এইসব
বিহঙ্গেরা
পরিচ্ছেদ – ৯
আজ টানা কুড়ি দিন পরে ইউনিভারসিটি-তে এলো বনলতা। ওকে দেখে
তোড়া ছুটে এসে চেঁচিয়ে উঠেছে--- ওমা! কোথায় ছিলে গো এতদিন? আমি তো তোমাদের বাড়ি
চিনি না। না হ’লে চ’লেই যেতাম। তুমি নেই, আমরাই এঞ্জয় ক’রলাম পারো’র বিয়ে।
--- কার বিয়ে?
--- পারো। পারমিতা গো।
--- কী ব’লছো! কবে?
--- এইতো, আজ ছ-দিন হোল।
--- তবে ভালো হয়েছে, আমি ছিলাম না। যা মেয়ে!
--- তুমি জানো না, তাই ব’লছো।
--- জানি, সব জানি।
--- তুমি জানো! বলোনি তো!
--- কী ব’লবো?
--- এই যে, ও ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে।
--- সে তো সবাই খায়। তুইও খাস।
এমন একটা আক্রমণে চম্কে যায় তোড়া। এক মুহূর্তে ওর মুখটা
ফ্যাকাশে হ’য়ে যায়। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে---
আমি অতো বড়ো পানকৌড়ি নই। বাবা বাবা! কী মেয়ে! কিন্তু তুমি জানো, পারো কাকে বিয়ে ক’রেছে?
--- জানি।
--- বলো তো, কাকে।
--- অবশ্যই একটা ছেলেকে। মেয়েকে নিশ্চয়ই নয়।
--- তাই বলো। ওর বর কে জানো? মাথা ঘুরে প’ড়ে যাবে। ভার্সিটির হীরকখণ্ড রণজয়। বনলতাকে নামটা শুনে ভুরু
কোঁচকাতে দেখে তোড়া ফের বলে--- আরে বাবা, রনি গো, রনি।
চোখ পাকায় বনলতা। রনি’কে সকলেই চেনে। তা বলে--- রনি! পারমিতাকে! জোক্স হচ্ছে না?
--- না গো। এটা জোক্স নয়। দিস ইজ রিয়ালিটি। ফ্যাক্ট। আরে
তোমার মোবাইল নাম্বারটাও তো কেউ জানে না। তাই তোমাকে কনট্যাক্ট ক’রতে পারিনি।
--- আমার কিন্তু কোন পারসোনাল মোবাইল নেই। তবে সত্যি এটা
কিন্তু মিরাক্ল। কোথায় যে কার ঘাটে কার নৌকো বাঁধা, কে জানে, বল। শেষে রনি
পারমিতা’কে।
--- আরে গিনিস বুকের রেকর্ডটা কী জানো? পারো বদলে গেছে।
একেবারে পাকা নববধূ। সলজ্জ, বিনম্র আর হিমশীতল। শুধু মিট মিট ক’রে হাসছে। মনে মনে হয়তো ব’লছে, ‘কেমন দিলাম, দ্যাখ।’
বনলতা তোড়াকে ব্যঙ্গ ক’রে বলে--- কেন? তোর বুঝি হিংসে হচ্ছে?
--- ধুর, তুমি কী যে বলো, বনলতাদি! ওই যে তুমি ব’ললে না, কার ঘাটে কার নৌকো বাঁধা থাকে...। আমার নৌকো যদি
রনি’র ঘাটে বাঁধা থাকতো, তবে পারো’র সাধ্য কি ছিনিয়ে নেয়! সাথে সাথেই প্রসঙ্গ পাল্টে দিয়ে
বলে--- কিন্তু তুমি এতোদিন আসোনি কেন গো? তুমি তো জেনারেলি ক্লাশ কামাই করো না?
রসিকতা ছেড়ে এবার ওদের বাক্যালাপ স্বাভাবিক হয়। বনলতা
জানায়--- ভাইরাল ফিভারে প’ড়েছিলাম রে। খুব
খারাপ অবস্থা হ’য়েছিলো। এখনও
উইকনেস পুরো কাটে নি। সামনে পরীক্ষা। অথচ দ্যাখ, কতগুলো ক্লাশ গেলো, স্যারদের নোট্স গেলো।
গত পনেরো তারিখে যখন ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরছিলো বনলতা,
তখন বাসে ব’সেই মনে হ’চ্ছিলো একটা জ্বর জ্বর ভাব যেন লাগছে। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই সোজা তিন। সেই যে
বিছানা নিয়েছে, আর কোন জ্ঞান নেই। কদিন যাবৎ শুনছিলো, এই ধরনের ফিভারটা হ’চ্ছে অনেকের। কিন্তু এর কোনো প্রিভেনশন নেই যে, ব্যবস্থা
নেবে। বাবা আর কত অফিস কামাই ক’রবে! পুরো
নার্সিংটা মা-কেই ক’রতে হ’য়েছে। রান্না থেকে শুরু ক’রে বনলতার দেখাশুনো সব। মা তো সুস্থ থাকে না। কিন্তু এতে একটা ভালও হ’য়েছে। মা’র মধ্যে একটা ‘পারবো না, পারবো না’ ভাব একেবারে ব’সে যাচ্ছিলো। সেটা
কেটে গেছে। মা একটা আস্থা যেন ফিরে পেয়েছে। বাবা অফিস থেকে ফিরলে তাকে টিফিন পর্যন্ত
ক’রে দিচ্ছে মা নিজে। প্রথম প্রথম বাবা ব’লতেন,
--- তুমি অনেক করেছো। এবার ছাড়ো। আমি বাকিটা ক’রে দিচ্ছি।
মা-ই বাঁধা দিয়েছে। বাবা’কে এগোতে দ্যায় নি। আসলে বাড়িতে কোন একটা দুর্ঘটনা ঘ’টলে যেমন বাড়ির মানুষগুলোর মধ্যেকার ছোটো ছোটো মান-অভিমান
ছুটে যায়, একটা রি-ইউনিয়ন ঘ’টে যায়, তেমনি
বিপদে-আপদে অসুস্থ মানুষও একটা চাপে প’ড়ে তার হাতে-পায়ে জোর ফিরে পায়। তাকে তো ফিরে পেতেই হবে। তাকে তো ক’রতেই হবে--- এই ভাবটা তাকে অনেকটা মানসিক জোর ফিরিয়ে দ্যায়।
মা বাবা’কে ব’লে দিয়েছে,
--- আমি তো ঘরের মধ্যে। আমার আর কি পরিশ্রম হ’য়েছে! তুমি অফিস থেকে ফিরে কি এসব পারো!
বাবা হাসেন। বাবা’র জন্যে বনলতা’র বড়ো কষ্ট হয়।
মানুষটা বড়ো একা। অফিসের নানা ঝামেলা মিটিয়ে যখন বাড়িতে আসবেন, তখন যদি কেউ
দ্যাখেন, বাড়ির মানুষটা বিছানায়, তবে মানুষের বাড়ি ফিরবার স্পৃহাটাই তো চ’লে যায়। অসুস্থতা কেই-বা বরদাস্ত করে! কিন্তু বনলতা’র বাবা বহির্বিমুখ মানুষ। তাই বাইরে খুব একটা থাকেন না।
তবে মাঝে মাঝে অফিসের কাজে বাইরে চ’লে যেতে হয়ই। সেটা
একদম হঠাৎই ঘটে। আগে ব’লে যাবার কোনো
উপায় থাকে না। তাও খুব বেশীদিনের জন্যে নয়। বড়জোর দু-দিন, কি তিনদিন। একেবারে চ’লে গিয়ে বাড়িতে রাখা মোবাইল ফোনে একটা কল ক’রে জানিয়েও দিতে হয় কখনও কখনও।
ব্যাঙ্কে লোন ডিপার্টমেন্ট-এ বাবা আছেন। বাবা’র একটাই সমস্যা অফিসে। বাবা’র ডিপার্টমেন্ট-এ বিপুল ঘুষের কারবার চলে। এটা বাবা একেবারে হজম ক’রতে পারেন না। চোখের সামনে দ্যাখেন, অন্যায় হ’চ্ছে, কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই। বলাটা বাবা’র কাজ নয়। বাবা ভিজিল্যান্স নন। বরং ব’লতে গেলে তোমারই বিপদ। কোন ঘুষে খোদ কর্তা জড়িয়ে আছে, তা তো
জানা নেই। কেউই প্রতিবাদকারীকে সাপোর্ট করে না। ক্যাননা কেউই ধোয়া তুলসীপাতা নয়।
অবিনাশ সেন চুপ ক’রেই থাকেন আর
এ্যাসিডিটির শিকার হন। কারোর শত্রুও হন না, আবার কারোর সাথে ভালো ক’রে মিশতেও পারেন না। জেনে শুনে কে-ই বা একজন মন্দ মানুষের
সাথে দেঁতো হাসি ছাড়া অন্য কোন সম্বন্ধে জড়ায়! তাই তিনি কারোর শত্রুও হন না, বা
তাদের সাথে তাঁর ওঠা-বসাও নেই।
শ্বশুরবাড়ি’র সাথে কোনো
সম্পর্ক না থাকাটা বাবা ঠিক মেনে নিতে পারেন নি। বনলতা জানে, যদি বনলতা’র মামা’রা মুখ ফুটে ব’লতেন যে, তাঁরা তাদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে কোন ভাগ বোন’কে দিতে পারবেন না, তাদের অর্থের প্রয়োজন, তবে বাবা নির্ঘাত
সব ছেড়ে দিতেন খুশি মনে। কোনো রকম দ্বিরুক্তি পর্যন্ত ক’রতেন না। তাতে অন্তত সম্পর্কটা তো থাকতো। কিন্তু ঘটনাটা
যেভাবে ঘ’টলো, তাতে বাবা’র সম্মানে লেগেছিলো। তাই বাবা একটু মুষড়েই থাকেন। একটু
চুপচাপ।
বনলতা’র ফিভারটা ওকে
এতটাই কাবু ক’রেছিলো যে, আজও ও
ইউনিভারসিটিতে আসতে পারবে, ভাবেনি। কিন্তু মা’র অভিজ্ঞ হাতের পথ্য ওকে চাঙ্গা ক’রে দিয়েছে। হাত-পায়ে তো জোরই পাচ্ছিলো না। কিন্তু ক্লাসে গিয়ে একেবারে প্রমাদ
গ’নল বনলতা। সর্বনাশ! স্টাডি এতোটা এগিয়ে
গেছে, ভাবতেই পারেনি। ওর তো কোনো প্রাইভেট টিচারও নেই। সোশিওলজি সাবজেক্ট-টা প’ড়তে কোনো প্রবলেম নয়, কিন্তু নোট্স বানানো তো ওর কম্ম নয়।
তাঁর জন্যে একটা ম্যাচিওরিটি লাগে। সেটা বনলতা পাবে কোথায়! ক্লাশের পড়াটায় অনেকটা
উপকার হোতো। ও শর্টহ্যান্ড জানে। তাই প্রফেসরেরা যা বলেন, পাই টু পাই নোট নেয়
বনলতা। কিন্তু এই একমাসে ক্লাশ বিশাল দূর চ’লে গ্যাছে। ম্যানেজ করাটাই ওর পক্ষে প্রবলেম হ’য়ে যাবে।
এই কথাটা ব’লেছিলো তোড়া’কে। তোড়া’কে এই সেদিনও খুব
একটা পছন্দ ক’রতো না বনলতা।
কিন্তু মেয়েটা নিজেই যেন একটু গায়ে পড়া। বিশেষত জোর ক’রে কেন যে বনলতা’র সাথে ও একটা অন্তরঙ্গতা ক’রতে চায়, কে জানে।
অবশ্য কোনো কোনো মানুষকে জীবনে ভালো লেগে যায়। এর কোনো যথার্থ কারণ থাকে না। হয়তো
সেই কারণে বনলতা’কে তোড়া একটু বেশী
ফেভার করে। আজকাল বনলতাও তোড়া’কে অনেকটা স্পেস
দ্যায়। হয়তো ও এমনই স্নেহকাতর মেয়ে। পড়াশুনোর নানা সমস্যা তোড়া’র সাথেই আলোচনা করে। তোড়া বেশ ভালো ছাত্রীও বটে। বেশ ভালো
নোট্স লেখে।
তাই তোড়া’কেই ব’ললো--- কী ক’রবো, বলোতো? আমার
যে কিচ্ছু প্রিপারেশন হয়নি! একটা জ্বরে ক্লাসে কতটা পিছিয়ে গেলাম!
তোড়া-ই উব্জে ব’ললো--- ডোন্ট ওরি, বনলতা দি। তোমায় দিদি ডাকি কি ওমনি ওমনি?
আমি আছি না? আমার নোট্স তো আমার দাদাই বানিয়ে দ্যায়।
--- আহা! তাতে আমার কী হবে? তুমি তো তোমার কথা শুনিয়ে দিলে।
ব্যঙ্গ করে বনলতা।
--- শোনাইনি, গুরু। জানিয়েছি।
কপট রাগ করে বনলতা--- এসব আবার কী ভাষা! ‘গুরু’!
--- সরি সরি। যাকগে। আজ আমার সাথে বাড়িতে চলো। নোট্সগুলো
নিয়ে আসবে। জেরক্স ক’রে আমাকে ফেরৎ
দিলেই হোল। ব্যস। বলে তোড়া।
--- তুমি দেবে! নিজের কানকেই বিশ্বাস ক’রতে পারে না বনলতা। বলে--- তোমার দাদা’র বানানো নোট্স? বিস্মিত হয় বনলতা।
--- কেন দেবো না?
--- না, কেউ তো দ্যায় না। আমি হ’লে কি দিতাম নাকি?
--- সেটা তো পারসোনাল ব্যাপার। আমি তা মনে করি না। আমার
নাম্বার কি তুমি কেড়ে খাবে?
ক্লাশ শেষ হ’তেই তোড়া একটা
রিকশা ডেকে নিয়ে তাতে টেনে তুললো বনলতা’কে। বনলতা ‘রিকশা কেন? রিকশা
কেন’ ক’রতে ক’রতেই রিকশা ছেড়ে দিলো। আর তোড়া জানালো,
--- বাঃ! আমাদের বাড়িতে তুমি প্রথম যাচ্ছো। হাঁটিয়ে নিয়ে
যাবো নাকি? একটা আতিথেয়তা আছে না?
বনলতা হাসে--- খুব পেকেছিস। ব’লেই ও জিভ কাটে। বলে--- এমা, আমি তোমাকে হঠাৎ ‘তুই’ ব’লে ফেললাম।
--- বেশ ক’রেছো। তোমার মুখে
এই তুইটা বেশ দারুণ শোনালো। আমাকে তুমি তুই-ই বোলো, কেমন?
--- কিন্তু তোর দাদা কী মনে করবেন! এই বুড়িটা তাঁর বোনকে
অমনি বোকা বানিয়ে হাত ক’রে নোট্স নিতে
এসেছে। সেটা কেমন হবে?
--- আরে ধুর। আমার দাদা’র সাথে তোমার দেখা হবে থোরাই। বাবু বাড়ি আসবেন একেবারে রাত এগারোটায়। তার চেয়ে
বড়ো কথা, আমার দাদা যদি এমনটা ভাবতো, তবে আমি কি তোমাকে নোট্স দেবার কথাটা ভাবতে
পারতাম? আমার সবই তো দাদা। চলো। তোমাকে দুর্দান্ত কফি খাওয়াবো। দাদা বলে, আমি নাকি
হেভি কফি বানাই।
হঠাৎ বনলতা’র মনে পড়ে, মা তো
চিন্তা ক’রবে। একটু টেনশান নিলেই তো সে মহিলা
বিছানায় প’ড়ে যাবে। তোড়া’কে এ কথা ব’লতেই ও ব’ললো--- সে তো বটেই।
তোমার কোন মোবাইল নেই, তো বাড়িতেও কি কোনো ফোন-টোন নেই?
--- না। বাড়িতে একটা মোবাইল আছে।
--- তাহলে তুমি আমার মোবাইল থেকে বাড়িতে একটা কল ক’রে দাও না। জেঠিমা খবরটা পেয়ে যান।
ব’লেই নিজের ব্যাগ
থেকে ওর মোবাইল সেট-টা বের ক’রে বনলতা’র হাতে দ্যায়। বনলতা দ্যাখে, বেশ দামী সেট ব্যবহার করে
তোড়া। তাই ও শাসনও করে--- এ্যাতো দামী সেট ব্যবহার করিস তুই! দুম ক’রে হারিয়ে গেলে?
--- দাদা দিয়েছে। ভালভাবে গ্র্যাজুয়েশন ক’রতেই দাদা এইটা গিফ্ট ক’রেছে। ভালো না?
--- ভালো মানে! খুব ভালো।
এরপর বাড়িতে একটা কল করে বনলতা। মা ফোনটা পেয়ে আশ্বস্ত হন।
মনে মনে ঠিক ক’রে নেয় বনলতা,
বাড়ি গিয়ে তোড়া’র নাম্বারটা
মোবাইলে লোড ক’রে নেবে। এটাও
ভাবে বনলতা, মেয়েটা নেহাৎ খারাপ নয়। অজানা কোনো কারনে হয়তো বনলতা’র ওপরে একটা আত্মীয়তা ফিল করে। বেশ একটা ‘ছোট বোন ছোট বোন’ ভাব আছে মেয়েটার মধ্যে। যতই ইউনিভারসিটির ছাত্রী হোক না কেন, এখনও ওর মধ্যে
ম্যাচিওরিটি পুরো আসে নি। হয়তো অনেক পরিনত বা নতুন নতুন কথা বলে তোড়া। কিন্তু তা
নিশ্চয়ই প্রায় সবই ওর দাদা’র শিখিয়ে দেওয়া
কথা। এগুলো ওর কথা হ’তে পারে না। এসব
নকল করা কথা। বাস্তব দুনিয়া হয়তো দ্যাখেনি মেয়েটা। ওর দাদাও হয়তো কোনো বইপড়া
বইপোকা মাত্র। তারই দৌলতে এইসব বড়ো বড়ো কথা ব’লে অন্যকে চমকায়। বেশী বই প’ড়লে যে তাঁর জীবন
সুখের হবে, বা সে বাস্তব জীবলে অনেক জেনে যাবে, তা তো নয়। বই আছে বইয়ের জগতে। জীবন
আছে জীবনে।
সত্যি, না মিশলে মানুষকে চেনা কতই না দুষ্কর! এই মেয়েটাকে
বনলতা আদৌ চিনতো না গতকালও। শুধু চিনতো না--- তা নয়। পছন্দও ক’রতো না ওকে। কিন্তু আজ! শুধু নোট্স-এর জন্যে নয়। আজকাল
মেয়েটাকে দেখে বেশ একটা ‘কোলধরা কোলধরা’ লাগে। গোদা বাঙ্গলায় যাকে বলে ‘ন্যাওটা’। বনলতা বোঝে যে,
মানুষকে কাছ থেকে না দেখলে একেবারে চেনা যায় না। যে মানুষটা অহংকার ক’রে বলে, সে মানুষকে একবার দেখে চিনে নেয়, আসলে বাস্তবে সে
হয়তো মোটেই মানুষ চিনতে পারে না। কোনো এক গ্রন্থে নাকি ব’লেছে, স্ত্রী চরিত্র বড়োই দুর্বোধ্য। আসলে মনুষ্য চরিত্র
মাত্র দুর্বোধ্য।
এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন তোড়াদের বাড়িতে পৌঁছে
গেছে বনলতাদের রিকশা। শীতের হাল্কা রোদে বেশ লাগছিলো। সামনেই তোড়াদের বাড়ি। এ
জায়গাটা’র নাম অফিস পাড়া। তোড়া’কে রিকশা থেকে নামা’র প্রস্তুতি নিতে দেখে বুঝে গেলো বনলতা যে, সামনের বাড়িটাই ওদের। ভারী সুন্দর
বাড়ি ওদের। গাছে দিয়ে সাজানো। ইউনিভার্সিটি থেকে ডান দিকে ঘুরে রাজা রামতলা পেরিয়ে
যে কটা বাড়ি দেখলো বনলতা, তার মধ্যে এই বাড়িটাই শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ পেতে পারে।
বাড়িটার তিনদিকে টানা বারান্দা। হয়তো পেছন দিকেও বারান্দা’টা গেছে। গোটা বারান্দাতে কংক্রিটের টাইল্স ডিজাইন ক’রে ছাদ দেওয়া। তাতে ব্রাউন রং করা। বারান্দাতে পুরনো দিনের
সরু সরু লোহার রড দিয়ে কোমর অবধি ঘেরা। তার ওপর কাঠের ফ্রেম। বারান্দায় বসানো কোনো সোফা-টোফা নয়। সাদা রং করা একেবারে
পেটি কয়েকটা বেঞ্চ। লোহার রডগুলো সাদা রং করা। মোট তিন-চারটে রং-এ গোটা বাড়িটা রং
করা। সবুজ, সাদা আর লাল। বেশ একটা রিসর্ট রিসর্ট ভাব। বোঝা যায়, কোনো শিল্পী’র হাতের ছোঁয়া আছে বাড়িটাতে।
তোরা’র ডাকে সম্বিত
ফেরে বনলতা’র--- কৈ? এসো। ভেতরে এসো।
ব”লেই তোড়া আপন মনে
গেয়ে উঠলো, ‘এসো এসো আমার ঘরে
এসো, আমার ঘরে... ।’
তোড়া’কে চোখ গরম ক’রে ধ’মকে রিকশা থেকে
নামে বনলতা। গোটা বাড়িটায় একটা কেমন যেন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। ঘরে ঢোকে বনলতা। তোড়া
ওকে নিয়ে গিয়ে বসায় নিজের ঘরে। সেই ঘরটা পর্যন্ত নানা গাছ দিয়ে ঘেরা। ঘরের একটা
গোটা দেওয়াল সম্পূর্ণ কাচের। তাতে ভারী পর্দা লাগানো। পর্দা খুললেই দেখা যায় ওপাশে
দারুণ ফুলের বাগান। তোড়া হুড়মুড় ক’রে বের ক’রে দ্যায় ওর যাবতীয় নোট্স খাতা। বনলতা সেই সম্ভার দেখে ব”লে ওঠে,
--- এতো কে করে রে? কী দারুণ বাগান। এখানে ব’সলেই তো পড়ায় মন লেগে যায়। কে করে দ্যায় রে?
--- দুজনেই ক’রি। আমি আর দাদা। কথাটা ব’লেই প্রসঙ্গ
পালটায় তোড়া--- তুমি নোট্সগুলো খুঁজে খুঁজে বের ক’রে নাও। আমি ততক্ষণে সফেন কফি ক’রে আনি।
--- আরে! তুই বোস তো।
--- দাঁড়াও। আগে কফি’র ক্রেডিট-টা নেই। ব’লে একটা দমকা
হাওয়ার মতো বেরিয়ে যায়। বনলতা ওর নিজের জরুরী নোট্সগুলো বেছে রাখতে রাখতেই ফিরে
এলো তোড়া। হাতে দুটো একেবারে হাল ফ্যাশানের কফি মাগ। মুখে টেলিভিশনের এ্যডের সুর, ‘কফি শে-এ-এ-ক!’ একটা সিপ মেরেই বনলতা জানায়,
--- বাঃ! বেশ বানিয়েছিস তো! তোর তো অনেক গুন।
--- ব’ললাম না, আমি ভালো
কফি বানাই? তোমায় শিখিয়ে দেবোখন। বর’কে খাইয়ে একেবারে চমকে দেবে।
--- তুই বুঝি তোর বরকে খাওয়াবি ব’লেই তুই শিখেছিস? কেন? আমি নিজে খেতে পারি না? বাবা’কে বা মা’কে খাওয়াতে পারি
না?
--- আরে ধুর। বাবা-মা কি কফির সাথে রোমান্টিক টাচ পাবে? কফি
তো রোমান্টিক পানীয়। দুজনে কফি বানিয়ে হাল্কা হাল্কা সিপ দিতে দিতে জমিয়ে প্রেম
করো।
বনলতা জানিয়ে দ্যায়--- আমি কালকেই ফটোকপি ক’রে নেবো। তুই কালকেই ফেরত পাবি।
তোড়া বাধা দিয়ে বলে--- তুমি এতো ব্যস্ত হয়োনা, বাবা। আমার
পরীক্ষায় বিরাট কিছু নম্বর-টম্বর পাওয়া নিয়ে আমি অত ব্যস্ত নই, বনলতা দি।
--- মানে! এ্যাতো সুন্দর নোট্স। আর তুই এসব কী ব’লছিস! অবাক লাগে বনলতা’র। ও ফের বলে--- আমি একটু চোখ বোলালাম। দারুণ। আমি ফলো ক’রতে পারলে তো চোখ বুজে ছক্কা মারতে পারবো। আর তুই এসব ব’লছিস!
হঠাৎ তোড়া ঝাঁপিয়ে প’ড়ে বলে--- ওমা! তোমার ‘ফলো’ কথাটায় মনে এলো। যে ছেলেটা মঞ্জুলা’কে ফলো ক’রতো না? তার নাম
রবি। আমি রবিদা ব’লে ডাকি। মঞ্জুলা
না, তার সাথে ভ্যানিশ।
--- ভ্যানিশ মানে! ভ্যানিশ মানে কী? বনলতা আকাশ থেকে পড়ে।
--- ভ্যানিশ মানে ‘নয়-দশ-এগারো।
--- নয়-দশ-এগারো! মানে? একটু খুলে বল্, মনা, কী ব্যাপার?
আমার তো টেনশান হ’য়ে যাচ্ছে। এসব কী
হচ্ছে! পারমিতা দুম করে বিয়ে ক’রলো, মঞ্জুলা
ভ্যানিশ...।
--- বুঝলে না? দ্যাখা, প্রেম, মিলন আর প্রজাপতি। ফুড়ুৎ। উড়ে
গেলো। হঠাৎ তোড়া বনলতা’র কড়া মাপের
দৃষ্টি দেখে নরম স্বরে ব’ললো--- না...
মানে... আসলে মঞ্জুলা’র বাবা তো বিরাট
হোমরা-চোমরা ব্যবসায়ী। সে এ বিয়েতে মত দিতো না। তাই রবিদা একটা চাকরী পেতেই গতকাল
রাস্তা দেখে নিয়েছে।
বনলতা বিস্মিত। বলে কী! এতো সিনেমা’র গল্প। গল্পের মতই তো একটা ক্লাইম্যাক্স ঘটিয়ে দিলো।
মঞ্জুলা’টা তো বেশ ডুবে ডুবে জল খায়! তোরাই
প্রসঙ্গ টানে,
--- এবার বুঝলে তো, কেন আমি সেদিন মঞ্জুলা’কে এগিয়ে দিতে অস্বীকার ক’রেছি? বাবা, যার মাল সে তার দায়িত্ব নিক। তাছাড়া আমি কাউকে গার্ড দিই, দাদা
একবার জানতে পারলে আমার বারোটা বাজিয়ে দেবে। দাদা’র সাথে ‘বন্ধু বন্ধু’ ঠিক আছে। কিন্তু এসব ব্যাপারে জড়ালে দাদা মোটেই বন্ধু
থাকবে না।
--- তুই বুঝি দাদা’কে খুব ভয় পাস?
--- রেভারেনশিয়াল ফিয়ার, গো।
এবারে প্রসঙ্গ পালটায় বনলতা--- আচ্ছা তোড়া, তোর বাবা-মা
কাউকে দেখলাম না তো? তাঁরা কি বাইরে থাকেন?
--- হ্যাঁ। একেবারে এই গ্রহের বাইরে। গ্রহান্তরে।
--- মানে!
--- ওমা! তুমি বুঝি জানো না? আমার বাবা বা মা কেউই তো নেই।
আজ দশ বছর। একটা কার এ্যাক্সিডেন্টে...। আমাদের একা ফেলে চ’লে গেছে। আমার বাবা-ই বলো, বা মা। সবই ঐ দাদা।
এমন ক’রে তোড়াকে কথা ব’লতে এই প্রথম শুনলো বনলতা। মনে মনে যেন বনলতা বিশ্বাস ক’রতে পারে না, কারোর বাবা-মা দুজনেই একসঙ্গে নেই। হঠাৎ মায়ের অসুস্থ মুখটা মনে পড়ে গেলো বনলতা’র। বাবা আর মা দুজনের একসঙ্গে মৃত্যু ভাবতেই পারে না ও। ও
বিলক্ষণ জানে, একদিন ওরা চ’লে যাবে। কিন্তু
সেইদিনকার না-হওয়া অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ ক’রতে কেঁপে ওঠে ও। বনলতা কখন যেন ভাবাবেগে তোড়া’র মুখটা নিজের বুকে টেনে নেয়। পরেই মনে হয়, এমা! একি! আমি কে? সহপাঠী বই তো
নই। অকেক চেরে দিয়েই প্রসঙ্গ পাল্টাতে তোড়াকে জিজ্ঞাসা করে,
--- তাদের কোনো ছবিও তো দেখছি না তো, রে?
তোড়া একটু অস্বস্তিতে প’ড়ে উত্তর দ্যায়--- আমাদের বাড়িতে কি কোনও ছবি আছে, বনলতা দি? তুমি দ্যাখো তো।
আসলে দাদা ছবি পছন্দ করে না। বিশেষ ক’রে যে মানুষ ছেড়ে চ’লে যায়, তাদের তো
নয়ই। দাদা বলে, ‘এতে নাকি কাজ করতে
অসুবিধা হয়।’ স্মৃতি নাকি ভালো
নয়। বোঝো। আমাদেরও কোনো ছবি টাঙ্গানো পাবে না। সব এ্যালবামে। দেখবে?
বনলতা মনে করে, ওর দেখারই বা কী দরকার? ও তো তাঁদেরকে চেনে
না। তাই মুখে বলে--- না, আজ থাক। পরে একদিন না হয় এসে দেখবো। আজ মা চিন্তা ক’রবে।
হঠাৎই তোড়া ব’লে ওঠে--- জানো বনলতা দি, কিছু মনে কোর না, আমার দাদাই আমার মা বলো, বাবা
বলো--- সব। কিন্তু মা’তো মা-ই, বলো।
আজকে তোমার বুকে মাথাটা রেখে না একটা আলাদা ফিলিংস হ’লো। হয়তো এইজন্যেই মানুষ পূর্বজন্মের কথা বলে।
বেশ একটা অস্বস্তি হ’চ্ছিলো বনলতা’র। ও তাড়াতাড়ি ব’ললো--- আমি আজ যাই রে, এ্যাঁ?
বনলতা পেছন ঘুরতেই ডেকে দিলো তোড়া। বনলতা’কে অবাক ক’রে দিয়ে ব’লে উঠলো--- বনলতা দি, তুমি আমার বৌদি হবে?
আচমকা এমন কথায় অবাক হোল বনলতা। রাগও হ’লো ওর ওপরে। ব’লে দিলো--- এসব কী, তোড়া! তোর কি মাথা খারাপ! তোর দাদা জানতে পারলে কিন্তু
ভীষণ রাগ ক’রবেন। সবকিছু নিয়ে ছেলেমানুষি ক’রতে নেই। বড়ো হ’য়েছিস। একটু ভেবে কথা বল।
--- কেন? তুমি কি এঙ্গেজ্ড?
তোড়া’র প্রশ্নে বিরক্ত
হ’য়ে বনলতা শুধু ব’ললো--- ছিঃ! ব’লেই আবার পেছন ঘুরে হাঁটা দিলো।
নাছোড় তোড়া আবার প্রশ্ন ক’রলো--- তুমি কিন্তু এড়িয়ে গেলে। বলো না, তুমি কি এনগেজ্ড?
এবার একটু ধ’মকে দেবার প্রয়োজন
বোধ করে বনলতা। কিন্তু কৃতজ্ঞতা ব’লে একটা ব্যাপার
আছে।। সেহেতু আর কথা বাড়ালো না ও। আবার ও পা বাড়াতেই তোড়ার পরের কথাটা এসে প’ড়লো,
--- আমার দাদা’টা বড্ড একা, বনলতা দি। আমিও। দাদা’কে দেখে ভীষণ খারাপ লাগে, জানো। এমন পাগল...! কিন্তু ঘেঁটে দ্যাখো, পাকা সোনা।
যে বাজারেই বেচবে, লক্ষ টাকা দাম।
বনলতা এবার চোখ পাকাতেই তোড়া নিজের স্টাইলে ফিরে আসে---
তাছাড়া দাদা’র একটা হিল্লে না
হ’লে আমিও তো মুভ ক’রতে পারছি না। ওকে কার হাতে দিয়ে যাবো, বল তো? কে ওকে
সামলাবে! ওর তো খাওয়া-দাওয়া কিছুরই ঠিক থাকে না।
বনলতা বোঝে, তোড়া ওর ভুল’টা সামলাচ্ছে। ও বুঝতে পেরেছে, এতোটা বলা ওর ঠিক হয়নি। তাই এখন নিজের দোহাই
পাড়ছে। পরিস্থিতিটা সহজ করার জন্যে একটা কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ ক’রে বনলতা বলে,
--- তোর জন্যে আবার কে অপেক্ষা ক’রে আছে রে?
তোড়া মাথা নিচু ক’রে বলে--- কাউকে ব’লো না। কেমিস্ট্রি’র সম্বিত।
--- বাবা! তোকে এই প্রথম ব্লাশ ক’রতে দেখলাম ব’লে মনে হোল?
--- চেনো? সম্বিত মিত্র?
--- তা চিনি না। তবে কাউকে ব’লতে মানা ক’রছিস, অথচ আমাকে ব’ললি যে বড়ো? কেন? আমি কি তোর ঘটকালি ক’রবো নাকি?
--- সব কেন’র কি উত্তর হয়? তবে সেই ঘটকালি’র জন্যেই তো তোমাকে এই প্রস্তাব দিলাম।
--- বেশী পাকা! তা বিয়ে ক’রবি, এম.এ.-টা কমপ্লিট ক’রবি না?
--- না না। আমরা তো এম.এ. ক’রছি দেখা-সাক্ষাৎ ক’রবো ব’লে। কেউ বাধা দেবে না, কোথায় যাচ্ছিস? এখন বাইরে কি? এসব
প্রশ্ন নেই। দাদা’কে মিথ্যে মিথ্যে
ব”লে তো নিয়মিত ডেটিং-এ যেতে পারি না, বলো।
--- তাহলে ওর চাকরী-বাকরী?
--- কীসের চাকরী-বাকরি! ওদের বিশাল ব্যবসা। সেখানে ওকে
বসাবার জন্যে তো ওর বাবা নিত্য চাপ দিচ্ছেন। কিন্তু ও ফিক্ল অবস্থায় কাজে ব’সবে না।
বনলতা বোঝে, ও আচ্ছা পাগলের পাল্লায় প’ড়েছে। কিন্তু ওর আজ মনে হয়, প্রেম একটা পাগলামি বটে, কিন্তু
সেইটাই মহা সর্বনাশ করে। মানুষকে প্রাকটিক্যাল হ’তে হয়। তা নয়তো ওর নিজের মতো ভুগতে হয়। কিন্তু কিছু না ব’লে হেসে দিয়ে বলে,
--- তাহলে বেশ বড়ো ঘাটে নৌকো বেঁধেছো, মেয়ে! তা ব্যবসায়ী ব’লে কথা? ভালো ছেলে হবে তো? এ্যাতো পয়সা ব’লছিস...। তোকে শেষে...?
বাকি কথাটা আর মুখ ফুটে বলে না বনলতা।
--- কেন! আমাদের মঞ্জুলাও তো ব্যবসায়ীর মেয়ে। ও কি খারাপ?
বনলতা বোঝে, তর্ক ক’রে কোন লাভ নেই। প্রেমে তর্ক চলে না। তাই ওকে ব’লে দ্যায়--- ভাবিস না, সব ঠিক হ’য়ে যাবে। আমি আজ যাই?
