্যাঁ, সুন্দর। এরপর বিয়ের দু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই
বলবে, ‘সারাদিন শুধু “হ্যাঁগো” “কিগো”! আর পারি না
বাপু। জ্ব’লে যাচ্ছি।
প্রতিবাদ করে তোড়া--- না স্যার, মোটেই না। আমি ওরকম মেয়ে
নই।
তোড়াকে বসিয়ে রেখে সম্বিত উঠে দাঁড়িয়ে বলে--- এভাবে বিরস
মুখে এখানে ব’সে থাকাটা বড়ো
বাজে। তুমি একটু ওয়েট করো। আমি একটু বাদাম-টাদাম কিনে আনি। শুধু ব’সে না থেকে টুকটাক চালাতে চালাতে কথা বলি। আমার আবার
রেস্তোরা-ফেস্তোরা তেমন স্যুট করে না। সে যদি আমায় কিপ্টে বলো, নো প্রবলেম।
--- সরি স্যার, আমারা এরকম ব’লতে শিখিনি। আমার দাদা এমনটা শেখায়নি।
--- ওক্কে বস্। আমার অপরাধ হ’য়েছে। সরি।
--- তুমি কিন্তু আজ একটার পর একটা ফাউল ক’রছো, সম্বিত। সব হিসেব জমা থাকছে।
ব’লে তোড়া হাসে। আজ
ও নিজেকে একদম আলাদা একটা মেয়ে ব’লে আবিষ্কার করে।
আজ ওকে দেখে কেউ কি চিনবে! চিনতে পারবে? সম্বিত একটু দূরে গেছে বাদাম কিনতে।
দ্যাখা যাচ্ছে, দূরে। ছোট্ট দেখাচ্ছে ওকে। সেখানে বেশ আরো কয়েকজন ঘিরে দাঁড়িয়ে
বাদাম কিনছে। বাদাম যেন একটা বিশেষ খাদ্য যাকে প্রেমের সহযোগী অনুখাদ্য ব’লে ধ’রে নেওয়া যেতে
পারে। তোড়া মনে মনে ভেবে নেয়, এই প্রথম ও সম্বিতের সাথে বাইরে এসেছে। কেউ ব’ললে বিশ্বাস ক’রবে না। আট বছরের প্রেম। অথচ প্রেমিকের সাথে এই প্রথম বাইরে। এই কারণেই তোড়া
আর সম্বিত ছাড়া কেউ জানে না যে, ওদের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। এই গোপনীয়তায় সম্বিত
ওকে পূর্ণ সহযোগিতা ক’রেছে।
একেবারে অন্যমনে ছিলো তোড়া। হঠাৎ একটা কোট-প্যান্ট পরা লোক
এসে হাজীর হলো ওঁর সামনে। তোড়া তাকে চেনে না। লোকটা তোড়াকে দেখে একমুখ হেসে দিলো।
বলল--- কী ব্যাপার! কার সাথে এসেছো? এ্যাতো দূরে? মা-বাবা জানেন?
তোড়া তাকিয়ে দেখলো, আর মনে করার চেষ্টা ক’রলো, কে হ’তে পারে। একে তো ও
মোটে চেনে না ব’লে মনে হ’চ্ছে। ভদ্রলোকটা তো সেধে গায়ে প’ড়ে কথা ব’লছে। অথচ দেখে তো
মনে হ’চ্ছে, বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের মানুষ। ওকে কি
চেনে নাকি? কিন্তু তোড়া হাজার চেষ্টা ক’রেও চিনতে পারলো না। আবার তোড়া এটাও লক্ষ্য ক’রছে, লোকটা ওর বাবা-মা’র কথা ব’লছে। তাতে ক’রে এটা তো স্পষ্ট
হ’চ্ছে যে, হয়তো লোকটা ভুল ক’রে ওকে এসব ব’লছে। বাবা-মা তো বহুদিন আগে... । কেসটা বুঝে উঠতে পারে না মোটে। নিজেদের অঞ্চলের
মধ্যে তোড়ার যত মস্তানি। এখানে তো ও একেবারে নবাগতা। তাই বেশ খানিকটা ভেজা বেড়ালের
মতো অবস্থা ওর। মুখটা শুকিয়ে যায়। মানুষটার যা ব্যক্তিত্ব, তাতে ভালো মন্দ ব’লেও দেওয়া যাচ্ছে না। ও জিজ্ঞাসা ক’রলো,
--- আপনি কি ভুল করছেন, স্যার? আপনাকে আমি তো চিনতে পারছি না।
আমাকে আপনি কোথা থেকে চিনলেন?
আবার হেসে ভদ্রলোকটি ব’ললেন--- তোমাদের বাড়িতে তো আমি রেগুলার যেতাম। মনে নেই? চিনতে পারছো না, না
চিনতে চাইছো না?
লোকটার কথার শেষের অংশগুলো বেশ ধমকের মতো শোনালো। তোড়া খুব
বিপদে প’ড়ে গেলো। কে জানে, দাদাকে চেনে কিনা।
কিন্তু দাদার নাম তো মোটেই ব’লছে না! একবার
ভাবলো তোড়া, ব’লে দ্যায়, ‘আমার বাবা-মা তো বেঁচে নেই। আমার ছোটবেলাতেই...।’ আবার ভাবলো, থাকগে। পরিবারের কথাটা লোকটাকে আগে থেকে না
বলাই ভালো। আজকাল নানা মানুষ কলকাতা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যারা অন্যের পরিবারে
খবরা-খবর নিয়ে নানা বদমাইশি করে। এবারে বিরক্তি লাগতে লাগলো সম্বিতের ওপরে। এতক্ষণ
কী বাদাম কিনছে! এরকম জায়গায় একটা মেয়েকে একা রেখে দিব্যি...। তোড়া মনে মনে ঠিক ক’রে নেয়, লোকটাকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, তোড়া ওর অপরিচিত। তা
নয়তো বেশ একটা রিস্কি ব্যাপার ব’লে মনে হ’চ্ছে এখন। এখান থেকে চিৎকার ক’রে ডাকলেও তো সম্বিত শুনতে পাবে না। না, এবারে এখান থেকে
সম্বিতের কাছে চ’লে যাওয়াই ভালো।
এই না ভেবে যেই উঠে দাঁড়িয়েছে, অমনি লোকটা একটা ধমক দিয়ে ব’সলো,
--- কোথায় যাচ্ছো? বোসো চুপ ক’রে। বোসো।
তোড়া এতোটা ভয় পায় যে, ঝুপ ক’রে ব’সে পড়ে। জীবনে ধমক খায়নি তোড়া। দাদা কখনও
একটা মন্দ কথা বলেনি। কিন্তু এই মক্কেলটি কে যে, ওকে এভাবে ধমকাচ্ছে? এর মধ্যে
কয়েকজন লোক ছুটতে ছুটতে ওখানে এসে পড়ে। সঙ্গে এক মহিলাও ছিলো। তারা এসেই
ভদ্রলোকটিকে ধ’রে নিয়ে যায়।
তোড়াকে হাতজোড় ক’রে মহিলাটি বলে,
--- আপনাকে বোধহয় ধমক-ধামক ক’রছিলেন, না?