তোড়া বনলতা’র গাল দুটো একবার
আস্তে টেনে ধ’রে আদর ক’রে ব’ললো--- তুমি না ‘যাই’ ব’লো না।
--- ভেরি ব্যাড! তোড়া দিস ইজ ভেরি ব্যাড। ব’লে বেরিয়ে যায় ও। বেশ বুঝতে পারে, তোড়া নিজের ব্যাপারে যতটা
না চিন্তিত, তার বেশী ওর চিন্তা ওর দাদা’কে নিয়ে। ভাগ্যবান দাদা ওর। বিচিত্র মেয়ে এই তোড়া। যতটা প্রকাশ্যে ‘হিহি’ করে, ততটা
বাস্তবে নয়। ওর ভেতরে একটা বেদনা আছে, একটা স্নেহ কাতরতা আছে। আর তাকে ঢেকে রাখছে
মেয়েটা। আজকে তোড়াকে ওর বেশ ম্যাচিওরড লাগে।
------------------------
এইসব
বিহঙ্গেরা
পরিচ্ছেদ – ১০
অমরেশ ঘোষাল গতকাল
রাত থেকে গোটা কল্যাণীতে একেবারে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন। পুলিশ, থেকে শুরু করে
রাজনৈতিক দাদা, সুপারি খাওয়া পাতি গুন্ডা থেকে ভাইলোগ--- সকলকে একেবারে
নাস্তানাবুদ ক’রে তুলেছেন। তাঁর
বক্তব্য, তাঁর মেয়ে’কে যে বা যারা
এ্যাব্ডাক্ট ক’রেছে, তাদের
জ্যান্ত অথবা মরাবডি তাঁর চাই। যেখান থেকে হোক, চাই। যত টাকা লাগে, লাগুক। চাই।
তাঁর মেয়ে’র গায়ে যেন হাত না পড়ে। যদি পড়ে, তবে সেই
‘কাটা হাত’ চাই। যেভাবে হোক, চাই। সারা বাড়ি মাথায় ক’রে তুলেছেন অমরেশ ঘোষাল। গতকাল থেকে তাঁর বাড়ি থেকে গাড়ি বের হচ্ছে, আর গাড়ি
ঢুকছে। কে আসছে, কে যাচ্ছে, কোথা থেকে আসছে, কোথায়ই বা যাচ্ছে, তার কোনো সঠিক
ধারা-বিবরণ বাড়ি’র মানুষও বোধহয়
দিতে পারবে না। অমরেশ বাবু অনর্গল একবার বাড়ি’র ওপর, একবার নীচ ক’রছেন। শধু তাঁর
হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে,
--- জ্বালিয়ে দেবো! সব জ্বালিয়ে দেবো! অমরেশ ঘোষালের মেয়ে’র গায়ে হাত প’ড়লে বুঝতে পারবে কল্যাণী। সব জ্বালিয়ে দেবো।
ঘন ঘন টেলিফোন বাজছে, আর একটি ছেলে, যাকে অমরেশ বাবু’র ডান হাত ব’লে সবাই চেনে, সে
টেলিফোন ধ’রছে। তারও চোটপাট কম নয়। একটু আগে থানা’র ওসি’কে ধমকাচ্ছিলো,
--- আপনার উর্দি খুলে নেব, ব’লে দিলাম। আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন দাদা। চাকরী বাঁচাতে চান তো তার মধ্যে
পাত্তা লাগান। দাদা’র কিন্তু এম.এল.এ, এম.পি. হ’তে লাগে না। নামটাই
যথেষ্ট। অমরেশ ঘোষাল। মনে থাকে যেন।
থানা’র ওসি পারলে তো যে
ধম্কি দিলো, তার দাঁত খুলে নিতে পারলে খুশি হতো। কিন্তু মাঝখানে ঐ যে নামটা---
অমরেশ ঘোষাল। ঐ নামটাই তো মহা মুশকিলে ফেলেছে। এর মধ্যে কয়েকবার লোকাল এম.এল.এ.’র ফোন এসে গেছে। ফোন এসেছে খোদ ডি.আই.জি. সাহেবের। কিন্তু ও.সি. কী করবে! কিডন্যাপ ঘ’টেছে, এমন কোনো খবর তো তিনি পান নি। আর এ ব্যাপারে কোন
টাকা-কড়ি তো চাওয়াও হয় নি। তিনি নিজে শিয়োর এটা একটা বাড়ি-পালানো কেস। কিন্তু কে
দেবে গ্যারান্টি! এ্যাব্ডাকশান তো ক’লকাতায় ঘ’টছে। আকছার ঘ’টছে। সে তো সবাই জানে। অমরেশ বাবু যে এই ঘটনাটাকে তার
পোলিটিক্যাল কেরিয়ারের কাজে লাগাবেন, বিরোধী পার্টি’কে নাজেহাল ক’রবেন এই একটা
ইস্যু দিয়ে, তা একটা বাচ্চা ছেলেও জানে। কথায় আছে না, ‘গয়লা তার বাচ্চা’র দুধেও জল দেয়’ আর ‘শ্যাকরা তার স্ত্রী’র অলঙ্কার থেকেও সোনা মারে’। এটা ওদের
মজ্জাগত। এটা শিখে নিতে না পারলে উন্নতি নেই। তেমনি রাজনৈতিক নেতাগুলো। নিজের
সন্তানকেও তারা জড়াবে রাজনৈতিক প্রচারে। কে আটকাবে! নিজের মেয়েকে নিজেই আন্ডার
গ্রাউন্ড ক’রে দিয়ে প্রচার ক’রবে যে, এতে বিরোধী চক্রান্ত আছে। প্রায়ই তো কাগজে এসব
বেরোয়। সবাই জানে। তাছাড়া নানা ব্যবসায়ীকে কিডন্যাপ ক’রে নেওয়া তো হর-হামেশা ঘ’টছে। এলেবেলে দুধ ভাতেরা তো আর এ্যাব্ডাকশান করে না। মার্ডার ক’রে দিতে পারে কিছু টাকা’র বিনিময়ে। কিন্তু পার্টিকে লুকিয়ে রাখা অনেক ঝক্কি। সে সব বিরাট হাতের কাজ।
অবশ্য এখনও অমরেশ বাবু তেমন কোন পোলিটিক্যাল ইস্যু খাড়া করেননি। তাই ও.সি. সাহেবের অবস্থা
এখন ‘আমি কার মাউশা (মেশোমশাই) রে!’
একটু আগে ও.সি.’র মিসেস টেলিফোন ক’রেছিলো। সে তো স্বামী’র কাছে খোদ আই.জি. সাহেবের বাবা।
বাঙ্গাল কথা বলে এই ও.সি.। আজও দেখের ভাষা ছাড়তে পারে নি। কিন্তু বৌ’কে আজ ও.সি. ভ্রূক্ষেপ না ক’রে ব’লে দিয়েছে,
--- তোমার সোয়ামী মারা গেছে গিয়া। ছেরাদ্দের ব্যবস্থা করো।
কিন্তু আমি পিণ্ডি গেলতে আসথে পারবো কিনা, জানি না।
টেলিফোনে ও.সি. সাহেব আজ বহুকাল পরে শুনলেন যে, তার বাড়ি’র হাই কম্যান্ড কেঁদে ফেলেছে। চেঁচিয়ে তার ঘর-জ্বালানি
পর-ঢলানি কন্যা রত্ন’কে ব’লছে--- ও পুঁটি! তোর বাবা কী সব ব’লছে রে! মানুষ’টার কী যেন হ’য়েছে! তোর
জন্মদিনে কী সব অলুক্ষুণে কথা ব’লছে!
তারপর রিসিভার রাখার ‘খটাশ’ শব্দ। ভদ্রলোকটি গায়ে-গতরে বেশ ছিলেন ব’লে এস.আই. পরীক্ষায় ব’সেছিলেন, আর পাশও
ক’রেছিলেন। অপশান দিয়েছিলেন কে.পি.-তে। কিন্তু চাকরী হ’লো ডাব্লু.বি.পি.-তে। নিশ্চিত কোন
ব্লান্ডার ক’রে ব’সেছিলেন ফর্মে। ব্যস। তার খেসারত আজও দিতে হ’চ্ছে। ভবিতব্য তার শরীরে কোথাও যেন একটি বংশদণ্ড আর কোথায়
যেন একটি সদ্য প্রজ্বলিত আলোক বর্তিকা স্থাপন ক’রে দিয়েছে! সেই থেকে ঘ’ষছে তো ঘ’ষছেই। একদিকে অমরেশ বাবু’র চামচা’র ধমক, অন্যদিকে
আই.জি. সাহেবের তাগাদা। কে জানতো, পুলিশের চাকরী এ্যাতো হ্যাপা! একটু মস্তানি ক’রবার জন্যেই তো এই চাকরী নেওয়া। পাওয়ার চেয়েছিলো এস.আই. সাহেব। এসব জানলে
কি এই লাইনে আসতো। প্রত্যেক দিন ক্রাইম বেড়ে যাচ্ছে, চুরি, ছিনতাই, এ্যাক্সিডেন্ট,
ধর্মঘট, ভাঙ্গচুর, অবরোধ, খুন, রাহাজানি, বৌ পোড়ানো, ফোর নাইনটি এইট এ,
এ্যাবডাকশান, মেয়ে পালানো, বৌ পালানো, জুভেনাইল ডেলিঙ্কোয়েন্সি,
হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ---- কত কী! তার ওপর জঙ্গী হামলা। কখনও ক্যাম্প, কখনও
থানা। কোন শুয়োরের... জানতো! এমন একটা মন্দ ভাষা মুখে আসতেই সামলে নিলো ওসি।
পাল্টে ভাবলো, কোন ভালোমানুষের বরাহনন্দন জানতো যে, জান-প্রান কয়লা ক’রে দেবে এই চাকরী! মাইনে আছে, উপরি আছে, মস্তানি আছে, আর
আছে প্রভাব খাটিয়ে ছেলেটার জন্যে একটু সুযোগ-সুবিধে ক’রে নেওয়া। কিন্তু এ তো চাকরী ছাড়ার যোগার। তার বাড়িতে আজ
জন্মদিন, কাল মৃত্যুদিন, পরশু বিয়ে, তার পরের দিন আদ্যশ্রাদ্ধ। সব নিমন্ত্রণ। দাও
আর খাও। গাণ্ডেপিণ্ডে খাও, পরের দিন চোঁয়া ঢেকুর তোল। ঘেন্না ধ’রে গেলো জীবনে। আবার থানা’র ফোন বাজলো।
এদিকে অমরেশ বাবু’র স্ত্রী এই জ্ঞান হারাচ্ছেন, এই আর্তনাদ ক’রছেন। যখনই জ্ঞান ফিরছে, তিনি ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা ক’রছেন। নানা মন্দির থেকে ফুল, জল, প্রসাদ, তেল-সিন্দুর
আনাচ্ছেন। কখনও ওঝা, কখনও গুরুদেব, আবার কখনও গনৎকার আসছে বাড়িতে আসছে, যাচ্ছে।
এমনকি অনুসন্ধান যজ্ঞের আয়োজনও প্রায় স্থির। বাড়ি’র চাকর-বাকর লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর বিছানা’র পাশে। কখন কী লাগে, না লাগে। কাল রাত থেকে অমরেশ বাবু’র স্ত্রী’র অবস্থা চিন্তার
ব্যাপার হ’য়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাইভেট প’ড়ার পরে মেয়ে আর ফেরেনি। সে প’ড়তে বেরিয়েছিলো বেলা দুটোর সময়। সোম, বুধ, শনি সাধারণত তখনই
যায় মঞ্জুলা। কিন্তু এদিন সন্ধে গড়িয়ে রাত, রাত গড়িয়ে আরো রাত। মেয়ে আসে না। ওর
সেলফোনে রিং ক’রতে জানা গেলো,
সেটা মেয়ে’র ঘরেই বাজছে। তার মানে সেটা সে নিয়েই
যায়নি। যখন রাত এগারোটা, তখন অমরেশ বাবু প্রায় ধম্কে এলেন মঞ্জুলা’র অধ্যাপক’কে। কেন তিনি
মঞ্জুলা’কে উস্কে দিয়ে এম.এ. পড়াচ্ছেন এবং তাই
এই ঘটনায় তিনিই দায়ী। তিনি শুধু মঞ্জুলা’র বাবা’কে এক সময় ফোনে ব’লেছিলেন,
--- মেয়েটার পড়া’র খুব ইচ্ছে। ওকে পড়াতে পারলে ভালো হয়।
সুতরাং কথা ব’লবে যে, পাতা কাটবে সে। এখন তিনি ধমক
খাচ্ছেন। অমরেশ বাবু’কে পাল্টা ধমক
দেবার ক্ষমতা তাঁর নেই। সে তো যম নিয়ে খেলা।
অবশ্য মন্টুদা’র চা-এর দোকানের সবাই জানে যে, রবি-ই ফার্স্ট টাইম গোলটা ক’রেছে। তার তপস্যায় মুখ তুলে তাকিয়েছেন মদন দেব আর প্রজাপতি
ঋষি। তারপরে তারা গতকাল গা ঢাকা দিয়েছে। কোথায় গেছে, দীপ্তদা ছাড়া আর কেউ জানে না।
কিন্তু সে কথা মুখ ফাঁক ক’রে বলা যাবে না।
কার ঘাড়ে মাথা আছে, দীপ্ত দা’র বিরুদ্ধে যাবে!
দীপ্তদা সকলকে মুখে কুলুপ আঁটতে ব’লে দিয়েছে। ব্যস্,
সকলের মুখে পুরনো জং ধরা তালা প’ড়ে গেছে। খোলে কার
বাপের সাধ্যি! এ ঘটনায় তো তালা আর মুখ দুটোই ভেঙ্গে দিতে দেওয়া যায় না। অমরেশ বাবু’র বাড়ি থেকে তাদের তালায় চাকরী, চাঁদা, ব্যবসা ক’রে দেওয়া ইত্যাদি নানা মেশিন অয়েল লাগানো হ’য়েছে। কিন্তু তালা খোলেনি। বাঁচলে তো চাকরী বা ব্যবসা।
দীপ্তদা মেরে মাথা ভেঙ্গে দেবে।
এই ঘটনাকে ঝামেলা বানাবার মূল পাত্রী হ’লেন মঞ্জুলা’র পিসী। তিনি
রাতদিন ধম্কাতেন ভাই অমরেশ বাবু’র ওপর। ঐ একটাই
মানুষ ধম্কান ঐ ক্ষমতাশালী মানুষটাকে। মেয়ে মঞ্জুলাকে পাত্রস্থ ক’রবার জন্যে তিনি হাত ধুয়ে প’ড়েছিলেন। সে নাকি ‘ডাগর-ডোগর’ হ’য়ে উঠেছে। এখন
বাড়িতে রাখাই নাকি গলায় ফাঁস আটকে রাখা। কিন্তু একমাত্র সন্তান মঞ্জুলা। মেয়ে আর
মেয়ের মা’র বায়না রক্ষা ক’রতে গিয়ে এবার ওর এম.এ. অবধি লেখাপড়া গড়িয়েছে। সেই পিসিও চ’লে এসেছেন খবরটা শুনে। আজ সকালেই তিনি পাড়া জ্বালাতে এসে প’ড়েছেন। তিনি এলেই পাড়া জ্বালান ব’লেই মনে করে মঞ্জুলা। এই ভাইকে মানুষ ক’রতে গিয়ে নাকি তিনি বিয়ে ক’রতে সময় পাননি। সত্যি সত্যি সময় পাননি, না পাত্র পাননি--- সেটা কেউ জানে না।
অমরেশ বাবু’র কাছে তিনি নাকি মাতৃসমা। তাই অমরেশ
বাবু’কে তিনিই ধম্কান-দাব্ড়ান আর সবাইকে
দাবড়ে বেড়ানো মানুষ এই মহিলাকে কিছুই ব’লতে পারেন না। সেই মঞ্জুলা’র পিসি এসে ইস্তক
পাড়া মাথায় ক’রছেন।
--- আমি হাজার বার ব’লেছি, অমু্ এবারে মেয়েটার বিয়ে দে। বিদেয় কর্, বিদেয় কর্। শুনেছিস আমার
কথা? তোরা তো আবার মেয়েকে শিক্ষা দিবি। দ্যাখ, তোদের শিক্ষা দিয়ে গেছে। বংশের মুখে
কালি লাগিয়ে চ’লে গেছে। এসব
কিডন্যাপ-ট্যাপ নয়। ও মেয়ে যা চুলবুল ক’রছিলো! পালিয়েছে।
অমরেশ বাবু গলা নামিয়ে ব’লেছেন--- আহা দিদি! তুই চুপ ক’রবি? মঞ্জুলা ‘চ’লে গেছে’ তোকে কে ব’ললো? আমার মেয়েকে
আমি চিনি না? আসলে আমি যে ইলেকশানে দাঁড়াবো, এটা শুনে অবধি বিরোধী পক্ষ একটা বিরাট
ষড়যন্ত্র ক’রেছে। এটা কিডন্যাপ। পলিটিক্যাল
এ্যাবডাকশান। ও তুই বুঝবি না, দিদি।
--- ফের যদি তুই ‘বুঝবি না, বুঝবি না’ ক’রবি তো তোর মুখে আমি ছ্যাঁকা দেবো গরম খুন্তির। ছোটবেলা’র কথা ভ্যলে যাসনি, অমু। এই আমি তোকে ব’লে দিলাম। আবার ধম্কান দিদি।
এই কোন্দলে বাড়ির রান্নাবান্না সব শিকেয় উঠেছে। ডাক্তার
আসছে, ওষুধ আসছে, ই.সি.জি, ই.ই.জি. সব টেস্ট চ’লছে। আর প্রতিবেশীরা সব এই জানলা বা ঐ ঘুলঘলি দিয়ে দেখা’র আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে কী কী ঘ’টছে। এটা বেশ পরের মাসখানেক একটা আলোচনার মতো খোরাক হ’য়ে থাকবে। বাচ্চাদের ইস্কুলের সামনে, বিকেলের পার্কে,
রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে অথবা পান চিবোতে চিবোতে দুপুরে সবাই ঘুমিয়ে প’ড়লে অন্দরমহলে চোখমুখ পাকিয়ে নানা আলোচনা চ’লবে। কেউ দুষবে অমরেশ বাবুকে তার রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে,
কেউ দুষবে আজকাল-কার অকর্মণ্য প্রশাসনকে, কেউ দুষবে মেয়েটাকে।। তাদের এই দোষারোপ
চাপানোয় যে কারোর কিছু যায় আসে না, সেটা ভাবতে তাদের ব’য়েই গেছে। অবশ্য সবটাই নির্ভর ক’রছে ব্যাপারটা কী ঘটবে, তার ওপর। বেশ একটা সন্দেহজনক বা
রগরগে, সাশপিশাস বা ক্রিটিসিজ্মের বিষয় পেলো শ্রীপল্লী’র বাসিন্দারা। এমনিই অমরেশ বাবু’র নামে নানা বদনাম, তার ধনের প্রতি নানা মানুষের ঈর্ষা, তার
প্রতিষ্ঠা’র প্রতি ধনীদের আক্রোশ, অন্য পাড়ায় তার
নাকি কেমন যেন পত্নী র’য়েছে ব’লে একটা প্রচার, একটা আঞ্চলিক ঘেন্না আর রাজনৈতিক ক্ষমতা’র প্রতি নানা মানুষের প্রশ্ন।
ভদ্রলোকটির এখন ডুয়াল একজিস্টেন্স। মাথা’র চুল অবিন্যস্ত, গায়ের পোশাক ধূসরিত, মুখে সিগারেট জ্বলছে
আর নিভছে। বাড়ি’র ভেতরে গেলে নাকি
তিনি মুখটি চুন ক’রে থাকেন তার
নিজের দিদি’র সামনে, আর স্ত্রী’র বিছানার পাশে। কিন্তু বের হয়ে এলেই একটি জ্যান্ত বাঘ।
তাঁর গর্জনে সবাই অস্থির। সমালোচকেরা এখন যে কথা তাকে ব’লছে, তাতে কান পাতা যায় না। এখন ভারতচন্দ্রের ভাষায় বলা যায়
নয়া, ‘মাতঙ্গ পড়িলে গড়ে পতঙ্গ প্রহার করে...’ । এখন ব’লতে হবে, ‘হাতি যহন হ্যান্দোলে পড়ে, চামচিক্কাতেও লাত্থি মারে।’
এই যখন শ্রীপল্লী’র শ্রীহারা অবস্থা, তখন সুদূর উড়িষ্যায় পুরী নামক একটি অঞ্চলের সমুদ্র সৈকতে ব’সে দুটি প্রাণী। রবি আর মঞ্জুলা। এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট’এর এম্প্লয়ী নায়ক রবি রায় আর নায়িকা মঞ্জুলা ঘোষাল। তারা
দুজনে বিস্ময়ে হতবাক হ’য়ে সমুদ্রের
মত্ততা দেখছে, তাণ্ডব দেখছে। বাড়ির তাণ্ডব তাদের থেকে কত দূরে!
সমুদ্রের ঢেউগুলো আছড়ে আছড়ে প’ড়ছে ওদের পায়ের কাছে। এ সময়টা সাধারণত কেউ পুরীতে আসে না।
এটা অফ সিজ্ন। ওরাও তো আর ঘুরতে আসেনি। এসেছে প্রাণের দায়ে। অফ সিজ্ন হ’লেও এসব জায়গা তো ফাঁকা যায় নয়া। এখনও বেশ কয়েকজন বীচে ঘুরে
বেড়াচ্ছে। নুলিয়াগুলো মাথায় ছোট্ট ছোট্ট টুপি চাপিয়ে ওদের নৌকো নিয়ে জলে ভেসে
বেড়াচ্ছে। রবি বালি দিয়ে যেন কী একটা বানাচ্ছে সমুদ্র সৈকতে। বাড়ি-টারি হবে হয়তো।
সমুদ্রের সামনে ব’সে মঞ্জুলা’র মনে হয়, এই বিশালত্বের সামনে এলে মনের সব ক্ষুদ্রতা, ছোট
ছোট ইগো কোথায় চ’লে যায়! কারণ
যতদূর দেখা যায় এখানে ব’সে, শুধু নির্মল নোনতা জল আর জল। যেন মানুষের দুঃখের সমুদ্র, মানুষের
চোখের জলে ভর-ভরন্ত লবণাক্ত সরিতসাগর। একবার মনে হয়, পালিয়ে যাবার জন্যে কী বিশাল
স্থান প’ড়ে আছে এই বিরাট বিশ্বে। বাবা’র সাধ্যি কি ওদের হাতে পায়! বীচের ওপরে নানান রঙের কাঁকরা
ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হয়, হাত বাড়ালেই ধরা যাবে। এই তো, কাছেই। কিন্তু হাত বাড়াও,
সোজা টুক করে সেঁধিয়ে যাবে বালির মধ্যে তোমার না দেখা কুচি কুচি গর্তের মধ্যে।
বিকেলে সূর্য ডুবুডুবু হ’লে অদ্ভূত দৃশ্য
পুরী’র আর পুরী’র সমুদ্রের। কোনো শিল্পী’র সাধ্য কি সেই
ছবি এঁকে দেবে!
রবিদেরকে না হয় এ সমাজ ‘বঞ্চিত’ শব্দটার সাথে একটা চার অক্ষরের অশ্রাব্য
গালাগাল জুড়ে দিয়ে সম্বোধন ক’রবে, কিন্তু
মঞ্জুলা’র মতো সোনালী মেয়েরা? তারা তো বাবা-মা,
পাড়া-প্রতিবেশী, সবার কাছে আদরের ধন। হাতের অমূল্য অঙ্গুরীয়। ধুয়ে মুছে যত্নে
রাখতে হয়। কিন্তু তা যদি কোনভাবে নিতান্ত নোংরায় প’ড়ে যায়, তার মূল্য ক’মে যায় না ঠিকই,
তবে তা কি আর হাতে ধারণ করা যায়! এমন ঘটনার পর কি বাবা-মা ওকে আর রবি’কে কোনদিন গ্রহণ ক’রতে পারবে! মনে পড়ে মঞ্জুলা’র, বাবা-মা’র সাথে একবার পুরীতে এসেছিলো। কত আনন্দ ক’রেছিলো! সারাদিন ধ’রে ঝিনুক কুড়িয়েছে মা’র সাথে, সমুদ্রের
বীচ থেকে বেশ কিছু শো-পিস কিনেছিলো, সমুদ্রের ঢেউয়ে চুবিয়ে স্নান ক’রেছিলো। আর আজ?
কালই পুরী এক্সপ্রেসে এখানে এসেছে ওরা। রাতের গাড়ি। কিন্তু
দুজনেই চোখের পাতা এক ক’রতে পারেনি। মাথা’র মধ্যে প্রথম বাড়ি থেকে পালাবার উদ্বিগ্নতা ওদেরকে জাগিয়ে
রেখেছে। মধুচন্দ্রিমা যে এমন গম্ভীর হ’তে পারে, তা কি ওরা কালীবাড়িতে বিয়ের আগে ভেবেছিলো? এখানে এসে ওরা কোন হোটেলে
ওঠেনি। ওরা উঠেছে তোড়া’র এক পিসতুতো দাদা’র বাড়িতে। তিনি অবিবাহিত। একজন শিক্ষক। বয়স পাঞ্চাশ পঞ্চান্ন। কোন দায়-দায়িত্ব না থাকায়
রাজনীতি আর সমাজসেবা নিয়ে আছেন। দীপ্ত’র ফোন পেয়ে ওদেরকে রিসিভ করেছেন। তিনি বেশ রাশভারী মানুষ। এখানে আসা ইস্তক তার
সামনে যেতে বেশ ভয় ভয়ই ক’রেছে মঞ্জুলা’র। অথচ দীপ্তদা ব’লেছেন, এই মানুষটি নাকি একটা উপযুক্ত শেল্টার। ওদের যাবতীয় দায়িত্ব ক-দিনের
জন্যে রক্ষা ক’রতে পারেন তিনি।
ওরা সোজা ওঁর কাছে এসে আত্মসমর্পণ করেছে। তিনি ব’লে দিয়েছেন, ওদেরকে বাড়ি ফিরতেই হবে আর তিনি যেদিন ব’লবেন, সেদিনই। ওরা মেনেও নিয়েছে। এই ভদ্রলোকটিকে না চিনলেও
রবি অন্তত দীপ্তদা’কে ভরসা করে শতকরা
একশো ভাগ। ফফ্লে ইনিও ভরসাযোগ্যই হবেন।
শ্রীপল্লী’র যুবকেরা হয়তো ব’লছে, ‘সাবাস রবি। তুই-ই
জিতলি। এভাবে সবাইকে চমকে দিয়ে চাকরী পেলি, আবার রাত কাটতে না কাটতেই হিরোইন
জুটিয়ে একেবারে তাকে নিয়ে সোজা পগার পার। একেবারে রাজত্ব সহ রাজকন্যা।’ হয়তো মঞ্জুলা’র বন্ধুরাও এমন কিছু ব’লছে। ‘মঞ্জুলাই ক’রে দেখালো।’ এমন নানা মুনি’র নানা মত। কেউ কেউ অনুযোগ ক’রেও হয়তো ব’লেছে, ‘ তবু এভাবে
বাবা-মা’কে আঘাত ক’রে চ’লে যাওয়াটা কি ঠিক? অন্তত মা’কে ব’লে যেতে পারতো
মঞ্জুলা।’ বয়োজ্যেষ্ঠরা হয়তো ব’লছেন, এই তো আজকের সন্তান! সন্তান, না শয়তান! মানুষ করো, আর
তারপর তাদের বেইমানি’র জন্যে প্রস্তুত
থাকো।’ মঞ্জুলা’র পিসি’র মতো হয়তো অনেকে ব’লছে, ‘আমরা ব’লি তো শুনবে কে? এ্যাতো পড়াশুনো করা মানেই তো মেয়েরা এসব ক’রবে। আরে বাবা, সেই তো ঘর-সংসার ক’রবে আর সন্তান মানুষ ক’রবে। তো বই-পত্তর দিয়ে কোন হাতি-ঘোড়াটা হবে, শুনি।’
আসলে মঞ্জুলা আর সইতে পারছিলো না। ওর পিসি বাবা’কে এ্যাতো জ্বালাচ্ছিলো যে, যে কোন সময় বাবা বাড়ির ছাদে
প্রজাপতি উড়িয়ে দিতেন। টাকা আর ক্ষমতা যে কী ক’রতে পারে, তা যে দ্যাখেনি, সে জানে না। আজ মঞ্জুলা’র শুধু মা’র মুখটা মনে প’ড়ে যাচ্ছে। একমাত্র এই মহিলাটিই ওর যত চিন্তার কারণ। মা’র হার্টের কন্ডিশন ভালো নয়। হয়তো এ্যাতোক্ষণে বাড়িতে মা’কে নিয়ে একটা কাণ্ড বেঁধে গেছে। কিন্তু রবি’কে এভাবে তুলে না আনলে আর কোনদিন ওকে কি ও পেতো! বাবা পেতে
দিতেন না। মঞ্জুলা জানে, রবি ওকে যতটা ভালোবাসে, ততটা অন্য কেউ বাসতে পারতো না।
বাবা’র প্রতিপত্তি আর প্রভাবে ওকে বাধ্য হ’য়ে বিয়ে ক’রতে হোতো। তাতে কি
মঞ্জুলা মর্যাদা পেতো? কোথায় যেন শুনেছে ও, ‘যদি বিবাহিত জীবনে সুখী হতে চাও, তবে তুমি যাকে ভালোবাসো, তাকে বিয়ে না ক’রে যে তোমাকে চোখে হারায়, তাকে বিয়ে করো। একদিন ঠিক তার
ভালোবাসায় তুমি তাকে ভালবাসতে শুরু ক’রবে। তোমার নিজেকে তুমি যতটা পাল্টাতে পারো, ততটা অন্যকে পারো না।’
তাই রবি’কে হারাতে চায়নি
ও। ছেলেটা ওর পেছনে ছিনে জোঁকের মতো প’ড়েছিলো। একবারের জন্যে ওকে কোনো অপদস্ত করেনি, অসম্মান করেনি। মঞ্জুলা জানে,
রবি কৃতার্থ কারণ মঞ্জুলা ওকে এ্যাক্সেপ্ট ক’রেছে। ও চিরকাল কৃতার্থ থাকবে। পুরুষের প্রচলিত ছল্ছলেপনা থাকবে না। মঞ্জুলা’র প্রেমেই ম’জে থাকবে। রবিও
অনেকটা দারিদ্রের মতো। দারিদ্রে কাটাতে কাটাতে মানুষ যেভাবে দারিদ্র’কে একরকম ভালোবেসে ফ্যালে, তেমনিই রবি। ওকে মঞ্জুলা’র অভ্যেস হ’য়ে গেছে, আরো
যাবে। ওকে ভালবাসতে গেলে হয়তো অনেক জ্বালা পেতে হবে, তবু তাতে একটা ভালোলাগা
থাকবে। প্রচুর পাওয়ার মধ্যে ভালোবাসা ঠিক জমে না ব’লে মনে হয় মঞ্জুলা’র। তাছাড়া মঞ্জুলা
জানে, বাবা ভালোবাসা মানে ঠিক বোঝেন না। বাবা তো ভালোবাসেননি কাউকে। বাবা’র আছে অভ্যেস আর আসক্তি। পরিবারের প্রতি অভ্যেস আর ব্যবসা
সহ রাজনীতি’র প্রতি আসক্তি। এখানে আবেগের কোনো স্থান
নেই। রুক্ষ, শুষ্ক, নির্জলা একটা মানুষ বাবা। কারোর সাথে সুখ-দুঃখের কথা পর্যন্ত
বাবা বলেন না। মানুষটা ল’ড়তে জানেন, জিততে
জানেন প্রতিটা প্রতিকুলতা’র বিরুদ্ধে
দাঁড়িয়ে, কিন্তু চোখের জলের মধ্যে যে একটা অন্য তৃপ্তি আছে, সেটা মানুষটা বোঝেন
না। কিন্তু মঞ্জুলা ভালোবাসতে জানে। তাই রবি’কে ভালবাসতে পারবে ও।
রবি বালি দিয়ে তখনও একমনে একটা ঘর বানাবার চেষ্টা ক’রে যাচ্ছে। শুধু ঘর বানাচ্ছিলো, তা নয়। মঞ্জুলা’কে বুঝতে না দিয়ে চুপচাপ ভাবছিলো, একটা উত্তেজনায় কাজটা তো
ক’রে ব’সেছে। কিন্তু এতে মঞ্জুলা’র কোনো ক্ষতি হ’য়ে যাবে না তো? ওর মতো একটা ধনী পরিবারের মেয়ে’কে ও সুখী ক’রতে পারবে তো? যে
সম্পদে, ভোগে আর বিলাসিতায় মানুষ হয়েছে ও, তাতে ক’রে কোনো ভাবালুতায় এমন কাজটা ও ক’রে বসেনি তো? ওর এমনও মনে হয়, ভালোবাসা’র শেষ কথা তো বিয়ে নাও হ’তে পারে। হয়তো এই
বিয়েতে পরে মঞ্জুলা’র আক্ষেপ হবে। যে
যে ভোগ্যবস্তু পেয়ে বড়ো হয়েছে ও, তা তো
রবি’র পক্ষে ওকে দেওয়া সম্ভব নয়। বরং অনেক
খামতি থেকে যাবে। তেমন সমস্যা যদি হঠাৎ দেখা দ্যায়, তবে ওকে বাবা’র কাছে রেখে এলেই চ’লবে। ওকে কোনো কষ্ট দেবার কোন অধিকার তো ওর নেই। অবশ্য কালকের এই পালাবার
প্ল্যানটাও তো ওর নয়। ও তো প্রস্তুত ছিল না। মঞ্জুলাই এমন একটা প্ল্যান বাতলেছে। ও
তো ভেবেছিলো, পরে চাকরীটা একটু পাকা হ’লে মঞ্জুলাদের বাড়িতে একটা খবর দিয়ে তবেই ওকে বিয়ে ক’রবে। সেটা লুকিয়ে হ’লেও হ’তে পারে। এখন তো ওর হাতে ক্যাশ ব’লতে তেমন কিছু নেই। কিন্তু মঞ্জুলাই হঠাৎ ওকে চেপে ধ’রেছে। হঠাৎই ও চা-এর দোকানে এসে রবিদের বাড়ি’র ইতিবৃত্ত জেনে নিয়ে সোজা হাজীর হয়েছে রবি’র সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে। রবি’র বন্ধুরাই ওর সাথে মঞ্জুলা’র দেখা ক’রিয়ে দ্যায়। সেদিনই রবি’কে নিয়ে মঞ্জুলা পালাতে চায়। এসব শুনে রবি আপত্তি ক’রতে যাবে, আর তখনই ওর বন্ধুরা ওকে এই মারে তো সেই মারে,
--- শালা প্রেম মারাতে পারো, আর বিয়ে ক’রতে এ্যাতো ধানাই-পানাই কেন রে? একটা মেয়ে এতোটা সাহস
দেখাতে পারে, রাজত্ব ছেড়ে তোর মতো একটা ভিখিরি’কে নিয়ে বাঁচতে চাইতে পারে, আর তুমি মাল ভেরুয়াগিরি করবে! শালা হাঁফ পুরুষ!
উত্তেজনার এ্যাতগুলো কথা ব’লে ফেলে ছেলেগুলোর
যখন হুঁশ হয়েছে যে, মঞ্জুলা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, তখনই হাত জোড় ক’রে ক্ষমা চেয়েছে--- সরি ম্যাডাম, আপনার রোমিয়ো’কে একটু দাওয়াই না দিলে ও কেমন যেন মট্কা মেরে যায়!