তোড়া একেবারে সাইলেন্ট। কোন কথা যোগাচ্ছে না ওর মুখে।
মহিলা আবার ব’ললেন--- ওর মাথাটা না খারাপ। আসলে ওর একমাত্র মেয়ে বাড়ি থেকে চ’লে যায় একটা ছেলের সঙ্গে। তার কোন খোঁজ নেই। আজ দু-দুটো
বছর। পুলিশ আজও কোনও সন্ধান ক’রতে পারে নি।
এরপরে মাথাটা খারাপ হ’য়ে যায় ওর।
চিকিৎসা চ’লছে। উনি খুবই বিত্তশালী মানুষ। আসলে
আমারা এখানে রোজই আসি। ঐ যে লাল গাড়িটা? ওটা ওরই গাড়ি। ওর একটু আলাদা পরিবেশ
দরকার। ডাক্তার ব’লেছেন। তাই এই
গঙ্গার পাড়ে আসি ওকে নিয়ে। আপনাকে বোধহয় ভালোমন্দ কিছু ব’লেছেন। আপনি কিছু মনে ক’রবেন না। আসলে আজো উনি মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আপনাকে নিশ্চয়ই বাড়ি থেকে
পালিয়ে আসা কোন মেয়ে মনে ক’রেছেন। তাই না?
এটাই ওর একমাত্র সিম্পটম। খুঁজে বেড়াচ্ছেন মেয়েকে। মেয়ের চ’লে যাওয়ার শকটা উনি নিতে পারেন নি। কে-ই বা পারে, বলুন?
আপনি প্লীজ কিছু মনে ক’রবেন না। ওর হয়ে
আমরাই ক্ষমা চেয়ে নিছি।
তোড়া কিছু মনে করেনি, এমনভাবে হতবুদ্ধির মতো মাথা নাড়ে। ওরা
চ’লে যায়। তোড়া মাথা ধ’রে ব’সে পড়ে। ওর মনে
বার বার একটা কথাই উঁকি দিতে থাকে, যদি ও বিয়ে ক’রে এমনিভাবেই চ’লে যেতো, তবে ওর
দাদার কি অবস্থা হোতো? বার বার মনে হ’তে থাকে, এই যে দাদার জানার অন্তরালে সম্বিতের সাথে একটা সম্পর্ক ক’রে ব’সে আছে, এর
প্রতিক্রিয়া দাদার মনে কেমন হবে? মাথার মধ্যে এমন নানা প্রশ্ন, নানা সংশয়, নানা ধন্ধ ওকে ক্ষত-বিক্ষত
ক’রতে থাকে। তাই মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম ক’রতে থাকে তোড়ার। বার বার মনে হ’তে থাকে, মেয়েটার সন্ধান নেই কেন? সে কি বাড়ির ভয়ে লুকিয়ে
আছে বিয়ে ক’রে, নাকি ছেলেটা ওকে বিক্রি ক’রে দিয়েছে কোথাও? কাগজে এমন কত খবরই তো ছাপা হয়! মনে হয়,
সম্বিত ওকে ঠকাবে না তো? আসলে যে পাপ করে, তার পাপ এক। আর যার ওপরে পাপ হবে ব’লে মনে হয়, তার পাপ শতেক। সে নানা মানুষকে পাপী ভাবতে থাকে।
এর মধ্যে সম্বিত ফিরে এসেছে। দু-হাতে বাদাম ভাজা। কিন্তু
তোড়াকে এভাবে ব’সে থাকতে দেখে
ঘাবড়ে যায়। জিজ্ঞাসা করে,
--- কী হ’য়েছে, তোড়া? কী
ব্যাপার? মাথাটা কি ধ’রেছে?
তোড়ার সম্বিতের ডাকে হুশ হয়। মাথা তুলে সম্বিতকে হঠাৎ জড়িয়ে
ধরে। কেঁদে ফ্যালে তোড়া। সম্বিত আরও ঘাবড়ে যায়। তোড়াকে এই প্রথম কাঁদতে দেখলো ও।
তাই পরম আদরে ওকে জড়িয়ে ধরে। পরম আদরে বলে,
--- এই তো, আমি তো আছি। কী হয়েছে, সোনা? আমাকে বলো, কী
হয়েছে। কেউ কি কিছু ব’লেছে? কোনো টন্ট
ক’রেছে কেউ?
তোড়া সম্বিতের বুকের মধ্যে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতেই বলে---
আমি বাড়ি যাবো। আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো। আমি বাড়ি যাবো, সম্বিত।
হতবাক হ’য়ে যায় সম্বিত।।
এর মধ্যে এমন কী ঘ’টে গেলো যে, তোড়া
একটা বাচ্চা মেয়ের মতো ‘বাড়ি যাবো বাড়ি
যাবো’ ব’লছে? কিছু না বুঝেই বলে--- ওকে ওকে। কুল ডাউন তোড়া। কুল ডাউন। চলো। বাড়িই চলো।
নো প্রবলেম। এসো।
তোড়া বাইকে উঠতেই হেসে দিয়ে বলে সম্বিত--- দাদার আদরের
সোনা। বুঝেছি। দাদার জন্যে মন কেমন ক’রছে।
কিন্তু বাইকে উঠে তোড়ার মুখে গোটা ঘটনাটা শুনে বলে---
দ্যাখো দেখি! আমার জন্যে তোমাকে কি সব অকওয়ার্ড অবস্থায় প’ড়তে হোল! ছি ছি!