আজ আর ছেলেগুলোর এমন ভয়ঙ্কর বিশেষণগুলোকে মন্দ লাগে না
মঞ্জুলা’র। তাই ও শুধু মিটি মিটি হাসে। কিন্তু
এইসব ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ রবি’র কানে গরম
উত্তপ্ত সীসা ঢেলে দ্যায় যেন। ‘হাফ-পুরুষ’ শব্দটা ওর বুকের মধ্যে একটা হাম্বর দিয়ে যেন আঘাত ক’রতে থাকে। একজন পুরুষ মানুষের কাছে এই ‘হাফ পুরুষ’ অপবাদ কোথায়
লাগে, তা যেন ওর বন্ধুরা জেনে বুঝেই ওকে ব’লেছে। রবি’র পৌরুষ ওকে যেন
সেই হাম্বর দিয়ে আঘাত ক’রেছে। মুক্তি চাই।
এই অপবাদ থেকে মুক্তি চাই। চীৎকার ক’রে বলতে চায় রবি,
--- আমি পুরুষ, মঞ্জুলা। তুমি একজন পুরুষ’কে ভালবেসেছো। আমি তোমায় ভালবাসি। আমি তোমাকে নিয়ে চ’লে যেতে পারি তেপান্তরের মাঠে, আকাশের দেশে, তারাদের
রাজ্যে। বিশ্বাস করো মঞ্জুলা, আমি পুরুষ।
মঞ্জুলা’র জমানো কুড়ি
হাজার টাকা ব্যাঙ্কে ছিলো। সেটা মঞ্জুলা এটিএম থেকে তুলেছে। তারপরে বাড়ি থেকে কোনো
জামাকাপড় ছাড়াই বেরিয়ে এসেছে প্রাইভেট পড়া’র নাম ক’রে। সেখান থেকে
নান্টুদের বাড়ি, সেকাহ্ন থেকে দীপ্তদা’কে ফোন, তারপরে সোজা পুরী এক্সপ্রেস। শূন্য হাতে নায়ক তার নায়িকাকে নিয়ে
বেরিয়ে গেছে। হাসি পায় রবি’র। চাকরী আর
প্রেমের প্রথম ট্রিট’টা দিয়েছিলো
মঞ্জুলাই। আজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে মঞ্জুলারই পয়সায়। একটু আগে নিজেকে ভিখিরি
ভাবছিল রবি। কিন্তু দীপ্তদা’র পিসতুতো দাদা
একটা দারুণ কথা ব’লে মেজাজটা বদলে
দিয়েছেন,
--- তুমি খুব লাকি, রবি। নায়িকাকে তো নায়কেরাই ফুঁসলে নিয়ে
যায়। কিন্তু তোমাকে ফুঁসলে নিয়ে এসেছে স্বয়ং নায়িকা। তার নিজের খরচায়। বলো, এটা
লাক নয়।
কথাটা মনে ক’রে হাসে রবি। একটা
হাত তুলে দ্যায় মঞ্জুলা’র কাঁধে। মনে মনে
বলে, ‘ভয় পেয়ো না, মঞ্জি। আমি তোমার এই
ভালোবাসা’র মূল্য দেবো। তুমি ভেবো না।’
রাত তখন প্রায় দশটা। মঞ্জুলা এ্যাব্স্কন্ড হবার পর কেটে
গেছে সাতটা দিন। একটা ফোন আসে অমরেশ বাবু’র বাড়িতে। ফোনটা আসে লোকাল থানা থেকে। ততক্ষণে টেলিভিশানে মঞ্জুলা’র কিডন্যাপ হবার খবর টেলিকাস্ট হ’য়ে গেছে। প্রেস তো একটা খবর পেলে তাকে রগ্রগে ক’রে বাজার মাত করবেই। একজন হবু এমএলএ-এর মেয়ে ব’লে কথা। লোকাল থানা থেকে জানিয়েছে, এটা কিডন্যাপ বা এ্যাব্ডাকশানের
কেস নয়। উড়িষ্যা পুলিশ থেকে মেসেজ এসেছে যে, মঞ্জুলা ঘোষাল নামে একটা মেয়ে আর আর
রবি রায় নামে একটা ছেলে পরস্পরকে বিয়ে ক’রে পুরী’তে আছে। টেলিভিশন
দেখে ওরাই পুলিশের কাছে সারেন্ডার ক’রেছে। তাদের সাথে আছেন একজন প্রবীণ শিক্ষক। তিনিও রাজনীতি’র লোক। তিনিই ওদের শেল্টার দিয়েছেন। ওরা সুস্থ আছে, ভালো
আছে। দু দিন পরেই ওরা ফিরে আসবে। ছেলেটি ওয়েস্ট বেঙ্গল এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টের
এমপ্লয়ী। যতদূর খবর, ছেলেটির কোন ব্যাড রেকর্ড নেই। এটাও জানিয়েছে থানা থেকে যে,
এখানে ডিএম-কে ডায়রেক্ট মেসেজ দিয়েছে ওখানকার ডিএম। এটাও ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে,
কোন পাওয়ারফুল পারসোনালিটি যেন ওদের ওপর কোন ইল্লীগ্যাল স্টেপ না নেয়। ওরা ম্যাচিওর্ড।
এটা লিগ্যাল ম্যারেজ।
এই মেসেজ আসা মাত্র মঞ্জুলা’র পিসি ওর বাবা’কে তাতিয়ে দিতে
চেষ্টা ক’রেছিলেন, যেন ওরা ফিরে এলে ছেলেটাকে সোজা
হাজতে পুরে দেন অমরেশ বাবু। এসব মন্দিরে বিয়ে-ফিয়ে নাকি কোন বিয়ে নয়। আর তখনই
মঞ্জুলা’র মা যেন ভোজবাজির মতো সেরে উঠেছেন, আর
রুখে দাঁড়িয়েছেন। ননদ’কে জীবনে এই প্রথম
আঙ্গুল তুলে ব’লেছেন,
--- দ্যাখো ঠাকুরঝি, কাল তুমি এখান থেকে চ’লে যাবে। আর কোনদিন এখানে আসবে না। আমাদের মেয়ে, আমরা
বুঝবো, কী করবো।
মঞ্জুলা’র জাঁহাবাজ পিসি
ভ্রাতৃবধূ’র অগ্নিমূর্তি দেখে একটু ঘাবড়েই গেছেন।
স্ত্রী’কে সুস্থ দেখে অমরেশ বাবুও আর কোনো কথা
বাড়াননি। তিনি থানা থেকে ঐ শিক্ষকের টেলিফোন নম্বর নিয়ে তার সাথে যোগাযোগ ক’রে ওদের কথা দিয়েছেন যে, ওরা নির্ভয়ে বাড়ি আসতে পারে। ওদের
বিরুদ্ধে কোন অনাদর হবে না। ভালোয় ভালোয় কেটে যায় সব। মঞ্জুলা’র মা সুস্থতা ফিরে পান। প্রাণ ফিরে পায় ‘ঘোষাল ভিলা’। এক সময় বাড়ি’র উত্তেজনা, ছোটাছুটি সব শান্ত হয়। এরপর সে বাড়ি থেকে
ভালোমন্দ রান্না’র গন্ধ পাড়া’কে আমোদিত করে।
-------------------------
এইসব
বিহঙ্গেরা
পরিচ্ছেদ – ১১
ফার্স্ট আওয়ারেই অবিনাশ সেন আদালতে জামিন পেয়ে গেলেন।
অবিনাশ বাবু’র এ্যাডভোকেট
ছিলেন দীপ্তিময় রায়। কেমন ক’রে যে একজন
সামান্য পুলিশ কর্মী’র নির্দেশে এই
ল-ইয়ারটি এলেন, কেনই বা তাঁর হ’য়ে এই কেস হাতে
নিলেন, আর কেনই বা যেমন ক’রে অর্থের জন্যে
ফীজ নিয়ে উকিলরা ক্লায়েন্টদের ভোগান্তির চূড়ান্ত করে, তেমনটা না ক’রে বিনা দাবি’তে দিব্যি কাজটা ক’রে বেরিয়ে চ’লে গেলেন, তা ভাবলে অবাক লাগে অবিনাশ বাবু’র। মনের মধ্যে যখন বিশ্বাসের ভিতটা একেবারে নাড়া খেয়ে
গেছিলো, তখন আর একবার তাঁর প্রত্যয় হ’লো, মানুষ পুরোটা নষ্ট হয় না। এরা আছে ব’লেই হয়তো জগত-সংসার আজো চ’লছে। এ্যাডভোকেট
ছেলেটি নেহাতই বাচ্চা মানুষ। কতই বা বয়স হবে? বড় জোর ত্রিশ-বত্রিশ। কিন্তু কী
সুন্দর ক্ষুরধার বুদ্ধি তার! কী ইনটেলিজেন্ট চোখমুখ! ঝক্ঝকে চেহারা। তার মধ্যে
উঁকি মারছে শরীরে লুকিয়ে থাকা বেশ সুগঠিত পেশী। যেহেতু তিনি নিজে একজন বাংলার
তথাকথিত কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, সেহেতু ছেলেটিকে দেখে অবধি মুগ্ধ হ’য়ে ভাবছিলেন, এমন একটি ছেলেকেই তো মানুষ জামাতা হিসেবে
কামনা করে। তাঁর নিজের ঘরেই তো একটি বিবাহযোগ্যতার বয়স উত্তীর্ণপ্রায় কন্যা র’য়েছে। কিন্তু ছেলেটি যে আজ তাঁর উকিল। রক্ষাকর্তা। এসব
আবেগের ব্যক্তিগত ভাবনা তো আদালতে চলে না। ছেলেটি কম বয়সী হলেও বেশ গাম্ভীর্যের
সঙ্গে মক্কেলের সাথে একটাও বেশী কথা না ব’লে শুধু ঘটনাটা জেনে নিয়ে কড়া মাপের আর্গুমেন্ট পেশ ক’রে আর অবিনাশ বাবু’র জামিনের কাজ শেষ ক’রে একেবারে
দেবদূতের মতো আদালত চত্বর থেকে বেরিয়ে গিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলো। অবিনাশ বাবু’র মনে হয়, এ কি এক বিস্ময় মানব।
অবিনাশ বাবু আদালতে তেমন অনভিজ্ঞ নন্। অফিসের নানা কেসে
নানা ক্লায়েন্টদের বিরুদ্ধে তাঁকে আদালতে অফিসের হ’য়ে উইটনেস হ’তেই হয় মাঝে মাঝে।
ফলে আদালতের কেস-কামারি দেখেছেন বেশ। তবে শুধুই সাক্ষী হওয়া। নিজের কোন কেসে উকিল
ধ’রতে হয়নি তাঁকে। যখন কোনো লোনের টাকা
রিকভারির সময় ক্লায়েন্ট নানাভাবে ফাঁকি দেবার জন্যে নানা কায়দা করে, তখনই কেস হয়
তার নামে। অবিনাশ বাবু একটি লিমিটেড কোম্পানির তকমা আঁটা ব্যাঙ্কের রিকভারি
ডিপার্টমেন্ট সামলান। তাঁকেই ফোর্স নিয়ে যেতে হয়। তাঁকেই কোর্টে উইটনেস হ’তে হয়। কিন্তু এভাবে খোদ তাঁকেই এ্যারেস্ট হ’য়ে যেতে হবে, এমনটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। এখনও তাঁর
বিশ্বাস ক’রতে ভয় হয়। জীবনের প্রায় তিরিশটা বছর
তিনি সুনামের সাথে চাকরী ক’রেছেন এই একটি
ব্যাঙ্কে। তাঁর নামে একটি দুর্নীতি’র অভিযোগ কেউ দিতে
পারেনি। অথচ আজ...। বাড়িতে তাঁর অসুস্থ স্ত্রী, মেয়ে এসব পোলিস কেসের ব্যাপারে
নিতান্ত অনভিজ্ঞ। কোর্ট, কেস, বিচারক, পুলিশ--- এসব থেকে তাঁর পরিবার কত দূরে! এসব
এ্যাভয়েড ক’রতে চান ব’লেই তো শ্বশুরবাড়ি’র বিরুদ্ধে কোন
আইনি পদক্ষেপ তিনি নেনেনি। বনলতা’র মামা’রা যে অসভ্যতাটা ক’রলেন, তার বিরুদ্ধে বনলতা’র মা’কে দিয়ে তিনি সহজেই একটি ‘স্যুট ফর ক্লেইম অন দ্য প্যাটারনাল প্রপার্টি’ করাতেই পারতেন। কিন্তু তিনি লোক হাসানো শুধু নয়, মামলা-ম্যাজিস্ট্রেট-উকিল
ইত্যাদি পছন্দও করেন না কখনও। আদালতের নোংরামি, আইনজীবীদের উঞ্ছবৃত্তি তিনি
দেখেছেন। আইনের বাজার ব’সিয়ে কীভাবে
মানুষকে বোকা বানিয়ে টাকা লুটছে একদল মানুষ, তা তিনি জানেন। বিচারকের পেছনে চোখ
বাঁধা নারীমূর্তিটি যেন সত্যিই চোখ বাঁধা। আইন যেন অন্ধ হ’য়ে দাঁড়িয়ে আছে ধৃতরাষ্ট্রের মতো। মনে মনে এক পক্ষ বেছে
নিয়েছে। অথবা যে পক্ষ যত বেশী টাকা দিয়ে সাক্ষী-সাবুদ, বিচারক, উকিল-মোক্তার
কেনাবেচা ক’রতে পারবে, তারই জয়। ভালো, না মন্দ--- তা
তার বোঝার উপায় নেই। সে তো অন্ধ। ঐ চোখ বাঁধা মূর্তি যেন নিরপেক্ষতার প্রতীক নয়
আদৌ। আদালত তো প্রহসনের নাটমঞ্চ।
সেই অবিনাশ বাবু’কে যেতে হ’লো হাজতে। বাড়ির
কেউ কি ভাবতে পেরেছে! এমনকি শত্রু যদি কেউ থাকে, তাদের কাছেও এটা বিস্ময়। যার
বাড়িতে তিনি ভাড়া থাকেন, তিনি জলধর চক্রবর্তী। এক সময়ের সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন।
বেশ পণ্ডিত মানুষ। বেশ বৃদ্ধ। তার অভিজ্ঞ দৃষ্টি বেশ চিনেছিলো অবিনাশ বাবু’কে। তিনিই ব’লেছিলেন,
--- সেন মশাই, আমার এই অশীতিপর জীবনকাল ধ’রে আমি একটা কথা বুঝেছি। ‘সততা’ একটা আপেক্ষিক বিষয়। প্রতিটি মানুষের
কাছে তার পৃথক পৃথক অর্থ। ফলে হাওয়াটা বুঝুন আগে। তা নয়তো তো ঘূর্ণাবর্তে প’ড়ে যাবেন।
কিন্তু একটা মানুষ কখনও অন্যের কথায় উজ্জীবিত হ’য়ে উঠে তার নিজস্বতা ত্যাগ ক’রে একটা অন্য মানুষ হ’য়ে ওঠে না। যে ভূত
মানে, বা ঈশ্বর--- তাকে যতই বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদ দিয়ে খান্ খান্ ক’রে তার ভ্রম দেখানো যাক না কেন, সে যেমনটা ছিলো, তেমনটাই
থাকে। শ্মশানের পাশ দিয়ে গেলে তাদের গা ছম্ ছম্ করে, চোখে নানা অশরীরী প্রতিভাত
হয়। অথবা বিপদে প’ড়লে সে দুইহাত জোর
ক’রে ঠাকুরকে ডাকতে থাকে। মানৎ ক’রতে থাকে--- এটা পেলে ওটা দেবে। বোঝে না, ঠাকুর যদি তাকে
এটা দেন, তবে ওটার জন্যে তিনি আর তার ওপর নির্ভর ক’রবেন কেন। সুতরাং নিজেকে বদলানো মানুষের নিজের সিদ্ধান্ত বা নিজের লব্ধ
দৃষ্টির পরিণাম না হ’লে সম্ভব নয়। তাই
অবিনাশ বাবুও বদলাননি।
কিন্তু তিনি কি ভেবেছিলেন, তাঁর সততা তাঁকে এখানে এনে
ফেলবে! তাই তিনি এ্যারেস্ট হ’য়ে যতটা না ভেঙ্গে
প’ড়েছিলেন, তার থেকে অনেক বেশী কষ্ট
পেয়েছিলেন এইকথা ভেবে যে, মানুষ তাহলে কেন সততা নামে একটা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধ’রে থাকবে! অবিনাশ বাবু রক্তমাংসের মানুষ, ষড়রিপু তাঁকে
উজ্জীবিতও করে, আবার ক্লান্তও করে। তাঁরও চিন্তা-ভাবনা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। ফলে তিনিও
ভুলে যাচ্ছিলেন, ভালোত্বের একমাত্র পুরস্কার হ’ল যন্ত্রণা, সততা’র পরিণাম
ভোগান্তি, সত্যের বিনিময়ে পাওয়া যায় দুর্গতি। এসব জেনেই কোনো কোনো মানুষ এসবকে
জীবনে ধারণ করে। এ জন্যে তারা প্রস্তুত থাকে, প্রস্তুত থাকতে হয়। এইসব যন্ত্রণাই
একটি ভালোমানুষকে স্বতন্ত্র করে। কিন্তু কতদিন? মানুষ তো একটা পুরস্কার পেতে চায়।
মহাপুরুষের অপার্থিব প্রাপ্তিতে এক লহমা’র ক্ষিদে মিটতে পারে, কিন্তু তা তার দীর্ঘকালীন পুষ্টিসাধন ক’রতে পারে না। সুখ না হোক, একটা শান্তিময় জীবন মানুষ পেতে
চায়। তাই সততা’র ওপর অবিনাশ বাবু’র আস্থা ধীরে ধীরে ছিঁড়ে কুটে যাচ্ছিলো।
ঘটনাটা ঘ’টেছিলো একেবারে
নাটকীয়ভাবে। জলধর বাবু’র একতলায় দুটো ঘর
ভাড়া নিয়ে অবিনাশ বাবু’রা থাকেন। একটি ঘর
মেয়ে বনলতা’র, আর একটিতে বুড়োবুড়ি। অবিনাশ বাবু
সন্ধেবেলা শ্রীরামপুর থেকে ফিরেছেন। দু-দিন আগে অফিস থেকে সোজা গিয়েছিলেন লোন
রিকভারিতে। বাড়িতে ফোন ক’রে জানিয়ে
দিয়েছিলেন। এমনটাই করেন তিনি। নতুন কিছু নয়। বাড়িতে এসে স্ত্রী’কে এক কাপ চা দিতে বলেন আজকাল। বনলতা অসুস্থ হবার পর থেকে
বাধ্য হ’য়ে তাঁর স্ত্রী মেয়ে’র ওষুধ-পথ্য ক’রে নিজেই অনেকটা সেরে উঠেছিলেন। তাঁর মানসিক অবসাদ অনেকটা কেটে গিয়েছিলো। ফলে
প্রায় সব কাজই তিনি এখন নিজে হাতেই করেন। স্ত্রী চা এনেছেন। অবিনাশ বাবু সবে বনলতা’র খবর নিচ্ছেন মিনতি দেবী’র কাছ থেকে, আর মেয়েও নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে বাবা’র সামনে। সারাদিনের পর একটু হাসি বিনিময় হ’য়েছে, কি হয়নি... হঠাৎ বাড়ি’র সামনে একটা পুলিশের জিপ এসে দাঁড়ায়। কার গাড়ি দেখতে-না-দেখতেই তা থেকে
সাত-আটজন পুলিশের লোক ভেতরে ঢোকে, আর কোনো কথা বলার সুযোগটুকু না দিয়ে তুলে নিয়ে
যায় অবিনাশ বাবু’কে। যে স্ত্রী, যে
কন্যা সন্তান তাঁকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, তাদের বিশ্বাসকে বিস্মিত ক’রে দিয়ে তাদের সামনে পুলিশ টেনে নিয়ে গেলো অবিনাশ বাবুকে।
যাবার সময় তাদের মুখের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারেননি অবিনাশ বাবু, পাছে সেখানে বিস্ময়ের
থেকে অবিশ্বাস বেশী ক’রে দেখতে পান! না
হয় তাঁকে কোন হ্যান্ডকাপ লাগানো হয়নি। তবু যদি তারা মনে ক’রে ফ্যালে, যে ঘরের মানুষটাকে তারা মনে প্রাণে সর্বান্তকরণে
বিশ্বাস ক’রতো, তিনি একটা অসৎ কাজ ক’রে বসেছেন, আর তাই তাঁকে চোরের মতো ধ’রে নিয়ে যাচ্ছে কোতোয়ালির সৈন্যরা! বাকরোধ হ’য়ে গিয়েছিলো তাদের। কিছুই ব’লতে পারেন নি অবিনাশ বাবু। অবিনাশ সেন শুধু একটা দৃষ্টি তাদের দিকে নিক্ষেপ ক’রেছেন মাত্র, আর ব’লতে চেয়েছেন, ‘আমি কোনো অপরাধী
নই।’ বাড়িওয়ালা জলধর বাবু দোতলা থেকে মুখ
বাড়িয়ে ব’লেছিলেন,
--- অবিনাশ বাবু, সত্যমেব জয়তে! ভাববেন না।
কিন্তু কোন সত্য? কীসের জয়? কী ব’ললেন তিনি? কেন ব’ললেন?--- কিছুই বনলতা বা তার মা মিনতি দেবী বুঝতে পারলেন না। বোবা’র মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন। অবিনাশ বাবু জানতেও পারলেন না,
তাঁর নিষ্ক্রান্ত হবার পরেই তাঁর যে স্ত্রী অনেকটা সেরে উঠেছিলেন, তিনি অজ্ঞান হ’য়ে ধরাস্ ক’রে প’ড়ে যান। বনলতা হাহাকার ক’রে ওঠে। ততক্ষণে পুলিশ ভ্যান ওদের পাড়ার গলি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। বনলতা ঠিক ক’রতে পারে না, এখন ও কোনদিকে যাবে। মানুষের আত্মীয়-স্বজন,
বন্ধু-বান্ধব কাছেপিঠে থাকলে অন্তত এমন একটা বিপদের দিনে একটা লোকবল পাওয়া যায়।
ওদের বাড়িওয়ালা তো যে ধরনের বয়স্ক মানুষ, তাঁকে দিয়ে যে কোনো কাজ হবে, তার ভরসা
করাটাই তো আত্যন্তিকতা। তাই বনলতা একটা বিশাল উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে প’ড়ে যায়। সাঁতার না জানা একটা মানুষ যেন জলের মধ্যে উবছে।
ডুবতে ডুবতে সাঁতার শিখে না গেলেও অসহায় অবস্থায় মানুষ নিজের বল-বুদ্ধি ফিরে পায়,
তার দুর্বলতা, অজ্ঞতা, বা ভীরুতা সব কেটে যায় কেমন ক’রে। তারি জোরে মা’র চোখে-মুখে জল দিয়ে মা’কে একটু সুস্থ ক’রে বনলতা সোজা দোতলায় বাড়িওয়ালার ঘরে গিয়েছিলো। যদি জলধর
বাবু কোনো সাহায্য ক’রতে পারেন। এমনিই
তিনিই বৃদ্ধ আর অথর্ব। তাঁর বাড়ি ছেড়ে খুব একটা নড়াচড়া করার মতো সামর্থ্য নেই।
তবু তিনি ব’ললেন,
--- এখন তো কিছু হবে না, মা। এখন তো রাত আটটা বেজে গেছে।
কাল সকালে একজন উকিলের কাছে যেয়োখন। আমি ঠিকানা দিয়ে দেবো। এখন মা’কে একটু সামলাও।
বনলতা আবার ছুটে আসে ঘরে। মা’কে নিশ্চিন্ত ক’রতে গিয়ে বনলতা
আবিষ্কার ক’রলো যে, তার মা’কে বাঁচাতে হ’লে এখনই ডাক্তার ডাকতে হবে। ব্যাপারটা পুরো বুঝুক, না বুঝুক--- শুধু বনলতা নয়,
এটা সকলেরই প্রত্যয় যে, অবিনাশ বাবু এমন কোনো কাজ ক’রতে পারেন না যে, তাঁকে গ্রেফতার হ’তে হবে। এ ঘটনা’র পেছনে অন্য কোনো
গল্প নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু বনলতা একটু নার্ভাস কেননা তাকেই তো যুদ্ধে নামতে হবে।
এবার উকিল, পুলিশ, থানা, কোর্ট, সাক্ষী, জেরা সব তাকেই ফেস ক’রতে হবে। এ যাবৎ এ সব তো শুধু সিনেমাতেই দেখেছে ও। কিন্তু
এখানে, এই কল্যাণীতে ওর তো তেমন কিছু চেনা-জানা নেই। এখানে তো ওরা সাত-আট বছর
মোটে। তাছাড়া বনলতা তো এখানে তেমন একটা বাইরে-টাইরে বের হয় না। পড়াশুনো সঙ্ক্রান্ত
যেটুকু বাইরে যাওয়া। ব্যস্। ফলে এই সাত-আটটা বছরেও এখানে অনেকটা প্রবাসীর মতো
থাকে বনলতা। চন্দননগরে যে ওর জন্ম। সেই চন্দননগরকে মন থেকে উপড়ে ফেলতে পারেনা
কিছুতে। তাই আজ একটা ভাইয়ের অভাব খুব অনুভব করে ও। একটা ছেলে বাড়িতে থাকলে আজ
লড়াইটা খুব কঠিন হোতো না। কিন্তু জীবনের লড়াই তো থেমে থাকে না। হঠাৎ ওর মনে প’ড়লো, এই অবস্থায় তোড়া’কে একটা ফোন করা যেতে পারে। ওকে তো নানা জায়গায় নানা মানুষ চেনে। নানা মানুষের
সাথে ওর তো ওঠা বসা। এমনকি ওর পরিচিত অনেকগুলো ছেলেও আছে। ও একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই
ক’রতে পারবে। জলধর বাবু’র ওপর তেমন একটা নির্ভর ক’রতে পারে না বনলতা।
তোড়া ছিলো প্রাইভেট টিচারের বাড়িতে। তখনও ওদের ক্লাশ চ’লছিলো। অন্তত আরো আধঘণ্টা দেরী ওদের ছুটি হ’তে। ওকে ফোনে জানাতেই ও অাকাশ থেকে প’ড়লো। শুধু বিস্মিত নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে ব’লেও দিলো,
--- বনলতা দি, তুমি একদম চিন্তা ক’রো না। আমি দেখছি। একজন এ্যাডভোকেট চাই এখন, যিনি তোমার
বাবা’কে কাল জামিন করাতে পারবেন। ব্যস্। তুমি
টেনশান নিও না। তোমার এই গুন্ডা বোনটা কি ক’রতে আছে! তুমি জেঠিমা’কে দ্যাখো।
--- তুই এখন কোথায় রে, মনা?
--- আমি পি.ভি. মানে আমাদের টিচারের বাড়িতে। আধঘণ্টা মতো বাকি আছে। আমি কি
যাবো দাদা’কে নিয়ে?
--- দাদা’কে তুই পাবি কোথায়
এখন? তিনি কোথায় কোথায় ক্লাশ ক’রছেন, কে জানে!
বাড়িতে তো ফিরবেন রাত দশটা’র পরে। না না,
তাঁকে ব্যস্ত ক’রিস না। সারাদিন
তিনি পরিশ্রম করেন। থাক এখন। তুই ওদিকটা সামলা।
ব্যস্। তারপরেই বনলতাদের বাড়ির সেলফোনটা অফ্ হ’য়ে গেলো। সেট-টাতে চার্জ নেই, ব্যাল্যান্স আছে কিনা, জানা
নেই। বাড়িতে থাকে ব’লে বনলতা সেট-টাকে
চার্জ দেবার কথা মনেও রাখতে পারে না। তাছাড়া মা সুস্থ হ’য়ে যেতে মা-ই অনেকটা সামলায়। মা’কে সেলফোন ব্যবহারও শিখিয়ে দিয়েছে ও। তার চেয়ে বড়ো কথা,
এখানে আশেপাশে একটাও দোকান নেই যে, সেখানে গিয়ে রিচার্জ ক’রে আনতে পারবে। তাই মা যে অসুস্থ, এটা তোড়া’কে বলাই হোল না। ও তো জানলো, বাবা এ্যারেস্ট হয়ে যেতে মা
ভেঙ্গে প’ড়েছে মাত্র। জেঠিমা’কে সামলানো বলতে তো মা’কে প্রবোধ দেওয়ার কথা বোঝাতে চাইলো। অবশ্য ওকে ব’লেও বা কী লাভ হতো! রাত আট-টার সময়ে ও কোথায় ছুটবে দাদা’র জন্যে! তিনিই বা কী ভাববেন! ক্লাসমেট ব’লে এতোটা ফেভার নেওয়া উচিত নয় ব’লে হঠাৎ মনে হয় বনলতা’র। ওদের বাড়ি থেকে তো বনলতাদের বাড়িতে আসতে অন্তত আধঘণ্টা-টাক সময় নেবে। তাও
আসতে হবে বাসে। মোবাইলের আর কী-ই বা দরকার! কাউকে তো খবর দেবার নেইও। তাড়াতাড়ি
বনলতা ছুটলো মা’র জন্য ডাক্তারের
বাড়িতে। ভাগ্যিস পাড়াটা ডাক্তার পাড়া। সেখানে তাঁকে না পেয়ে সোজা ক্লিনিক। তাঁকে
প্রায় তুলে আনলো বনলতা। কেমন করে এ্যাতোসব ক’রলো, ভাবলে শিউরে ওঠে ও নিজেই। মা’কে দেখানো হ’লো, মা একটু
সুস্থও হ’লো। কিন্তু বনলতা’র ঘুম ছুটে গেলো। একদিকে মা, আর একদিকে বাবা। কোনদিকে বনলতা
যাবে, বুঝতে পারে না।
সেদিন সারারাত ধ’রে একদল কুকুর রাস্তায় হল্লা ক’রছিলো। একবার এদিক
থেকে ওদিক, আর একবার ওদিক থেকে এদিক। রাত’টা বিনিদ্র কেটে গেলো বনলতা’র। রাতে মোবাইল
চার্জ দিয়ে তবে পরদিন সকালে তোড়া’কে ফোন ক’রতে গিয়ে দেখলো, সত্যিই ফোনে ব্যালান্সও নেই। আর তোড়া গোটা
দশেক মিস্ড কল ক’রেছে। এখন মা’কে রেখে যে রিচার্জ ক’রতে যাবে, তার কোনো ভরসা নেই। সে তো অনেক দূর। অবশ্য তোড়া’র ওপর ভরসা আছে। ও পারলে অবশ্যই কিছু ক’রবে। মঞ্জুলা থাকলেও হোতো। ওর বাবার তো বেশ
ইনফ্লুয়েন্স-টিনফ্লুয়েন্স আছে। তাঁকে ধ’রে কিছু একটা করানো যেতো। কিন্তু তাদের তো এখন মাথার ঘা’য়ে কুকুর পাগল। মেয়ে এ্যাব্স্কন্ড। সে পালিয়ে বিয়ে ক’রে ব’সেছে। তাছাড়া ওর
বর-ও তো লোকাল ছেলে। কিন্তু কোথায় তারা! বিপদ যে এভাবে আসতে পারে, তা কি ভেবেছিলো
বনলতা! শয্যা বনলতা’র মা’কে আবার বন্দী ক’রলো।
ওদিকে অবিনাশ বাবু’কে নিয়ে পুলিশ থানায় উপস্থিত হ’লে তিনি এই প্রথম
জানতে পারলেন, তাঁকে ঘুষের মামলায় ধরা হ’য়েছে। আকাশ থেকে পড়েন তিনি। অফিসে তাঁর টেবিলের পাশে বসেন ধরণী বাবু। লোনের
কেসে এন্তার টাকা আয় করেন বাঁ-হাতে। কী করেন, কীভাবে ম্যানেজ করেন, এ্যাতো টাকা
কেন চাই--- এসব কিছুরই কোনো হদিশ পান না অবিনাশ বাবু। তাঁর মনে একটাই প্রশ্ন---
কেন তাঁকে এ্যারেস্ট করা হ’লো। তাঁকে কি
ফাঁসানো হ’য়েছে? কে-ই বা ফাঁসালো? ফাঁসালে তাই বা
কেন? তিনি তো কারোর বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য করেন না। ধরণী বাবু’র কীর্তি দেখেও তিনি তো তাঁকে কক্ষনও কিছু বলেন নি। তাহ’লে? এই উৎকোচ-এর কারবার ক’রে ধরণী বাবু বিরাট প্রাসাদোপম বাড়ি বানিয়ে ফেলছেন, ছেলেকে একটা বিরাট মোবাইল
ফোনের শো-রুম ক’রে দিয়েছেন, নানা
প্রত্যন্ত গ্রামে জমি-জমা কিনেছেন। অবিনাশ বাবু একা কেন? সবাই জানে যে, এসব বেনামে
ভোগ করেন ধরণী বাবু। অবিনাশ বাবু বেশ বোঝেন, ধরণী বাবু শুধু নন্, কোনো অসৎ মানুষ
কোনো সৎ মানুষকে সহ্য ক’রতে পারে না।। তবে
এটা তাদের সৌভাগ্য যে, তেমন মানুষ চোখেও পড়ে না, বা তারা ওদের কাজে বাধাও দ্যায়
না। তাই ওদেরকে বিপদেও প’ড়তে হয় না। তাই
অঙ্কটা কিছুতে মিলছে না অবিনাশ বাবু’র। তাঁর অপরাধটা কী? তিনি কার শত্রু হ’য়ে দেখা দিলেন।
সারা রাত তাঁকে কাটাতে হোল পুলিশ হাজতে। সে রাত তাঁর কাছে
একটা চরমতম ঘৃণ্য রাত। সাত-বাই-আট একটা ঘরে সে রাত কেটেছে তাঁর। পাশেই একটা ছোটো
মতো খোলা জায়গা করা র’য়েছে কয়েদীদের
বাথরুম করার জন্যে। ল্যাট্রিন ক’রতে হ’লে কোমরে দড়ি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হ’চ্ছে পাশেই একটা নোংরা জায়গায়। অবশ্য কোনো অজ্ঞাত কারণে
অবিনাশ বাবু’র সাথে একটু
ব্যতিক্রম আচরণ করা হ’য়েছে। অবিনাশ বাবু
এর কারণটা খুঁজে পাননি। সেই একটা রাত অবিনাশ বাবু’র সাথে ছিলো একটা পকেটমার, একটা ঠগ-জোচ্চর, একটা ছিনতাইবাজ, আর একটা
এ্যাটেম্পট টু মার্ডার চার্জের আসামী। তিনি লেখক হ’লে সেই রাতেই গোটা তিনেক উপন্যাসের খোরাক তিনি পেয়ে যেতেন। তাদের সাথে অগত্যা
অবিনাশ বাবু’র পরিচয় হ’য়েছে, তাদের জীবনের গল্পও তিনি সেই রাতে শুনেছেন। ওদের এক
একটা জীবন একেক রকম, অনন্য ওদের জীবন দর্শন। কীভাবে ওরা পকেটমার হলো, কীভাবে খুন ক’রতে উদ্যত হ’লো--- এসব নানা
কাহিনী তিনি শুনছিলেন আর আশ্চর্য হ’চ্ছিলেন স্বাধীন দেশে স্বাধীন মানুষের জীবন কাহিনিতে। একজন এস.আই. রাতে ডিউটি ক’রছিলেন। তিনি একবার অবিনাশ বাবু’কে ব’লেওছেন,
--- স্যার, ওদের কথা মোটে বিশ্বাস ক’রবেন না। ওরা সব এক একটা বিরাট অভিনেতা। সব বানিয়ে বানিয়ে
বলে সিম্প্যাথি পাবার জন্যে।
সে রাত অবিনাশ বাবু’র ঘুম হয়নি। সারা রাত থানা’র ঘণ্টাটা বেজেছে
ঢং ঢং ক’রে। এই শব্দে তো ঝিমুনিও হয় না। এখানে
থাকলে মরা মানুষও জেগে উঠবে। কখন যেন রাত কেটে গেছে, বুঝতেই পারেননি তিনি। একটু
চুপচাপ ব’সে থাকলেই বাড়ির জন্যে নানা ভাবনা এসে
মাথায় ভিড় ক’রছে। অবিনাশ বাবু
জানতেন, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে কোর্টে প্রোডিউস ক’রতে হবে পুলিশকে। থানা’র কাজকর্ম দেখে তিনিও বুঝতেই পারছিলেন, তাঁকে সকালেই কোর্টে দাঁড়াতে হবে। থানা’র সেকেন্ড অফিসার অবিনাশ বাবু’র নাম-ঠিকানা-জীবিকা সব একটা রেজিস্টার-এ লিখছিলেন। অবিনাশ
বাবু’কে দেখে তাঁর মনে সন্দেহ হ’য়েছিলো যে, এই কেসে কোনো একটা গণ্ডগোল আছে। তাঁর অভিজ্ঞ চোখ
যথার্থই অনুমান ক’রতে পারছিলো নানা
কথা। তিনি অবিনাশ বাবু’কে জিজ্ঞাসাও ক’রেছিলেন, কোনো উকিল-টুকিল ঠিক করা হ’য়েছে কিনা। অবিনাশ বাবু জানিয়েছেন, না তিনি এসব করার সময়
পেয়েছেন, না বাড়িতে এমন কেউ আছে যে এসব কাজ ক’রতে পারবে।
সেকেন্ড অফিসার কৌতূহলে জানতে চেয়েছিলেন--- আপনি কি জানেন,
আপনাকে কোন চার্জে ধরা হ’য়েছে?