তারপর বাইকে স্টার্ট দিয়ে অবস্থাকে সহজ ক’রতে সম্বিত ব’লে ওঠে--- জড়িয়ে ধ’রো কিন্তু। আর তো
আমার সঙ্গে এভাবে বেরোবে না। তাই এই শেষবার। চল্ পান্সি বেলঘরিয়া।
--------------------
এইসব
বিহঙ্গেরা
পরিচ্ছেদ – ৮
যখন কোনো বাড়িতে বাবা-মা’র নিত্য অশান্তি কমন, বাড়িতে কাক-চিল ব’সতে পারেনা, সেই বাড়িতে যদি দুজনেই সারাটা দিন চুপচাপ কাটিয়ে দ্যায়, তবে বাড়ির
মানুষের মনে একটা দুশ্চিন্তা তো হয়ই। অথবা যে ছাত্রটিকে ক্লাশে দেখলেই মাস্টারমশাই
তাকে এক প্রস্থ না পিটিয়ে শান্তি পান না, সেই ছাত্রটিই যদি মাস্টারমশাইকে সপ্রেম
আর শান্ত দ্যাখে, তবে তার দুশ্চিন্তা হয় বৈকি। আজ মঞ্জুলার তেমনই হ’চ্ছে। আজ দিন দশেক হোল, ও রাস্তায় বের হ’লে যে ছেলেটা পাহারাদারের মতো ফলো করে, সেই ছেলেটা আর পেছনে
আসে না। কেউই আজকাল ওকে ফলো করে না। এ এক মস্ত জ্বালা হ’য়েছে।
মানুষের একটা ভালো হোক বা মন্দ--- কেমন একটা অভ্যেস হ’য়ে যায়! পছন্দ করুক, না করুক--- অভ্যাসটা তো কাজকর্মের সাথে
লেগে থাকে। মঞ্জুলা জানতো, রাস্তায় বের হওয়া মানে, ঠিক ছেলেটা পেছনে পেছনে লেগে
থাকবে। কিন্তু আজও প্রাইভেট প’ড়তে বেরিয়ে
কয়েকবার পেছনে তাকিয়েছে। দেখেছে, ছেলেটা নেই। একটা ফাঁকা ফাঁকা অনুভূতি হ’চ্ছে মঞ্জুলার। ফলে ওর হাঁটার গতি যেন কমে যাচ্ছে বার বার।
যেন মঞ্জুলা অপেক্ষা ক’রতে ক’রতে হাঁটছে। যেন ছেলেটা এখনই পেছনে দৃশ্যমান হবে যদি
হাঁটাটা মঞ্জুলা শ্লথ ক’রে দ্যায়। কিন্তু
না। আজো না। আজও ওকে একা একা যেতে হবে অনেকটা পথ। সঙ্গে কেউ আছে, ওর কোন বিপদ-আপদ
নেই--- এসবের মধ্যে পথটা কখন যেন অতিক্রান্ত হয়ে যেতো। অন্তত অবাঞ্ছিত লোকটাকে
নিয়ে একটা এঙ্গেজমেন্ট তো সারা পথ জুড়ে থাকতো। তাতে পথশ্রান্তি তো কাটতো। যে আসছে,
সে কী করছে, কী ক’রলে তাকে একটু
ভোগানো যায়, মাঝ পথে লুকিয়ে গেলে কেমন হয়--- এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে পোঁছে যাওয়া
যায় একটা গন্তব্য স্থানে। কিন্তু আজ দিন পনেরো হ’লো সেটা বন্ধ। হেঁটে যাচ্ছি তো হেঁটেই যাচ্ছি। কোনও কাজ যেন হাতে নেই। আজকে
বেশ অদ্ভুত লাগে মঞ্জুলার এই কথা ভেবে যে, এই ছেলেটার জন্যেই ও একদিন তোড়াকে ওর
সঙ্গে আসতে অনুরোধ ক’রেছিলো। তখন কি ও
জানতো, ছেলেটা না থাকলে এমন একটা অনুভূতি হ’তে পারে! কী যেন নেই নেই ভাব হ’তে পারে?
প্রথম দিন মনে হ’য়েছিলো, ভালোই হ’য়েছে। আজ তো
জ্বালাবার কেউ নেই। আজ দিব্যি একা একা স্বাধীন মতো হেঁটে স্যারের বাড়ি যেতে পারবে।
কেউ একজন সঙ্গে থাকলে, বিশেষ ক’রে অপ্রত্যাশিত বা
অবাঞ্ছিত কেউ, তবে হাঁটা-চলা বেশ সামলে ক’রতে হয়। শুধু মনে হয়, কোথায় যেন একটা অসংলগ্নতা, বা একটা অসংবরন ভাব মনে হানা
দিচ্ছে। আজ আর সে শঙ্কা নেই। বেশ খোলামেলা হাল্কা চালে হেঁটে যাওয়া যাবে।
ইউনিভারসিটিতে যাওয়া, ফেরা বেশ ভালোই কেটেছে। ওর সহ-পাঠিনীরা ওকে বিদ্রূপ ক’রে ব’লেওছে,
--- কিরে? তোর বডিগার্ড কোথায়? আজ আসেনি?
মঞ্জুলা অজানা কারনে লজ্জিত হ’য়েছে। ও-ও ব’লেছে--- চুপ কর
তো। তোরা পারিসও। কে না কে বডিগার্ড!
আর একজন ব’লেছে--- বাবা, একা
এলি! তোর সাহস আছে ব’লতে হবে।
তৃতীয় জনের প্রশ্ন--- তোর বডিগার্ড তোকে একা একা ছাড়লো! কী
লিবারেল, ভাই!
মঞ্জুলা ব’লেছে--- কী জানি
ভাই, জানি না। অন্তত আজ আমি স্বাধীন। তাই তা ধিন তা ধিন তাধিন!
রসিকতা ক’রলেও দ্বিতীয় দিনে
একটু অস্বাভাবিকতা ঠেকেছে ওর। আর কিছুনা। এই বেমক্কা ছেলেটা গেলো কোথায়? হঠাৎ
চৈতন্য উদয় হোল কি করে? এইসব। তাও একপ্রকার কাটানো গেছে। মন ভেবেছে, ছেলেটার
নিশ্চয় শরীর-টরীর খারাপ। হ’তে তো পারে।
কিন্তু তৃতীয় দিন থেকে বেশ একটা অস্বস্তি মঞ্জুলাকে গ্রাস ক’রেছে। বার বার মনে হ’চ্ছে যে, পেছনে সে যেন থাকে, সে যেন ইচ্ছে ক’রে লুকিয়ে লুকিয়ে হাঁটে পেছনে পেছনে। এইভাবে কয়েকবার পেছনে তাকিয়েও দেখেছে
মঞ্জুলা, যদি তাকে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু রাস্তার সেই অন্ধ ভিখিরি ছেলেটা ছাড়া
এই ভর দুপুরে কেউ কোত্থাও নেই। আর শুধু জগাদা নামে লোকটার পানের দোকানটা খোলা র’য়েছে। যে লোকটা মুষ্কো মতো, দোকানে একটা নীল গেঞ্জি প’রে ব’সে থাকে, সে-ই
বোধহয় জগাদা। আজও সে একাই ব’সে আছে। রাস্তাটাও
যেন একা একা বুক পেতে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
ঠিক হতাশা নয়, একটা অস্বস্তি মঞ্জুলাকে পেয়ে বসে। দু-একবার
দাঁড়িয়ে প’ড়েছে রাস্তায়। ওর নিজেরই মনে হয়, মনে মনে
কি ও ব’লেছে, ‘যেন ছেলেটা দেখা দ্যায়।’ নিজের প্রতি
আস্থাটাও নেই আজ। মনে হচ্ছে, যেন ও একবার ঠাকুরকে ডেকেওছে, ‘ছেলেটাকে যেন দেখা যায়।’ আবার এ কথাটাও মনে হ’চ্ছে, কোনো
ঠাকুর-টাকুরকে ও আদৌ ডাকেই নি। এ সব মনের ভুল। ও কেন ডাকতে যাবে! ছেলেটা ওর কে-ই
বা হয়!
হঠাৎ সব কিছুকে তুচ্ছ ক’রে একটা কণ্ঠ--- হ্যালো ম্যাডাম!