--- জানতাম না। এবারে জেনেছি। আমি নাকি ঘুষ কেলেঙ্কারিতে
যুক্ত! আমি তো আকাশ থেকে প’ড়েছি, স্যার। এসব
কী হ’চ্ছে, কে জানে!
অফিসার ব’ললেন--- আপনার
অফিসের দারোয়ানের স্ত্রী আজ ব্যাঙ্কে গিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা ডিপোজিট ক’রতে চেয়েছিলো। কিন্তু ঐ টাকা ভিজিল্যান্সের মার্ক করা
কারেন্সি। ফলে সাথে সাথে সে এ্যারেস্ট হ’য়েছে। দারোয়ানও এ্যারেস্টেড। তার আগের দিন আপনাদের অফিসের ধরণী গুপ্ত
এ্যারেস্ট হ’য়েছে। অবশ্য সে
আমাদের হেপাজতে নেই। ভিজিল্যান্স অনেকদিন ধ’রেই আপনাদের অফিসকে টার্গেট ক’রেছিলো। এখানে
ভালো এ্যামাউন্ট-এর হাশ মানি লেনদেন হয় ব’লে ইনফরমেশন ছিলো। ভিজিল্যান্স ব্যাঙ্কের এক পুরনো কাস্টমার’কে ধ’রে ঢোকে আপনাদের
অফিসে। আপনাদের ব্যাঙ্কের সেই কাস্টমারকে মার্ক করা এক বাঞ্চ কারেন্সি দেওয়াও হয়
ব্রাইব দেবার জন্যে। ইট অ্যাজ এ ট্র্যাপ। ব্রাইব দেওয়াও হয়। কিন্তু ধরণী বাবু’কে এ্যারেস্ট ক’রেও টাকা রেস্কিউ করা যায় নি।
অস্থির হ’য়ে ওঠেন অবিনাশ
বাবু। তিনি একটু রেগে গিয়েই জানতে চান--- তা এসবের সাথে আমার যোগ কোথায়?
--- আগে পুরোটা শুনুন, স্যার। ধরণী বাবু চকিতে টাকাটা সরিয়ে
দ্যায়। ভিজিল্যান্স টাকা না পেলেও ধরণী বাবু’কে এ্যারেস্ট করে। কিন্তু আলটিমেটলি টাকা রেস্কিউ না করা গেলে তো কোর্টে কোনো
প্রুফ সাবমিট করা যাবে না। ফলে ধরণী বাবু তো বেরিয়ে যাবেন। শুধু তাই নয়, ভিজিল্যান্স মানহানি’র মামলায় প’ড়ে যেতে পারে।
তাই একটা শেষ চেষ্টা ক’রে লোকাল শপিং মলগুলো, ব্যাঙ্ক এবং আরো নানা জায়গায় ঐ মার্ক
করা কারেন্সির নাম্বার-টাম্বার দিয়ে একটা ওয়ার্ন ক’রে দেওয়া হয়। অবশেষে সেই টাকা পাওয়া যায় দারোয়ানের স্ত্রী’র কাছ থেকে। সেই মহিলা তো এর গুরুত্ব বোঝেনি। সে একটা
ব্যাঙ্কে টাকা ডিপোজিট ক’রতে গিয়ে ধরা পড়ে।
তাদের ইন্টারোগেশন ক’রে জানা যায় যে,
দারোয়ান ঐ টাকা পেয়েছে আপনার পারসোনাল ড্রয়ার থেকে। ফলে আপনি তো ইমপ্লায়েড
এ্যাকিউজ্ড। চুরি করা আর চুরি’র মাল রাখা---
দুই-ই অপরাধ।
অবিনাশ বাবু এ হেন ঔপন্যাসিক ঘটনা শুনে তো হতবাক। তাঁর
ড্রয়ারে টাকা এলো কী ক’রে! ধরণী বাবু’র নেওয়া টাকা তাঁর ড্রয়ারে আসা’র সোর্স-টা যে কী, তা তাঁর মাথায় এলো না তক্ষনি। হঠাৎ মনে প’ড়লো, তিনি সেদিন হঠাৎ অফিসের অর্ডার পেয়ে শ্রীরামপুর গেছেন।
ব্যাপারটা এ্যাতো চট্জলদি ঘ’টেছে যে, নিজের
ড্রয়ার লক অবধি ক’রতে তিনি সেদিন
ভুলে যান। শ্রীরামপুর গিয়ে হঠাৎ চাবি’র কথা মনে প’ড়তে পকেটে চাবি না
পেয়ে তিনি পথেই হারিয়েছেন অনুমান ক’রে সেখানে থানাতেই
একটা জিডি করেন। তাঁর মানে তিনি সেদিন অফিসেই চাবি ফেলে গেছিলেন। ভয় পাননি অবিনাশ
বাবু কারণ তাঁর ড্রয়ারে গোপনীয় কিছু থাকে না তেমন যেটা নিয়ে তাঁকে টেনশান ক’রতে হবে। কিন্তু সেই সামান্য ভুল যে তাঁকে এখানে এভাবে টেনে
আনবে, তা তিনি অনুমান ক’রতেও পারেননি। তাই
তিনি অফিসারকে ব’ললেন,
--- কিন্তু আমি তো সেদিন আমার ড্রয়ার লক ক’রতেই ভুলে গেছিলাম। আনলক ফেলেই আমি শ্রীরামপুর বেরিয়ে যাই।
ফলে আমি তো বুঝতে পারছি না, কী থেকে কী হ’য়েছে। স্টিল নাউ আমার কাছে আমার চাবি নেই, অফিসার।
অফিসার বলেন--- আমাদের কাজ তো শেষ, স্যার। এবার যা ক’রবে, তা কোর্ট। তবে আপনাকে তো কোর্টে এই চাবি হারিয়ে যাওয়ার
কাহিনি-টা প্রমান ক’রতে হবে। কথাটা ব’লেই তিনি আবার জানতে চান, অবিনাশ বাবু’র বাড়ি’র লোক কোর্টে মুভ
করার জন্যে কোনো ল-ইয়ারকে ঠিক ক’রবার মতো কেউ আছে
কিনা। না থাকলে তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে একজন উকিলকে এ্যাপয়েন্ট ক’রে দিতে পারবেন। এ জন্যে কোর্ট অবধি অপেক্ষা ক’রতে হবে না। কথাকটা ব’লে তিনি জানিয়েও দেন যে, তিন মাস আগে অবিনাশ বাবু’র ব্যাঙ্ক থেকেই তাঁর ছেলে মোটর সাইকেল কেনার জন্যে লোন
নিয়েছে। তাই ব্যাঙ্কের প্রতি তাঁর একটা কর্তব্য আছে ব’লে তাঁর মনে হ’য়েছে। তিনি বা অনেকেই জানেন ডিফেডেন্ট নিতান্ত উকিল না দিতে পারলে কোর্ট-ই
একজনকে দাঁড় ক’রিয়ে দেবে।
পৃথিবীতে অবিশ্বাস্য বা অস্বাভাবিক অনেক কিছুই হয়। অবিনাশ
বাবু’র সাথে তেমন অনেককিছুই এই একটা ঘটনা থেকে
ঘ’টেছিল, যা তিনি মনে ক’রলে এখনও হতবাক হ’য়ে যান। বিগত কুড়ি-বাইশ ঘণ্টা অবিনাশ বাবু’র সাথে তেমনই ঘ’টে চ’লতে থাকে। এ সবই তাঁর জীবনে অভিনব, অপ্রত্যাশিত। একটা
পবিত্র সকাল যে এমন অভিশপ্ত হ’তে পারে, তা কে
ভেবেছিলো! সকালে তিন কাপ চা খান তিনি। আজ এক ভাঁড় জুটেছে এবং তাও চা নামের কলঙ্ক।
আটটা নাগাদ একটি ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সী ছেলে থানায় আসে। সে প্রথমে ডিউটি অফিসারের
সাথে কথা ব’লে অবিনাশ বাবু’কে রেকগ্নাইজ করে। তারপর একটি ওকালতনামা দেখিয়ে অবিনাশ বাবু’কে বলে,
--- ডোন্ট ওরি, স্যার। আমি আপনার এ্যাডভোকেট। আমার নাম শ্রী
দীপ্তিময় রায়। আপনি একটা সই ক’রে দিন, স্যার।
অবিনাশ বাবু আমতা আমতা ক’রে বলেন--- কিন্তু আমি তো কাউকে...।
তিনি লক্ষ্য ক’রছিলেন যে, ছেলেটি বেশ চৌকশ আর চটপটে। কথাও বলে খুব বুদ্ধিদীপ্ত চাউনি ফেলে
ফেলে। তিনি এও নিশ্চিত হন, ঐ সেকেন্ড অফিসারটি নিশ্চয়ই তাঁর ডিউটি শেষ হবার আগে এই
উকিলকে এ্যাপয়েন্ট ক’রে গেছেন।
এ্যাডভোকেটটি যে ওকালতনামা দ্যায়, তাতে তিনি সইও ক’রে দেন। অবিনাশ বাবু দ্যাখেন, তাতে ‘দীপ্তিময় রায়’ নামটি র’য়েছে। সেই নামেই টিক মার্ক দেওয়া। সই হ’লে ছেলেটি বলে,
--- চিন্তা ক’রবেন না। আজই আপনি বাড়ি যাচ্ছেন।
এবারে অবিনাশ বাবু জানতে চান--- আপনাকে কি থানার সেকেন্ড
অফিসার এ্যাপয়েন্ট ক’রেছেন?
মুচকি হাসে ছেলেটি। সংক্ষেপে বলে--- হ্যাঁ হ্যাঁ। সেকেন্ড
অফিসার।
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে অবিনাশ বাবু বলেন--- আপনাকে কী ব’লে যে ধন্যবাদ দেবো, তার কোনো ভাষা আমার জানা নেই।
--- এ সব দেবার কোনো দরকার নেই। এ কাজটা যে কোনো ল-ইয়ার ক’রতে পারে। আপনি সত্যিই নির্দোষ। আপনি দোষী হ’লে আমি কেসটা নিতামই না, স্যার।
অবিনাশ বাবু বোঝেন, ছেলেটির বয়স কম হ’লেও ছেলেটি বেশ বিবেচক। তিনি ব’ললেন--- সেটা তো জানি আমি। কিন্তু এ অবস্থায় যখন কেউ আমার হ’য়ে যোগাযোগ করার ছিলো না, তখন একজন পুলিশ অফিসার আমার কাছে
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, আপনাকে এ্যাপয়েন্ট করেন। এটা কি কম কথা!
ছেলেটি’র মুখে সেই মুচকি
হাসি। সে হাসিমুখেই বলে--- যদি সেই অফিসারকে এবং আমাকে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়, তবে
একটা কথা নিশ্চিত করুন--- আপনি কোনো শব্দবন্ধে আমাদেরকে সেটি জানাবেন না, আর আমার
নামটি আপনি প্রকাশ ক’রতে পারবেন না।
না, বাড়ি’র কারোর কাছে পর্জন্ত নয়। তারা জানলে
আপনি আপনার কথা রাখলেও বাড়ি’র কেউ এসে সেই
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কাজটি করুক, এটা আমি বা ঐ অফিসার চাই না। মনে রাখবেন, আপনি কিন্তু
জামিনটুকু মাত্র পেয়েছেন। কেস এখানেই ইতি নয়। এসব ঘ’টে গেলে আমি কিন্তু কেসটা আর চালাবো না।
বাধ্য হয়ে অবিনাশ বাবুকে কথা দিতে হয় এবং তা তাঁকে রাখতেও
হয়। এরপর ওইদিনই ফার্স্ট আওয়ারেই জামিন পান অবিনাশ বাবু। কোর্ট থেকে বেরিয়ে তিনি
তাঁর এ্যাডভোকেটের কোনো দেখা পান না। অনেক খোঁজেন। আধঘণ্টা-টাক খোঁজাখুঁজির পর
তিনি বার-লাইব্রেরিতে গিয়ে জানতে পারলেন যে, দীপ্তিময় রায় নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন
না। তাই তাঁর খোঁজ দিতে না পারলে আদালত চত্বরে তাঁকে পাওয়া যাবে না নিশ্চয়ই। ফলে
অবিনাশ বাবুকে বাড়ি ফিরতেই হয়।
যখন বনলতা মোবাইলে রিচার্জ জন্যে আর তোড়া’কে একটা ফোন ক’রে থানায় যাবার জন্যে বের হবে, তখনই অবিনাশ বাবু বাড়ি ফিরে আসেন। বনলতা অবাক।
এ্যাতো তাড়াতাড়ি বাবা যে বাড়ি ফিরে আসবে, এমনটা ভাবেইনি ও। কোর্ট সম্বন্ধে কোনো
ধারনা নেই ওর। তাই তোড়া যে যে কাজটা ক’রে দিয়েছে, তার জন্যে কৃতজ্ঞতায় আনত হয় বনলতা। বাবা’কে দেখে আবেগে চেঁচিয়ে ওঠে,
--- বাবা! তারপর বাবা’র বুকের ওপর প’ড়ে এ্যাতক্ষণ জ’মে থাকা বেদনা ঢেলে দ্যায়। বাবা মেয়েকে শান্ত করেন। এখন
বিপদ কেটে যেতে বনলতা’র গোটা শরীর
একেবারে ছেড়ে দ্যায়। এতোবর সঙ্কটের মুখোমুখি ও এ যাবত পড়েনি। বাবা ওকে পাখির ডানার
আড়াল দিয়েই বাঁচিয়ে রেখেছেন। শুধু ওর জানতে ইচ্ছে হয়, বাবা কী ক’রে এ্যাতো জলদি মুক্ত হোল। মেয়ে’র কৌতূহল শুনে অবিনাশ বাবু বললেন,
--- আর বলিস না, মা। আমরা কত কম জানি! পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে
কতই না গালমন্দ ক’রি! ওরা যেন মানুষ
নয়। একটা আলাদা জাত। কিন্তু সেই একজন পুলিশ অফিসার আমার এ্যাডভোকেট ঠিক ক’রে দিলেন। আর সেই মানুষটা একটা পয়সা না নিয়ে কাজ ক’রে চ’লে গেলো। আশ্চর্য
নয়, বল?
আশ্চর্য তো বটেই। বনলতা বুঝলো, তাহলে তোড়া কোনো ব্যবস্থা ক’রতে পারেনি। যাই হোক, যেই করুক। কাজ তো হ’য়েছে। কিন্তু ওর কদিন যাওয়া হোল না ইউনিভার্সিটিতে। মা যে
বিছানায়। আবার যুদ্ধ শুরু হলো বনলতা’র। তোড়া পরের দিন বিকেলে এসেছিলো খবর নিতে। বনলতা থানার অফিসারের এ্যাপয়েন্টেড
এ্যাডভোকেট-এর কথা ব’লতেই খুব খুশী হ’য়ে চ’লে গেলো। ব’লে গ্যালো,
--- বনলতা দি, আমায় ভুল বুঝো না। আমি না সকালে কোথাও কোনো
উকিলের ব্যবস্থা ক’রতে পারলাম না।
আমি চেষ্টা ক’রেছিলাম।
দুপুরবেলা থানায় কাকাবাবু’র সাথে দেখা ক’রতে গিয়ে শুনি, কাকাবাবু জামিন পেয়ে গেছেন কোনো এক উকিলের
দয়ায়।
বনলতা বলে--- না রে, সোনা। আমি মনে কিছু ক’রবো কেন? তুই তো একটা মেয়ে। আমারই মতো। আমি তো বুঝি। তুই
যথেষ্ট চেষ্টা তো ক’রেছিস। আমাকে ব’ললে তো আমি সেটাও ক’রতে পারতাম কিনা সন্দেহ।
পৃথিবীতে এখনও যে সত্য আছে, আদর্শ আছে, মমতা আছে--- তা
মানুষ ভুলতে ব’সলেও অবিনাশ বাবু
আজ জানতে পারলেন, তা আছে। আজ তিনি দেখলেন, জীবন এ্যাতো তিক্ত নয়, যত তিক্ত মানুষ
মনে করে। জীবনে বাতাস আছে, আলো আছে, মৃত্তিকা আছে, যারা মানুষের শত-সহস্র অত্যাচার
সহ্য ক’রেও মানুষকে এই সত্য বার বার জানিয়ে আসছে
যে, আছে। জীবন আছে, আর জীবন থাকলেই তার উপাদান আছে, এ্যাডভোকেট ছেলেটি তাঁর থেকে
বয়সে ছোট ব’লে তাকে প্রণাম করা ভালো দেখাতো না। আর
চাইলেও তিনি সেই সুযোগ পেতেন না। সে দেবদূতের মতো কাজটা ক’রেই কখন যেন অদৃশ্য হ’য়ে গেছে। কিন্তু প্রণাম করার মতো একটা মানুষ তিনি আজ দেখলেন, মুগ্ধ হ’লেন আর সেবাও পেলেন। ধন্য হলেন।
--------------------------
এইসব বিহঙ্গেরা
পরিচ্ছেদ – ১২
বনলতা’র ঘুম ভাঙলো
কলিংবেলে। কটা বাজে বোঝেনি ও। জানলাগুলো বন্ধ। ঘরটা অন্ধকার। এমনিতেই জানলা-টানলা
বন্ধ ক’রে শোয় বনলতা। কেউ জিজ্ঞাসা ক’রলে ব’লতে পারবে না,
কারণটা কী। সেটা লজ্জা’র কথা। ছোটবেলা মা
ব’লতো,
--- লতু এমন ক’রে তুই ঘুমোস যে, তোর জামা উঠে যায় মাথায়। ঠিক ক’রে শোয়া অভ্যেস কর। কিন্তু বড়ো হ’লে মা ব’লেছে--- লতু, বড়ো
হ’চ্ছিস। শুলে এখনও কেন তোর পা বেরিয়ে যায়
রে! শ্বশুরবাড়িতে বিপদে প’ড়বি।
বনলতা’র মনে হ’য়েছে, যেন একটা মেয়ে’র যা কিছু আপত্তিকর বিষয়, সব সোজা শ্বশুরবাড়িতেই ধরা প’ড়বে, আর তার জন্যে তাদেরকে সামলে চ’লতে হবে। এ দায় যে পুরুষেরও আছে, সেটা কোনো ব্যাপার নয়।
এমনকি ব্যাড হ্যাবিট-টা যে সব জায়গাতেই ব্যাড, সেটা কোনো ব্যাপার নয়। যে কোনো
অবস্থায় যে তা সামলে চ’লতে হবে, সেটা কেউ
বলে না। সব শ্বশুরবাড়ি’র দোহাই।
বনলতা জানে, এটা হয়। ওর আগে জামা, আর এখন কাপড় ঘুমের মধ্যে
সংযত থাকে না। সেই থেকে একটা ভয় মনে গেঁথে গিয়েছিলো বনলতা’র। তাই একতলায় ঘর ব’লে পা পর্যন্ত ঢেকে শোয় আজো। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস। কিন্তু ঘুম তো কারোর বাবা’রও নয়, মা’রও নয়। তাই তার
ওপর ভরসা না রেখে জানলা বন্ধ ক’রে শোয়াটাই নিরাপদ
মনে হয়েছে বনলতা’র। তাছাড়া মশা!
সন্ধ্যেবেলা জানলা বন্ধ না ক’রলে তো আর রক্ষে
নেই। তুলে নিয়ে গিয়ে সোজা পাশের পচা খালের জ’লে ফেলবে। আর এখন তো শীত। বেশ জাঁকিয়েই ঠাণ্ডা প’ড়েছে। ঠাণ্ডা চ’লে গেলো, উষ্ণায়নে সব সর্বনাশ হ’য়ে গেলো--- এই শুনতে শুনতে বনলতা দেখলো, সব ঠিকই আছে। পৃথিবী আছে পৃথিবীতেই।
একইভাবে মহা শূন্যে সে দিব্যি বন্ বন্ ক’রে সূর্য’কে প্রদক্ষিণ ক’রে বেড়াচ্ছে। তাই ওর মনে হয়, এতো চিন্তার কিছু হয়নি।
মানুষের সমস্যা মানুষই ঠিক ক’রে নেবে। কেউ এসে
সমাধানের পথ ব’লে দেবে না।
এবারে খুব কষ্টে লেপ স’রিয়ে বের হ’লো বনলতা। কে রে
বাবা এই সাত সকালে বেল বাজায়! না ওদের দুধ আসে, না খবরের কাগজ। বাবা অবিনাশ বাবু
খবরের কাগজ পড়া পছন্দ করেন না। সক্কালবেলা পবিত্র নিদ্রা ভেঙ্গে উঠে কোথায় খুন,
কার মৃতদেহ কোথায় মিললো, কোথায় গুলি চ’লেছে, বিধানসভায় কে কাকে জুতো ছুঁড়েছে--- এইসব প’ড়বার জন্যে পয়সা ব্যয় করা নাকি অর্থহীন। অবশ্য টেলিভিশনে তো
টাটকা খবর এ্যাতো তাড়াতাড়ি টেলিকাস্ট ক’রে দ্যায় যে, কাগজে তা বাসি হ’য়ে যায়। সবচেয়ে
বড়ো কথা হ’লো, টেলিভিশন বা কাগজের খবর তো নিরপেক্ষ
নয়। এক একটা মিডিয়া বা পেপার এক একটা পার্টি’র ধামাধরা। অবিনাশ বাবু মনে করেন, খবরের কাগজ প’ড়ে সময় নষ্ট না ক’রে
গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ পড়া অনেক কাজের কাজ। খবরের ব্যবসা করে ওরা। খবর না থাকলে
বানায়, একটা খবরকে নিয়ে চট্কে চট্কে তাকে তেতো করে। ওদের ভাষাতেই বলে, স্টোরি
বানানো। কে কত রসময় স্টোরি বানাতে পারে। ওরা বলে ‘স্কুপ’। স্কুপ না থাকলেও বানাও, খুঁচিয়ে বের
করো, অমুক অভিনেত্রী’র বাচ্চা হ’চ্ছে না কেন? বাচ্চা হ’ল তো এ্যাতো দেরী ক’রে কেন হ’লো? যে মেয়েটাকে মলেস্টেশন করা হয়েছে, সে কেমন ফীল ক’রছে? আরো কত কি! সব মশলাদার খবর।
এই কারণেই বাবা কাগজ নেয় না। সেই থোর-বড়ি-খাড়া,
খাড়া-থোর-বড়ি। এর তো বেশী কিছু নয়। পৃথিবীতে কোথায় কী ঘটছে, তার তালিকা না বানিয়ে
মানুষের জীবন, বোধ, আদর্শ, নীতি--- এসব নিয়ে বইপত্র পড়া দরকার। মূল্যবোধ তো
তলানিতে এসে ঠেকেছে। কাগজ প’ড়ে সেটা’র আরো সর্বনাশ ক’রতে চান না তিনি। এর জন্যে কোন হালফিল খবর লাগে না। এর জন্যে চাই গ্রন্থ।
সুতরাং এসব তো এ্যাতো সকালে আসার কোন কথা নয়। তা হ’লে কে রে বাবা! অগত্যা জড়ানো গলায় আপ্রাণ চেঁচিয়ে জানায়---
যা-আ-ই।
একবার চেঁচিয়ে বনলতা নেমে পড়ে খাট থেকে। দরজা খুলে দ্যাখে,
কে একজন মাথাটাকে জ্যাকেট দিয়ে মুড়ে দাঁড়িয়ে দরজায়।
--- কাকে চাই? প্রশ্ন করে বনলতা।
লোকটা কুই কুই ক’রে বলে--- অবিনাশ বাবু। অবিনাশ সেন। আছেন?
--- আপনি কে? কোথা থেকে আসছেন? মুখ বের করুন।
--- অবিনাশ বাবু। অবিনাশ বাবু’কে খুঁজছি। আছেন?
রেগে যায় বনলতা। এই সাত সকালে বড়ো বেয়াড়া আগন্তুক তো। রেগে
বেশ জোরেই বলে ও--- আগে বলুন, আপনি কে? অবিনাশ বাবু’কে পরে খুঁজবেন। মাথা বের করুন।
--- না... মানে... খুব ঠাণ্ডা তো।
এবারে আর ঝুঁকি নেয় না বনলতা। বারান্দা’র ঘড়িতে দ্যাখে, মোটে পাঁচটা বাজে। চেঁচিয়ে বাবা’কে ডাকে--- বাবা-আ! একবার এসো তো। কে একজন সাত সকালে
ফাজলামো ক’রছে।
এবারে জ্যাকেটের তলা থেকে বেরিয়ে বুল্টা’র মুখ। বনলতা’র মুখে হাত চাপা দিয়ে ব’ললো--- চুপ চুপ।
আমি রে। আমি।
--- ওমা! তুই! এই সাত সকালে! কী ক’রে এলি! অত দুর থেকে! চেঁচিয়ে ওঠে বনলতা।
দাঁত চেপে বুল্টা বলে--- চুপ ক’রতে ব’লছি না? মাইমা উঠে
যাবে। অন্তত দরজাটা তো ছাড়। ভেতরে ঢুকি।
বুল্টা বনলতা’র পিসতুতো ভাই। এই একটাই ভাই ওর পিতৃকুলে। জামসেদপুরে থাকে ওরা। পিশেমশাই
চাকরী করেন টাটা স্টিল-এ। যতদূর জানে বনলতা, বুল্টা আজো কোন চাকরী-বাকরি পায়নি।
বেকার ছেলেদের দলে ওর নাম। খুব একটা যোগাযোগ ঘটে না ওদের সাথে। তেমন কোন কাজ ছাড়া
পাঁচশো মাইল পেরিয়ে তো একা একা যাওয়া যায় না। ফলে বাবা-মা’র ওপর নির্ভর ক’রতেই হয়। মা তো আজ সুস্থ তো কাল বিছানায়। একটু স্ট্রেস নিলেই বা একটু
দুশ্চিন্তা ক’রলেই মা অসুস্থ হ’য়ে পড়ে। মা’কে নিয়ে জার্নি
করা বা তাকে একা ফেলে যাওয়া--- কোনটাই প্রায় সম্ভব হয় না ওদের পক্ষে। ঐ ফোনে
যেটুকু যোগাযোগ রাখা আর কি। সেটা আবার বাবা নয়, মা নিজেই করে। কিন্তু গত মাসখানেক
একেবারে কোনো কোনো যোগাযোগ ঘটে নি। সেটা মা’কে নিয়েই নানা প্রব্লেমের জন্যে। তারপর বাবা। বাবা’র কথাটা তো জানানো হয়ইনি ইচ্ছে ক’রে। জানিয়ে শুধু শুধু পিসি’কে টেনশানে ফেলার কোনো মানে হয় না। দূরে থাকে। তারা তো কোন ফয়সালা ক’রতে পারবে না। কিন্তু বুল্টা কেন এই সাত সকালে! ভালোবাসা’র আতঙ্কে ধক্ ক’রে ওঠে বনলতা’র মন। পিসীমনি
ভালো আছে তো?
--- আয় বুল্টা, আয়। ভেতরে আয়। পিসীমনি ভালো আছে? ব’লে হাত ধ’রে টেনে ভেতরে আনে
বনলতা ভাই’কে।
--- তোরা কিরে! একটা খবর দিসনি। এ্যাতো কিছু ঘটে গ্যালো।
বুল্টা অভিযোগ ক’রলো।
--- তুই আগে ভেতরে তো আয়। ব’লছি সব।
বুল্টা ভেতরে আসে। ওকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসায় দিদি।
তারপর চট্ ক’রে দু-কাপ কফি
বানায় বনলতা, আর মনে মনে ঠিক ক’রে নেয়, কী ব’লবে বুল্টা’কে। কেমন ক’রে ব’ললে ভালো হবে।
বুল্টা’র সাথে বনলতা’র ছোটবেলা থেকে ঠাট্টা’র সম্পর্ক। ওরা বয়সে গা-এ গা-এ। কফি নিয়ে এসে ওকে দ্যায়। নিজে একটা সিপ মেরে
বলে,
--- তুই এ্যাতো সকালে কোন ট্রেনে এলি!
--- চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার। কোনরকমে জামশেদপুর থেকে এসেছি
চক্রধরপুরে। তারপরে ঐ ঢিক্ঢিকে গাড়িতে ওভার নাইট। আমি তো এখানে এসেছি ঘণ্টাখানেক
আগে। ভাবলাম, এ্যাতো সকালে ঘুম ভাঙ্গাবো তোদের! তাই গলি’র মুখে দোকানটা সবে খুলে উনুন জ্বালাচ্ছিলো। ওটা বোধহয়
হোটেল-ফোটেল হবে। ওখানে ব’সে সিগারেট
খাচ্ছিলাম। তা সে দোকানদার আমায় দেখে চিনলো ‘নতুন মাল’। কোথায় এসেছেন,
কী ব্যাপার--- নানা প্রশ্ন। এখানে এসেছি জেনে প্রথমে এ বাড়ির দুর্ঘটনা’র কথা, তারপরে সিম্প্যাথি, আর শেষে ব’ললো, মামু নাকি জামিন পেয়ে গেছে।। দেখলাম, সব তথ্য ওদের
নখদর্পণে। ব’লে প্রসঙ্গ
বদলায়--- তো এবার ব’লতো, কী ঘ’টলো।
--- আসলে কী বলবো, বল তো! বাবা যদি ঘুষ নেয়, তবে তো সকলকে
ঢাক পিটিয়ে বলা যায় না, ‘আমার বাবা ঘুষ
নিয়েছে। আর তাই তাঁকে পুলিশ এ্যারেস্ট ক’রেছে। বল, বলা যায়?
--- বাজে কথা বলবি না, লতুদি। মামু... আর ঘুষ! আমি কি পাগল,
নাকি আমার মা উন্মাদ? তুই ভুল বোঝাচ্ছিস আমাকে!
--- তাছাড়া আর কী বলবো, বল তো? এমন ঘটলে তো মানুষ একটা কমন
কথাই বলে, আমার বাবা জীবনে ঘুষ খায় না। এটা চক্রান্ত। কথাটা কেউ বিশ্বাস করে কি?
বনলতা ভাই’কে কৈফিয়ত দ্যায়।
--- মা তো প্রথম টিভি-তে দেখেছে। মামু’র নাম ব’লেছে, ব্যাঙ্কের
নাম ব’লছে, এ্যাড্রেস ব’লছে। ব্যস্, মা’র মাথা খারাপ। জানিস তো আজকাল, নিউজ চ্যানেলগুলো তো মুখিয়ে থাকে নতুন নতুন
স্কুপ খোজা’র জন্যে। খাওয়াতে হবে তো। মা তো চীৎকার
শুরু ক’রে দিয়েছে, ‘বাবু, তুই ফোন কর্। তুই খবর নে। কী ব্যাপার! দাদা ঘুষ নিতে
পারে না। আমার দাদা দেবতুল্য। আমি যত ব’লি, ‘আরে দাঁড়াও। আমায় আগে দেখতে দাও, শুনতে
দাও। তত মা চেঁচায়। শেষে আমি ফোন ক’রলাম মোবাইলে।
দেখি, সেটা একবার আউট অফ রিচ, একবার সুইচড্ অফ ব’লছে।
--- হ্যাঁ, ফোনে চার্জও ছিল না। ব্যাল্যান্সও ছিল না।
শেষে দেখলাম, এতো মহা ঝামেলা হ’লো। শেষে মা ঘাড় ধ’রে পাঠালো আমাকে। রাতের গাড়িতেই কোনো রকমে বডি সেঁধিয়ে ঝিমোতে ঝিমোতে হাওড়ায়
পৌঁছলাম। এখন কফিটা শেষ ক’রেই বাথরুম যাবো।
একটু গরম জল ক’রে দে তো। একদমে
কথাগুলো শেষ ক’রলো বুল্টা।
--- তাহ’লে তো তোর বেশ
কষ্ট হ’য়েছে রে। ব’লে বুল্টা’কে গরম জল দিয়ে
বাথরুমে পাঠিয়ে দ্যায় বনলতা। তারপর চা বানিয়ে ডেকে তুললো বাবা’কে। বুল্টা’র আসার খবর শুনে
মা যেন একটু প্রাণ ফিরে পেলো।
বাথরুম যাবার আগে পিসীমনি’কে ফোন ক’রলো বুল্টা।
বনলতা পুরো শুনতে পেলো না। শুধু এ পারের কথাগুলো শুনলো। ‘মা, আমি বুল্টা... হ্যাঁ,
তুমি চিন্তা ক’রো না... হ্যাঁ...
মামু বাড়িতে... না না... আমি ঠিকমতো পৌঁছেছি... লতুদি গরম জল ক’রে দিয়েছে... আমি বাথরুম যাবো... বাবা’কে দাও... বাবা, এখানে সব ঠিক আছে... হ্যাঁ, বেইল হ’য়ে গেছে...চিন্তা করো না... আমি খবর দেবো... না, আমি এখনও
সবটা শুনিনি... আগে এ্যা ক’রে আসি... না,
মামু ওঠেনি... লতুদি চা দিচ্ছে... হ্যাঁ, আমি কথা ব’লিয়ে দেবো... রাখছি।’
বাথরুম থেকে একেবারে স্নান ক’রে বেরিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বুল্টা অবিনাশ বাবু’র ঘরে আসে। তিনি তখন চা খাচ্ছেন। বনলতা সেখানে দাঁড়িয়ে বুল্টা
পর্ব শোনাচ্ছে। বোন দেখলো, তার সেই ছোট্ট ভাই আজ এক পূর্ণ যুবক। বুঝতে পারলো, ও
নিশ্চয়ই শরীর চর্চা-টর্চা করে। তা নয়তো ওর হাতের বাইসেপ, চেস্ট মাস্ল ল্যাটিস
এভাবে হাত নাড়া’র সাথে সাথে
রিপ্লাই ক’রতো না। অবিনাশ বাবু’কে মিট ক’রেই ওর প্রথম প্রশ্ন,
--- কেসটা কী, মামু?
অবিনাশ বাবু’র বর্ণনা শুনে চোখ
লাল ক’রে ব’ললো--- মামু, লোকটা’র জিওগ্রাফিটা
একবার দেবে তো। রাস্তায় এমন পিট্বো, এম্মন পিট্বো যে, বাবা’র নাম... কথাটা ব’লেই জিভ কেটে আবার ব’ললো--- সরি মামু।
মুখ থেকে রাগে বেরিয়ে গেছে।
অবিনাশ বাবু ভাগ্নে’কে নিরস্ত ক’রলেন--- না না,
বাবা। তোকে আর পিটতে হবে না।
--- তোমার উকিল কে?