কে যেন ডাকলো? গলাটা চেনা চেনা লাগছে না? মঞ্জুলার আবার মনে
হোল, এটাও মনের ভুল। একা রাস্তায় এরকম মনের ভুল হয়। মানুষ তো ঘুমের মধ্যেও হঠাৎ
তার নাম ধ’রে কেউ ডাকলো ব’লে ভুল ক’রে উত্তরও দ্যায়।
একে বুড়িরা বলে ‘নিশির ডাক’। তাই এসব ইল্যুশন খেরে ফেলে মঞ্জুলা আবার দু-পা হাঁটে।
আবার ডাক,
--- একটু দাঁড়িয়ে যাবেন? প্লীজ, ম্যাডাম!
না, এবার তো ভুল নয়। ঠিকই শুনেছে। ফিরে তাকানো যাক। আগে তো
রাস্তায় দু-দুবার ভুল ক’রে এমনিই
তাকিয়েছে। আবার না হয় একবার ভুল ক’রেই তাকাবে। এবার
একটা অন্য কণ্ঠ কানে এলো,
--- রবি দা! জোরে ডাকো। এ্যাতো নিচু ডাকলে কি ম্যাডাম শুনতে
পাবে?
তখনও পেছন তাকায়নি মঞ্জুলা। রবি দা’র কণ্ঠ ধ’মকে ব’ললো--- চুপ কর। বেশী পাকা!
মঞ্জুলার মনের ভেতরে একটা বিরাট আন্দোলন হ’লো। একটা জলের ঘূর্ণি যেন পাক খাচ্ছে। মনে হোল, কেউ যেন বড়ো
ভরসার মানুষ তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মনের মধ্যে তখন একটা গুড় গুড় ধ্বনি যেন
মঞ্জুলা নিজের কানে শুনতে পাচ্ছে। পাছে কেউ শুনতে পায়, তাই খুব জোরে সামলে নিলো নিজেকে।
পেছন তাকিয়ে দেখলো, সেই মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে। মনে হোল, ব’লে ফ্যালে, ‘এ্যাতোদিন কোথায়
ছিলেন?’ কিন্তু শব্দগুলো কেমন যেন কবিতার মতো হ’য়ে যাবে। কী যেন একটা কবিতার এমন একটা লাইন পড়েওছিলো। তাই
নাটক ক’রে ব’ললো,
--- আমায়? আমায় ডাকছেন?
ছেলেটা ‘হ্যাঁ’ বলার মতো মাথা নাড়লো। মঞ্জুলা আবার ব’ললো--- এ্যাতো আস্তে ডাকলে কেউ শুনতে পায় বুঝি কখনও!
শব্দগুলো মঞ্জুলার মুখ থেকে যেন ম্যাজিশিয়ানের হাত থেকে
ম্যাজিক শো-এ ফুর ফুর ক’রে বেরোনো ফিতের
মতো বেরিয়ে আসছিলো। কোথাটা ব’লেই ভাবলো, এতো
সাহস ও পেলো কোথা থেকে! কেমন যেন নিজেকে ফরোয়ার্ড ফরোয়ার্ড মনে হোল। তাই
ফরোয়ার্ডের মতই ব’লে দিলো,
--- আমায় সব সময় ফলো করেন কেন?
ছেলেটা মাথা নিচু ক’রে থাকে। যেন বলার মতো কোন ভাষা নেই ওর। মঞ্জুলা বুঝলো, মাটিটা নরম। তাই সুযোগ
বুঝে বেশ শাসন ক’রে আবার বলে---
এ্যাতোদিন যে গায়েব ছিলেন? কোথায় গিয়েছিলেন?
ছেলেটা কাছে এসে ব’ললো--- সেইটাই তো ব’লবো ব’লে... আসলে একটা গুড নিউজ দেবো ব’লেই তো ডাকলাম।
মঞ্জুলা দেখলো যে, ছেলেটা তোতলাচ্ছে। ও আর এখানে দাঁড়াতে
চাইছিলো না। যে কোন মুহূর্তে ইউনিভারসিটির যে কেউ এসে যেতে পারে। এখান দিয়েই তো
স্যারের কাছে সকলে প’ড়তে যায়। একেবারে
ব্যাপারটা র’টে যাবে গোটা
ইউনিভারসিটিতে। তাছাড়া ঐ যে অন্ধ ছেলেটা... ও দেখতে পায় না বটে। কিন্তু যেভাবে
মুখটা এদিকে ক’রে আছে, তাতে যেন
মনে হ’চ্ছে, ও ওর ঘোলাটে চোখ ফিয়ে মঞ্জুলার
ভেতরটা স্পষ্ট দেখতে পাবে। ও শুনেছে, প্রতিবন্ধীদের অনুভূতি খুব প্রবল হয়। অন্তত ঐ
রবিদা নামে ছেলেটার থেকে বেশী তো বটেই। তাই হাঁটতে থাকলো পা-এ পা-এ। রবি নামে
ছেলেটাও এগোতে থাকে। অন্ধ ছেলেটা পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
--- রবি দা, আজ দুটো গুড নিউজ পেলাম। তার জন্যে একটা টাকা
দিয়ে যাও।
কী মনে হ’লো মঞ্জুলার, ও
একটা পাঁচ টাকার কয়েন পিছিয়ে গিয়ে দিয়ে এলো অন্ধ ছেলেটাকে রবি ব’ললো,
--- আপনি দিলেন কেন? আমিই তো দিতাম।
এই প্রথম ছেলেটার নাম জানতে পারে মঞ্জুলা। রবি। সেই জন্যেই
কি অন্ধ ছেলেটিকে কৃতজ্ঞতায় টাকা দিলো মঞ্জুলা? সন্দেহ হয়, এটা ও নিজে সেই মঞ্জুলা
তো? কোথা থেকে কথা বলার মতো ভাষা পেলো ও? মনে মনে সাবধান ক’রলো নিজেকে, ‘ধীরে, ধীরে মঞ্জুলা, ধীরে এ্যাতো হর-বর ক’রোনা। বড্ড বেশী কথা বোলছো।
রবি ব’ললো--- আমি একটা
চাকরী পেয়েছি। সরকারী। তারই নানা কাজে... মানে মেডিক্যাল, পি. ভি., আদার পেপারস
এইসব নানা কাজে এ্যাতোদিন ফেঁসে ছিলাম...।
কথাটা ব’লে এমনভাবে তাকালো
রবি যেন একটা বোকা ছেলে হঠাৎ একটা বোকামি ক’রে বোকা বোকা কথা ব’লে ব’সেছে। কথাটা ব’লে রবি নিজেই ভাবলো, ‘সরকারী’ শব্দটা ব্যবহার করার কী দরকার ছিলো? যেন বিয়ের সম্বন্ধ ক’রতে এসেছে। তখনও এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মঞ্জুলা আর
সেই দৃষ্টি রবির ভেতরটাকে ছারখার ক’রে দিলো। রবি
বুঝলো, আজ ও ম’রেছে। কারোর মুখে
কোনো কথা নেই। এক সেকেন্ড, দু সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড--- হঠাৎ মঞ্জুলারও মনে হোল,
এটা ঠিক হ’চ্ছে না। এভাবে বাকরুদ্ধ হওয়ার মানে কী? বড়জোর একটা ভদ্রতাজনক ‘কংগ্র্যাট্স’ বলা যেতে পারে। তার বেশী কেন? তাই ব’লতেও চাইলো ও। কিন্তু ব’লে ফেললো অন্য
কথা,
--- তাহলে তো ভালো খবর। যান, চা-এর দোকানের বন্ধুদের সাথে
সেলিব্রেট করুন। আমার কাছে কেন? বলেই মঞ্জুলা ভাবলো, এ সব কী ব’লছে ও! কেন ব’ললো, ‘আমার কাছে কেন?’ এ কথার মানে কী? তা কি ছেলেটা আদৌ বোঝে না!