এই তো মুশকিল হ’লো অবিনাশ বাবু’র কাছে। তিনি তো
তার নাম না ব’লতে প্রতিশ্রুত।
আমতা আমতা ক’রে ব’ললেন--- সে তো সব তো ঠিক আছে। সে চেনাশূনো। তুই এখন ওসব
নিয়ে ভাবিস না তো।
--- ভাববো না! তুমি ব’লছো! তুমি আমার একটাই মামা। তাহ’লে কার কথা ভাববো! না হ’ক আমি নিয়মিত
খবরা-খবর নিতে পারি না। কিন্তু আমি কি ভুলে গেছি, মামু? একবার আমি ছোটবেলা সিঁড়ি
থেকে প’ড়ে গেছিলাম। মনে আছে? আমার থুত্নি ফেটে
গেছিলো। কে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে হাসপাতাল ছুটেছিলো? তুমি তখন ভাবোনি আমার কথা?
--- তাহ’লে তুই কি সেই ঋণ
পরিশোধ ক’রবি? মামু’র ঋণ?
আবার জিভ কাটে বুল্টা। কানে হাত দিয়ে বলে--- ছি ছি! আমার
যেন নরকে ঠাই হয়।
মাঝখানে পড়ে বনলতা বলে--- তুই যে পিট্বি ব’লছিস, তুই থাকিস জামশেদপুরে। তুই এখানে কী ক’রবি? তোকে এখানে চেনে কে?
প্যান্ট-টা চাপাতে চাপাতে বুল্টা গা ঝেরে উত্তর দিলো---
তুই দেখবি? দেখতে চাস? এখানে আমার কতটা কানেকশন? বুল্টা’কে দেউলিয়া ভাবিস না, লতুদি।
অবিনাশ বাবু ঠাণ্ডা করেন ভাগ্নে’কে--- না না, বাবা। তুই মাথা গরম ক’রিস না। সারা রাত জার্নি ক’রে এসেছিস। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম কর। একটু ঘুমো। তারপর দিদি’র সাথে গপ্প ক’রিস। ও তো একা একা থাকে এই বুড়ো-বুড়ি’কে নিয়ে। বোর ফিল করে।
বনলতা এই ভাইকে কোনদিন ভাইফোঁটা দেয়নি। নিজে ভ্রাতৃহীনা ব’লে দুঃখের কার্ত্তিক পুজো ক’রতে কখনও সাধ হয়নি
ওর। কিন্তু আজ এ্যাতোদিন পরে এ্যাতো বড়ো ভাইটাকে দেখে মনের মধ্যে সেই চাপা দেওয়া
ইচ্ছেটা কেমন যেন রিমঝিম ক’রে উঠলো। বুল্টা
তখন দিব্যি দিদি’র বিছানায় কোনো
নিষেধাজ্ঞা’র পরোয়া না ক’রে একটা বাচ্চা ছেলের মতো ঘুম দিয়েছে। বিকেল পাঁচটায় ভাইকে
ডেকে দ্যায় বনলতা। যদি সারাক্ষণ ঘুমিয়ে কাঁটায় ছেলেটা, তবে একটু গপ্পো-সপ্পো ক’রবে কখন! আজ যে ভাইয়ের সাথে ওর নানা কথা শেয়ার ক’রতে খুব ইচ্ছে হ’চ্ছে। নিঃসঙ্গ হ’লেও তো মানুষ
বনলতা। তাই ওকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিয়ে হাসতে হাসতে বলে,
--- বাবা রে বাবা! ঘুমোচ্ছিস এমন ক’রে যে, পাশে কোন বাচ্চা-কাচ্চা’কে শুইয়ে দিলে সেটা ভয়ে তো চিৎকার ক’রে উঠবে। কী নাক ডাকছিস!
প্রতিবাদ করে বুল্টা--- থাম তো তুই, লতুদি। একটা পুরুষ
মানুষ ঘুমোবে আর তার নাসিকা গর্জনে যদি একটা শিশুই ভয় না পেলো, তবে সে আর কী
পুরুষমানুষ! তাকে তার বৌ ভয় পাবে কেন?
--- বাবা! কী ফিলজফি! ‘বৌ ভয় পাবে।’ আর তাই ব’লে ওইরকম রাক্ষসের মতো নাক ডাকাতে হবে! তবে তো আমার বিয়েই
করা হবে না। আমার পাশে শুয়ে যদি কোনো পুরুষমানুষ ওইরকম গোঁ গোঁ করে, তবে পেন্নাম
আমার বিয়েতে।
চোখ ক’চলে উঠে ঘুম জড়ানো
গলায় বুল্টা বলে--- হ্যাঁ, ভালো কথা। তুই বিয়ে ক’রছিস না কেন রে?
ভুরু কোঁচকায় বনলতা--- কেন রে? আমার বিয়ে নিয়ে তুই এ্যাতো
ব্যস্ত কেন? তুই কি আমার বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলি?
বুল্টাও ছাড়ে না--- হ্যাঁ, দেখছিলাম। কব্জি ডুবিয়ে খাবার
স্বপ্ন। দাঁড়া, আমি মামু’র সাথে কথা ব’লছি। তোকে বিদেয় ক’রে তবে ছাড়বো।
--- আমি কি তোর পাকা ধানে মই দিয়েছি নাকি যে, তুই আমাকে
বিদেয় ক’রবি?
--- দিয়েছিস তো। তুই আমার পথের কাঁটা। তোকে বিদায় ক’রতে পারলেই আমি মামু’র যা কিছু, তাতে থাবা বসাবো।
এ কথায় বনলতা হেসেই অস্থির হয়। বলে--- যা কিছু? তুই কি
ঠিকঠাক জানিস, মামু’র এই ‘যা কিছু’-টা কী? বরং আমি
তোকে হেল্প ক’রি। লোন। শুধু
লোন। তাইতেই তুই না হোক থাবা বসা। আজই বসা। এর জন্যে আমাকে বিদেয় ক’রতে হবে না।
--- তাই হোক। ওইটাই হাতে আসুক আগে।
বনলতা ভাই’কে দ্যাখে আর মনে
মনে গর্ব করে। এমন একটি দিব্যকান্তি ভাই ক’জনের আছে! ওর হাতের বাইশেপে টোকা মেরে বলে--- ব্যায়াম ক’রিস বুঝি?
--- তা ক’রি না! এইসব মাস্ল-মন্দির
কি এমনি এমনি হয় নাকি? আস্লি জিম। দ্যাখ, সিক্স প্যাক হ’চ্ছে কিনা। ব’লে নিজের জামা তুলে বুল্টা পেট দ্যাখায়।
--- বাবা! নিজেকে হ্যান্ডসাম করার কী ইচ্ছে! তা কেউ কি তোর
এই মাস্লের মন্দিরের দিকে তাকায়-টাকায়? নাকি একা একাই আয়নায় শরীর দেখিস?
--- না না। ওসব ক’রলে এই ক’লকাতা’র মেয়ে-ফেয়ে ছাড়া চ’লবে না। কে জামশেদপুরে প্রেম করে! দে না ফিট ক’রে একটা মেয়েকে। তোদের ইউনিভার্সিটিতে কত মেয়ে।
--- ভ্যাট্। আমি কি এজেন্সি নিয়েছি নাকি? ওসব নিজের এলেমে
ক’রতে হয়।
--- কে ব’ললো তোকে? তুই
প্রেমে’র কী বুঝিস রে? এ্যাতোটা রূপ নিয়েও আজো
আইবুড়ি র’য়ে গেলি। প্রেমের সব কেসেই কেউ না কেউ
হেল্প করে। হয় দিদি, নয় ছোট বোন, তা নয়তো বৌদি। তা ঐ দুটোতো আমার কপালে নেই। তাই
তুই দিদি, তোকেই ব’লছি।
বুল্টা’কে বেকার অকর্মণ্য
ভেবে দিদি বনলতা একটু আঘাত ক’রতে চেষ্টা করে---
তা তোর সাথে কোনো মেয়ে প্রেমটা ক’রবে কেন? তুই
করিসটা কী? বাবা’র টাকায় ব্যায়াম ক’রলেই কি গার্লফ্রেন্ড পাওয়া যায়! নিজে কিছু কর, তবে তো
গার্লফ্রেন্ড।
--- কেন রে? প্রেমের সাথে কিছু করা-না-করার রিলেশন কী? আমি
কি কোনও মেয়েকে জিজ্ঞেস ক’রবো, ‘তুমি কী করো যে, প্রেম ক’রতে এসেছো?’ প্রেম ইজ প্রেম।
এখানে কোনো কাজ করো কিনা, কী দরকার। লাভ উইথ মানি ডেস্ট্রয়েজ দ্য হানি।
--- আরে এটাই তো আমাদের সোশাল সিস্টেম। তোমাকেই ক’রতে হবে। মেয়েরা যদি কিছু করে তো সেটা এক্সট্রা। নাকি তুই
ভেবেছিস, বউ-এর পয়সায় ব’সে ব’সে খাবি?
এবারে পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে বুল্টা। বনলতা’র সামনে নাচিয়ে
বলে--- দেখে রাখ। পাঁচ-পাঁচটা বৌ পুষতে পারি রে।
বনলতা ভিজিটিং কার্ডটা পড়ে। তাতে লেখা ON DEMAND ENTERPRISE
/ Supplier from Pin to Paradise / Jamshedpur / Jharkhand .
--- কী বুঝলি?
--- বুঝলাম, মাল সাপ্লাই ক’রিস। ইধার কা মাল উধার।
রেগে যায় বুল্টা। মুখ ঝাম্টা মেরে বনলতা’কে বলে--- তোদের দ্বারা কিস্সু হবে না। মাল ব’লিস না। সেটা বললে তো তোদের বোঝায় রে। গুড্স বল। গুড্স।
ওরে তিনটে এমপ্লয়ী পুষি রে। মাইনে দিই পনেরো শো টাকা ক’রে। কিছু বুঝলি?
--- মাইরি! সত্যি?
--- মাইরি না তো কী? মাসে অন্তত একবার কলকাতা’য় আসি রে। বড়বাজারে। আমার কাজ শুধু অর্ডার ধরা। ব্যস্।
সাপ্লাইয়ের লোক আছে। অন লাইন কারবার চলে রে
বস্। ব’লে বুল্টা দেমাক
দেখায়।
বনলতা এবার ওকে চেপে ধরে--- ও তাহলে ধরা প’ড়ে গেলি। তুই ক’লকাতায় আসিস। কৈ, আমাদের এখানে তো আসিস না!
--- এই দ্যাখো, রাগ ক’রছিস কেন? আরে আমি তো আসি হ্যারিকেন ট্যুরের মতো। এখানে এলে তো আমার চার-চারটে
ঘণ্টা ড্যামেজ। মা’র সাথে তো
মাইমা-মামু’র কথা হয়। তোদের খবর তো পাই। এই কিছুদিন
হয়নি। আর তার মধ্যেই এসব কেলেঙ্কারি ঘ’টে গেলো। এদিকে কিছু না ক’রলেই তো কথা
শোনাবি।
অন্য মনে বনলতা বলে--- তাহলে এখানে ছেলেগুলো চা-এর দোকানে ব’সে আড্ডা দ্যায় কেন বল তো? তোর মতোও তো নিজে নিজে কিছু না
কিছু ক’রতে পারে।
এবারে বুল্টা খাটে পা গুটিয়ে যোগাসন ক’রে বসে। বলে--- মামু আসবে না তো? তাহলে একটা সিগারেট ধরাই।
বনলতা মাথা নেড়ে ভরসা জানাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে একমুখ
ধোঁয়া ছেড়ে বলে--- এখানে সেই কালচারটাই যে নেই রে। বিহারে, মানে আমরা তো এখনও
ঝাড়খণ্ড ব’লি না। বিহারই ব’লি। ওখানে কোনো ছেলে ব’সে থাকে না। ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট তো। সবাই কিছু না কিছু ক’রছে। আসলে কিছু করার স্কোপ র’য়েছে ওখানে। এখানে তো কায়দাবাজি দেখতেই সব ব্যস্ত। এখানে বাবা-কাকারাই তো
রাস্তায় আড্ডা দ্যায়। অফিস ফেরত বাড়ি যায় না। ছেলেপুলেরা কী দেখছে বল তো!
বনলতা মেনে নেয়--- হ্যাঁ, সেটা একটা কথা বটে।
--- একটা কথা নয়। সেটাই কথা। এখানে ট্যালেন্ট আছে, ওখানে
আছে শ্রমবুদ্ধি। এই ছেলেগুলোই দেখবি, ওখানে গিয়ে যেই প’ড়বে, আড্ডা দেবার লোক পাবে না, অমনি কাজে নেমে প’ড়বে।
এরপরই প্রসঙ্গ পাল্টে বুল্টা বলে--- তোদের মামাদের কী খবর
রে?
বনলতা মুখ বেঁকায়। বলে--- জানি না। জানতে চাইও না। কোন
কানেকশান তো নেই।
--- মাকে ব’ললাম, একটু ঝেড়ে
দিয়ে আসি। কিন্তু মা’র কথা, ‘না। দাদা পছন্দ করে না।’ শালা মামা তো না, বদের ধামা।
--- ছাড় তো ওদের কথা। বনলতা এই সুখকর আড্ডাটা নষ্ট ক’রতে চায় না মামাদের প্রসঙ্গ টেনে। বরং এসব ব’লতে ওর খুব কষ্ট হয়। মামাদেরকে ও খুব ভালোবাসতো। যেমনটা
বাংলা’র সব ছেলে-মেয়েরাই মামা ব’লতে অজ্ঞান থাকে।
প্রসঙ্গ পালটায় বুল্টা--- তাহলে তোর কথা বল। তুই বিয়ে ক’রছিস না কেন? আমি তো মামু’কে মা’র সাথে ফোনে কথা ব’লতে ব’লতে দুশ্চিন্তা ক’রতে শুনেছি। মা-ও মাঝে মাঝে বিড়বিড় ক’রেছে এটা নিয়ে। তোর কী ব্যাপার? কেউ আছে? তাহ’লে বল্। আমি মামু’র সাথে কথা ব’লি।
--- আহা-হা! কী আমার বীরপুরুষ রে! মামু’র গলা শুনলে ভয়ে গুটিয়ে যায়। আবার বিয়ে নিয়ে কথা বলবে! দিদি
ব্যঙ্গ করে ভাইকে।
মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ ক’রে বুল্টা বলে--- না রে। এটাকে ঠিক ভয় বলে না। এটা হ’লো রেভারেন্স। মানে আমি ব’লতে চাইছি, এটাকে বলে শ্রদ্ধা মেশানো ভয়। আমি মানুষটাকে খুব শ্রদ্ধা করি। একটা
সৎ, সত্যবাদী মানুষকে না আমাদের মতো বাজে মানুষেরা এমন ভয়ই করে। ওটাকে ভয় বলে না।
এই যে লোকটা মামু’কে ফাঁসালো। ও কি
মামুকে ভয় করে? না। ভয় ক’রলে কি ফাঁসাতে
সাহস ক’রতে পারতো? কিন্তু কথা ব’লে দ্যাখ, ও বলবে, এই মানুষটাকে ও ভয় করে। মানে রেভারেন্স। এবার
বল্। তুই কি কোনো এ্যফেয়ারে আছিস?
--- না রে, পাচ্ছি কৈ!
--- পাচ্ছি কৈ মানে! পেতে চাইছিস কি? খুঁজছিস কি? বাংলায় কি
ছেলের অভাব? ‘পাচ্ছি কৈ’--- ‘পাচ্ছি না’ মানে কী?
--- হ্যাঁ, এখন এটাই বাকি আছে। পথে বেরিয়ে যাকে পাবো তাকেই
ব’লবো, ‘তুমিই কি সেই?’ তোর মাথা খারাপ!
--- মাথা খারাপ নয়। শোন, চোখটা তো খোলা রাখবি। মানুষকে তো
একটা সিগনাল দিবি। একটা লোক তো বুঝবে আগে, এ পথে ঢোকা যাবে কিনা। তুই যদি একেবারে
পাহারের মতো গম্ভীর হ’য়ে থাকিস, তবে কেউ
কি তোর ধারে কাছে ঘেঁষবে? ভয় পাবে না! এমনিতেই আমাদের বাবা’রা ‘ছেলে আর মেয়ে’ যে দুটো আলাদা জাতি--- সেটা একেবারে চোখে আঙ্গুল দিয়ে
দেখিয়ে আমাদেরকে রাক্ষস বানিয়েছে। তুই হ’লি ‘বনলতা দেবী’ আর আমি ‘দেবজ্যোতি ওরফে
বুল্টা রাক্ষস’। এবারে কেউ আর
সাহস ক’রে এগোবে!
বনলতা ভাইয়ের সাথে রসিকতায় মেতে ওঠে--- তাহলে তুই বল, কেমন
ছেলেকে বিয়ে করা উচিত।
--- সেটা তো একেক জনের মনের ব্যাপার, রুচির ব্যাপার। আমি কী
ব’লবো! তবে আমি ব’লতে পারি, চাকরিজীবী বিয়ে ক’রবি না। চাকরী করা মানুষ মানে ওরা সব কিছু একটা লিমিটের চোখে দ্যাখে। লিমিটেড
মাইনে ওদের, লিমিটেড ছুটি-ছাঁটা, লিমিটেড আনন্দ-ফুর্তি। ফলে তোকেও ওরা একটা লিমিটে
বেঁধে ফেলবে। ওরা হেভি খরুস, মক্ষীচুষ। ব্যবসায়ী পাত্র দেখবি। বড়ো মন, খোলা হৃদয়।
--- কেন? তোর মামা-ও তো চাকরী করে।
বিরাট প্রতিবাদ করে বুল্টা--- মামু-কে টানবি না। মামু ইজ
মামু। মামু’র সাথে তুই তুলনা ক’রতে পারবি? ও রকম মানুষ হয়! তুই চিনিস আর কাউকে?
--- তুই ব্যবসায়ী ব’লে ব্যবসায়ী’র কথা ব’লছিস। তাছাড়া তোর মতো ছেলে পাবো কোথায়, বল।
--- না রে। রিয়েলি। তুই আমার সাথে জামশেদপুরে চল। তোকে
দু-মাসে বিয়ে দিয়ে জোড়ে পাঠিয়ে দেবো, প্রমিস। ওখানে এক সে বড়কর এক গ্রুম আমার নজরে
আছে। বল, কথা বলবো মামু’র সাথে।
--- আমার কথা থাক। তুই তাহলে আজো একা একা ঘুরছিস কেন? একটা
বৌ এনে পিসিমনি’কে অন্তত একটু
রিলিফ দে।
--- হবে হবে, সব হবে। আমাদেরকে তো বিয়ে ক’রলেই চলে না রে। প্রস্তুত হ’য়ে বিয়ে ক’রতে হয়। একটু
গুছিয়ে নিই।
--- তাহলে আমায় চাপ দিচ্ছিস কেন? আমাকে একটু গুছোতে দে।
সিগারেট-টা জানলা দিয়ে বাইরে ফলে দিয়ে হেসে ফেলে বলে বুল্টা---
তোদের মেয়েদের আবার কী প্রস্তুতি কী রে! ফ্যামিলি তো চালাতে হবে আমাদেরকেই। তোরা
যে চাকরীই কর না, বড়ো জোর তোরা একটু আধটু সাপোর্ট দিবি। তার জন্যে কোনো গুছিয়ে
নিতে লাগে! শোন, আমি কিন্তু কাল ভেগে যাবো। এখানে ফর গড সেক, যেমন কোনো প্রবলেম
নেই, আমাকে আটকে থাকলে তো চ’লবে না।
ব্যথা পায় বনলতা। কালই ভাইটা চ’লে যাবে! আজ বহুদিন পরে ভাইয়ের সাথে বেশ দুপুরটা কাটছিলো।
তাই ব’ললো--- তুই কালই চ’লে যাবি! দুটো দিন থাক না।
--- না বস্, আমাকে তো বিজনেসটা সামলাতে হবে। অনেক কাজ পড়ে
থাকে। একবার জ’মে পাহাড় হ’য়ে গেলে তোলা মুশকিল।
পরদিনই বনলতাকে বেশ কয়েকফোটা চোখের জল ফেলিয়ে ঝড়ের মতো আসা
ভাইটা ঝড়ের মতো জামশেদপুরের দিকে ব’য়ে যায়। বনলতা
আবার ইউনিভার্সিটি, নোট্স, ক্লাশ--- এইসবের মধ্যে হারিয়ে যায়। জীবনে সুখ বা আনন্দ
হয়তো এমনি হঠাৎ এসে কোথায় ভেসে যায়। মানুষকে ক্লান্ত করে অথবা আবার এমন একটা দিনের
জন্যে তৈরী থাকতে বাধ্য করে।
------------------------------
এইসব বিহঙ্গেরা
পরিচ্ছেদ – ১৩
সকালবেলা দীপ্ত ঘোষপাড়ায় ক্লাশ ক’রছিলো। এখানে ও
মঙ্গল আর শুক্রবার ক্লাশ করে। সকাল আটটা থেকে দশটা। এর পরেই সোজা শ্রীপল্লী’তে। ঠিক এই সময় একটা বাচ্চা মেয়ে এসে ওকে ডাকে। বলে।
--- মাস্টারমশাই, আপনাকে এক ভদ্রলোক খুঁজছেন।
দীপ্ত জানতে চায়, কে খুঁজছেন। মেয়েটি বলে যে, ও চেনে না।
কিন্তু এরপর দীপ্ত’র কথায় মেয়েটি
যাকে এনে হাজীর করে, তিনি আর কেউ নন্, স্বয়ং অবিনাশ বাবু। অবিনাশ সেন। দীপ্ত’কে দেখেই অবিনাশ সেন হাতজোড় ক’রে নমস্কার জানান। দীপ্ত’কে বিনিময়ে ভদ্রতাবশত তাই ক’রতে হয়। কিন্তু ও
অসন্তুষ্ট হয় অবিনাশ সেন’কে দেখে। ওর
চোখেমুখে সেই অসন্তোষ লক্ষ্য করেন অবিনাশ বাবু।
এই সেই দীপ্তিময় রায়। একজন দক্ষ আইনজীবী’র মতো অবিনাশ বাবু’কে জামিন ক’রিয়ে পোলিসের
খপ্পর থেকে বের ক’রেছিল। এরপর
আদালতে মামলা চ’লতে থাকলে
সন্দিগ্ধ আসামীকেও যে নিজেকে নির্দোষ প্রমান ক’রার একটা ব্যাপার থাকে, আর তাতে যে মামলাটা অনেক বেশী অনুকূলে আসে, সেটা এই
প্রথম জেনেছিলেন অবিনাশ বাবু। সেটাও প্রমান ক’রে দ্যায় দীপ্তিময় রায়। বে-কসুর খালাস পান অবিনাশ বাবু। ছেলেটি ব্যক্তিগতভাবে
তদন্ত ক’রে সুকৌশলে প্রমান করে যে, অবিনাশ সেন
তাঁর অফিসের ঘুষ কাণ্ডের বিন্দু-বিসর্গ অবগত ছিলেন না। ভিজিল্যান্স যখন ব্যাঙ্কে
যায়, তখন অবিনাশ সেন আদৌ ব্যাঙ্কে ছিলেন না। বাস্তবে ভিজিল্যান্স ব্যাঙ্কে যাবার
দু-ঘণ্টা আগেই রিকভারি টিম নিয়ে অবিনাশ বাবু শ্রীরামপুরের উদ্দেশে বেরিয়ে যান।
ধরণী বাবু’ই আসল কালপ্রিট। যেহেতু এই পাপে ধরণী
বাবু পুরনো পাপী, সেহেতু ঘুষের টাকা রিসিভ ক’রেই যে কোনো কারণে তিনি সন্দেহ করেন, তাঁদের পুরনো কাস্টমার থেকে যে ব্রাইব
তিনি নিয়েছেন, তাতে কোনো গণ্ডগোল আছে। সাথে সাথে টাকা-টা তিনি অবিনাশ বাবু’র ড্রয়ার আন্লক দেখে আর টেবিলের ওপরে তাড়াহুড়োয় ভুলে রেখে
যাওয়া চাবিটা লক্ষ্য ক’রে সেখানে চালান ক’রে ড্রয়ার লক্ ক’রে দিয়ে চাবিটা টেবিলের ওপরে ফেলে রাখেন। এখানেই অপরাধী একেবারে অপরাধের নিয়ম
মতো একটি ভুল ক’রে ক্লু রেখে যায়।
চাবিটা নিজের কাছে নিয়ে রাখলে বা অন্যত্র ফেলে দিলে অবিনাশ বাবু নিজেকে নির্দোষ
প্রমান ক’রতে একটু অসুবিধায় প’ড়তেন কেননা তিনি চাবি’র খোঁজ ক’রেছেন অফিসে আসা’র পর। তাই পোলিস স্টেশনে কোন জিডি করেননি। ফলে চাবি যে
হারিয়েছে, সেটা সহজে প্রমান ক’রতে পারতেন না
তিনি। হয়তো ধর্মের কল বাতাসে নড়ে ব’লেই এমনটা ঘ’টলো। এরপর ধরনী বাবু এ্যারেস্টেড হন। টাকা উদ্ধার না হওয়ায়
ধরণী বাবু ভিজিল্যান্সকে ডিফেমেশন কেসের হুমকিও দেন। ভিজিল্যান্সও একটু অস্বস্তিতে
পড়ে। এরপর অফিসের সিকিউরিটি অবিনাশ বাবু’র চাবিটা লক্ষ্য করে। ফলে সে ধ’রে নেয়, একটু অসৎ
হ’লেই কিছু-না-কিছু হাতিয়ে নেওয়া যেতে
পারে। লোকটা প্রাইভেট সিকিউরিটি’র গরিব দারোয়ান। ও
জানে, পারসোনাল ড্রয়ারে নিজস্ব ওয়ালেট বা টাকাটা-পয়সাটা রাখেন বাবু’রা। পরে কালেক্ট ক’রে নেন। সে রকম কিছু পাওয়া গেলেও যেতে পারে ভেবেই চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলে টাকা’র বাঞ্চটি পেয়ে যায়। অভাবে স্বভাব নষ্ট। অতগুলো টাকা’র লোভ বড়োলোকেই সামলাতে পারে না, তো গরিব! কিছু না জেনেই
টাকা-টা নিয়ে বাড়ি চ’লে যায় সে। অফিসে
কিছু একটা ঘ’টেছে, ও জানে।
কিন্তু ব্যাপারটি গোপন রাখার চেষ্টা করা হয় ব’লেই লোকটা বিস্তারিত জানে না। আর তারপরেই ঘ’টে যায় নাটকীয় ঘটনা। অবিনাশ বাবু’র এ্যাডভোকেট কোর্টে অবিনাশ বাবু’র অফিসের এবং শ্রীরামপুরের সাক্ষী-সাবুদ, তাঁর এ্যালিবাই, পাস্ট রেকর্ড
ইত্যাদি প্রডিউস ক’রলে বিচারে অবিনাশ
বাবু বেকসুর খালাশ পেয়ে যান।
কিন্তু অবিনাশ বাবু’র বিস্ময় এই দক্ষ আইনজীবী’র ইন্দ্রজাল দেখেই
কাটেনি। যে মানুষটা তাঁর হ’য়ে উপকার ক’রলো, তাঁর শর্ত ছিলো, অবিনাশ বাবু’র এই কেসের বিষয়ে কারোর সাথে কোনো কথা ব’লবেন না। এমনকি এ্যাডভোকেটের নাম পর্যন্ত বাইরে প্রকাশ করা
যাবে না। ছেলেটি নাকি এই জীবিকা ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু বার এ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার ও
আজো আছে। এই খবর বাইরে প্রকাশ হ’লে তাঁর পক্ষে
নাকি এই জীবিকা ছেড়ে থাকা মুশকিল হবে। নানা মানুষের নানা সমস্যা। তাদেরকে ইগ্নোর
করা ওর পক্ষে নাকি মুশকিল। তাছাড়া কাউকে কোনো উপকার ক’রে ছেলেটি কোনো প্রচারও চায় না। অবিনাশ বাবু মুগ্ধ ছেলেটি’র বিচারবোধ দেখে। দেবদূতের মতো ছেলেটি তাঁর জীবনে আসে আবার
ঝড়ের মতো কাজ সমাধা ক’রে চ’লেও যায়। হারিয়ে যায়। কোর্ট থেকে বেরিয়ে অবিনাশ বাবু ওকে আর
দেখতে পান নি। গোটা ঘটনাটা কেমন যেন একটা গল্পের মতো অবিনাশ বাবু’কে বিস্মিত করে।
সেই থেকে তিনি এই ছেলেটির শর্ত পালন ক’রে আসছেন। যেদিন অবিনাশ বাবু খালাশ পান, সেদিন তিনি নিজের
এ্যাডভোকেটের সাথে সাক্ষাৎ ক’রতে গিয়ে ব্যর্থ হ’য়েছেন। কেস শেষ হ’তেই সে কোথায় উধাও! তাঁকে ধ’রতে পারেন নি।
অবিনাশ বাবু’কে রিসিভ ক’রতে অফিসের এতো মানুষ ভিড় ক’রলো যে, তাঁর বাইরে আসতেই দেরী হ’লো। এসে দ্যাখেন, সে নেই। বিস্মিত বিমূঢ় অবিনাশ বাবু সদর্পে বাড়ি ফিরেছেন।
কিন্তু সেই থেকে নিজের মুখে কুলুপ এঁটেছেন। এ্যাডভোকেট ছেলেটিকে একটা পয়সা পর্যন্ত
দিতে পারেননি। ছেলেটি টাকা’র কথা ব’ললেই কেমন যেন এড়িয়ে এড়িয়ে গেছে! তারপর উধাও। কী মুশকিল! এই
ঋণ অবিনাশ বাবু ব’য়ে বেড়াবেন কী ক’রে! তাই শেষবারের জন্যে দেখা ক’রে ঋণ পরিশোধ ক’রতে এসেছেন।
দীপ্ত অবিনাশ বাবু’কে দেখে না চেনার ভান করে। অভিনয় ক’রে বলে--- আপনাকে তো...?
অবিনাশ বাবু হেসে দেন। বলেন--- না চেনা’র ভান ক’রছেন? আপনি তো
বিলক্ষণ চিনতে পেরেছেন আমাকে।
দীপ্ত আরো একটু গভীর অভিনয়ের চেষ্টা করে--- আমাকে তো
সারাদিন বহু মানুষকে মিট ক’রতে হয়। সবাইকে
চিনে রাখা তো সম্ভব নয়।
অবিনাশ বাবু হাসেন। ভাবেন, ‘তুমি হয়তো একটি জাঁহাবাজ উকিলের মতো চালাক, কিন্তু আমার তো মাথা রুপোলী হ’য়েছে। বুদ্ধি একেবারে নেই, এমন আন্ডার-এস্টিমেট আমায় ক’রো না।’ তাই তিনি শুধু
মুখে ব’ললেন--- সারাদিন যারা আপনার সাথে দেখা ক’রতে আসেন, তাঁদের মতোই আমি একজন, মনে ক’রুন। আপনার সাথে আমার খুব প্রয়োজন। আমি কি অপেক্ষা ক’রবো? আপনার পড়ানো শেষ হ’লে...
দীপ্ত তো ভদ্রলোকটি’কে সত্যিই বিলক্ষণ চিনেছে। এ্যাভয়েড করার জন্যেই না চেনার ভান ক’রছিলো। কিন্তু অবশেষে বুঝলো যে, অবিনাশ সেন কথা না ব’লে যাবেন না। তাই ছেলেমেয়েদেরকে ব’লে দিলো--- তোরা আজকে যা। আমি ওঁর সাথে একটু কথা ব’লে নি।
অবিনাশ বাবু দেখলেন, গোটা কুড়ি বাইশ-তেইশ বছরের যুবক-যুবতী
ঘর থেকে গল্ গল্ ক’রে বেরিয়ে গেলো।
এখানে ঢোকার আগেই তিনি দেখেছেন যে, এটি একটি বাড়ি’র একতলা’র একটি হলঘর।
এখানে ভাড়া নিয়ে ছেলেটি ক্লাশ করে। বাইরের সিঁড়ি-তে তাদের সকলের চটি-জুতো বেশ
সাজিয়ে রাখা, বেশ কয়েকটি সাইকেল দাঁড় করানো ছিল, আর দাঁড়ানো একটি মোটর সাইকেল।
ছেলেমেয়েগুলো তাদের যার যার চটি পায়ে গলিয়ে যার যার সাইকেল নিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
শুধু মোটর সাইকেলটি প’ড়ে থাকে। তার
মানে, এই যানটি স্বয়ং মাস্টার মশাইয়ের। চুপ ক’রে অবিনাশ বাবু ছেলেমেয়েদের চ’লে যাওয়ার দিকে
তাকিয়ে থাকেন।
এখানে আসতে তাঁকে বেশী কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি। বার
এ্যাসোসিয়েশনে গিয়ে দীপ্তিময় রায়-এর খোঁজ ক’রতেই প্রায় সকলে জানিয়ে দিয়েছেন যে, এ্যাডভোকেট দীপ্তিময় লোকাল লোক। এমনকি
তিনি বেশ পরিচিত ও জনপ্রিয়। ফলে এখানে তাঁকে খুঁজে পেতে কোন অসুবিধে হবে না।
অঞ্চলের যে কোন যুবক-যুবতীই নাকি তাঁর খোঁজ দিতে পারবে। অবশেষে অচেনা এক যুবককে
প্রশ্ন ক’রতেই একে কোথায় কখন পাওয়া যাবে, তাঁর
ডিটেল্স পেয়ে যান তিনি। এখানে এসেই শেষে অবিনাশ বাবু ধরেন তাঁর দেবদূতকে। সকলে চ’লে যেতে দীপ্ত ডেকে নেয় অবিনাশ বাবু’কে। আবার অভিনয় ক’রে বলে,
--- এবার বলুন, আমি আপনার কী উপকার ক’রতে পারি?
এবারে অবিনাশ বাবু মুচকি হাসেন। ভাবেন, ছেলেটিকে এবারে তো
বুঝিয়ে দিতে হবে যে, উনি যে চিনতে অস্বীকার ক’রতে চাইছেন, সেটা আগন্তুক ধ’রতে পেরেছেন। তাই
মুচকি হাসি মুখে নিয়েই তিনি বলেন--- না, আর কোন উপকার নয়। এবারে আমাকে উপকারের
প্রতিদানটা সারতে হবে যে। এই কারণেই আমার আসা। আর আমি যে অবিনাশ সেন--- তা তো আপনি
বুঝতেই পেরেছেন। তবে কেন চিনতে অস্বীকার ক’রছেন?
--- কী ক’রে বুঝলেন, আমি
আপনাকে চিনতে পেরেছি? দীপ্ত শেষবার চেষ্টা করে অভিনয়ের।
--- না হ’লে একজন
মাস্টারমশাই কি একজন আগন্তুককে বলেন, ‘আপনাকে চিনতে পারছি না?’ আপনার সাথে তো
নানা অভিভাবক সাক্ষাৎ ক’রতে আসেন। সকলকে
তো আপনার চেনার কথা নয়। তাছাড়া একজন অভিভাবক এলে কি মাস্টারমশাই ছাত্রছাত্রীদের
ছেড়ে দেন? এমন তো আসতেই থাকবেন অভিভাবক। আমি তখনই বুঝলাম, আমাকে চিনতে আপনি
অস্বীকার ক’রতে চাইছেন। তাই দয়া ক’রে আর না চেনার ভান ক’রবেন না।
দীপ্ত বেমক্কা ধরা প’ড়ে গিয়েও কোনো অসহায় ভঙ্গিমা করে না। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা ক’রে বলে--- আমি তো আপনাকে ব’লেইছি, আমাকে কোনো কৃতজ্ঞতা জানাবেন না।
--- জানাই নি তো, মিঃ রায়। আমি শুধু আমার কাজে এসেছি। কাজটা
ক’রেই চ’লে যাবো। অবিনাশ সেন জানিয়ে দেন। এর সাথে এ কথাও জানিয়ে দেন যে, তিনিও তাঁর
প্রতিশ্রুতি রক্ষা ক’রেছেন এবং আজো ক’রছেন। আজ পর্যন্ত কাউকেই তিনি দীপ্ত’র কথা বলেননি। বাড়িতেও নয়।
দীপ্ত এ কথা শুনে বেশ খুশি হয়। এই এতক্ষণে একটুখানি হেসে
বলে--- থ্যাংকস টু ইউ, স্যার।
অবিনাশ বাবু এবারে তার খোলস থেকে বেরিয়ে এসে বললেন--- বেশ,
তাহ’লে আমাকে চিনতে পেরেছেন। কিন্তু আমাকে
থ্যাংকসটুকু জানালেই তো চ’লবে না, মিঃ রায়।
আপনি আমার কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিক নেবেন না--- ভালো। সেটা না হয় আপনার নৈতিক
বিষয়। আমি তাতে মাথা গলাবো না। কিন্তু আপনি তো আমাকে কোনো ঋণজালে আবদ্ধ ক’রতে পারেন না। আমি কেন আপনার ঋণ ব’য়ে বেড়াবো, বলুন তো?
দীপ্ত অবাক হ’য়ে জানতে চায়--- কোন ঋণের কথা ব’লছেন, বলুন তো?
--- একটা কেস চালাতে গেলে কতককগুলো কমন খরচ তো ক’রতেই হয়। সেগুলো তো পারিশ্রমিকের মধ্যে পড়ে না। সেগুলো তো
কোর্টের খরচ। ক্লায়েন্টকে তা বহন ক’রতেই হয়। আপনি
সেগুলোও তো নেন নি আমার থেকে। আমি কেস মিটে যেতে আপনাকে দেখতেই পেলাম না। আপনি তো
একেবারে ভিনি ভিডি ভিসি। এলেন, দেখলেন, আর জয় ক’রে বেরিয়ে গেলন। এটা তো অন্যায় হ’লো। একসঙ্গে এক কাপ চা পর্যন্ত খাওয়া হ’লো না। অন্তত একসঙ্গে তো সেলিব্রেট করা যেতো। প্রায় দু-তিন বছর পরে কোর্টে
দাঁড়িয়ে এই মামলা-টাতে আপনিও তো জিতলেন। ঠিক কিনা?
এবার সত্যি দীপ্ত বাকরুদ্ধ। ও বেশ বুঝতে পারলো যে, মানুষটি
আপাদমস্তক একটি ভালো মানুষ। ভালো মানুষদেরকে বড়ো ভয় পায় দীপ্ত। এই মানুশগুলো’র ট্যাঁক ফাঁকা থাকলেও কোথায় যেন একটা রাজকীয় চাল থাকে,
একটা আলাদা লেভেলের কনফিডেন্স ওঁদের থাকে, একটা ব্যক্তিত্ব থাকে। তাকে অতিক্রম করা
যায় না। তাই এদেরকে ভয় পায় দীপ্ত। এখন এই মানুষটিকে বেশ ভয় পেলো ও। ও জানে,
সাবধানে এদের সাথে কথা ব’লতে হয়। যখন তখন
অবাঞ্ছিত কথা বেরিয়ে এলে এই মানুষগুলো প্রত্যুত্তরে কিছু বলেও না। এদেরকে ঘাঁটা
বেশ মুশকিল। তাই কোনোরকমে পরিবেশ পরিস্থিতি বাঁচিয়ে সাবধানে দীপ্ত ব’ললো,
--- আমি আপনাকে পরে হিসেব দিয়ে দেবো। আপনি চিন্তা ক’রবেন না। আপনি একটা মিথ্যে স্ক্যান্ডাল থেকে মুক্ত হ’য়েছেন, এটাই আমার বড়ো পাওনা। আমি কারোর জন্যে কিছু তো ক’রতে পারলাম। এটাও তো একটা প্রাপ্তি।
--- তাহ’লে এক কাপ চা হোক।
হেসে দিয়ে দীপ্ত বলে--- হোক।
--- দোকানে যেতে হবে তো?
দীপ্ত জানায়--- না না। কোথাও যেতে হবে না। একটা বেল বাজাতে
হবে শুধু।
একটা বেল ছেলেটির পাশে ঝুলতে দেখলেন অবিনাশ বাবু। ছেলেটি
সেটা টিপতেই ওপর থেকে একটি মেয়ে নেমে এলো। দীপ্ত তাকে উদ্দেশ ক’রে ব’ললো--- খেন্তি,
দু-কাপ চা দে তো। আমার একজন অতিথি এসেছেন।
মেয়েটি রাগ ক’রে ব’ললো--- সবার সামনে ‘খেন্তি’ ব’ললে কোনো চা হবে না কিন্তু।
দীপ্ত হেসে দিয়ে বলে--- জানিস, আমার মা আমাকে কী ব’লে ডাকতেন? ডাম্বেল। আমি ব্যায়াম ক’রি তো। আমি ছোটবেলা থেকে মা’র শিলের নোড়া, হামান-দিস্তা যা হাতের সামনে পেতাম, তাই দিয়েই ব্যায়াম ক’রতাম। এখনও ক’রি। তাই এখনও আমি ডাম্বেল। তোরা কেউ জানিস না।
--- তাই ব’লে খেন্তি! মেয়েটি
শেষবার প্রতিবাদ করে।
--- আচ্ছা, আমি তোকে ‘জয়ন্তী’ ব’লে ডাকলে তুই খুশি হ’বি? মনে হবে না,
দীপ্তদা’র মতো গলায় কেউ যেন ডাকছে? বল্।
--- কথা’র রাজা তুমি। ব’লে মেয়েটি জিভ ভেঙ্গিয়ে চ’লে যায়।
অবিনাশ বাবু প্রশ্ন করেন--- আপনাকে একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন ক’রবো? অবশ্য আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে।
--- বলুন।
---- আপনার মা কি... আপনি ব’ললেন, ‘ডাকতেন’।
--- হ্যাঁ। আমাদের মা-বাবা একসাথে আমাদের ছেড়ে চ’লে গিয়েছেন। একদম অনাথ আমরা। আমরা দুই ভাইবোন।
--- আহা হা হা! মা যাদের নেই, তাদের যে কেউ নেই। ব’লে আক্ষেপ করেন অবিনাশ বাবু।
বাধা দিয়ে দীপ্ত--- না না। আমার তো আপনারা আছেন। আপনাদের
নিয়েই তো বাবা’কে, মা’কে খুঁজে পাই। আমার মা সব সময় আমাকে সকলের পাশে দাঁড়াতেন।
তখন মা’কে কত দুষতাম! কত বিদ্রূপ ক’রতাম! আজ বুঝি, এটা একটা আনন্দ। অনাবিল অানন্দ। মা তাই ক’রতেন। আজ আমি বেশ আনন্দ পাই।
চা আসে, বিস্কুট আসে। কিন্তু অবিনাশ বাবু অবাক হয়ে দ্যাখেন,
এই ছেলেটি তাঁকে কোন প্রশ্ন করে না। অবিনাশ বাবু’র বাড়ি’র কথা, চাকরী’র কথা--- কিচ্ছু না। তাই অবিনাশ বাবু’র মনে হয়, এই ছেলেটিকে মনের দু-একটা কথা যেন বলা যায়, শেয়ার
করা যায়। ছেলেটি বয়সে ছোট হ’লেও বলা যায়। তিনি
এ-ও মনে করেন, সমাজে কিছু মানুষ থাকেন, যারা বয়সে হয়তো ছোট বা অসমান। কিন্তু
তাঁদের মানসিক মান এতোটাই পরিণত যে, তাঁদেরকে অনেক বড়োরা পর্যন্ত একটা বড়ো পিড়ি
দিয়ে ব’সেন। বেমানান লাগলেও দ্যান। সকলের কাছে ‘দীপ্তদা’ নামে এই ছেলেটি
যেন তেমন কোন গোত্রের মধ্যে পড়ে ব’লে মনে হয় অবিনাশ
বাবু’র।
চা-পান শেষ হয়। দু-একটা এপাশ ওপাশ বাক্য বিনিময় হয় এবং শেষে
অবিনাশ বাবু উঠতে উদ্যোগ নেন। হঠাৎ দীপ্ত ব’লে ওঠে,
--- একটা কথা ব’লবো মিঃ সেন?
অবিনাশ বাবু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকান দীপ্ত’র দিকে। দীপ্ত আবার বলে--- আপনার সমস্যা তো মিটে গেলো। কিন্তু আপনার চোখেমুখে তো কোন আনন্দের বা
স্যাটিস্ফ্যাক্সশনের ছাপ দেখছি না? একটা আবছা মেলাঙ্কলি এক্সপ্রেশন দেখছি। কেন, ব’লুন তো? অবশ্য আপনার যদি ব’লতে কোনো আপত্তি থাকে, তবে থাক। আমি এই কটা দিন ধ’রে আপনাকে দেখতে দেখতে এই একটা উদ্ধার ক’রেছি। থানা’র সেকেন্ড
অফিসারের অভিজ্ঞ চোখ পর্যন্ত এটা লক্ষ্য ক’রেছে। আর তাই তিনি আপনাকে এ্যাডভোকেট এ্যাপয়েন্ট ক’রে দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
মৃদু হাসেন অবিনাশ বাবু। চুপ ক’রে তাকিয়ে থাকেন দীপ্ত’র মুখের দিকে। বুঝতে চেষ্টা করেন, ছেলেটির প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন। দীপ্ত-ও
বুঝতে চেষ্টা করে--- এ কথা ওর বলা উচিত হ’লো কিনা। তাই ও আবার বলে,
--- আমার মনে এলো, তাই ব’ললাম। আমি অবশ্য আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোট। আপনার ব’লতে আপত্তি থাকতেই পারে।
আবার হাসেন অবিনাশ বাবু। এবার বলেন--- মানুষের অনেক
মেলাঙ্কলিনেস থাকে, বাবা। তোমাকে যে কী ব’লি! কথা-কটা ব’লেই জিভ কাটলেন তিনি। লজ্জা পেয়ে ব’ললেন--- এই দ্যাখো, আমি আবার তোমাকে ‘তুমি’ ব’লে ফেললাম। কিছু মনে ক’রো না, বাবা।
--- এই দেখুন, এটাও তো আপনি সেই ‘তুমি’ই ব’ললেন। তার চেয়ে এই-ই ভালো হ’লো। আপনার মুখে ‘আপনি’ ডাকটা খুব বেমানান লাগছিলো।
এইখানটায় অবিনাশ বাবু একটু আবেগপ্রবণ হ’য়ে পড়েন। আবেগেই ব’ললেন--- তা-ই যখন ব’ললে, তখন তোমাকে ব’লি। আমার পরিবারে নানা ঘটনা ঘটনা ঘ’টেছে। নানা বঞ্চনা, নানা উৎকণ্ঠা’র জীবন আমার। কিন্তু আমি সুখী ছিলাম নিজে নিজেই। সমস্যা
আমার মেয়েটা। আমার একমাত্র মেয়ে বনলতা।
হেসে ফ্যালে দীপ্ত। হাসতে হাসতে বলে--- আপনার মেয়ে আপনার সমস্যা! কেন? মেয়ে কী সমস্যা তৈরী ক’রলো?
এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে যান অবিনাশ বাবু। বাধো বাধো কণ্ঠে
বলেন--- না, মেয়ে সমস্যা, মানে এই নয় যে, আমার মেয়ে’র কারণে আমার জীবন ওষ্ঠাগত। বরং আমার মেয়ে আর পাঁচটা মেয়ে’র থেকে আলাদা। খুব ঠাণ্ডা, রিজার্ভ, ওবিডিয়েন্ট। অন্য কিছু
নয়।
--- তবে?
--- আসলে মেয়েটার বয়স হ’চ্ছে, কিন্তু মেয়েটা মোটে ওর বিয়েতে মত দিচ্ছে না। কথাটা পাড়লেই কেমন এড়িয়ে
যায়। কেন, এই তো বুঝতে পারছি না। এর কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। মেয়েটা কোনো না
কোনো এক্সকিউজ দিয়ে চ্যাপ্টারটা এ্যাভয়েড করে। এই যে এম.এ. প’ড়ছে। এটা ওর পড়া’র কথাই নয়। ও শিক্ষকতা ক’রতে চায় না। আমি
জানি। এটা বিবাহ এড়িয়ে যাবার একটা অজুহাত। ও চেয়েছিলো চাকরী ক’রতে। কিন্তু যেহেতু সেটা একটা সুদূরপ্রসারী অনিশ্চিত
ব্যাপার, সেহেতু এই এম.এ.-তে ভর্তি হ’লো। আমাদের তো বয়স
হ’চ্ছে, বলো। কত ভালো ভালো সম্বন্ধ এসেছে।
কিন্তু না।
অবিনাশ বাবু’র হতাশাভরা
কথাগুলো শুনেও দীপ্ত’র ডাল গলে না। ও
আজকের প্রজন্ম। অবিনাশ বাবু যতই ওকে পরিণত মনে করুন না কেন, ও এ বিষয়ে বাবা
শ্রেণীয় মানুষদেরদের প্রাচীন মানসিকতা চেনে। তাই একটু ব্যঙ্গাত্মক সুরে প্রশ্ন ক’রলো--- ‘ভালো ভালো সম্বন্ধ’ মানে?
--- ভালো ভালো সম্বন্ধ মানে আর কিছু না। আপাতদৃষ্টিতে ভালো
সম্বন্ধ ব’লতে আমরা যা বুঝি, আর কি। অবিনাশ বাবু
জানান। এই ধরো, একটু ভালো দেখতে-শুনতে, একটু ভালো চাকরী, ভালো পরিবার, অঞ্চলে বা
কর্মক্ষেত্রে ছেলেটি’র ভালো রেকর্ড---
এইসব আর কি। এ ছাড়া একটি ভালো পাত্রের অন্য কোনো অর্থ তো আমি জানি না।
দীপ্ত বুঝতে পারে না, এর কোনো পাল্টা সদুত্তর ও দিতে পারবে
কিনা, অথবা দেওয়া উচিত কিনা। তাই ও আবার যুক্তি দিতে চেষ্টা করে--- হয়তো তাদেরকে
কোনো কারণে আপনার মেয়ে’র ‘ভালো’ ব’লে, মানে যোগ্য ব’লে মনে হ’চ্ছে না।
অবিনাশ বাবু যেন দীপ্ত’র কথা শোনেননি, এমন একটা ভাব নিয়ে জানালেন--- না... না। অন্য কিছু। অন্য কোনো
কারণ! আমরা ধ’রতে পারছি না।
হঠাৎ দীপ্ত মনে একটু সাহস সঞ্চার ক’রে ব’ললো--- একটা কথা
আমি আপনাকে ব’লতে পারি, মিঃ
সেন। অবশ্য আপনি যদি আমাকে পার্মিশন দেন।
--- এ তুমি কী ব’লছো, বাবা! আমি নিজেই তো তোমার সাথে আলোচনা ক’রছি। তোমাকে ব’লে ফেললাম তো একটা ভালোমন্দ আলোচনা করার জন্যেই। তুমি
ম্যাচিওর্ড ইয়াং ম্যান। এ্যাতোগুলো চ্ছেলেমেয়ে তুমি হ্যান্ড্ল করো। তুমি হেজিটেট
ক’রো না। বলো। ব’লে অবিনাশ বাবু দীপ্তকে একেবারে পাওয়ার অফ এ্যাটর্নি দিয়ে
দিলেন।
দীপ্ত একটু সঙ্কোচ ক’রেই বলে--- আপনি একজন ডক্টর কন্সাল্ট করুন। আপনার মেয়ে... মানে সে তো লেস্বিয়ানও
তো হ’তে পারে। আজকাল তো এমনটা ভীষণ দেখা
যাচ্ছে। তাই ব’ললাম। প্লীজ ডোন্ট
মাইন্ড। আপনি কিছু মনে ক’রবেন না। আপনি
প্রব্লেমে আছেন ব’লেই আমি কথাটা ব’লে ফেললাম।
--- লেস্বিয়ান? এটা’র মানে কী, গো? ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকেন সরল সোজা অবিনাশ বাবু।
--- আই মীন... ডোন্ট মাইন্ড... আপনার মেয়ে’র তো কোনো সেক্সুয়াল কমপ্লিকেসি থাকলেও থাকতে পারে। তো তো ক’রে বলে দীপ্ত।
অবিনাশ বাবু হেসে ফ্যালেন। দু-হাত তুলে বাধা দিয়ে বলেন---
না না, দীপ্ত। সে সব কিছু নয়। ওর মা’র সাথে আমি কথা ব’লেছি। অন্য কোনো
কিছু...।
এসব কথা সমাপ্ত হ’তেই অবিনাশ বাবু উঠবো-উঠবো ক’রতে দীপ্ত ডেকে
বলে তাঁকে--- মিঃ সেন, একটা কথা। আপনার মেয়ে’র নামটা যেন কী বললেন?
--- বনলতা। বনলতা সেন।
--- ব-ন-ল-তা সেন! বেশ থেমে থেমে নামটা উচ্চারণ করে দীপ্ত।
কী যেন একটা বিষয় কোথায় টেনে নিয়ে যায় দীপ্ত’কে!
--- ওটা নিয়ে তুমি এতো ভেবো না। আমিই ঐ নামটা দিয়েছি। ওটা
আমার একটা অবসেশন ব’লতে পারো। কাঁচা
বয়সের অবসেশন।
হঠাৎই দীপ্ত প্রশ্ন ক’রে বসে--- আচ্ছা মিঃ সেন, আপনারা এখানে কি আগাগোড়া আছেন, নাকি এর আগে অন্য
কোথাও ছিলেন?
--- কেন বল তো? তুমি কি আমাদের চেনো ব’লে মনে হ’চ্ছে?
দীপ্ত একটা আচ্ছন্নের মধ্যে বলে--- না না, তা নয়, স্যার।
এমনি প্রশ্ন ক’রছি। শুধু জানতে
চাইছি।
অবিনাশ বাবু প্রত্যুত্তর করেন--- আমরা ছিলাম চন্দননগরে।
কিন্তু সে তো আজ ধরো গিয়ে...
অবিনাশ বাবু’কে থামিয়ে দিয়ে
দীপ্ত আবার প্রশ্ন করে--- চন্দননগর, না? আপনার মেয়ে কোন স্কুলে প’ড়তো?
--- বনলতা? ও তো টাউন স্কুলে প’ড়তো।
বিড়বিড় করে দীপ্ত--- টা-উ-ন স্কু-ল। আই সি!
--- কী ভাবছো, বলো তো? দীপ্ত’কে বিড়বিড় ক’রতে দেখে বিস্মিত
অবিনাশ বাবু জানতে চান।
দীপ্ত কিছুক্ষণ কী যেন ভাবে। তারপর হঠাৎ ব’লে বসে--- আচ্ছা মিঃ সেন, আমি যদি আপনার মেয়ে’কে বিয়ে ক’রতে চাই? যদিও আমি
আপনার মেয়ে’কে দেখিনি, তবুও যদি আমি চাই, আপনি কি
রাজী হবেন? আমার বয়স থার্টি টু প্লাস, আমার হাইট পাঁচ-এগারো, কোয়ালিফিকেশন এম.এ. এল.এল.বি.। আর বর্তমান পেশা প্রাইভেট টুইশান। মান্থলি ইনকাম কমবেশি
প্রায় বিশ হাজার টাকা। চলবে? তাছাড়া আমি মার্শাল আর্টের ব্ল্যাকবেল্ট। আমার স্ত্রী’কে আমি রক্ষা ক’রতে পারবো। আমি কি আপনার মেয়ে’র যোগ্য ব’লে আপনার মনে হয়?
দীপ্ত’কে একদমে
এ্যাতোগুলো কথা ব’লে যেতে দেখে
অবিনাশ বাবু অবাক। তিনি বুঝতে পারেন না,
কী ব’লছে দীপ্ত! কেন হঠাৎ এসব ব’লছে। এ সব কথা’র মানে কী? লতু’কে বিয়ে ক’রবে! একটু আগে অবিনাশ বাবু দীপ্ত’কে জানিয়েছেন, লতু বিয়ে ক’রতে চাইছে না। তাই অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে তিনি ব’লে দিলেন--- তুমি শুনলে, ও বিয়ে ক’রতে চাইছে না। তবুও তুমি এ কথা ব’লছো?
দীপ্ত যেন এসব কথা শুনতেই পায়নি। ও আপন ঘোরেই বলে--- আপনি
আমায় আগে বলুন, আমি আপনার মেয়ে’র যোগ্য কিনা?
আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো অবিনাশ বাবু বলেন--- তুমি!
তোমার মতো ছেলে আমি পাবো কোথায় বলো তো? থানা’র সেকেন্ড অফিসার আর তুমি আজ প্রমান ক’রে দিয়েছো যে, পুরনো প্রবাদগুলো আজ আর খাটে না।
এ কথায় দীপ্ত যেন একটু বাস্তবে ফিরে আসে। তাই প্রশ্ন করে---
পুরনো প্রবাদ! কোন পুরনো প্রবাদ, বলুন তো?
--- যদি কিছু মনে না করো, তবেই ব’লবো।
--- না না, আপনি বলুন।
--- ঐ যে ‘উনিশটা শকুন ম’রে একটা উকিল হয়’। আর ‘পুলিশে ছুলে আঠারো ঘা’। তোমরা দুজনে তো এই প্রবাদ দুটোকে মিথ্যে ক’রে দিয়েছো।
অবিনাশ বাবু’র এই কথায় তাঁকে
লজ্জা লজ্জা ভাব ক’রতে দেখে দীপ্ত হা
হা ক’রে হেসে ওঠে।
অবিনাশ অবিনাশ বাবু ওর হাসি থামিয়ে দিয়ে বলেন--- যদি তুমি
আমার মেয়ে’কে বিয়ে ক’রতে রাজী থাকো, তবে আমি তাকে রাজী করাবোই।
হাঁ হাঁ ক’রে বাঁধা দ্যায়
দীপ্ত--- না না, মিঃ সেন। ওটা দয়া ক’রে ক’রবেন না। নো ফোর্স।
--- তুমি বুঝতে পারছো না, দীপ্ত। আমায় এটা ক’রতেই হবে। ফর হার সেক। জোর দিয়ে ব’ললেন অবিনাশ বাবু। তুমি শুধু আমাকে বলো, আমাকে কীভাবে
প্রসীড ক’রতে হবে।
দীপ্ত বেশ গম্ভীর মুখে সিরিয়াস কথা আলোচনা ক’রতে প্রস্তুত হয়। ও অবিনাশ বাবু’কে সত্যি সত্যি জানায়--- দেখুন স্যার, আমার পরিচয় এবারে
সম্পূর্ণ আপনাকে দেবার প্রয়োজন হ’চ্ছে। আমার
বাবা-মা কেউ নেই। তারা আমাদের দুই ভাইবোনকে রেখে একটা এ্যাক্সিডেন্টে চ’লে গেছেন। আমিই আমার বোন’কে কোলেপিঠে ক’রে মানুষ ক’রেছি। আসলে আমার বোন আর আপনার মেয়ে এক সাথেই পড়ে। একই ইয়ার।
একই সাবজেক্ট। আমাকে আপনার এ্যাডভোকেট ক’রে থানা’র সেকেন্ড অফিসার
পাঠান নি। আমার বোন তোড়া আমায় এঙ্গেজ ক’রেছে তার দিদি’র বাবা’কে বাঁচাতে। আপনার মেয়ে’কে আমার বোন দিদি ব’লেই ডাকে। আপনার
মেয়ে বনলতা সেই রাতেই আমার বোন’কে ফোনে কন্ট্যাক্ট
করে। কিন্তু বিষয়টা আমরা ইচ্ছে ক’রেই গোপন রেখেছি,
এবং আজও গোপন রাখতে চাই, যাতে আপনার মেয়ে আমার বোনের কাছে নিজেকে ঋণী মনে না করে।
এতে ওদের বন্ধুত্বে যে একটা পবিত্রতা আছে, সেটা বিঘ্নিত হবে, স্যার। বেঁচে থাকবে
দয়ালু আর দয়াপ্রার্থী দুই ক্লাশমেট। উপকার স্যার, এমন একটা বিষয়, যেটা উপকৃত’কে অসম্মানের চূড়ান্ত করে। কৃতজ্ঞতা প্লাস পরিশোধ--- সবটাই উপকারী
চরিত্র দাবী করে বা প্রত্যাশা করে। না পেলে উপকৃতের বদনাম ক’রতেও ছাড়ে না। ডোন্ট মাইন্ড স্যার, আমি এটা মনে প্রাণে
অপছন্দ ক’রি।
অবিনাশ বাবু বিস্মিত হন এই পরিবারটিকে দেখে। দুটি ছোট ছোট
ছেলেমেয়ে। অথচ তাদের বিচার কত উঁচু। তিনি ব’লেই ফ্যালেন--- বাঃ বাঃ! আমি অবাক হ’চ্ছি তোমার কথা শুনে। কোথায় শিখেছো এইসব আদর্শ!
--- আমার বাবা, আমার মা, স্যার। তাঁরাই আমার দীক্ষাগুরু।
--- তাই বলো। আমি তাই ভাবি, বিরাট মাপের কোনো মানুষ নিশ্চয়ই
তোমাদের দুই ভাইবোন’কে ডানা’র আড়ালে রেখে দিয়েছেন। বড়ো ভালো লাগলো তোমার মাধ্যমে আজ
তোমার বাবা-মা’কে চিনতে পেরে।
আলাপ হ’লে আরো ভালো লাগতো। কিন্তু সে সুযোগ তো
নেই। জানো দীপ্ত, আজকে সব কেমন যেন গল্পের মত ঘ’টে যাচ্ছে। এবার তিনি পরিবেশ হাল্কা করার জন্যে বলেন--- তাহ’লে তো একটা প্রবাদের বদনাম ঘুচলো না। কিন্তু আর একটা তো পার
পেয়েই গেলো।
শুধু এই কথাকটাই তিনি বলেননি। মনে মনে স্থির ক’রে ফেলেন যে, এই ছেলে’র সাথেই তিনি বনলতা’র বিয়ে দেবেন।
দেবেনই। দুর্লভ ছেলে এই দীপ্ত। আজকের দিনে এমন একটি ছেলে পাওয়া তো অমাবস্যা’য় চাঁদ দেখতে পাওয়া। দেখতে-শুনতে, শিক্ষা-আদর্শে,
চিন্তায়-ভাবনায়--- কোনোটাতেই তো ছেলেটির তুল্য কোনো পাত্র তাঁর চোখে নেই। তাই মুখে
বলেন--- তাহ’লে?
দীপ্ত জানায়--- আমার বাবা-মা যদিও নেই, আমার তথাকথিত
অভিভাবক তো আছেন। আমার কাকা, জ্যাঠা, পিসি। বিয়ের ব্যাপারে তাঁরা কথা ব’ললেই ভালো হয়। তাছাড়া আপনাদেরও আত্মীয়-পরিজন আছেন। তাঁরাও এ
পক্ষের অভিভাবকদের দেখতে চাইবেন। নিমুরে-নিছুরে পাত্র কে-ই বা চায়!
অবিনাশ বাবু বলেন--- তা তো নিশ্চয়ই। তাহ’লে তুমি তাঁদের কবে পাঠাবে?
--- আপনি যদি রাজী থাকেন, তবে একটা দিন ধরা যাক। ধরুন,
আগামী রবিবার। এই কথায় অবিনাশ বাবু সম্মতি জানাতেই দীপ্ত বলে--- তবে আগে আপনার
মেয়ে’র অভিমত জেনে নেবেন। তিনি কী চান? যেন
কোন সীন ক্রিয়েট না হয়। অন্তত আমি বা আপনি কেউই কিন্তু জানি না, তিনি কেন বিয়েতে
মত দিচ্ছেন না।
--- ওটা নিয়ে তুমি ভেবো না, বাবা। অনেক পুরুষ মানুষেরই
বিয়েতে একটা ভীতি থাকে। ফলে একটা মেয়ে’র তো তা থাকতেই পারে। বিশেষ ক’রে আজকাল যে সব
কাণ্ড-বান্ড ঘ’টছে। তবে বাবা,
আমাকে একটু সাহায্য করো তুমি। আমাকে বলো, তোমার অভিভাকদের সাথে আমি কিরকম ব্যবহার
ক’রবো? মানে আমি ব’লতে চাইছি, তাঁদের বৈবাহিক দাবী-দাওয়া যদি থাকে, তবে আমি
সম্মত হবো তো? আমি তো বনলতা’কে আমার সর্বস্ব
দিতেই পারি।
দীপ্ত বেশ বুদ্ধি ক’রে বিষয়টা এড়িয়ে যায়। ও জানিয়ে দ্যায়--- এসব তো আপনাদের ব্যাপার। আমার এই
ব্যাপারে থাকা কি ভালো হবে?
--- বেশ বাবা, বেশ। তোমার অভিমত জানা হ’য়ে গেলো। আর কোনো সমস্যা নেই। তাহ’লে ঐ কথাই র’ইলো। আগামী
রবিবার। বিকেলে তো?
--- বেশ। বিকেলেই হবে। কিন্তু মনে মনে দীপ্ত যে কথাটা ব’ললো, সেটা আর অবিনাশ বাবু জানতেও পারলেন না। ও ব’ললো, ‘সমস্যা আছে, মিঃ
সেন। ঘোর সমস্যা আছে। আর সেটা আপনাদেরকেই ফেস ক’রতে হবে। আমি সাজিয়ে দেবো না। আমার ডিউটি আমি ক’রেছি। হবু শ্বশুরমশাইকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়ে এনেছি। ব্যাস্। আমার কথাটি
ফুরলো, ন’টে গাছটি মুড়লো।
--------------------------------
এইসব বিহঙ্গেরা
পরিচ্ছেদ-১৪
আজ বাড়িতে সকাল থেকে একটা সাজো সাজো রব প’ড়ে গেছে। ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক লাগছে বনলতা’র। মা আগেরদিন ঘরের পর্দাগুলো কাচিয়েছে, আজ বাড়িতে বিছানায়
নতুন চাদর পেতেছে, চেয়ার-টেবিলগুলোতে ঘরে রেখে দেওয়া কভার পরানো হ’য়েছে, ঘরের সামনেটাকে ঝাড়ু দিয়ে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা
হ’য়েছে। ব্যাপারটা কী, কিছুতেই বুঝতে পারছে
না বনলতা। একবার ভেবেছে, মা’কে জিজ্ঞাসা ক’রবে। কিন্তু মনে মনে আবার নিজেকে নিরস্ত ক’রেছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটে সাধারণত কোন এক্সক্লুসিভ গেস্ট এলে।
কিন্তু এক্সক্লুসিভ-টি কে? মা ওকে কেননিজে ব’লছে না? মা টুকটুক কাজ ক’রছে আর আড়চোখে
মেয়েকে দেখেও নিচ্ছে। কোনো কোন কাজে ওকে ডেকেও নিচ্ছে। আজ রবিবার। বাবা বাজারে
গিয়েছিলেন। বনলতা দেখেছে, বাবা কী সব যেন মিষ্টি-টিশ্টি কিনেও এনেছেন আজ। কিন্তু
তাঁরা ব্যাপারটা ব’লছেন না কেন?
ক্রমশ পরিষ্কার হ’চ্ছে, বাড়িতে মেয়ে দেখানোর একটা তোরজোড় চ’লছে। মেয়ে দেখানোর সময়ে এমন একটা প্রস্তুতি নেওয়া হ’য়ে থাকে। এর আগেও দু-একবার এমনটা এ বাড়িতে ঘটেছে। ব্যাপারটা
চেনা বনলতা’র। সে তো ওর বিএ পার্ট-টু পরীক্ষার পর
পর। দু-বারই বনলতা ক্যান্সেল ক’রেছে সেই সম্বন্ধ।
আজ একবার মনে হ’লো, এইবেলা বাড়ি
থেকে বেরিয়ে তোড়াদের বাড়িতে চ’লে যাবে। সেখানে
সারাদিন কাটিয়ে আসবে সন্ধেবেলা। সেখানে তোড়া’র দাদা’র সাথেও দেখা হ’য়ে যেতে পারে। তাঁকে তো একটা ধন্যবাদ জানাতে হবে তাঁর নোট্সগুলো
এভাবে দেবা’র জন্যে। বাবা-মা যখন খুলে-মেলে ব’লছেই না কোন কথা। পরক্ষণে মনে হ’য়েছে, বাবা-মা’কে একটা ফিক্টিশাস ব্যাপার নিয়ে ও বড্ড জ্বালাচ্ছে। যেটা হবার নয়, সেটা নিয়ে
ব’সে থেকে শুধু শুধু বাবা-মা’র প্রায় বৃদ্ধ বয়সে একটা অতিরিক্ত চিন্তার ব্যাপার হ’য়ে উঠেছে। এই বিশাল পৃথিবীতে প্রার্থিত কোন কিছু খুঁজে
পাওয়া যে একেবারে অসম্ভব না হ’লেও একটা বিশাল
প্রশ্ন--- সে বিষয়ে মানুষের কোন সন্দেহ নেই। সন্দেহ নেই বনলতা’রও। অথচ তার জন্যেই আজ পর্যন্ত ওর বাবা-মা একটা সংশয়ের
মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। মা’র শরীর ভালো নয়।
বাবা’র, বিশেষ ক’রে মা’র ভয়, যে কোন সময়ে
তিনি চোখ বুজবেন। অথচ মেয়েকে পাত্রস্থ না দেখে একটা অতৃপ্তি নিয়ে চ’লে যাবেন ব’লে তার মনে একটা
আশঙ্কা তৈরী হ’য়েছে।
মাঝে মাঝে বনলতা’র মনে হয়েছে, ওর তো একটা দায়িত্ব আছে বাবা-মা’কে শান্তি দেবার। ওর জীবনে যা-ই ঘটুক না কেন, অন্তত তাঁরা তো একটা নিশ্চিন্ত
মন নিয়ে বাকী জীবনটা কাটাতে পারবেন। তাদের মেয়েটা অবশেষে আজকে এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন
ক’রছে না--- মানে ও বোধহয় এবারে মেনে
নিয়েছে। মেনে প্রায় নিয়েছে বনলতা। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হ’য়েছে, একজনকে প্রতারনা ক’রবার কোন মানে হয় না। তাছাড়া ও যদি বিয়ে ক’রে ড্যাং ড্যাং চ’লেই যায়, তবে বাবা-মা’কে দেখবে কে? বাবা’র তো অফিস থেকে ছুটি, মানে অবসর পাবা’র এখনও কিছু দেরী আছে। তাহলে বাড়িতে তো মা একা। এটা ভাবতে গিয়ে বনলতা আরো
পিছিয়ে আসে বিয়ে থেকে।
একটা বিষয় সেদিন উপন্যাসে প’ড়েছে বনলতা। সেটাকে বলা হয় ‘যৌন ঋণ’। বনলতা আজ বিয়ে ক’রলে তো সেটাও একটা যৌন ঋণের মতো ঘ’টবে। একটা নির্দোষ মানুষকে কেন এমন অজ্ঞাত অপমান দেবে! মনের মধ্যে যে মানুষটা
বাসা বেঁধে আছে, যার ধোঁয়াটে মুখ ওকে সর্বদা ওকে পীড়িত করে, যার সান্নিধ্য ওর মনে
একটু শান্তি দেবে ব’লে মনে হয়--- তাকে
পাশে সরিয়ে রেখে অন্য একটা মানুষের সাথে সঙ্গ করাই তো ‘যৌন ঋণ’। কেন এমন হ’লো? কেন এমন হয়!