কিন্তু রবি মোটেই তথাকথিত কোনো ঠাট্টা ক’রলো না। সহজ ভাষায় সোজাসুজি ব’ললো--- আসলে আজ থেকে তো আমি ওদের কাছে ভিন্ন জাতি হ’য়ে গেলাম। ওরা বেকার আর আমি সকার। ওদের নিয়ে আনন্দ করার কোন
অধিকার আর আমার রইলো না। ওরা এটাকে সেন্টিমেন্টে নেবে।
--- তাহলে কোনো গার্ল ফ্রেন্ডকে নিয়ে তো সেলিব্রেট ক’রতে পারেন। ভান ক’রে প্রশ্ন করে মঞ্জুলা। ভালোই জানে ও, গার্লফ্রেন্ড থাকলে মঞ্জুলার পেছন পেছন
খামোকা ঘুরবে কেন?
রবির ব’লতে ইচ্ছে হোল,
তুমিই তো... তুমিই তো সেই...। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো জোরসে। তারপর ব’ললো--- গার্লফ্রেন্ড? কেউ আমাদের ফ্রেন্ড হ’তে চায় নাকি? আপনি হ’তে চান?
রবির প্রশ্নের একটা মোক্ষম উত্তর খুঁজছিল মঞ্জুলা। ব’লেও দিলো--- আমি? আমাকে দিয়ে চ’লবে? পরেই সুর পাল্টে ব’ললো--- হ’তে পারি। আমার
আপত্তি নেই। আমার সঙ্গে কি সেলিব্রেট করা যাবে?
মঞ্জুলার ছুঁড়ে দেওয়া চাতুরীতে ভেতরে ভেতরে লাফিয়ে ওঠে রবি।
যেন আকাশে ঘোর অমাবস্যাতেও একটা রূপোর থালার মত হাসিরাশি চাঁদ দেখেছে, এমন একটা
হাসি দিয়ে ও ব’লে উঠলো,
--- আপনি? রিয়ালি?
--- অগত্যা। চাকরী পেয়েছেন ব’লে কথা। কাউকে না কাউকে সেলিব্রেট তো ক’রতে হবেই। কাউকে না কাউকে সঙ্গে তো চাই-ই। অগত্যা আমিই না হয়...।
--- না না। আপনি অগত্যা নন। ইউ আর মোস্ট ওয়ান্টেড। না মানে
আমি ব’লতে চাইছি... আপনার কোন বিকল্প তো নেই।
--- রিয়েলি? ঠিক আছে। চলুন। তাহলে একটা রেস্তোরায় ঢোকা যাক।
মঞ্জুলা প্রস্তাব দ্যায়।
--- Restaurant ! ও বাবা! আমি তো ভাবলাম, বাদাম ভাজা দিয়ে সারবো। আমি তো এক্সপেক্ট ক’রিনি। তাই রেডিই ছিলাম না। আর মাইনে না পেলে তো...। তোতলায়
রবি।
--- ওকে। সেটা না হয় বিকেলটা ঢ’লে গেলে হবে। দুপুরের প্রথম ট্রিট-টা না হয় আমিই দেবো। হবে
তো? মঞ্জুলা পরিস্থিতি সামলায়। বুঝতে পারে, একটি কর্মহীন ছেলেকে ঝপ্ ক’রে রেস্তোরার কথাটা বলা ঠিক হয় নি। আরো একটা ব্লান্ডার ও ক’রে ব’সেছে। নিজে নিজেই
ভেতরে ভেতরে জিভ কাটে মঞ্জুলা। আবার ও বিকেলের কথাও ব’লে ফেলেছে।
রবি বিস্মিত হ’য়ে ব’লে ওঠে--- আপনি বিকেল অবধি আমার সঙ্গে
থাকবেন? সিরিয়াসলি? আমি না জাস্ট বিশ্বাস ক’রতে পারছি না। একটা স্বপ্নের মতো মনে হ’চ্ছে।
মঞ্জুলা আবার রসিকতা করে--- কেন? আপনার মত নেই?
--- কী যে বলেন! অমত করার সাহস আমার আছে নাকি!
--- তা এখানে দাঁড়িয়েই স্বপ্ন দেখবেন, না কি যাবেন? যে কেউ
দেখেটেখে ফেললে আপনারও বিপদ, আমারও। চলুন।
আজকে বার বার কেমন যেন আলগা হ’য়ে যাচ্ছে মঞ্জুলা। দেখে ফেলার ভয় কারা পায়, সেটা যেমন
মঞ্জুলা বোঝে, তেমন রবি কি বোঝে না? ও এবার রবিকে নিয়ে ঢোকে ‘ডেলিশিয়াস’এ। ডেলিশিয়াস এ তল্লাটের সেরা রেস্তোরা। সবাই এখানে আসতে সাহস
পায় না। এমনকি এখানে দারোয়ানকে পর্যন্ত টিপ্স দিতে হয়। তবে এখানে ডিশগুলো বেশ
স্ট্যান্ডার্ড করে। ভাইফোঁটায় ও ভাইদের নিয়ে এখানে এসেওছে আগে। শুধু তাই নয়,
ভাই-বোনদের সাথে এখানে আসেও ও মাঝে মাঝে। ঢুকতেই ডোর কিপারটা চিনতে পেরে ব’ললো-
--- গুড আফটার নুন, ম্যাডাম!
মঞ্জুলার ফেভারিট একটা ক’রে চিকেন নুড্লস সুপ অর্ডার দিলো মঞ্জুলা। সঙ্গে দুটো কফি। রবি ভীষণ অস্বস্তি
অনুভব ক’রছিলো। ব’লে ওঠে,
--- বাবা! আপনাকে তো চেনেও দেখছি। কিন্তু এ্যাতোগুলো টাকা
একসঙ্গে ব্যয় করার কী দরকার ছিলো?
মঞ্জুলা হাসে। ব্যঙ্গ করে--- এ্যাতো কঞ্জুস নাকি আপনি!
বাবা! মাইনে পেলে তাহলে ভালোমন্দ হবে না ব’লছেন?