কেন এ্যাতটুকু মানসিক স্বাধীনতা পাবে না ও! ওর মতো রোজ ম’রছে কোন মেয়ে? কেন ওর এই অবিরল যন্ত্রণা, ক্ষতস্থান থেকে
অবিরল রক্ত ক্ষরণ? এই সবই ভাবছিল বনলতা।
আজ ও মনে মনে ঠিকই ক’রে রেখেছে, বাবা-মা যদি কোন পাত্র সত্যি পেয়েই থাকে, তবে আর বাধা দেবে না। যা
থাকে কপালে। আর একটা অবাস্তব ভাবনা নিয়ে এই অসহায় মানুষ দুটোকে আর ভোগাবে না। তাই
বনলতা মা’কে আর কিছু জিজ্ঞাসাও ক’রছে না। ও বুঝতে পারে, বাবা-মা একটা আশঙ্কার মধ্যে আছে।
হয়তো মেয়ে আবার এই আয়োজনে বাধা দেবে। তাই হয়তো আগে থেকে কিছু ব’লছে না। বাবা-মা’র মনেও তো একটা সাধ থাকে। তাঁদের তো আর দ্বিতীয় কেউ আর নেই। তাঁদের যা কিছু
ভাবনা-চিন্তা, তা তো শুধু এই এক মেয়েকে কেন্দ্র ক’রে। বনলতা দেখেছে, মা আগে থেকেই বনলতা’র জন্যে ওর বাবা’কে দিয়ে এটা সেটা
গয়না গ’ড়িয়ে রেখেছে। সেও আজ অনেকদিন। বনলতা মা হ’লে ও-ও এমনটাই ক’রবে। বাবা-মা তো সন্তানদেরকে নিজেদের ভালো বা মন্দ সংস্কার এইভাবেই দিয়ে যায়।
আজ সন্তানের যে দায়বদ্ধতা, তা পালন ক’রবে বনলতা। এই কথাই মনে মনে স্থির ক’রে নেয়।
মা ওর জন্যে রিঠা এনে তা গরম জলে দিয়ে রেখেছে। ব’লেছে--- লতু, মাথায় আজ একটু রিঠা দিস। তোর চুলটা বড্ড রাফ হ’য়ে গেছে।
--- কেন মা, শ্যাম্পু র’য়েছে? কন্ডিশনার রয়েছে? আবার রিঠা কেন? বনলতা মা’র সাথে একটা লুকোচুরি খেলতে চায়।
মিনতি দেবীও লুকোচুরি খেলেন--- রিঠা চুল’কে সুন্দর করে। তোর ঐ পত্রিকাতেই তো প’ড়লাম। ঐ যে... কী যেন পত্রিকা নিস...?
বনলতা কিছু না ব’লে হাসে।
মা আবার বলে--- বা! এতে হাসির কী হ’লো! তুই নিস ব’লে আমিও না হয় একটু আধটু প’ড়লাম বইটা। আমার
জন্যে তো পড়ি না। তোর জন্যে পড়ি।
বাবা বাজার থেকে এসে ব’ললেন--- লতু, তোর হাতের এক কাপ চা খাওয়াতো। মা সুস্থ হ’য়ে গেছে ব’লে আজাকাল খুব
ফাঁকি দিস বাবা’কে। তোর হাতের
চা-টা আমি পছন্দ ক’রি, জানিস।
বনলতা একটু খোঁচা দেয় বাবা’কে--- তবুও তো আমাকে বিদেয় ক’রবার জন্যে তুমি
ব্যস্ত। তোমাদের ওসব আমার জানা আছে। কত ভালোবাসো আমাকে! মেয়ে বড়ো হ’লে তার থেকে প্রেম স’রে গিয়ে তোমাদের জামাইপ্রেম জেগে ওঠে। তাকে আনা’র জন্যেই তোমরা পাগল হও। আমরা তো বাড়ির বিড়াল। আমাদের বিদেয় ক’রবার জন্যে তোমাদের রাতে ঘুম হয় না।
মিনতি দেবী বাপ-মেয়ে’র মাঝখানে মাথা গলায়--- ব’লিস না লতু, ওরকম
ক’রে ব’লিস না। তোর বাবা কিন্তু ভ্যা ক’রে কেঁদে দেবে।
--- তুমি চুপ করো। তোমাদের আমি চিনি না! বনলতা পরোক্ষে
আজকের সত্যিটা প্রকাশ ক’রে দেয়।
--- না না, তোর বাবা’কে আমি যা খুশী ব’লি, ব’লি। মেয়ে কিছু ব’ললেই বাবা’র চোখ দিয়ে জল
গড়ায়। তুই চা দে তো। নয়তো সেটাও খাবে না। মিনতী দেবী সাবধান করেন মেয়েকে।
জল বনলতা’রও চোখ দিয়েও আসে।
বাবা-মা’কে ছেড়ে যেতে হবে, ভাবলেই ওর চোখ কোথা
দিয়ে যে এ্যাতো জল পায়, ও বোঝে না। অন্তরালে গিয়ে চাখ মুছে নেয় ও। মিনতি দেবী একটু
শান্তি পান। তিনি নিশ্চিত, মেয়ে সব বুঝতে পারছে।
তবু সে যে প্রতিবাদ ক’রছে না, এটাকে
ভাগ্য মানছেন তিনি। তাহ’লে এবার একটা
হিল্লে হবে। মেয়েটার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। আর কতো পড়াশুনো ক’রবে? চাকরী-বাকরী ক’রবে--- এমন তো কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
একমাত্র বাবা-মাই জানে, কন্যা সন্তান বড়ো হ’লে বাবা-মা’র মনের মধ্যে কী
হয়। তিনি শুনেছেন, বিদেশে নাকি বাবা-মা এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। তিনি মনে
করেন, ওরা মানুষই নয়। যেমন ওদের ভূতের মতো দেখতে, তেমন ওদের ভূতের মতো স্বভাব।
বাবা-মা দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়ে’র বিয়ে না দিলে কি
চলে! ছেলেমেয়ে কোথায় কী ক’রে ব’সবে! যদি প্রেম-ট্রেম করেও, বাবা-মা তার খোঁজ নেবে, আর বিয়ে
তারাই আয়োজন ক’রবে। এটাই তো একটা
পরিবারের ধারা। এর অন্যথা হ’লে কি হয় নাকি!
বাবা-মা তো বাবা-মা’ই থাকে। এ দেশ, আর
বিদেশ কী? বাবা-মা’র মন কি বদলে যায়
নাকি? এটাই বনলতা’র মায়ের অটুট
বিশ্বাস।
বনলতা বাবা কিম্বা মা’কে জিজ্ঞাসাও করেনি, কে আসবে, কখন আসবে, কোথা থেকে আসবে। যে যেখান থেকেই আসুক,
পাত্রকে দেখতে যেমনই হোক, রাজপুত্র কিম্বা হিরিম্ব--- বনলতা’র কাছে সবই এক। ওকে যদি প্রশ্ন করা যায়, তুমি কিভাবে ম’রতে চাও? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই ওর কাছে। মৃত্যু যখন
আসবে, তখন এলেই হয়। ফাঁসিই বা কী, আর গুলিই বা কী? কোন পাত্রকেই ওর মনে ধ’রবে না। ওর সেই মানুষটাই চাই। যে পাত্রই হোক, তার মাথা কেটে
ফেলে দিয়ে যদি সেই অহংকারী মানুষটার মাথা জুড়ে দেওয়া যায়, তবেই মন উঠবে ওর। বনলতা
ভাবেই নি যে, এ্যাতো বছর পরে সেই মুখ একই থাকে না। ওর নিজেরও নেই। আজ ও শুধু
বাবা-মা’কে খুশী করার জন্যে নিজেই বলি হবে না, আর
একটা ছেলেকেও বলি দেবে। তবে একটা কথা মনে মনে স্থির ক’রে ফেলেছে বনলতা। যদি সম্বন্ধটা ঘ’টেই যায়, তবে ছেলেটিকে সব জানিয়ে দেবে। গোপন কথা, কিন্তু ব’লতেই হবে। বিয়ের পর কোন এক ঘটনায় ‘আমি তো এসব জানি না’--- এসব ঘ’টতে দেবে না
বনলতা। যদি সে চায় বিয়ে ক’রতে, তবেই বিয়ে
হবে। তা নয়তো নয়।
তখন বিকেল পাঁচটা। দুটি রিকশা নিয়ে দুই ভদ্রলোক আর একটি
মহিলা আসেন বনলতাদের বাড়িতে। অবিনাশ বাবু তাঁদেরকে সাদর আমন্ত্রণ জানান। বেরিয়ে
আসেন বনলতা’র মা। সকলের মুখে যেন একটা প্রশান্তি’র হাসি। পরিচয় হয় অবিনাশ বাবু’র সাথে। ওরা একজন দীপ্ত’র কাকা এবং অপরজন দীপ্ত’র কাকিমা। ওরা
এসেছেন, কোন্নগর থেকে। আর তৃতীয়জন দীপ্ত’র জ্যাঠা। তিনি এসেছেন রানাঘাট থেকে। ওরা আসন গ্রহণ ক’রতেই নানা বিষয় নিয়ে অযথা আলোচনা হ’তে শুরু হয়। আজকের অত্যধিক গরম, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য
রাজনীতি, সমাগত নির্বাচন, তার সম্ভাব্য ফলাফল, বর্তমান সরকারের অকর্মণ্যতা ইত্যাদি
নানা প্রচলিত অথচ অস্বস্তিকর বিষয় নিয়ে নানা মত চালাচালি হ’লো। মিনতি দেবী ইত্যবসরে ভেতরে যান। অতিথিদের চা-জলখাবার
প্রস্তুত করেন, আর মনে মনে ভাবতে থাকেন, মেয়েকে কী ব’লে সামনে আনবেন। অবশেষে সেই সমস্যাও কাটিয়ে ওঠেন তিনি।
মেয়েকে কিছু না ব’লতেই মেয়ে কেমন
যেন বুঝে যায়, তার কী করা কর্তব্য। যে লৌকিকতাগুলো না ক’রলেই নয়, তার প্রথম পদক্ষেপটি মিনতি দেবী সাফল্যের সাথেই
অতিক্রম করেন। বনলতা নিজে চা নিয়ে অতিথিদেরকে দেবার জন্যে বৈঠকখানায় আসে।
অতিথিরা তটস্থ হন। চা-এর থেকে অনেক বেশী নজর দেন
পরিবেশনকারিণী’র দিকে। বনলতা চ’লেই যাচ্ছিলো। কিন্তু জ্যাঠা নামক ব্যক্তিটি ওকে ধ’রে বসান তাঁরই নিকটে, একটি শান্তিনিকেতনী মোড়া’তে। বনলতা’র পড়াশুনো, তার
শখ-সাচ্ছ্বন্দ, অতিরিক্ত যোগ্যতা, শিক্ষা জীবনের অতীত ফলাফল, সাংসারিক নানা কাজের
ফিরিস্তি, রন্ধনে ওর সক্ষমতা অক্ষমতা ইত্যাদি আরো নানা বাক্যালাপে জড়িয়ে যান বনলতা’র সাথে। মা মিনতি দেবী প্রমাদ গ’ণতে থাকেন, যেন কোনো অপ্রত্যাশিত বাক্য বিনিময় না ঘটে।
মেয়েকে তিনি চেনেন। যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘ’টতে পারে। কিন্তু সমস্ত বিপদ কাটিয়ে উঠে পাত্রী পছন্দের সিদ্ধান্তটি
পাত্রপক্ষের বয়ঃপ্রাপ্তরা জানিয়ে দেন। বনলতা কাঠ হয়ে ব’সে থাকে। ওরা প্রশংসাই করেন বনলতা’র রূপের।
বনলতা জানে এবং মানে, ও কুৎসিত না হ’লেও সুন্দরী নয়। এ প্রশস্তি বাতুলতা মাত্র। এ সমস্ত ওর কাছে
বড়ই অপ্রীতিকর ও অস্বস্তিকর বটে। কিন্তু আজ ও কোনটারই প্রতিবাদ করে না। নিজেকে
আপ্রাণ সংযত ক’রে রাখে। চুপ ক’রে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। মনে মনে ঠিক ক’রে ব’সেছিলো যে, আজ
হাড়িকাঠে গলা দিয়ে শান্ত নিরীহ ছাগবৎসের মতো আত্মনিবেদন ক’রবে এই বাড়ির দুই অসহায় প্রায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা’র জন্যে। কোনো প্রশ্ন নয়, কোন বিতর্ক নয়, কোন বিপত্তি নয়।
কিন্তু নিয়তি কেন বাধ্যতে। ছন্দপতন ঘটান পাত্রের জ্যাঠামশাই নামক সেই ব্যক্তি।
তিনি ব’লে বসেন--- মিঃ
সেন, আমাদের পাত্রী পছন্দ। এখানে কোনো দ্বিতীয় কথা’র ব্যাপার নেই। আর দেনা-পাওনা নিয়ে তো কিছু বলা’র নেই, কেননা সে সব তো এখন আইনত দণ্ডনীয়। তবে বিবাহ ব’লে কথা। তার তো একটা সাধারণ রীতি থাকে, তা না বুঝবে আইনজ্ঞ,
না বুঝবে আইনজীবী। এটা সামাজিক ব্যাপার। সেই রীতি তো আপনাকে আমাদের স্মরণ ক’রিয়ে দিতে হবে না নিশ্চয়ই। এ সব আপনি বোঝেন। সকলেই বোঝে।
কথাগুলাও বনলতা’র গা-টা জ্বালিয়ে দেয়। ভরা সভায় এমন ও সহ্য ক’রতে পারে না। এ সব যে দানসামগ্রী দেবার জন্যে কন্যার পিতাকে পরোক্ষ নির্দেশ,
তা বোঝা’র বয়স বা বুদ্ধি বনলতা’র হ’য়েছে। কিন্তু ও আজ
নীরব। সব স’য়ে নেবে। নেবে এই দুটি অসহায় প্রাণীর
স্বার্থে। মেনে নেবে সব। মুখ বুজে একটা অশিক্ষিত মেয়ের মতো সব সইবে। মনে ওর একটাই
প্রশ্ন, বাবা খুশী হবে তো?
অবিনাশ বাবু হেসে বলেন--- এ সব নিয়ে আপনারা উদ্বিগ্ন হবেন
না। আমার পাত্র পছন্দ হয়েছে। খুব পছন্দ হ’য়েছে। ওর জন্যে আমি সব ক’রতে পারি। তাছাড়া
লতু তো আমার একমাত্র সন্তান। আমার বাড়িতে তো এই একটাই কাজ। তাতে অর্থের সাথে কোনো
আপোষ আমি ক’রবো না। আপনাদের বা আমার উভয়েরই সম্মান
অক্ষুণ্ণ থাকবে।
হাসাহাসি হয়, মিষ্টি খাওয়া-খাওয়ি হয়, এবং এরপর আসে বিবাহের
তারিখ নির্দিষ্ট করার প্রসঙ্গ। অবিনাশ বাবু বনলতা’র এমএ পরীক্ষা সমাপ্ত হবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু ঘোর আপত্তি জানান
পাত্রপক্ষ। যেন পাত্রীপক্ষের কোনো প্রস্তাব মানা’র কোন কারণই নেই। সকলের হ’য়ে কাকিমা ব’লে ওঠেন,
--- এমএ! কেন? এমএ দিয়ে কী হবে? দীপু তো ওর বউ’কে চাকরী ক’রতে দেবে না।
কাকা তাঁর স্ত্রী’কে সমর্থন ক’রে বলেন--- হ্যাঁ
হ্যাঁ। শুভস্য শীঘ্রম। বাড়ির বউ’কে অফিসে পাঠিয়ে
আমরা বাড়িতে ব’সে ফুর্তি করার
মতো পরিবার নই, মিঃ সেন।
--- না, আসলে ওর তো একটা মনোবাসনা আছে। মাস্টার্সটা ওর
স্বপ্ন। ও নিজে তো চাকরী ক’রতে চাইতেও পারে।
সেটা আমরা আর আগে থাকতে কী ক’রে ব’লি!
জ্যাঠা ঘোর আপত্তি জানান--- না না। আমাদের পরিবারে বৌয়েরা
কখনও চাকরী-বাকরী করেনি।
অবিনাশ বাবু পড়েন মহা মুশকিলে। কোন পক্ষ তিনি এখন নেবেন, এই
সঙ্কটে প’ড়ে যান। কোনটা করা তাঁর উচিত হবে, তিনি
বুঝতে পারেন না। এসব ব্যাপারে তাঁর একেবারেই অভিজ্ঞতা নেই। বৈবাহিক কথাবার্তা একটি
গভীর অভিজ্ঞতার প্রশ্ন। তা তো তাঁর নেই। তিনি একবার টেড়িয়ে মেয়েকে দ্যাখেন। একটু
আম্তা আম্তা ক’রে বলেন,
--- কৈ, দীপ্ত তো আমায় এমন কিছু বলেনি।
দীপ্ত নামটা কেমন যেন শোনা শোনা লাগছিলো বনলতা’র কানে। একবার স্মৃতিটা তলিয়ে দেখতে চাইছিল ও। কিন্তু পর
মুহূর্তেই কানে এলো পরবর্তী সংলাপ। স্মৃতিটা ছিঁড়ে গেলো।
--- দীপ্ত আপনাদেরকে আদৌ কিছু ব’লেছে কি? আমাদের ছেলে তেমন নয় যে, কাকা-জ্যাঠা’র কথা’র বিরুদ্ধে কোনো
কথা ব’লবে। আমাদের কথাই ফাইনাল।
জ্যাঠা’র কথাটা কেমন যেন
একটা বক্রোক্তি ব’লে মনে হয় বনলতা’র। মনে মনে ও বলে, ‘সত্যি তো লোকটা বড়োই জ্যাঠা! আজই এমন ক’রছে, পরে কী ক’রবে, তার তো ঠিক
নেই। এবার উঠে দাঁড়ায় ও। চ’লে যেতে চায়।
জ্যাঠা আবার জ্যাঠামি করেন,
--- তুমি কি চ’লে যাচ্ছো, মা?
বনলতা জীবনে এই প্রথম কারোর দিকে অগ্নিদৃষ্টি দেয়। ও ব’লেই দেয়--- হ্যাঁ, চ’লে যাচ্ছি। এখানে ব’সে থাকলে আমার
অপমান হ’চ্ছে।
অবিনাশ বাবু বোঝেন, তাঁর মেয়ে বেঁকে যাবে এবারে এবং তাকে এই
বেঁকা থেকে আর সোজা করা যাবে না। কিন্তু তাঁর আর কথা ব’লবার সাহস হয় না। তিনি বুঝতে পারছিলেন, আজকালকার একটি মেয়ে
এসব কথা সহ্য ক’রতে না-ই পারে। সে
চাকরী করুক, না করুক, কেউ তার ডানা ছেঁটে দেবে, এটা নাও মানতে পারে। তিনি মনে মনে
ঠিক ক’রেই রাখেন, দীপ্ত’র সাথে দেখা ক’রলেই সব মিটে যাবে। অবিনাশ বাবু ভুল করেননি, এটা তার মনের গভীর বিশ্বাস। দীপ্ত
এমনটা ভাবতেই পারে না।
কাকা নামক মানুষটি অবিনাশ বাবু’কে প্রশ্ন ক’রে বসেন--- তাহলে
তো আপনার মেয়ে এই সম্বন্ধটা ভেঙ্গেই দিতে চাইছে ব’লে মনে হ’চ্ছে।
গমনোদ্যত বনলতা ব’লতে চাইছিলো, ‘ভেঙ্গে নয়, গ’ড়ে উঠতেই দিতে চাইছে না’। কিন্তু না, যথেষ্ট ব’লেছে ও। আর নয়।
তাই দরজা’র পর্দা সরিয়ে ও ভেতরে ঢুকে যায়। অবিনাশ
বাবু সবিনয়ে পাত্রপক্ষকে অবশেষে জানালেন--- আমি একটু বাড়িতে আলোচনা ক’রি। আমি আপনাদেরকে জানাবো। আজকের ছেলেমেয়ে তো। ওদের একটা
স্বতন্ত্র মানসিকতা গ’ড়ে উঠেছে। ওরা
আমাদের মতো ক’রে সবটা ভাবে না।
আজকে আপনারা আসুন। আমি জানাবো।
মানে মানে এবার অতিথিরা ওঠেন। তাঁরা বুঝে নেন, কথা বাড়িয়ে
কোন লাভ নেই। পাত্রী বাড়ির মিষ্টি তখনও তাঁদের পেটে গুজ গুজ গুড় গুড় ক’রছিলো। তাঁরা বিদায় নিতে গেলে অবিনাশ বাবু আরো বলেন---
আমাকে ক্ষমা ক’রবেন। এখনই কোন
ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি কথা ব’লবো। নমস্কার!
অতিথিরা তাকে ক্ষমা করেন কিনা, তাঁর আর জানা হয়নি। নীরবে
তাঁরা একে একে বাড়ি থেকে চ’লে যান। কিন্তু
অবিনাশ বাবু মেয়ের দিকে একেবারে তাকাতে পারেন না। তাঁর মনে হয়, তাঁর অভিমানিনী
মেয়ে যেন অপমানে, ক্ষোভে আর লজ্জায় জ্বলছে। তাই তিনি নীরবে নিজের ঘরে ঢুকে
স্ত্রীকে সবটা খুলে বলেন। মিনতি দেবী অবিনাশ বাবু’কে অবাক ক’রে দিয়ে মেয়ে’র মতে মত দিয়ে বলেন,
--- মেয়ে আমাদের। তাই ব’লে তো সে ফ্যালনা নয়। তার তো একটা মতামত আছে, নাকি? বিয়ে ব’লে কি তাকে জলে ফেলে দিতে হবে! তার তো একটা সম্মান আছে।
অবিনাশ বাবু মাথা নিচু ক’রে ব’সে ভাবতে থাকেন, এরপর কিভাবে তিনি
এগোবেন। এই সমীকরণটা তাঁর কাছে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিলো। মিলছিলো না মোটে। ঠিক এই
সময় মেয়ে এসে নীরবে ঢোকে বাবা-মা’র ঘরে। বাবা’কে মাথা নিচু ক’রে ব’সে থাকতে দেখে বলে,
--- বাবা, তোমায় মাথা নিচু ক’রে ব’সে থাকতে হবে না। তুমি কোনো অন্যায়
করোনি। না ওদের কাছে, না আমার কাছে। কারোর কাছে নয়। তুমি একটা চেষ্টা করেছো আর
পাঁচজন বাবা’র মতোই। এতে তো
কোনও পাপ নেই। অপরাধ নেই।
মেয়ে’র এমন সোজা-সাপ্টা
কথা আজ তিনি বিগত আটাশ বছরে শোনেননি।। তিনি হাঁ ক’রে তাকিয়ে থাকেন মেয়ে’র দিকে। শেষে
বলেন--- দীপ্ত এমন ছেলে নয় রে। বিশ্বাস কর, মা। আমি ভুল ক’রিনি। আমি চিনতে একটুও ভুল ক’রিনি। সে-ই তোর বাবা’কে বাঁচিয়েছে
পুলিশের হাত থেকে। এই সে-ই উকিল। আমার কাছ থেকে একটি পয়সা নেয় নি। ও আলাদা। এরা
সবাই কেমন যেন!
বনলতা বলে---
তোমাকে সহজ সরল পেয়ে ভুল বুঝিয়েছে। সে ভালো হ’লে তার পাঠানো কাকা-জ্যাঠা এমন মন্দ হয় কী ক’রে? আছে কোনো যুক্তি? বলো।
যুক্তি তো অবিনাশ বাবু নিজেই খুঁজছেন। পাচ্ছেন তো না। কোথা
থেকে কী সব ঘ’টে গেলো! এর মধ্যে
কোথাও একটা গরমিল আছে ব’লে তাঁর মনে হয়।
কিন্তু বনলতা বাবা’কে এবারে আক্রমণ ক’রলো,
--- বাবা, ছেলেটি থাকে কোথায়? ঐ যে রানাঘাট, না কি কোন্নগর
ব’ললো--- সেখানে?
ব’লতে না চাইলেও
কেমন যেন মেয়ে’র এই প্রথম
আক্রমণে বেচারা বাবা মুখ ফস্কে ব’লে ফেললেন--- না,
ছেলেটি তো লোকাল। থাকে ঐ অফিস পাড়ায়।
তখন তিনি না-মেলা সমীকরণের মধ্যে হাতরে বেড়াচ্ছেন। বনলতা
বাবা’র কাছে অফিস পাড়া’র নাম শুনে মনে মনে বলে, ‘তাহলে তো লোকটা তোড়াদের পাড়াতে থাকে। এবারে লোকটা ম’রেছে। সোজা তোড়া’কে নিয়েই যাবে আজ। তোড়া বেশ কড়া কড়া কথা ব’লতে জানে। ছেলেটাকে বুঝিয়ে দেবে, কত ধানে কত চাল। আজই হাতে গরম ব্যবস্থা হ’য়ে যাবে। তাই বাবা’কে আর একবার জিজ্ঞাসা করে,
--- ছেলেটির ভালো নামটা বলো তো।
মিনতি দেবী অবাক হন, মেয়ে হঠাৎ ছেলেটির নাম জানতে চাইছে
কেন। তিনি মেয়েকে জিজ্ঞাসাও করেন--- তুই নাম-ধাম দিয়ে কী ক’রবি? তুই কি যাবি ওখানে?
--- বাঃ! যাবো না! বাবা সম্বন্ধ ক’রলো, আর বাবা’র উকিল লোক পাঠিয়ে বাবা’কে এভাবে ইন্সাল্ট
ক’রলো। তাকে একটু চিনে আসি।
মায়ের স্নেহ আতঙ্কিত হয়। তিনি বাধা দেন--- না না, তোকে কোথাও
যেতে হবে না। বিয়ের ব্যাপারে এসব হয়, মা। আরো কত কী হয়! তাছাড়া তুই তো বিদেয় ক’রে দিয়েইছিস।
হঠাৎ কেমন ক’রে যেন অবিনাশ
বাবু’র কোন একটা উত্তর না-মেলা অঙ্ক মিলে যায়।
তিনি ব’লে ওঠেন--- যাক না। ও একবার দেখেই আসুক
না। ওর সংশয় তো ঘুচবে। তোমার মেয়ে তো বড়ো হ’য়েছে, নাকি? ওর ওপর তোমার ভরসা নেই? দুটো স্টপেজ পার হ’লেই তো অফিস পাড়া। অফিস পাড়া তো ওর ইউনিভার্সিটি’র কাছেই।
বনলতা’র মা বাবাকে ধমক
দেন--- তুমি কেন বুঝতে পারছো না! এখন দিনকাল ভালো না। কোথায় কী ঘ’টে যাবে--- কিছু ঠিক আছে? তাছাড়া ঐ মানুষগুলো তো এখন ওখানেই
আছেন। তুমি বাবা হ’য়ে কী ক’রে...
অবিনাশ বাবু স্ত্রী’কে ইঙ্গিত করেন। নিষেধ করেন কোন কথা ব’লতে। তারপর বনলতা’কে বলেন---
ছেলেটির নাম দীপ্তিময় রায়।
নামটা দু-একবার আওড়ে নিয়ে বনলতা বেরিয়ে যায়। তখনও সন্ধে
হয়নি। তোড়া’কে ফোন ক’রলো একবার। কিন্তু ফোনটা এজগেজড্ পেলো। মনে মনে ঠিক ক’রলো, ফোন দরকার নেই। আজকে তো ওর কোনো পড়া-টরা নেই। বাড়িতেই
আছে। যাবে আর কোথায়! সোজা দেখা ক’রবে ওর সাথে।
তারপর ওকে নিয়ে কে এই দীপ্তিময় রায়, তার বাড়ি যাবে। ও নিশ্চয়ই চিনবে। তোড়া’কে তো চেনে না, এমন কেউ নেই। মা’কে আশ্বস্ত ক’রে বেরিয়েছে ও। জানিয়ে গেছে যে, ও পাড়ায় ওর ক্লাসমেট থাকে। অবিনাশ বাবু আবার
স্ত্রী’কে ঈশারা ক’রেছেন চুপ ক’রে থাকতে। মেয়ে
বেরিয়ে যেতে অবিনাশ বাবু মিনতি দেবী’কে ব’ললেন,
--- তোমার কি মেয়ের ওপর বা আমার ওপর ভরসা নেই?
--- আছে। কেন থাকবে না! আমার মেয়ে এ্যাতো হিল্লি দিল্লি ক’রে বেড়াচ্ছে। তার তো কোনো বদনাম নেই কোনদিন। ভরসা না থাকবার
কী আছে! কিন্তু...
--- তোমার যেমন মেয়ে’র ওপর ভরসা আছে, তেমনি আমারও আমার হবু জামাইয়ের ওপর ভরসা আছে। তুমি শুধু দেখে
যাও।
--- কিন্তু ঐ কাকা-জ্যাঠা? ওরা তো ওখানে...
--- ওরা ব’লেছেন যে, ওরা
ফিরে যাবেন যে যার বাড়ি। টেলিফোনে যা কথা হবার হবে। বুড়ো মানুষ, অত দূর যেতে তো
রাতের ওপর ভরসা ক’রবে না। দূরে যেতে
হবে না?
মা মিনতি দেবী কোন এক অদৃশ্য শক্তি’কে উদ্দেশ ক’রে কপালে হাত জোড়
ক’রে একবার ঠেকালেন। মনে মনে ব’ললেন, ‘আমার মেয়ে’টার যেন কোন বিপদ আপদ না হয়। ওকে রক্ষে ক’রো।
-----------------------------
এইসব
বিহঙ্গেরা
পরিচ্ছেদ - ১৫
আজ রবিবার। দীপ্ত’র কোনো ক্লাশ নেই। রবিবার কোনো ক্লাশ ও নেয় না। এই একটা দিন বোনকে পড়ায়, ওর
হাতের রান্না খায়, ওর সাথেই ব’সে লুডো খ্যালে।
এইমাত্র নিজের ঘরে ব’সে ব’সে দীপ্ত একটা নিবন্ধ লিখছে। মাঝে মাঝে কোনো কোনো লিট্ল
ম্যাগ থেকে লেখা-টেখা চায়। গল্প-টল্প নয়, শুধু নিবন্ধ লেখে দীপ্ত। নানা বিতর্কিত
বিষয় নিয়ে আগুন জ্বলা নিবন্ধ। নিবন্ধটা ওর হাতে ভালোই আসে। হঠাৎ বেঙ্গলি টু
বেঙ্গলি ডিক্শনারিটা দরকার পড়ে ওর। এপাশ ওপাশ খুঁজতে খুঁজতে ঢুকে যায় বোনের ঘরে।
গিয়ে দ্যাখে, বোনের ঘরে কোথায় যেন ওর মোবাইলটা গোঁ গোঁ ক’রে বাজছে। মোবাইলটা ভাইব্রেশনে দেওয়া হয়তো। তাই এই শব্দ।
একটু খুঁজতেই দেখলো, বোনের ব্যাগের মধ্যে মোবাইলটা গোঁ গোঁ ক’রছে। ব্যাগটা কাঁপছে। কিন্তু তুতু গ্যালো কোথায়? একবার
ডাকলো,
--- তুতু!
বাথরুম থেকে তোড়া’র উত্তর এলো--- আমি বাথরুমে রে, দাদা।
মোবাইলটা দেখে নিয়ে অফ ক’রে দেয় দীপ্ত, আর ডিকশনারিটা সাথে ক’রে নিয়ে দীপ্ত নিজের ঘরে চ’লে আসে ও। মিনিট
পনেরো পরে এসে তোড়া হাজীর হয়।
--- দাদা, ডাকছিলি?
--- আমি না। অনেকক্ষণ থেকে সম্বিৎ ডাকছে তোকে।
দাদা’র মুখে এই একটা
নাম উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে ফ্যাকাশে হ’য়ে যায় তোড়া’র মুখ। দাদা’র কাছে ধরা প’ড়ে তোড়া’র মতো দামাল
ডানপিটে মেয়েও গুটিয়ে যায়। থতমত খেয়ে বলে,
--- সম্বিৎ! কে সম্বিৎ?
--- আর নাটক ক’রিস না। বোনকে কপট ধমক দিয়েই তারপর সুর পাল্টে বলে--- জানিস তুতু, তুই একটা আর
আমি দুজনে দুটো বড়ো বড়ো অন্যায় ক’রে চ’লেছিলাম রে। তোর অন্যায়টা চ’লছিলো অনেক দিন ধরে। আজ ধরা প’ড়লো। আর আমি আজ
একটা অন্যায় ক’রেছি। দীপ্ত লেখা
থেকে মাথা না তুলেই কথাগুলো বলে।
--- অন্যায়! আমি না হয় অন্যায় ক’রতে পারি। কিন্তু তুই আবার কী অন্যায় ক’রলি? তোড়া বুঝতে পারে না।
--- আগে আমার অন্যায়টা স্বীকার ক’রে নিই। আমি আজ তোর মোবাইলটা একটু আগে আনলক ক’রেছি। তুই বড়ো হ’য়েছিস। আমার উচিত নয়, তবু ক’রেছি। ওটা
অনেকক্ষণ থেকে ভাইব্রেট ক’রছিলো। আমি
ভাবলাম, কেউ বোধহয় তোকে কল ক’রতে চাইছে। কিন্তু
পাচ্ছে না। তাই...। কিন্তু মোবাইলটা আনলক ক’রতে দেখলাম, সাম সম্বিৎ তোকে গোটা পনেরো কল ক’রেছে। তুই তো বাথরুমে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম, আমার বোন বড়ো হ’য়ে গেছে। তাকে কেউ এমন ফোন ক’রতে পারে, যার কারণে মোবাইলটা ভাইব্রেটরে রাখতে হ’য়েছে।
তোড়া ব’লতে পারতো, ‘ক্লাশের জন্যে মোবাইল ভাইব্রেট ক’রে রাখতে হয়।’ কিন্তু যেহেতু সেটাই একমাত্র কারণ নয়, সেহেতু দাদা’কে আর নিরস্ত ক’রতে চেষ্টা ক’রলো না। চুপ ক’রে মাথা নিচু ক’রে দাঁড়িয়ে শুনলো দাদা’র অভিযোগ। এই একটা
মানুষের কথাই শোনে তোড়া।
দীপ্ত ব’ললো--- সরি! আমি
তোর গোপন ক’রে রাখা একটা চ্যাপ্টার ওপেন ক’রে ফেলেছি। আমার উচিত হয়নি। আর তুইও একটা অন্যায় ক’রে চ’লেছিস আমার সাথে।
আমি জানি না, কতদিন ধ’রে এটা ক’রছিস। আমি যদি ভুল না ভেবে থাকি, তবে তুই কোনো একটা ছেলেকে
ভালো-টালো বাসিস হয়তো। কিন্তু আমাকে ব’লছিস না। আমি জানি, এসব বিষয় অপরকে শেয়ার ক’রলে এর মজা থাকে না। কিন্তু জাজমেন্ট-এর জন্যেও তো বড়োদের হেল্প লাগে। এটাও
বোধহয় আমারই অপরাধ। আমি তোর মনে হয়তো এমন কোনো ভরসা এনে দিতে পারিনি যে, তুই আমাকে
শেয়ার ক’রবি।
এবার তোড়া ওর দাদা’কে জড়িয়ে ধ’রে কেঁদে ফ্যালে।
কাঁদতে কাঁদতে বলে--- না রে, দাদা। প্লীজ, বিশ্বাস কর। ওসব নয়। এটা ঘটনা চক্রে শুধু বনলতাদি জেনেছে। আর
কেউই জানে না। তুই সত্যি ক’রে বল দাদা,
বড়োদের এসব বলা যায়?
--- কেন বলা যাবে না! তুই কি অন্যায় ক’রছিস? আর যদি এটা অন্যায়ই, তবে এই বিষয়ে জড়াচ্ছিস কেন?
--- তুই একেবারে উকিলের মতো আমায় জেরা ক’রছিস। আমি কি এ্যাতো উত্তর দিতে পারি।
দীপ্ত অভিনয় করে--- তাহলে এই উত্তরটা দে। এই বনলতাদি-টা কে,
যে কিনা আমার আগে আমার বোনের এমন একটা চ্যাপ্টার জেনে গেলো?