রবি ব’ললো--- না না। সে
আপনি যা খেতে চান, তাই হবে। আপনি চাইলেই গোটা মাইনেটাই হবে।
--- হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রথম প্রথম অমন কথা বলে সব পুরুষেরা।
কথাটা ব’লেই মনে হোল, এটা বলা আর একটা বোকামি হ’লো। কিছুতেই জিভটা বশে থাকছে না।
নিঃশব্দে সাদা টিউনিকে সাজগোজ করা পাগড়ী দেওয়া ওয়েটারেরা
খাবার দিচ্ছিলো। বেশ কিছু ছেলেমেয়ে এখানে ওখানে ব’সে নানা খাবার খাচ্ছে। রবির মনে হোল, ওরা সবাই একে অপরকে ট্রিট দিচ্ছে কিনা।
কিন্তু এসব বোকা বোকা প্রশ্ন করা তো যাবে না। মন ব’ললো, ‘যাক গে, মরুক গে।’ তবে এটা পরিষ্কার হোল যে, ওরা একে অপরকে চেনে অনেকদিন।
রবির মতো আনকোরা নয়। থেকে থেকে ওরা নিম্ন স্বরে হাসাহাসি ক’রছে। এই প্রথম রবির মনে হোল, বয়সটা কোন ফ্যাক্টর নয়। বয়স হ’লেও গার্লফ্রেন্ড নিয়ে রেস্তোরায় যাওয়ায় ও অনেক জুনিয়র।
অভিজ্ঞতায় ও ছোটো। মঞ্জুলা কি সত্যি ওর গার্লফ্রেন্ড নাকি? মঞ্জুলা রবিকে নিয়ে
একটা পর্দা ঘেরা কেবিনে ঢুকলো। বেশ সঙ্কোচ হ’চ্ছিলো রবির। এটা লক্ষ্য ক’রেছে মঞ্জুলা।
কিন্তু কেন সঙ্কোচ, তা না বুঝেই হেসে ফিসফিস ক’রে ব’ললো,
--- আমার ব্যাগে তিন-চারশো টাকা সব সময় থাকে, স্যার।
ঘাবড়াতে হবে না। আমার বাবা বেশ বড়লোক।
আধ ঘণ্টার মধ্যে দুটো দারুণ পোর্সিলিনের পাত্র আর নানা মশলা
একটা ট্রে-তে সাজিয়ে নিয়ে এসে পড়ে ওয়েটার। গরম গরম স্যুপ। হা ক’রে দেখছিলো রবি। এমন একটা দামী পোর্সিলিনের প্যান, এমন
কায়দা করা সব অদ্ভুত চামচ, জীবনে দ্যাখেনি। মশলার পাত্রগুলো পর্যন্ত রবিকে বশ ক’রে ফেলেছে। এসব খাবার কায়দাটাও রবির জানা নেই। আজ জীবনে
প্রথম এ্যাতো কস্টলি খাবার রবি রেস্তোরায় ব’সে খেতে চ’লেছে। কিভাবে শুরু
ক’রবে, সেটাই হ’ল সমস্যা। ভালো ক’রে দেখলো, মঞ্জুলা মশলা মিশিয়ে মিশিয়ে চামচ দিয়ে টুক টুক ক’রে স্যুপ খাওয়া শুরু ক’রে দিয়েছে। চোখ তুলে তাকিয়ে মঞ্জুল রবিকে ব’ললো,
--- খান। কফি একটু পরে আসবে। ব’লে খেতে খেতেই ব’ললো--- কেমন লাগছে, বলুন।
রবি লজ্জা ক’রতে ক’রতে আর মঞ্জুলাকে খাওয়ায় নকল ক’রতে ক’রতে ব’ললো--- দারুণ। রিয়েলি খুব খিদে পেয়েছিলো। ব’লেই ভাবলো, আজ বড্ড ইংরেজি শব্দ ব্যবহার ক’রছে ও। ইচ্ছে ক’রে ক’রছে না। হ’য়ে যাচ্ছে।
--- তাহলে আগে বলেন নি কেন? কথাটা ব’লতে ব’লতে মঞ্জুলা ভাবে,
কেমন অদ্ভুতভাবে একটা অচেনা অজানা ছেলের সাথে রেস্তোরায় ব’সে গসিপ ক’রছে, আর খাচ্ছে।
বাবা জানতে পারলে শুধু মঞ্জুলাকে নয়, রবিকে পর্যন্ত পাড়া ছাড়া ক’রবে। বাবার সে ক্ষমতা আছে। মঞ্জুলা জানে, টাকা যার ক্ষমতা
তার। এবার প্রসঙ্গ বদলায় মঞ্জুলা,
--- একটা কথা বলি?
--- বলুন।
--- একটা কথা ব’লবো কিছু মনে ক’রবেন না তো?
--- কেমন কিছু মনে ক’রবো না?
--- মন্দ।
--- না। ক’রবো না।
--- কথা দিলেন কিন্তু।
--- কথা ছাড়া আর কী কী চান, তাও দিলাম। দিলাম। বলুন।
মুখে এমনটা ব’ললেও মনে মনে ব’ললো, ‘মঞ্জুলা, তুমি আমার হও। তোমার জন্যে আমার জীবন- যৌবন-ধন-মান
পর্যন্ত সমর্পিত।
--- আমাকে ফলো করেন কেন?
এই প্রশ্নটা আগেও ক’রেছিলো মঞ্জুলা। রবি কী ব’লবে ভেবে পায় না।
তবে ঠিক করে যে, আজ আর মিথ্যে নয়। এটাই ওর কাছে সবচেয়ে বড়ো চান্স। হঠাৎ ব’লে দ্যায়,
--- আসলে আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।
--- ব্যস? শুধু ভালো লাগে? আর কিছু?
--- এই যে আপনি খাচ্ছেন, আপনার খাবার স্টাইলটাও ভালো লাগে।
--- ফ্লাটিং হ’চ্ছে বুঝি? চোখ পাকায় মঞ্জুলা।
--- ফ্লার্ট যে ক’রবো না, তা-ও নয়। কিন্তু যে যা নয়, তাকে তা ব’লে ফ্লার্টিং ক’রবো না। আপনার তো সবই সুন্দর। ফর গড সেক! ব’লে মেয়েদের মতো রবি নিজের গলায় আঙ্গুল দিয়ে ছোট্ট চিমটি
কাটলো।
তারপর মঞ্জুলা সিরিয়াসলি বলে--- আচ্ছা, এই যে চা-এর দোকানে
ব’সে রাতদিন আড্ডা দেন, সেটা কি কোন গার্লকে ফ্রেন্ড হ’তে ইমপ্রেস ক’রতে পারে কখনও? একটু সোবার হওয়া যায় না?
মাথা নিচু করে রবি। বলে--- আজ এ সব কথা থাক না।
--- আহা কিছু তো ব’লতে হবে। চুপচাপ তো খাওয়া যায় না। বলে মঞ্জুলা।
অগত্যা রবি মুখ খোলে--- সোবার হওয়ার কথা ব’লছেন? সোবার হওয়াটাই কঠিন নয়, ম্যাম। অপরকে সোবার থাকতে
দেওয়াটা কঠিন। মানুষ সোবার থাকতে দ্যায় না। আর তখনই আসে হতাশা। হতাশা অনেকটা
ক্যান্সারের মতো। এতে মানুষ রাস্তায় এসে বসে, নেশাচ্ছন্ন অবস্থায় চ’লে যায় অন্ধকারে।
--- কীসের এ্যাতো হতাশা?
মঞ্জুলাকে বিস্মিত দেখে রবি আরও ঘন হ’য়ে বসে। বলে--- স্বীকৃতি, ম্যাডাম। স্বীকৃতি। একটা চাকরী।
আমাদের দেশে একটা চাকরী একটা পুরুষের এক প্রামাণ্য, রিকগনিশন। এটা না পেলে সে
পুরুষ থাকে না, মঞ্জুলা। একেবারে ক্লীবলিঙ্গ হ’য়ে যায়। সেটা ভেবে দেখেছেন? আমরা তো সমাজের পার্মানেন্ট ফ্যালনা। ভদ্রবেশ ধ’রে চাকরীর পরীক্ষা দেই, কিন্তু যখন জোটে না, নানা মানুষ
সিম্প্যাথি দেখায়। কেউ বলে, ‘কী ব্যাপার রবি,
কিছু হলো?’ কেউ বলে, ‘ভেরি স্যাড! এতোগুলো এক্সাম দিলে, বাধাতে পারলে না!’ আবার কেউ এমনও বলে, ‘এখন তো আর সেই ডেডিকেশন নেই।’ এইসব ছেঁকা
দ্যায়। জ্বালা হয়। খুব জ্বালা, ম্যাম। ড্রাগ তো নিতে শিখি নি। তাই অভদ্র সেজে
থাকি। তখন আর কেউ কিছু বলে না। আমাদের ওপরে কারোর ভরসা থাকে না, রাগ থাকে না,
প্রত্যাশাও থাকে না। আমরা একগুচ্ছ গুড ফর নাথিং ফেলো। তবু তো আপনি আলাদা। আমার মতো
একজনের বন্ধু হ’তে চেয়েছেন।
--- তাহলে খারাপ খারাপ ভাষা কেন ব’লবে ওরা? মঞ্জুলা ফের চার্জ করে।
রবি আজ তাদের জীবনের সব লুকোনো তথ্যগুলো যেন বের ক’রে দিতে চায় মঞ্জুলার কাছে। আজ যেন ওর জাত্যান্তর ঘ’টেছে। আজ আর কোনো বাঁধা নেই ব’লতে। তাই সপাটে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘খারাপ ভাষা আমরা অন্য কাউকে ব’লি না। নিজেদেরকেই ব’লি। প্রত্যেকটি খারাপ খারাপ বিশেষণ ছুঁড়ে দেই আমাদেরকে আর আমাদের সিস্টেমকে
উদ্দেশ ক’রে।’ কিন্তু এসব ও বলে না কিছু। শুধু শুকনো হাসে।
মঞ্জুলা চাপ দ্যায়--- কী? বলুন।
রবি নিজেকে সামলায়। শরীরের গর্ভে থাকা যাবতীয় জ্বালা একটা
বোতলবন্দী দানবের মতো হাঁটু গেঁড়ে ব’সে থাকে। শুধু বলে--- আজকের দিনটা এভাবে নষ্ট ক’রবেন! এই দিনটার দাম আমার কাছে কতটা, তা আপনি জানেন না।
--- আমি তো জানতে চাই, শেয়ার ক’রতে চাই। আপনার কিছুটা কষ্ট তো আমাকে শেয়ার ক’রে দিন। জানেন তো, আনন্দ শেয়ার ক’রলে বাড়ে, কিন্তু বেদনা কমে।
রবি এই প্রথম মঞ্জুলার দিকে সোজা দৃষ্টি ফ্যালে। ইতিমধ্যে
কফি দিয়ে গিয়েছে। সেটার কাপে ছোট্ট একটা চুমুক মেরে বলে--- কখনও লক্ষ্য ক’রেছেন, কারো কারো শীতে ঠোঁট ফাটে না। কারো কারো ফাটে। যাদের
ফাটে, তারা লজ্জিত হয় মসৃণ ঠোঁট-এর সামনে। তাই তারা নিজেদের দাঁত দিয়ে ঠোঁটের
ছালগুলো ছেঁড়ে, রক্ত বের করে, জ্বালা তৈরী করে। আবার ছেঁড়ে। ক্ষত-বিক্ষত করে
নিজেকে। এই জ্বালা তাঁদেরকে বাঁচতে সাহায্য করে।
মঞ্জুলার মধ্যে কোন একটা চিকন সূক্ষ্ম তন্তু যেন একটা স্ট্রোক
ক’রে ওর সারা শরীরে একটা ঝাঁকি দিয়ে যায়। ও
বলে ফেলে--- বাবা! কী কঠিন ক’রে ব’ললেন! আপনার কি বাংলায় অনার্স ছিল? কথাটা ব’লে মঞ্জুলা এটাও লক্ষ্য করে যে, রবি কেমন যেন আনমনা হ’য়ে গেছে। তাই মনে করালো,
--- কফিটা খেয়ে নিন। রবি কফিতে একটা চুমুক মারতেই আবার মঞ্জুলার
ঝাঁপিয়ে পড়ে--- আমি আজকে একটাই শেষ প্রশ্ন ক’রবো।--- আচ্ছা, এসব তো হোল। কিন্তু এসবের সাথে রাস্তায় মেয়েদেরকে টিজ করার কি
সম্পর্ক বলুন তো? তারা তো কোন অপরাধ করে নি।
কফিটাতে শেষ চুমুক মেরে ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে সেটাকে ঠেলে
একটা পাশে সরাতে সরাতে রবি ব’ললো--- অপরাধ আমরা
কেউই নিজে হাতে ক’রি নি, ম্যাডাম।
তাকে লালন ক’রেছি, এটাই বেশ
গুরুতর অপরাধ। আপনি কি মানেন, একটি ছেলের জীবনে একটি মেয়ের কাছে থেকে পাওয়া একটা
স্বীকৃতির একটা বিরাট ভূমিকা থাকে? মেয়ের জীবনেও তেমনটা থাকে না, তা নয়।
মঞ্জুলা বুঝতে পারেনা এই কঠিন তত্ত্ব। ও বোকার মতো বলে---
মানে?
--- বোঝেন নি? বেশ। ধরুন, আপনি দেখতে বেশ ভালো। আই মীন,
আপনিও জানেন, আপনি সত্যিই দেখতে বেশ ভালো। এর জন্যে আপনাকে অবশ্য কিছু ধ’রতে-ট’রতে হবে না। তবু
ধরুন, আপনার কান দুটো আপানর মাথার আন্দাজে বেশ বড়ো। বেশ অড। মনে করুন, সেটা বেশ চোখে
পড়ে।
আকাশ থেকে পড়ে মঞ্জুলা। বলে--- সত্যি আমার কান দুটো এমন
নাকি? দেখিনি তো।
রবি লক্ষ্য করে, মঞ্জুলার মুখটা লাল হ’য়ে গেছে একটা অজানা আতঙ্কে। ও ঘাবড়ে গিয়ে বলে--- না না,
আসলে কিন্তু তা নয়। আমি একটা উদাহরণ দিলাম। তবু দেখলেন, আপনি কেমন রি-এ্যাক্ট ক’রলেন! এবার মনে করুন, সেই কারণে আপনার জন্যে আনা প্রত্যেকটি বিয়ের সম্বন্ধ একটার পর
একটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। এবার আপনার মনের মধ্যে কী হবে? নিজের জীবনের কোন অর্থ খুঁজে
কি পাবেন? আপনি কি প্রথমে মনে মনে এবং পরে প্রকাশ্যে পুরুষদেরকে গাল দেবেন না?