এবারে দাদা’কে একটু সুপথে
আনতে পেরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে
তোড়া--- আমাদের ইউনিভার্সিটি’র বনলতাদি! ঐ যে...! আমার ক্লাসমেট। একজন সিনিয়ার। খুব
রিজার্ভ? আমার নোট্সগুলো দিলাম? ব’লেছিলাম না? নানা
ভাবে তোড়া দাদা’কে বখাতে চেষ্টা
করে বনলতা’র পরিচয়। কিন্তু পারে না। শেষে বলে---
তুই না দাদা, সব ভুলে যাস। আমি সম্বিতের কথা ব’ললেও তুই ভুলে যেতিস। তোর শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের নাম মনে থাকে। এবার মনে প’ড়েছে?
আজকে বোন’কে একটু ক্ষ্যাপাতে
ইচ্ছে হ’ল ওর। ওর সাথে খুনসুড়ি করাই হয় না।
একাধারে বাবা, একাধারে মা হ’য়ে বড়ো ক’রতে হ’য়েছে তোড়াকে। তাই
ঠাট্টা ক’রে ওকে আক্রমণ ক’রলো--- আচ্ছা, কে না কে বনলতা, না লবঙ্গলতা... তার গুরুত্ব
আমার থেকে বেশী! আমার বাড়ি’র খবর সে জেনে
গেলো, কিন্তু আমি অন্ধকারে!
তোড়া আবার নানা কায়দা ক’রলো দাদা’কে বোঝাতে, কিন্তু
আবার ব্যর্থ হ’য়ে অবশেষে হাল
ছেড়ে দিলো। দীপ্ত আবার ব’ললো,
--- যা, আগে ঘুরে আয়। আজকে রবিবার। দ্যাখ গে, সে হয়তো
পাড়ারই আশে-পাশে ঘুর ঘুর ক’রছে। তারপর ফিরে
এলে না হয় এটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
তোড়া জানালো--- না রে, দাদা। এ সে বান্দা নয়। পাড়া’র মোড়ে এ ছেলে লাইন লাগাবে না। ফোন ক’রে জানতে হবে, কেন কল ক’রছে। আছেটা কোথায়। বড়োলোক বাপের বড়োলোক ব্যাটা। এর আবার কায়দা আছে।
--- ও.কে! বেস্ট অফ লাক।
এবারে তোড়া দাদা’র গালে একটা বিপুল সশব্দ চুম্বন ক’রলো। মুখে ব’ললো--- তুই না
একেবারে উপন্যাসের ‘দাদা’দের মতো। আইডিয়াল দাদা।
--- আর পাকামি ক’রতে হবেনা। যাও। পার্স থেকে দুশোটা টাকা নিয়ে যাও।
--- লাগবে না রে দাদা। ব’ললাম না? বড়োলোক বাপের বড়োলোক ব্যাটা! ওর পার্সটা মোটাই থাকে।
--- তাই ব’লে আমার বোন পরের
মাথা ভেঙ্গে খাবে, এটা আমার অনারে লাগে। সে পাঁচটা টাকা খরচা ক’রলে তুমিও পাঁচটা ক’রবে। যাও।
দীপ্ত বোনের সাথে আজ বহুকাল কোন রসিকতা করেনি। ওদের বয়সের
ফারাকটা রসিকতা করার পক্ষে অনেক। তাছাড়া ‘এ টিচার ইজ অলওয়েজ এ টিচার’। কিন্তু ওর বোনটা
যে কবে বড়ো হ’য়ে গেছে, ওর
ব্যস্ততা’র মধ্যে, তা দীপ্ত বুঝতেই পারেনি। আজ মনে
হয়, বোনটাকে বড়ো অবহেলা করা হয়েছে। মেয়েটা যেন একা একাই বড়ো হ’লো। দাদা’কে পেলোই বা
কতক্ষণ! আজকে কেন জানি একটু ওর সাথে হাসাহাসি ক’রে কিছুটা ক্ষতিপূরণ ক’রতে চাইলো দীপ্ত।
তাই তোড়া পেছন ফিরতে দীপ্ত একবার ডাকলো। তোড়া ফিরে দাঁড়াতেই দীপ্ত ব’লে উঠলো,
--- সামলে চলিস।
চোখদুটো অবিশ্বাসে বড়ো বড়ো ক’রে তোড়া ব’লে উঠলো--- কী রে,
দাদা?
এর উত্তর কথায় না দিয়ে দীপ্ত শুধু নিজের হাতের পাতায় একটা
চুম্বন ক’রে তোড়া’র দিকে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলো। তোড়া লজ্জায় আজ অনেকদিন পরে একটা সাধারণ মেয়ে’র মতো হাতের পাতায় চোখ ঢাকলো। তারপর প্রায় উড়েই বেরিয়ে
গেলো। হেসে দিলো দীপ্ত। মনে মনে ব’ললো, আমিও পারি
রে, মেয়ে। এমন নয় যে আমি ‘শুস্কং কাষ্ঠং
তিষ্ঠতগ্রে’। আমিও পারি। এবার দরজাটা বন্ধ ক’রে রেখে আবার লিখতে ব’সলো। দরজা বন্ধ না ক’রলে আবার কে না কে
এসে ব’সবে। কিন্তু কিছুতে মনটাকে গুছিয়ে নিতে
পারছিলো না। বার বার জ্যাঠা বা কাকা’র মুখ ভেসে ভেসে উঠছিলো। মনে হচ্ছিলো, ওরা যে ও বাড়িতে কী ক’রছেন, কী ব’লছেন, কে জানে।
ওদের তো চেনে দীপ্ত। কিন্তু সিস্টেম তো রক্ষা ক’রতে হবে। তা নয়তো ওরা নানা কথা ব’লবেন। তাছাড়া অবিনাশ বাবুই বা কী ভাববেন? পাত্রের আত্মীয়-পরিজন কেউ কি নেই?
তাই তো বাধ্য হয়ে...। ওরা ব’লেছেন, টেলিফোনে
খবর দেবেন। কিন্তু ওদের তো কারোর কোন সেলফোন নেই। সেই আদ্যিকালের বিএসএনএল। বাড়ি
যাবে, তবে টেলিফোন। এখনও অন্তত ঘণ্টা দুয়েক। সময়টা যেন দীপ্ত’র কাটছিলো না।
একটা রিকশা থেকে নেমেছে বনলতা। এটাই অফিস পাড়া। নেমেছে
তোড়াদের বাড়ি’র সামনে। এখন তো
প্রায় সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। সন্ধেবেলা বনলতা’র চেনা এলাকাও চিনতে অসুবিধে হয়। বাঁচোয়া যে, এখনও একটু একটু বিকেলের আলো দেখা
যাচ্ছে। এই আধো আলো আধো অন্ধকারে তোড়াদের বর্ণময় বাড়িটা বেশ দেখাচ্ছে। একটা বাংলো
বাংলো ভাব। তোড়া’কে কয়েকবার ফোনে ধ’রতে চেষ্টা ক’রেছে কিন্তু পায় নি। এনগেজ্ড, আর এনগেজ্ড। কী যে এ্যাতো কথা ব’লছে মেয়েটা, কে জানে! কার সাথেই বা ব’লছে? নিশ্চয়ই সম্বিৎ। মনে মনে ভাবে বনলতা, যেদিন ওর দাদা
জানতে পারবে, সেদিন বুঝবে মেয়েটা। একটা প্রেম না ক’রলে যেন ইউনিভার্সিটি’র ক্যান্ডিডেট
হওয়া যায় না। খালি তো টো-টো ক’রে ঘুরে বেড়াস।
জানিস, ছেলেটা কেমন? পেছন থেকে কে কখন ছুরি মেরে দেবে, তুই জানিস? তোর একটুও কি
অভিজ্ঞতা আছে? মানুষ চেনার বয়স তোর হয়েছে? মেয়েটা বেশী পাকা। ছেলেদের মতো দাবড়ে
বেড়ালেই সবজান্তা হওয়া যায় না রে। বনলতা’র আবার এ কথাও মনে হয়, অবশ্য বয়সটাই বা কী ওর! এই বয়সে তো একটু ছোক ছোক ক’রবেই। এমনও তো হ’তে পারে, ও ফোনে কথাই ব’লছে না। এটা
নেটওয়ার্কের ব্যাপার। আজকাল তো এমন কনজেশন থাকেই। ‘আউট অফ রিচ’ বলে, ‘আন-এ্যাভেলেব্ল’ বলে। তবে এই ভর সন্ধেবেলা নিশ্চয়ই ও কোথাও যাবে না। আজকে যে ওর পড়া নেই, এটা
কনফার্ম বনলতা। হয়তো দাদা’র কাছে ব’সে পড়ছে-টরছে। ওর দাদা’র নাকি কড়া শাসন আছে। একটা পারমিশন নিয়ে ওকে বের ক’রে নিয়ে এলেই হবে।
দীপ্তিময় রায় তো এ পাড়াতেই তো থাকে। দূরে তো নয়। নিশ্চয়ই আপত্তি ক’রবে না। আপত্তি ক’রলে তোড়া’র থেকে বাড়িটা
চিনে নিয়ে ও একাই যাবে। ও একাই পারবে। পারতে ওকে হবেই। ওর কাজ ওকেই ক’রতে হবে। আজকে লোকটাকে ফেস ক’রতেই হবে। ভগবান হ’য়ে গেছে নাকি?
বিয়ে পাগলা বুড়ো’র বিয়ের শখ আজ
মিটিয়ে দেবে।
ভাবতে ভাবতে তোড়াদের কলিংবেল টেপে বনলতা। দরজা খুলে যায়।
কিন্তু এ কাকে দেখছে ও! এ তো সেই লোকটা। ওকে আর স্কুলের দূটো মেয়েকে বটতলায় সেভ
করেছিলো। এ এখানে আসলো কোথা থেকে! এ তো এক ক’রতে এসে আর এক ঘটনা।
--- কাকে চাইছেন?
বনলতা না চাইতেই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো--- আপনি! আপনি কি
তোড়া’র...
লোকটা ব’ললো--- হ্যাঁ, আমি
তোড়া’র দাদা। কিন্তু তোড়া তো নেই।
--- আমি বনলতা। মানে... বনলতা সেন।
--- ও! আপনিই তোড়া’র বনলতাদি? বলুন, আমি কী করতে পারি?
নিজেকে যথেষ্ট বিনীত ক’রে বনলতা কথা বলা’র চেষ্টা করলো। এর
নোট্স প’ড়েই তো পরীক্ষা দেবে ও। তাই কথায়
কৃতজ্ঞতাভাব রক্ষা ক’রতে চেষ্টা করে
বনলতা--- কিছু মনে ক’রবেন না। আপনার
সাথে আমি পরে কথা ব’লবো, স্যার। আসলে
আমি একটু ব্যস্ত আছি। তোড়া’কে পেলে ভালো হ’তো। যাই হোক, আপনি কি ব’লতে পারবেন, এই পাড়াতে দীপ্তিময় রায়ের বাড়িটা কোথায়? শুনলাম, তিনি অফিস পাড়াতে
থাকেন।
একটা কমন খেলা খেলতে পারতো দীপ্ত। কিন্তু খেললো না। বেশ
বুঝলো, অবিনাশ সেনের বাড়িতে একটা কিছু ভয়ানক ঘ’টেছে
যার
কারণে মেয়েটিকে বাড়ি থেকে দীপ্তিময় রায়ের খোঁজে আজই বেরিয়ে আসতে হ’য়েছে। কিন্তু কী এমন ঘটলো! মনে মনে একবার ঈশ্বরকে ধন্যবাদ
জানালো দীপ্ত। ভাগ্যিস তোড়াকে ডেটিং-এ পাঠিয়ে দিয়েছে। কী অদ্ভুত যোগাযোগ! ওর
বিশ্বাস হ’লো, হোয়াট গড ডাজ, ডাজ ফর দা বেস্ট। এটাও
তো ও তোড়া’র থেকে ও গোপন ক’রেছে। তাহলে বোনের কাছে এটা ওর আরো একটা অপরাধ। ও মনে ঠিক ক’রে নেয় যে, তুতু’কে পরে এটা বোঝাতে হবে। এখনকার মতো পরিস্থিতি সামলাতে সোজা ব’লে দিলো,
--- আপনি দীপ্তিময় রায়ের সাথেই কথা ব’লছেন।
কথাটা শোনা মাত্র একটা ভারী হাতুড়ি যেন বনলতা’র বুকের মধ্যে বিপুল জোরে একটার পর একটা আঘাত ক’রতে লাগলো। এটা কি ক’রে সম্ভব, তা ও বুঝে উঠতে পারছিলো না। এখন ও কী ক’রবে! কী ব’লবে! কী বলা উচিত
এই অবস্থায়! কে ব’লে দেবে বনলতা’কে? মনে মনে একবার বনলতা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনাও ক’রে ফেললো, ‘হে ঈশ্বর, আমাকে
শক্তি দাও। সাহস দাও। বুদ্ধি দাও। বিবেচনা দাও।’
এ্যাতো মেয়েকে যে দীপ্ত দুটি বেলা পড়ায়, তাদের অনেকের
রোমান্স ভরা নানা ইঙ্গিত ওকে কখনও কখনও হজম ক’রতে হয়, অথবা যথেষ্ট বুদ্ধি দিয়ে ট্যাক্ল ক’রতে হয়, সেই দীপ্ত নিজের পরিচয়টা দিয়ে বনলতা’র সামনে যেন কেমন অসহায় হ’য়ে পড়ে। পায়ে কেমন
যেন জোর পায় না দাঁড়িয়ে থাকার। হাত-পা গুলো কেমন যেন ওর সাথে একসঙ্গে বেইমানি ক’রে ওকে মেঝেতে পেড়ে ফেলতে চাইছে। একবার দীপ্ত’র মনে হলো, ও প’ড়ে যাবে না তো? নিজেকে ঝাড়া দিয়ে খাড়া ক’রে রাখে আপ্রাণ। আর তখনই শুনলো,
--- ভেতরে আসবো কি?
বাকদেবি সরস্বতী যেন দীপ্তকে এবারে ভাষা দিলেন। ওর কানে
কানে যেন তিনি ব’লে দিলেন, কী ব’লতে হবে। দীপ্ত শুধু তা পাঠ ক’রলো--- আপনাকে ভেতরে আসতে দেবার আমি কে? আমার এ্যাতো সাহস
আছে, আমি দেবো না?
--- মানে? চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করে বনলতা। তখনও রাগে ফুঁসছে
ও। কিন্তু কিভাবে যে রাগটা দেখাবে, তা ধ’রতে পারছে না।
দীপ্ত দরজা ছেড়ে স’রে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ব’ললো--- আমার বোন
তুতু। ব’লেই নিজেকে শুধরে নিয়ে বলে--- সরি!
আপনাদের তোড়া... যাকে আমি মেয়ের মতো কোলেপিঠে মানুষ ক’রেছি, সে তার রোমান্সের খবর আমাকে না দিয়ে আপনাকে দিচ্ছে...
এর পরেও আপনাকে ঘরে ঢুকতে না দেবার দুঃসাহস আমি দেখাবো! আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে!
--- ও তাহলে আপনিই দীপ্তিময় রায়? বনলতা ‘বোকা’র মতো এই প্রশ্নটা’ বেশ বুদ্ধিমতী’র মতোই ক’রলো। যেন ও অনেক
কিছু মেপে দেখছে।
--- যদি আপনার কোন আপত্তি না থাকে... রসিকতা ক’রে উত্তর দিলো দীপ্ত। এ্যাতোক্ষণে ও একটু সাহস সঞ্চয় যেন ক’রতে পেরেছে ব’লে মনে হ’লো ওর।
--- আপনিই তাহলে আমার বাবা’কে থানা থেকে উদ্ধার করেছেন? সত্যিটা জেনেও মানুষ যেমন একই প্রশ্ন উকিলের মতো
কয়েকবার ক’রে কী একটা যাচাই ক’রে নিতে চায়, তেমনি জেনেও সেই একই কথাটা আর একবার কেন জানি
ও জেনে নিতে চাইলো। নাকি... সে সব নয়। এমনিই প্রশ্নটা ক’রে ব’সলো!
--- না। উদ্ধার-টুদ্ধার কিছু নয়। ওকে আইনের ভাষায় জামিন ব’লে। আমি কেন, যে কোনো আইনজীবীই কাজটা ক’রতে পারতেন। হ্যাঁ, তবে পুরো কেসটা অবিনাশ বাবু’র হ’য়ে আমিই ফাইট ক’রেছি। আর ও রকম একজন ভালো মানুষের হ’য়ে ফাইট ক’রতে পেরে আমি
নিজেকে বেশ কৃতার্থও মনে ক’রি। আজকাল মানুষ
তো অনেক আছে, কিন্তু ভালো মানুষ বানানো তো শ্রী শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র ভগবান বাবু প্রায়
বন্ধ ক’রে দিয়েছেন। কথা ক’টা ব’লে একটু মুচকি
হাসে দীপ্ত।
একটু সময় কেটে যেতে বনলতাও যেন এই লোকটাকে ফেস করার পাল্স
এবারে পেয়ে যায়। মনে মনে ভাবে, না, আর তোড়াকে লাগবে না। ও একাই পারবে। তাই একটু
বিদ্রূপাত্মক স্বরে বলে--- আপনি তো আবার ধন্যবাদ-টন্যবাদ পছন্দ করেন না। তাই আমাকে
একদিন রাস্তায় সেভ করার জন্যে, পরীক্ষাতে আমাকে একেবারে বিনা পয়সায় নোট্স দেবার
জন্যে, কিম্বা আমার বাবা’কে একেবারে ফ্রী
পোলিসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে তো কোন থ্যাংকস জানানো যাবে না। তাহলে কী দিয়ে
আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ক’রতে পারি, জানাবেন
দয়া ক’রে। কেননা সেটা করার পরে আপনার যে একটা
শাস্তি প্রাপ্য আছে, সেটা তো আপনাকে পেতেই হবে।
--- শাস্তি! আচ্ছা, সে সব পরে হবে। প্রথমে একটু চা চ’লবে কি? আমি তো কোন খাবার বানাতে পারি না। তাই সেটা অফার ক’রতে পারছি না। আর আপনাকে একা ব’সিয়ে রেখে দোকান থেকে সে সব আনতে যেতেও তো পারছি না। তাই
একটু চা চলবে কি?
--- আমি এখানে আপনার চা-বিড়ি খেতে আসিনি। কথাটা ব’লেই বনলতা ভাবলো, ‘চা’-এর সাথে ‘বিড়ি’-টা হঠাৎ ব’ললো কেন! মুখ ফ’স্কে বেরিয়ে গেছে শব্দটা। এটাও লক্ষ্য ক’রলো যে, এই কথাটায় লোকটা একটা জোর বিষম খেলো। কিন্তু কোন রসিকতা ক’রলো না। তাই বনলতা নিজেকে সামলে নিয়ে ফের ব’ললো--- আপনি জানেন, আমি আজ কী কারণে এখানে এসেছি?
--- না, জানি না। তবে ঐ যে বললেন, আমাকে একটা কোনো
শাস্তি-টাস্তি দিতে। আমি বোধহয় কোন অপরাধ ক’রেছি।
বনলতা এবারে সরাসরি কাজের কোথায় আসে---- আপনি জানেন, আপনার
কাকা, জ্যাঠা, কাকিমা আমাদের বাড়িতে গিয়ে কী কী ব’লে এসেছেন?
--- না, জানি না। ওদের থেকে কোন টেলিফোন এখনও পাইনি। ইন
ফ্যাক্ট ওরা এখনও বাড়িতেই পৌঁছননি। ফিরে ফোন ক’রবেন। কেন? কোন অবাঞ্ছিত কিছু...
--- শুধু অবাঞ্ছিত নয়, অপমানজনক কথাবার্তা ব’লে এসেছেন।
--- তাহ’লে আমি ওদের হ’য়ে ক্ষমা চাইবো কি? তাহলে কি দোষ খণ্ডানো যাবে?
--- না, খণ্ডানোর কোন কিছু নেই। কেননা, আমি আপনাদের এই
আত্মীয়তার প্রস্তাব রিফিউজ ক’রে দিয়েছি।
চেয়ারে হেলান দিয়ে প’ড়ে দীপ্ত বলে--- বেশ ক’রেছেন। বে-এ-শ ক’রেছেন।
বনলতা বোঝে না, লোকটা কী চায়। তাই আর একটু ঝাল মিশিয়ে
বলে--- বেশ যেমন ক’রেইছি, তাহলে
তাঁদেরকে কেন ব’লে দিলেন না, যেন
কোন পরিবারকে এমন ধারা অসম্মান না করেন?
মিটি মিটি হেসে দীপ্ত ব’ললো--- আমি যদি তাঁদেরকে আগ বাড়িয়ে কিছু ব’লে দিতাম, তাতে কি আপনার গৌরব বাড়তো? এই যে আপনি গৌরব ক’রে ব’লছেন, আপনি
তাঁদেরকে রিফিউজ ক’রেছেন, সেটা কি ক’রতে পারতেন? আজকে আপনি যে নিজের ওপর একটা কনফিডেন্স
পাচ্ছেন, সেটা কি পেতেন?
অবাক হ’য়ে যায় বনলতা। এই
লোকটা কী ব’লছে, এর মানে কী... এর কিছুই ও বুঝতে
পারে না। তাই ঘটনাটাকে এখানেই ইতি ক’রে দেবার জন্যে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেয়--- শুনে রাখুন, আমার পক্ষে
যাকে-তাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমি অন্য একজন’কে ভালোবাসি। এ ব্যাপারে আর এগোবেন না।
--- তাই নাকি? ও। ইউ আর অলরেডি ইন লাভ? ব’লবেন তো। এ কথায় বনলতা একটা কঠিন দৃষ্টি দিতেই দীপ্ত বলে---
না, আসলে আমি তো এটা জানতাম না। ঠিক ঠিক। এ অবস্থায় যাকে তাকে বিয়ে করা তো
একেবারেই সম্ভব নয়। অবশ্য যাকে-তাকে তো কেউই বিয়ে ক’রতে পারে না। তাই না? তাহলে আপনি বাড়িতে এটা তো ব’লে দিলেই আমার কাকা বা জ্যাঠা আপনাদের বাড়িতে যেতেন না। এসব
কিছুই ঘটতো না। যাক গে, এবারে একটু চা চ’লুক? আর তো ঝগড়া নেই? চিন্তা নেই, আমাকে চা ক’রতে হবে না। তুতু চা ক’রে ফ্লাস্কে রেখেই
গেছে। ঐ যে, টেবিলে রাখা। ভালো চা। কাপ এনে ঢেলে দিই?
কথাক’টা ব’লে ঝড়ের মতো লোকটা ঘরের একদিকে চ’লে যায়, আর একটা শো-কেস খুলে কাপ-প্লেট নিয়ে ভেতরে গিয়ে
ধুয়ে এনে চা ঢালতে শুরু করে। এ্যাতোক্ষণে বনলতা লক্ষ্য করে যে, লোকটা একটা নস্যি
রঙের লম্বা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে আছে। আর পরনে একটা বাটিকের সিল্কি সিল্কি লুঙ্গি।
লোকটাকে দেখতে বেশ অভিজাত। মুখে এক গাল সযত্নে কেটে ছেঁটে রাখা দাড়ি-গোঁফ, চোখে
চশমা। মাথা’র চুল অবিন্যস্ত। এলোমেলো অথবা ইচ্ছে ক’রে এলোমেলো। টেবিলটাতে ছড়ানো রয়েছে কাগজ কলম আর বই। এই
ঘরটাতে তো তোড়া’র সাথে ও আসেনি?
এইটা তাহলে তোড়া’র এই দাদা’র ঘর। একবার মনে হয়, কী অদ্ভুত যোগাযোগ! এই একটা লোক ওদের
সাথে পর পর কতগুলো ঘটনায় জড়িয়ে গেলো! আবার তোড়া ওরই ক্লাশ মেট। কিন্তু লোকটাকে তো
অসভ্য ব’লে মনে হ’চ্ছে না! এই যে লোকটা কাপে চা ঢালছে, একবারও কিন্তু এই কাজটা ক’রতে ক’রতে চোরা চোখে ওকে
দেখলো না পর্যন্ত। একমনে চা ঢেলে প্লেটে রেখে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলো। দিতে দিতে ব’ললো,
--- আমাদের মধ্যে অন্য কোন সম্পর্ক না হ’ক, বন্ধুত্ব তো হ’তে পারে।
বনলতা কোন উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে চা-এর কাপটা হাতে তুলে
নিলো। লোকটা আবার ব’ললো--- দেখুন, চা
যদি খেতে খারাপ হয়, তবে কিন্তু আমার দোষ নেই। আমি কিন্তু বানাইনি। বানিয়েছে আপনার
ছোটবোন। দায়টা ওর।
এবারও কোনো কথা ব’ললো না বনলতা। শুধু চা-তে একটা নিঃশব্দ চুমুক দিলো। মনে মনে ভাবলো, যে সব কথা
ও ব’লবে ব’লে ও এখানে এসেছিলো, তা তো বলার কোনো স্কোপই পাচ্ছে না।
লোকটা ওকে আবার ব’ললো--- ডোন্ট মাইন্ড, আপনি তাহলে কবে বিয়ে ক’রছেন? মাস্টার্স কমপ্লিট ক’রে? নাকি আগে? আই
মীন, আপনার বাবা-মা কবে নাগাদ এই গুড নিউজটা পাচ্ছেন? তাদের তো রাতে ঘুম নেই।
--- তাতে আপনার কি কাজ? সেটা তো আমাদের পারিবারিক ব্যাপার।
আপনি কেন মাথা গলাচ্ছেন? আমাদের কিছু উপকার করেছেন ব’লে?
--- না না। তা নয়। আপনার বাবা আমার কাছে তার মনের
দুশ্চিন্তা প্রকাশ ক’রেছেন ব’লেই এমনি প্রশ্ন ক’রলাম। না হয়, আমাকে উপকারী ব্যক্তি হিসেবে উত্তরটা দিলেনই। আমরা তো বন্ধু হ’লাম। বন্ধু কি বন্ধুকে কোনো প্রশ্ন ক’রতে পারে না? তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা জানতে পারে না? এই যে
আমার বোন আপনাকে তার এ্যাফেয়ারের কথাটা ব’লেছে। কেন ব’লেছে? বন্ধু ব’লেই না? তাই জানতে চাইছি, কবে নাগাদ...
--- ব’লতে পারবো না। তিন
শব্দে বনলতা’র উত্তর। উত্তর ওর
দিতে ইচ্ছে হ’চ্ছিলো না। কিন্তু
কেন জানি, উত্তর দিলো।
--- এ কথার কিন্তু অর্থ তিনটে, ম্যাম। করার অক্ষমতা, বলা’র অনিচ্ছা বা করার অসম্ভবতা। আপনার কোনটা?
বনলতা এ কথারও কোন উত্তর দিলো না। চা-এর কাপটা টেবিলে
নামিয়ে রাখলো শুধু।
--- আহা, আমাদের মধ্যে তো আর বিয়ে হ’চ্ছে না। এবার তো অন্তত শেয়ার করা যায়, নাকি? অবশ্য একান্ত
আপত্তি যদি থাকে তবে থাক।
বনলতা’র মনে হ’লো, কেন যে ম’রতে লোকটা যেন আর না এগোয়, সেই উদ্দেশ্যে নিজের এ্যাফেয়ার আছে ব’লে খেদিয়ে দিতে চাইলো! এখন তো এ পিছু ছাড়ছে না! এটুলি’র মতো লেগে আছে! তবে লোকটা বোধহয় তেমন মন্দ-টন্দ কিছু নয়।
একটা কথা কিন্তু লোকটা ঠিকই ব’লেছে, এই লোকটা’র কাকা-জ্যাঠা বা কাকিমা’কে অমন কঠিন কথা শুনিয়ে দিয়ে কিন্তু বেশ একটা কনফিডেন্স পাচ্ছে ও মনে মনে। আগে তো কখনও কোনো
মানুষকে এভাবে ঝ্যাক ঝ্যাক ক’রে কোন কথা শুনিয়ে ও দেয়নি। ফলে এমন অভিজ্ঞতা ওর এই প্রথম। সত্যিই মনের রাগ
মনে পুষে রাখলে সেই রাগ আর একটা অন্য রোগের জন্ম দেয় বোধহয়। লোকটার এমন প্রশ্নে ওর
ইচ্ছে হয়, ব’লে দেয় ‘অনিচ্ছা’। কিন্তু আপন মনেই
ব’লে বসে,
--- অসম্ভবতা।
--- অসম্ভবতা! কেন? আপনার জীবন, আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন। এতে অসম্ভব কী আছে? আপনি কি আপনার দোদুল্যমানতার কথা
ব’লছেন? আই মীন, আপনি কি ডিসিশন নিতে
পারছেন না? মানুষটি কি ভালো নয়? নাকি আপনি এখন মনে ক’রছেন, আর এগোবেন না? এমনও তো হতে পারে, লোকটি হয়ত এ্যাব্সকন্ড।
তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কীসের অসম্ভবতা?
এ তো মহা বিপদে প’ড়েছে বনলতা! ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে এই লোকটা’র কথা’র জালে। তাই কোনো সিদ্ধান্ত নেতে না পেড়ে
কেমন একটা যান্ত্রিকভাবে মোহাচ্ছন্ন হ’য়ে, যেন লোকটা ওকে হিপ্নোটাইজ ক’রেছে, এমনভাবে স্বগতোক্তি’র ব’ললো বনলতা--- জানি না। আমি জানি না।
--- আপনি জানেন না! মাই গড! আপনি জানেন না! না, আমার কিন্তু
একটা গণ্ডগোল ব’লে মনে হ’চ্ছে, ম্যাডাম। আপনি আমার ছোটবোনের দিদি ব’লে কথা। আপনি এমন একটা ডিলেমার মধ্যে আছেন, আর আমি হাতে হাত
জুড়ে ব’সে থাকবো! এটা হয় নাকি? আমার দায়িত্ব
নেই! তুতু এসে কী ব’লবে? ‘দাদা, তুই এ্যাতো কাণ্ড ক’রিস, আর আমার বনলতা দিদি’র একটা প্রবলেম
তুই শুধু কানেই শুনলি! কিছু ক’রলি না!’ আপনাকে কি সে ঠ’কিয়েছে? প্রতারণা ক’রছে? নাকি কিছু না
ব’লে আন্ট্রেস্ড হয়ে গেছে? একবার বলুন
তো। আমি তাকে আপনার কাছে এনে দাঁড় ক’রিয়ে দেবো। আপনি আমাকে চেনেন না। আমি সব পারি। দীপ্ত রায় সব পারে। যেন দীপ্ত ব’লতে চাইলো, ‘আমি তোমার জন্যে ঐ
দূর আকাশের সপ্তর্ষিমণ্ডল ধ’রে এনে দিতে পারি।
পাহারের মাথায় যে নাম না জানা বুনোফুল ফুটে থাকে, হাওয়ায় দুলে দুলে মানুষকে ডাকে,
হাতছানি দেয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উঠে আসতে, তাকেও তোমার জন্যে প্রাণ হাতে ক’রে এনে দিতে পারি। একবার ব’লেই দেখো না।’ কিন্তু ভুলেও আজ
এইমাত্র কোনো বেসামাল কথা বলেনি ও। শুধু ব’ললো,
--- যাক গে। আপনার বোধহয় আমাকে বন্ধু হিসেবে চাই না। তাই
আমাকে এ্যাভয়েড ক’রছেন। ওক্কে। তার
চেয়ে একটা অন্য কথা ব’লি বরং। বাইবেলে
একটি পাপী’কে সাত হাজার সাতশো সাতাত্তর বার ক্ষমা ক’রতে বলা হ’য়েছে। কিন্তু একটি
পাপী ক্ষমা চাইবার জন্যে কতদিন পর্যন্ত সময় পাবে, কবে তার ক্ষমা চাইবার সময়কাল
অতিক্রান্ত হ’য়ে যাবে, এসব কিছু
বলেনি। আপনি জানেন?
বনলতা আবার উত্তর দিলো--- আমি জানি না।
এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় দীপ্ত। বনলতা’র চেয়ারের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। আপন মনে ব’লতে থাকে--- কেমন গল্পের মতো, তাই না? জানেন, কত মানুষ
আমাদের জীবনে নানা সময় আসে। তাঁরা হয়তো আমাদের একান্ত আপন হ’তে পারে। কিন্তু তাঁদেরকে আমরা চিনতে পারি না। পারি না শুধু
নয়, ঠেলে দূরে স’রিয়েও দিই।
অবিশ্বাস ক’রি। আবার কত মানুষকে বন্ধু জেনে বরণ ক’রি। কিন্তু সে আঘাত ক’রে চ’লে যায়। আমিও একজনকে আমার জীবনে ঠেলে
দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। কেন দিয়েছিলাম, জানি না। পরে বুঝলাম, আমি বোকা। ঠেলে দূরে
সরিয়ে দেওয়াটা কোনো ক্রেডিট নয়। মানুষকে বরণ করাটাই ক্রেডিট। হাজারবার প্রতারিত হ’লেও আবার নতুন ক’রে বরণ করার মধ্যেই আছে গৌরব। আমি যখন এই সত্যটা অনুধাবন ক’রলাম, তখন আমি মহাশূন্যে একটা কক্ষপথ থেকে ছিটকে যাওয়া
উপগ্রহের মতো হারিয়ে গেছি। আপনি ব’ললেন না, যাকে-
তাকে বিয়ে করা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়? আমারও তো তাই। আমি যে সেই একদিন যে মেয়েটাকে
দূরে ঠেলে স’রিয়ে দিয়েছিলাম,
সেই মেয়েটার জন্যে ব’সে আছি। সে-ও হয়তো
আমারই মতো কক্ষপথ বিচ্যুত। সে-ও হয়তো আমাকেই খুঁজছে। আমিও তাই তাকেই তো খুঁজে চ’লেছি আজ এ্যাতোদিন। খুঁজবো। যতদিন তাকে না পাবো, খুঁজবো।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত হেঁটে চ’লে যাবো তার জন্যে। তাকেই আমার চাই। একটাই তো জীবন। এর শেষ দেখেই আমি ছাড়বো। ব’লতে ব’লতে দীপ্ত আবৃত্তি
ক’রে উঠলো,
‘হাজার বছর আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি, বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি/ আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক
চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন/ আমাকে দুদণ্ড শান্তি
দিয়েছিলো...।’
এ্যাতোদূর শুনেই বনলতা ওর দু-কানে হাত চাপা দেয়। এই কবিতাই
তো ওর জীবনের একটা অভিশাপ। আজ প্রায় কুড়িটা বছর...। বনলতা’কে কানে হাত চাপা দিতে দেখেই দীপ্ত ওর মুখের সামনে একটা
পুরনো চিরকুট মেলে ধরে। তাতে লেখা, ‘আমিই আপনার বনলতা, বনলতা সেন। আমি দূর থেকে আপনাকে দেখেছি।
আমি আপনার, আপনি আমার। আমি জানি, আমাকে নিয়েই এই কবিতা আপনি আজ বানিয়েছেন। আমি
আপনার জন্যে অপেক্ষা ক’রে আছি।...’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই চিরকুট দেখে বনলতা লজ্জায় লাল হ’য়ে যায়। কম বয়সে মানুষ কী বোকা থাকে, আজ এইমাত্র ওর মনে হয়! এই চিঠি ছিলো ওর বোকামো,
কিন্তু আজও মনে আছে যে, এই চিঠিটাই ছিলো ওর মনের সত্য। চোখ থেকে আজ অজস্র ধারায় জল
নামছে বনলতা’র। ঠেকাবার কোনো
পথ জানা নেই ওর। দীপ্ত নিজের একটা হাতের পাতা মেলে ধ’রলো বনলতা’র মুখের সামনে।
হাতের পাতায় বনলতা’র চোখ থেকে উষ্ণ
অশ্রু পড়ে ফোটা ফোটা। দীপ্ত ফিস ফিস ক’রে বলে,
--- আমাকে কি ক্ষমা করা যায়? বনলতা সেন, আমাকে কি গ্রহণ করা
যায়?
বনলতা অশ্রুবাষ্প-রুদ্ধ কণ্ঠে বলে--- আমি জানি না।
-----------------------------------
শব্দসংখ্যা – ৫০,৫২০