আপনার কি নিজেকে বাজারে শুইয়ে রাখা এক ধরনের মাছ ব’লে মনে হবে না, যার পেট টিপে টিপে দেখে কেনা হবে? আর পরে তাকেই র’সিয়ে খাওয়া হবে। আমাদের অবস্থা তো প্রায় তেমনই, ম্যাম।
একটা মেয়ের সামনে একসঙ্গে এ্যাতোগুলো কথা ব’লে হাফায় রবি। এই তো প্রথম। তার মনের সব ক্ষেদ, সব ক্ষোভ,
সব জ্বালা, সব যন্ত্রণা যেন বেরিয়ে আসে রেস্তোরার পর্দার আড়ালে ব’সে। এর মধ্যে ওদের ওঠার সময় হ’য়ে যায়। মঞ্জুলা বলে,
--- কখনও এরকম ক’রে ভাবিনি তো।
--- আর ভাবতে হবে না। উঠুন। কথাটা ব’লে রবি টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে--- জানেন, আমি কিন্তু এ
দিনটা জীবনে ভুলবো না, ম্যাম। এটা আমার কাছে একটা স্মরণীয় দিন। অবশ্য আপনি তো আর
মনে রাখবেন না।
মঞ্জুলা কাউন্টারে দাম দিতে দিতে বলে--- এতক্ষণ পরে আমার
সম্বন্ধে এমনটাই মনে হোল বুঝি? খুব বোদ্ধা তো আপনি! আর এই যে ‘ম্যাম ম্যাম’ ব’লে সম্বোধন ক’রছেন, এটা কি? একবার তো ‘মঞ্জুলা’ নামটা ব’ললেন। সেটা কি আপনার
পছন্দ নয়? না হলে একটা অন্য নামে না হয় ডাকুন। ‘ম্যাম ম্যাম’ ক’রবেন না। দূর দূর লাগে শুনতে।
রবি সপ্রতিভ হ’য়ে ওঠে--- না না, কী ব’লছেন! মঞ্জুলা কী
সুন্দর নাম! কিন্তু আপনার আজকে প্রফেসরের কাছে ক্লাসটা তো নষ্ট হোল।
রেস্তোরা থেকে বেরোতে বেরোতে মঞ্জুলা ব’ললো--- ও, সেটা এতক্ষণে মনে প’ড়লো বুঝি?
--- তাহলে এবার কোথায়?
--- কেন? চিনে বাদাম খেতে হবে না? তার জন্যে তো সময়টা
কাটাতে হবে। চলুন, রেলব্রিজে গিয়ে ব’সি। ওখানটা বেশ নির্জন। এতক্ষণে ছায়াও প’ড়ে গিয়েছে।
রবি যেন ওর নিজের কান-কে বিশ্বাস ক’রতে পারে না। মঞ্জুলা ব’লেছিলো যে, বিকেলে চিনে বাদাম ট্রিট দিতে হবে ওকে, কিন্তু সেটা যে এতোটা
সিরিয়াস, তা ভাবেইনি রবি। মুখ ফস্কে ব’লেই ফ্যালে,
--- রিয়েলি? আপনি বিকেল অবধি আমার সাথে কাটাবেন! মঞ্জুলাকে
নীরব দেখে আবার বলে---জানেন, আজ আমি বিশ্বাস ক’রছি, মানুষ চাওয়ার মতো ক’রে চাইলে আকাশের
চাঁদ বুঝি হাতে পায়।
মঞ্জুলা হেসে বলে--- পেয়ে গেছেন বুঝি?
লজ্জায় আর কুণ্ঠায় মাথা নিচু করে রবি। জিভ কেটে বলে--- আমি
কি তাই বলেছি নাকি? আমি কি আপনার যোগ্য?
মঞ্জুলা বলে--- বাবা! বাবা! মেয়েদের মতো বেশ ব্লাশ ক’রলেন তো!
রেলব্রিজে ওঠে ওরা। ওপর থেকে অনেকটা দেখতে পায় মঞ্জুলা। রবি
সেই থেকে দেখেই যাচ্ছে ওকে। মঞ্জুলা বেশ বুঝতে পারে যে, ওর দিক থেকে রবির চোখের
দৃষ্টি স’রছে না। রবি মুগ্ধ, সন্দিগ্ধ। কিন্তু ও
কিছু বলেনি। বিষয়টা যে ও লক্ষ্য ক’রেছে, তা-ও বুঝতে
দ্যায় নি। শুধু ব্রিজে ওঠার সময় অকারণে বা অজ্ঞাত কারণে কখনও মঞ্জুলা একবার পেটের
কাছের শাড়ি, একবার বুকের কাছের শাড়িকে কড়া শাসন থেকে একটু মুক্তি দিয়েছে। তারাও
তাই সুযোগ বুঝে মঞ্জুলার সামলে রাখা শারীরিক স্থানগুলোকে একটু অসংবৃত ক’রেছে। এমনকি সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে একটু বেশী বেশী ক’রে কাপড় তুলে পায়ের গোছ বের ক’রেই উঠেছে। কিন্তু রবির যেন সে সব দিকে কোন নজর নেই। ওর
চোখদুটো খেলা ক’রছে মঞ্জুলার
চোখে। রবি যেন মঞ্জুলার ভেতরটা পুরোপুরি প’ড়ে ফেলতে চাইছে। মঞ্জুলা যেন তা বুঝে ফেললো। তাই মনে মনে ব’ললো, ‘এ্যাতো সহজ
নয়,মিস্টার! আরে বাবা, শোননি “দেবা ন জানন্তি।’
ওপর থেকে রবি তাকায় নিচে। মনে হয়, ও যেন অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে। নিচ র’য়েছে কত নিচে! মনে মনে ঠিক করে, আর নিচে নয়। এবার ওপরে, আরো
ওপরে যেতে হবে। এবার ও অত উঁচু থেকে তাকায় আকাশের দিকে। কখনও এমনভাবে রেলব্রিজে
উঠে আকাশ দ্যাখেনি রবি। আজ যা যা দ্যাখে, তাতেই অবাক হয়। মঞ্জুলাকে বলে,
--- দেখুন দেখুন। আকাশটা। দারুণ না?
তখন আকাশ দিয়ে একদল পানকৌড়ি চ’লেছে দূরে কোন নতুন বাসার সন্ধানে।
-----------------------
(এইসব বিহঙ্গেরা-২ পড়ুন)
No comments:
Post a Comment